__._,_.___
Monday, March 30, 2015
[chottala.com] দেখা হবেরে হবে।।পহেলা বৈশাখে
https://www.facebook.com/media/set/?set=a.444292202322732.1073741835.343772822374671&type=1 ( PLEASE OPEN THE LINK )
__._,_.___
Posted by: Abu Rumi <abu_rumi@hotmail.com>
[* Moderator�s Note - CHOTTALA is a non-profit, non-religious, non-political and non-discriminatory organization.
* Disclaimer: Any posting to the CHOTTALA are the opinion of the author. Authors of the messages to the CHOTTALA are responsible for the accuracy of their information and the conformance of their material with applicable copyright and other laws. Many people will read your post, and it will be archived for a very long time. The act of posting to the CHOTTALA indicates the subscriber's agreement to accept the adjudications of the moderator]
__,_._,___
[chottala.com] হুমকির মুখে ভিন্নমত
হুমকির মুখে ভিন্নমত
30 Mar, 2015
|| গোলাম মুরশিদ ||
'গড্ডলিকাপ্রবাহ' কথাটা সুপরিচিত। কিন্তু এর অর্থটা অত পরিচিত নয়। 'গড্ডলিকা' মানে ভেড়ি, বিশেষ করে ভেড়ার পালে যে ভেড়িটা সবার সামনে চলে, সেই ভেড়ি। আর সংসদ অভিধানের মতে গড্ডলিকাপ্রবাহ কথাটার অর্থ: 'পালের ভেড়ারা যেমন অন্ধের মতো অগ্রবর্তী ভেড়া বা ভেড়ির অনুসরণ করে, তেমনি ভালো-মন্দ বিচার না করে অন্য সবার সঙ্গে অগ্রবর্তীর অনুসরণ।' ভেড়াদের এ এক মস্ত সুবিধা। দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিক্ষিপ্ত হওয়া দূরের কথা, ভাবারই ঝামেলা নেই। চোখ বুজে সামনের ভেড়াটাকে অনুসরণ করাই তাদের কাজ। শামসুর রাহমান হয়তো সে জন্যই বিদ্রূপ করে লিখেছিলেন, 'মেষরে মেষ, তুই আছিস বেশ'।
গোলাম মুরশিদ
গোলাম মুরশিদ
ভেড়ার মতোই মানুষও একটা জন্তু। উভয়েরই চোখ-মুখ-নাক ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে। কিন্তু এই মিল সত্ত্বেও মানুষ ভেড়া নয়। সে ভেড়ার মতো অন্ধভাবে চলতে পারে না। তার মৌলিক কারণ তার মন নামের একটা বস্তু আছে। সেই মন চায় স্বাধীনভাবে নিজের পথে চলতে। তা ছাড়া, মনের অন্দর মহলে আছে মনের থেকেও অদম্য আরেকটা চেতনা, সে হলো তার 'বিবেক'। সেই বিবেক তাকে পথ দেখায়। ভালো-মন্দ বিচার-বিবেচনা করার বুদ্ধি জোগায়।
পৃথিবীতে যখন থেকে মানুষের জন্ম, ভেড়ার জন্মও হয়তো তখন থেকে। এমনকি ভেড়ার বয়স মানুষের থেকে বেশি হওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু এতকাল পৃথিবীতে বাস করা সত্ত্বেও ভেড়াদের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক অথবা ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় গড়ে ওঠেনি। ভেড়ারা গান লেখেনি, 'এক সূত্রে বাঁধিয়াছে সহস্র জীবন'। সাম্যের ভিত্তিতে পরম নিশ্চিন্তে তারা নিরন্তর সুখে বসবাস করে আসছে। তাদের রাজনৈতিক নেতা নেই, সামাজিক মোড়ল নেই, এমনকি ধর্মগুরু নেই।
অন্যপক্ষে, মানুষ সামাজিক জীব। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। ব্যক্তিগত ভালো লাগা, মন্দ লাগা আছে। সে চায় নিজের মতে চলতে। অন্য মানুষের সঙ্গে আদান-প্রদান করে এবং পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আত্মতৃপ্তি তার কাছে পরম মূল্যবান। নিয়মকানুন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমাজের মধ্যেই সে যত দূর সম্ভব স্বাধীনভাবে বাস করতে চায়। সেই তার প্রধান আনন্দ ও প্রাপ্তি। কেবল পেট ভরিয়ে সে সুখী হয় না। তার সুখের মাত্রা ও সুখের ধরন নির্ভর করে সামাজিক জীব হিসেবে সে কতটা সাফল্য লাভ করেছে, কতটা গুরুত্ব লাভ করেছে, তার ওপর। তার চরম বাসনা, সে নেতা হতে চায়।
এই নেতৃত্বের লড়াইকে এককথায় বলে রাজনীতি। এখন থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, মানুষ একটা রাজনৈতিক জীব। সে রাজনীতি না করে পারে না। এক পথে রাজনীতি করা বন্ধ করা হলে সে আরেক পথ ধরে রাজনীতি করবে। মানুষের এই নেতৃত্বের লড়াই থেকেই ছোট-বড় নানা রাজনৈতিক দল এবং উপদলের সৃষ্টি হয়। অঞ্চলের ভিত্তিতে মানুষ বিভক্ত হয়ে যায়। আলাদা জাতি গড়ে ওঠে। নানা দার্শনিক আবির্ভূত হয়ে জীবনদর্শনের নানা রকমের ব্যাখ্যা দেন। এসব দার্শনিক চান তাঁদের অনুসারীরা তাঁদের মতবাদ অনুসরণ করে তাঁদের জীবনাচরণ করুক। তা-ই থেকে গড়ে ওঠে নানা আনুষ্ঠানিক ধর্ম ও উপধর্ম।
দৃষ্টান্তস্বরূপ খ্রিষ্টধর্মের কথা ধরা যাক। যিশুখ্রিষ্ট ছিলেন ইহুদি। তবে তিনি ইহুদি ধর্মের কিছু নতুন ব্যাখ্যা দেন। সেই ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন তাঁর যে অনুসারীরা, তাঁদের বলা হয় খ্রিষ্টান অর্থাৎ খ্রিষ্টবাদী। তাঁর মৃত্যুর কয়েক শ বছর পরে খ্রিষ্টধর্ম পূর্ব ও পশ্চিম—এই দুই শাখায় বিভক্ত হয়—ইস্টার্ন অর্থডক্স খ্রিষ্টধর্ম আর ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্ম। কিন্তু সেখানেই শেষ হলো না। ষোলো শতক থেকে তিন-চার শ বছরের মধ্যে নানা ধর্মগুরুর ব্যাখ্যা ও নেতৃত্ব অনুযায়ী খ্রিষ্টধর্ম প্রোটেস্ট্যান্ট, ব্যাপটিস্ট, লুথারিয়ান, প্রেস্বেটারিয়ান, অ্যাংলিকান, মেথডিস্ট, কোয়েকার, মর্মন, ইভেনজেলিকাল, বর্ন এগেইন, যেহোবা'স উইটনেস ইত্যাদি নানা শাখায় বিভক্ত হয়েছে। প্রতিটি শাখার নেতারাই দাবি করেন যে তাঁরা ধর্মের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সে ব্যাখ্যাই অভ্রান্ত এবং তাঁদের সম্প্রদায়ই অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় শ্রেষ্ঠ।
এভাবে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, এমনকি ইসলাম ধর্মেরও নানা শাখা তৈরি হয়েছে। প্রতিটি শাখার অনুসারীরা দাবি করেন যে অন্য শাখার থেকে তাঁদের ধর্মীয় ব্যাখ্যাই শ্রেষ্ঠ। কাজেই এ ব্যাপারে নিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। কোনো সিদ্ধান্তই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
বস্তুত এ থেকে একটা জিনিসই প্রমাণিত হয়, সে হলো : মানুষ বুদ্ধিজীবী জীব এবং সে নিজের মতো করে চিন্তা করে। মানুষের এই স্বাধীন চিন্তাকে রোধ করার কোনো পথ নেই। অতীতকালে চেঙ্গিস খানের অথবা তৈমুরের হাতে কত লোক নিহত হয়েছে, তার সঠিক হিসাব কারও জানা নেই। কিন্তু হাল আমলে হিটলারের হাতে ৬৫ লাখ ইহুদি প্রাণ দিয়েছে। কমিউনিস্ট দেশগুলোয় ভিন্নমত পোষণ করার জন্য স্ট্যালিন, মাও, পলপটের হাতে লাখ লাখ লোক নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের গণহত্যা, বসনিয়ার গণহত্যা, রুয়ান্ডার গণহত্যা ইত্যাদি হত্যাকাণ্ডে লাখ লাখ লোক নিধন হয়েছে। এসব গণহত্যার কারণ ভিন্নমত ও রাজনীতি। কিন্তু এই পাইকারি হত্যা দিয়ে ভিন্নমতকে হত্যা করা যায়নি, অথবা রাজনীতিও বন্ধ করা যায়নি।
বস্তুত মতামত, ভিন্নমত ও স্বাধীন মত পোষণ করা মানুষের স্বভাব। প্রাণ দিয়েও মানুষ নিজের মতকে রক্ষা করে। মতামত ছাড়া জন্তুদের পক্ষেই বাঁচা সম্ভব, মানুষের পক্ষে নয়। কারণ, মানুষ বুদ্ধিমান ও রাজনৈতিক জীব। বেঁচে থাকার জন্য সে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো করে চিন্তাও করে।
স্বাধীনভাবে চিন্তা করার, স্বাধীন মত পোষণ করার, স্বাধীনভাবে বিশ্বাস করার, স্বাধীনভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস পালন করার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। ধর্মীয় বিশ্বাস বললে অবশ্য খ্রিষ্টধর্ম, হিন্দু ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, ইহুদি ধর্ম ইত্যাদি ধর্মের মতো আনুষ্ঠানিক ও বহুজন-সমর্থিত ধর্মকেই বোঝায় না। তা ব্যক্তিগত ধর্মও হতে পারে। কেউ ইচ্ছা করলে এক ধর্ম ত্যাগ করে আরেক ধর্ম পালন করতে পারে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারও তার জন্মগত, যদিও প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করে অন্যের অনুভূতিকে আঘাত করার অধিকার তার আছে কি না, তা বিতর্কের বিষয়। অন্তত অন্যের আবেগকে আহত করার উদ্দেশ্যে মত প্রকাশের অধিকার তার নেই।
একনায়ক অথবা স্বৈরাচারীকে মানুষ পছন্দ করে না। কারণ, একনায়ক অন্যদের মতামতকে গ্রাহ্য করে না। সে চায় নিজের মত অনুসারে অন্যদের চালাতে। মানুষ কেবল খেয়ে সুখী হলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাবার সংগ্রহ করত না। বরং বিনা পরিশ্রমে খাওয়াদাওয়া করে কারাগারে বাস করত। অথবা একনায়কের মত অনুসারে চলে বৈষয়িক উন্নতি করত। কিন্তু মানুষ তা করে না।
কিন্তু ইদানীং জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দারুণ উন্নতি হলেও স্বাধীন মত পোষণ এবং পালন করার সভ্য রীতির ওপরই হুমকি এসেছে। রাজনীতি থেকে আরম্ভ করে ধর্মমত পালন করা পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে মানুষ পরের মতের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তার চেয়েও মারাত্মক কেউ ভিন্নমত পোষণ ও পালন করলে, তাকে নিজের শত্রু বলে বিবেচনা করে। নিজের মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ না করে, বরং সে ভিন্নমতের গলা টিপে ধরে। যুক্তি দিয়ে নয় অথবা কোনো অহিংস উপায়ে নয়, প্রয়োজনবোধে সে সহিংসভাবে ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করতে চায়। আমাদের সমাজে সম্প্রতি কেবল ভিন্নমতকে নীরব করার প্রবণতা দেখা দেয়নি। কোনো মতকে বিপজ্জনক মনে করলে দরকার হলে, সেই মতাদর্শীকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
সম্প্রতি ভিন্নমত পোষণ করার জন্য অভিজিৎ রায়কে অজ্ঞাতনামারা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। অদূরেই বহু লোক ছিল। কেউ বাধা দেয়নি। হত্যাকারীদের কেউ ধাওয়া করে ধরার চেষ্টা করেনি। কেউ মুমূর্ষু অভিজিৎকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি। এ থেকে কয়েকটা কথা প্রমাণিত হয় ১. পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহিষ্ণুতা এক দল লোকের বিবেক ও বিবেচনা থেকে একেবারে লোপ পেয়েছে, ২. পরের মতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য এরা খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না, ৩. আমরা এত স্বার্থপর হয়েছি যে অন্যের বিপদ দেখলে তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে যাই না, ৪. আমাদের সংবিধানে মত পোষণ ও প্রকাশ করার যে স্বাধীনতা আছে, সে কেবল কথার কথা। এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করা কেউ দায়িত্ব বলে বিবেচনা করে না ও ৫. সভ্যতার পথ থেকে আমরা দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছি।
মার্চ ২৭, ২০১৫। সৌজন্যে : প্রথম আলো
গোলাম মুরশিদ : গবেষক, প্রাবন্ধিক
ghulammurshid@aol.com
'গড্ডলিকাপ্রবাহ' কথাটা সুপরিচিত। কিন্তু এর অর্থটা অত পরিচিত নয়। 'গড্ডলিকা' মানে ভেড়ি, বিশেষ করে ভেড়ার পালে যে ভেড়িটা সবার সামনে চলে, সেই ভেড়ি। আর সংসদ অভিধানের মতে গড্ডলিকাপ্রবাহ কথাটার অর্থ: 'পালের ভেড়ারা যেমন অন্ধের মতো অগ্রবর্তী ভেড়া বা ভেড়ির অনুসরণ করে, তেমনি ভালো-মন্দ বিচার না করে অন্য সবার সঙ্গে অগ্রবর্তীর অনুসরণ।' ভেড়াদের এ এক মস্ত সুবিধা। দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিক্ষিপ্ত হওয়া দূরের কথা, ভাবারই ঝামেলা নেই। চোখ বুজে সামনের ভেড়াটাকে অনুসরণ করাই তাদের কাজ। শামসুর রাহমান হয়তো সে জন্যই বিদ্রূপ করে লিখেছিলেন, 'মেষরে মেষ, তুই আছিস বেশ'।
গোলাম মুরশিদ
গোলাম মুরশিদ
ভেড়ার মতোই মানুষও একটা জন্তু। উভয়েরই চোখ-মুখ-নাক ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে। কিন্তু এই মিল সত্ত্বেও মানুষ ভেড়া নয়। সে ভেড়ার মতো অন্ধভাবে চলতে পারে না। তার মৌলিক কারণ তার মন নামের একটা বস্তু আছে। সেই মন চায় স্বাধীনভাবে নিজের পথে চলতে। তা ছাড়া, মনের অন্দর মহলে আছে মনের থেকেও অদম্য আরেকটা চেতনা, সে হলো তার 'বিবেক'। সেই বিবেক তাকে পথ দেখায়। ভালো-মন্দ বিচার-বিবেচনা করার বুদ্ধি জোগায়।
পৃথিবীতে যখন থেকে মানুষের জন্ম, ভেড়ার জন্মও হয়তো তখন থেকে। এমনকি ভেড়ার বয়স মানুষের থেকে বেশি হওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু এতকাল পৃথিবীতে বাস করা সত্ত্বেও ভেড়াদের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক অথবা ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় গড়ে ওঠেনি। ভেড়ারা গান লেখেনি, 'এক সূত্রে বাঁধিয়াছে সহস্র জীবন'। সাম্যের ভিত্তিতে পরম নিশ্চিন্তে তারা নিরন্তর সুখে বসবাস করে আসছে। তাদের রাজনৈতিক নেতা নেই, সামাজিক মোড়ল নেই, এমনকি ধর্মগুরু নেই।
অন্যপক্ষে, মানুষ সামাজিক জীব। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। ব্যক্তিগত ভালো লাগা, মন্দ লাগা আছে। সে চায় নিজের মতে চলতে। অন্য মানুষের সঙ্গে আদান-প্রদান করে এবং পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আত্মতৃপ্তি তার কাছে পরম মূল্যবান। নিয়মকানুন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমাজের মধ্যেই সে যত দূর সম্ভব স্বাধীনভাবে বাস করতে চায়। সেই তার প্রধান আনন্দ ও প্রাপ্তি। কেবল পেট ভরিয়ে সে সুখী হয় না। তার সুখের মাত্রা ও সুখের ধরন নির্ভর করে সামাজিক জীব হিসেবে সে কতটা সাফল্য লাভ করেছে, কতটা গুরুত্ব লাভ করেছে, তার ওপর। তার চরম বাসনা, সে নেতা হতে চায়।
এই নেতৃত্বের লড়াইকে এককথায় বলে রাজনীতি। এখন থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, মানুষ একটা রাজনৈতিক জীব। সে রাজনীতি না করে পারে না। এক পথে রাজনীতি করা বন্ধ করা হলে সে আরেক পথ ধরে রাজনীতি করবে। মানুষের এই নেতৃত্বের লড়াই থেকেই ছোট-বড় নানা রাজনৈতিক দল এবং উপদলের সৃষ্টি হয়। অঞ্চলের ভিত্তিতে মানুষ বিভক্ত হয়ে যায়। আলাদা জাতি গড়ে ওঠে। নানা দার্শনিক আবির্ভূত হয়ে জীবনদর্শনের নানা রকমের ব্যাখ্যা দেন। এসব দার্শনিক চান তাঁদের অনুসারীরা তাঁদের মতবাদ অনুসরণ করে তাঁদের জীবনাচরণ করুক। তা-ই থেকে গড়ে ওঠে নানা আনুষ্ঠানিক ধর্ম ও উপধর্ম।
দৃষ্টান্তস্বরূপ খ্রিষ্টধর্মের কথা ধরা যাক। যিশুখ্রিষ্ট ছিলেন ইহুদি। তবে তিনি ইহুদি ধর্মের কিছু নতুন ব্যাখ্যা দেন। সেই ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন তাঁর যে অনুসারীরা, তাঁদের বলা হয় খ্রিষ্টান অর্থাৎ খ্রিষ্টবাদী। তাঁর মৃত্যুর কয়েক শ বছর পরে খ্রিষ্টধর্ম পূর্ব ও পশ্চিম—এই দুই শাখায় বিভক্ত হয়—ইস্টার্ন অর্থডক্স খ্রিষ্টধর্ম আর ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্ম। কিন্তু সেখানেই শেষ হলো না। ষোলো শতক থেকে তিন-চার শ বছরের মধ্যে নানা ধর্মগুরুর ব্যাখ্যা ও নেতৃত্ব অনুযায়ী খ্রিষ্টধর্ম প্রোটেস্ট্যান্ট, ব্যাপটিস্ট, লুথারিয়ান, প্রেস্বেটারিয়ান, অ্যাংলিকান, মেথডিস্ট, কোয়েকার, মর্মন, ইভেনজেলিকাল, বর্ন এগেইন, যেহোবা'স উইটনেস ইত্যাদি নানা শাখায় বিভক্ত হয়েছে। প্রতিটি শাখার নেতারাই দাবি করেন যে তাঁরা ধর্মের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সে ব্যাখ্যাই অভ্রান্ত এবং তাঁদের সম্প্রদায়ই অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় শ্রেষ্ঠ।
এভাবে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, এমনকি ইসলাম ধর্মেরও নানা শাখা তৈরি হয়েছে। প্রতিটি শাখার অনুসারীরা দাবি করেন যে অন্য শাখার থেকে তাঁদের ধর্মীয় ব্যাখ্যাই শ্রেষ্ঠ। কাজেই এ ব্যাপারে নিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। কোনো সিদ্ধান্তই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
বস্তুত এ থেকে একটা জিনিসই প্রমাণিত হয়, সে হলো : মানুষ বুদ্ধিজীবী জীব এবং সে নিজের মতো করে চিন্তা করে। মানুষের এই স্বাধীন চিন্তাকে রোধ করার কোনো পথ নেই। অতীতকালে চেঙ্গিস খানের অথবা তৈমুরের হাতে কত লোক নিহত হয়েছে, তার সঠিক হিসাব কারও জানা নেই। কিন্তু হাল আমলে হিটলারের হাতে ৬৫ লাখ ইহুদি প্রাণ দিয়েছে। কমিউনিস্ট দেশগুলোয় ভিন্নমত পোষণ করার জন্য স্ট্যালিন, মাও, পলপটের হাতে লাখ লাখ লোক নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের গণহত্যা, বসনিয়ার গণহত্যা, রুয়ান্ডার গণহত্যা ইত্যাদি হত্যাকাণ্ডে লাখ লাখ লোক নিধন হয়েছে। এসব গণহত্যার কারণ ভিন্নমত ও রাজনীতি। কিন্তু এই পাইকারি হত্যা দিয়ে ভিন্নমতকে হত্যা করা যায়নি, অথবা রাজনীতিও বন্ধ করা যায়নি।
বস্তুত মতামত, ভিন্নমত ও স্বাধীন মত পোষণ করা মানুষের স্বভাব। প্রাণ দিয়েও মানুষ নিজের মতকে রক্ষা করে। মতামত ছাড়া জন্তুদের পক্ষেই বাঁচা সম্ভব, মানুষের পক্ষে নয়। কারণ, মানুষ বুদ্ধিমান ও রাজনৈতিক জীব। বেঁচে থাকার জন্য সে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো করে চিন্তাও করে।
স্বাধীনভাবে চিন্তা করার, স্বাধীন মত পোষণ করার, স্বাধীনভাবে বিশ্বাস করার, স্বাধীনভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস পালন করার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। ধর্মীয় বিশ্বাস বললে অবশ্য খ্রিষ্টধর্ম, হিন্দু ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, ইহুদি ধর্ম ইত্যাদি ধর্মের মতো আনুষ্ঠানিক ও বহুজন-সমর্থিত ধর্মকেই বোঝায় না। তা ব্যক্তিগত ধর্মও হতে পারে। কেউ ইচ্ছা করলে এক ধর্ম ত্যাগ করে আরেক ধর্ম পালন করতে পারে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারও তার জন্মগত, যদিও প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করে অন্যের অনুভূতিকে আঘাত করার অধিকার তার আছে কি না, তা বিতর্কের বিষয়। অন্তত অন্যের আবেগকে আহত করার উদ্দেশ্যে মত প্রকাশের অধিকার তার নেই।
একনায়ক অথবা স্বৈরাচারীকে মানুষ পছন্দ করে না। কারণ, একনায়ক অন্যদের মতামতকে গ্রাহ্য করে না। সে চায় নিজের মত অনুসারে অন্যদের চালাতে। মানুষ কেবল খেয়ে সুখী হলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাবার সংগ্রহ করত না। বরং বিনা পরিশ্রমে খাওয়াদাওয়া করে কারাগারে বাস করত। অথবা একনায়কের মত অনুসারে চলে বৈষয়িক উন্নতি করত। কিন্তু মানুষ তা করে না।
কিন্তু ইদানীং জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দারুণ উন্নতি হলেও স্বাধীন মত পোষণ এবং পালন করার সভ্য রীতির ওপরই হুমকি এসেছে। রাজনীতি থেকে আরম্ভ করে ধর্মমত পালন করা পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে মানুষ পরের মতের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তার চেয়েও মারাত্মক কেউ ভিন্নমত পোষণ ও পালন করলে, তাকে নিজের শত্রু বলে বিবেচনা করে। নিজের মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ না করে, বরং সে ভিন্নমতের গলা টিপে ধরে। যুক্তি দিয়ে নয় অথবা কোনো অহিংস উপায়ে নয়, প্রয়োজনবোধে সে সহিংসভাবে ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করতে চায়। আমাদের সমাজে সম্প্রতি কেবল ভিন্নমতকে নীরব করার প্রবণতা দেখা দেয়নি। কোনো মতকে বিপজ্জনক মনে করলে দরকার হলে, সেই মতাদর্শীকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
সম্প্রতি ভিন্নমত পোষণ করার জন্য অভিজিৎ রায়কে অজ্ঞাতনামারা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। অদূরেই বহু লোক ছিল। কেউ বাধা দেয়নি। হত্যাকারীদের কেউ ধাওয়া করে ধরার চেষ্টা করেনি। কেউ মুমূর্ষু অভিজিৎকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি। এ থেকে কয়েকটা কথা প্রমাণিত হয় ১. পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহিষ্ণুতা এক দল লোকের বিবেক ও বিবেচনা থেকে একেবারে লোপ পেয়েছে, ২. পরের মতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য এরা খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না, ৩. আমরা এত স্বার্থপর হয়েছি যে অন্যের বিপদ দেখলে তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে যাই না, ৪. আমাদের সংবিধানে মত পোষণ ও প্রকাশ করার যে স্বাধীনতা আছে, সে কেবল কথার কথা। এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করা কেউ দায়িত্ব বলে বিবেচনা করে না ও ৫. সভ্যতার পথ থেকে আমরা দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছি।
মার্চ ২৭, ২০১৫। সৌজন্যে : প্রথম আলো
গোলাম মুরশিদ : গবেষক, প্রাবন্ধিক
ghulammurshid@aol.com
__._,_.___
Posted by: Shahadat Hussaini <shahadathussaini@hotmail.com>
[* Moderator�s Note - CHOTTALA is a non-profit, non-religious, non-political and non-discriminatory organization.
* Disclaimer: Any posting to the CHOTTALA are the opinion of the author. Authors of the messages to the CHOTTALA are responsible for the accuracy of their information and the conformance of their material with applicable copyright and other laws. Many people will read your post, and it will be archived for a very long time. The act of posting to the CHOTTALA indicates the subscriber's agreement to accept the adjudications of the moderator]
__,_._,___