অমানুষিকতা কত নিকৃষ্ট হতে পারে
সি রা জু র র হ মা ন
« আগের সংবাদ | পরের সংবাদ» |
সাভারে গত বুধবার ধসে পড়া রানা প্লাজা ভবনটি থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত উদ্ধার করা লাশের সংখ্যা ৩৮০। মূলত স্বেচ্ছাসেবী মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে কয়েকশ’ মানুষকে জীবন্ত উদ্ধার করা হয়েছে। আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি কিংবা সংগঠনের অভাব সত্ত্বেও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের অদম্য উত্সাহ ও দৃঢ়তার প্রশংসা সবাই করেছেন। উদ্ধার কাজের গোড়ার দিকে সেনাবাহিনীর তত্পরতা খুব বেশি চোখে পড়েনি। সেনাবাহিনী এখন ভারী যন্ত্রপাতি নিয়োগ করেছে। খুব সম্ভবত ‘রিকভারি’র (জীবিত উদ্ধার) চাইতে ‘স্যালভেজ’ই (লাশ ও সম্পত্তি উদ্ধার) হবে মূল লক্ষ্য। আর কত লাশ উদ্ধার হবে নির্ভর করছে মাটির নিচে দেবে যাওয়া নিম্নতর তলাগুলো ওঠানো সম্ভব হবে কিনা তার ওপর। তবে সংখ্যা নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে। নয়শ’র বেশি লোক এখনও নিখোঁজ। তাদের মধ্যে খুব বেশি কাউকে জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা এখন ছেড়ে দিতেই হবে।
বিশ্ব মিডিয়া পরিস্থিতির এবং বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প সম্পর্কে অত্যন্ত করুণ একটা চিত্র তুলে ধরেছে দিনের পর দিন। দুর্ঘটনার পাঁচ দিন পর রোববার পর্যন্তও ব্রিটিশ রেডিও এবং টেলিভিশনের খবরে এটাই ছিল প্রধান শিরোনাম। পত্রিকাগুলোও খুবই বিস্তারিত খবর এবং প্রতিবেদন প্রচার করেছে দিনের পর দিন। ইউরোপ-উত্তর আমেরিকার মিডিয়াও মোটামুটি একই রকম গুরুত্ব দিয়ে এ খবরটা প্রচার করেছে। এই লন্ডনে অনেক অবাঙালিও ব্যক্তিগতভাবে শোক ও সহানুভূতি জানিয়েছেন বাংলাদেশীদের। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও এ রকম ট্র্যাজেডি ঘটতে দেয়া সম্ভব বলে তারা ভাবতে পারছিলেন না।
শেখ হাসিনা তার বর্তমান সরকারে এ যাবত্ দু’জন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন। শুনেছি তাদের উভয়ের সম্পর্কে চায়ের দোকানে কিংবা বৈঠকখানায় মানুষ ‘স্টুপিড’ এবং ‘ইডিয়ট’—এ দুটি ইংরেজি বিশেষণই ব্যবহার করে বেশি। এ দু’জন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজকর্ম এবং কথাবার্তাদৃষ্টে অধিকতর উপযুক্ত কোনো বিশেষণ খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই ভবন ধসের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় হীনমতি রাজনৈতিক ফায়দা আদায়েরই চেষ্টা করেছিলেন। বিরোধী দলগুলোকে অপবাদ দেয়ার আশায় তিনি বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াতের লোকেরা রানা প্লাজার পিলার ধরে নাড়াচাড়া করছিলেন, হয়তো সে কারণেও এই আটতলা ভবনটি ধসে পড়ে থাকতে পারে। শত শত মানুষের মৃত্যু নিয়ে এমন কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা অচিন্তনীয়।
মন্ত্রী নির্বাচনে শেখ হাসিনার সুখ্যাতি নেই, ছিল না কখনও। তার নিজের বিচারবুদ্ধি সম্পর্কেও প্রায়ই হতাশা প্রকাশ করা হয়। সাভারের এই মহা ট্র্যাজেডির ব্যাপারেও তিনি সেসবের ওপরে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষা এবং ত্রাণ প্রচেষ্টার চাইতেও নিজের সরকার, নিজের দল আর সে দলের মাস্তানদের রক্ষা করাই তার বিবেচনায় বড় হয়ে উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল অন্য সব অনুষ্ঠান-আয়োজন বাতিল করে উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের তদারকিতে মনোনিবেশ করা। সেটা তিনি করেননি। পাঁচ দিন বিলম্ব করে তিনি প্রথমে হাসপাতালে কয়েকজন আহতকে এবং তারও পর সাভারের বিধ্বস্ত ভবনটির ধ্বংসস্তূপ দেখতে গিয়েছিলেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া এবং শেখ হাসিনা
চরম মর্মবেদনার সঙ্গে আমাকে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের মহাসাইক্লোনের কথা স্মরণ করতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার সেই প্রলয়ের ক্ষয়ক্ষতিকে খাটো করে দেখাতে চেয়েছিলেন। ১৪ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের হয়ে দূতিয়ালি করতে পিকিং যাচ্ছিলেন। পথে সাত-আট ঘণ্টা ঢাকায় তিনি যাত্রাবিরতি করেন। কিন্তু ভোলা-মনপুরা-হাতিয়া অঞ্চলের সে প্রলয় সম্পর্কে কিছুই বলেননি তিনি, এমনকি হেলিকপ্টার কিংবা বিমান থেকেও ধ্বংসের ছবি দেখে আসার কথা তার মনে হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানকে সেজন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ক্রুদ্ধ মানুষ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছিল প্রতিশোধ হিসেবেই। তার জের ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে, পাকিস্তান ভেঙে যায়।
দুই হাজার তের সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ার পরও একটি ট্রেনের উদ্বোধন করতে যাওয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রকৃত তথ্যাদি সম্পর্কে খোঁজখবর না নিয়েই সেখানে তিনি ঘোষণা করেন যে, আগের দিন ভবনটিতে ফাটল দেখা যাওয়ার এবং পুলিশের হুশিয়ারি সত্ত্বেও গার্মেন্ট শ্রমিকরা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কর্মস্থলে ঢোকে এবং তার ফলেই সেখানে প্রাণহানি ঘটেছে।
অথচ প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। পাঁচটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা ফাটল ধরা ভবনের কারখানায় কাজে যেতে অনিচ্ছুক ছিল। কিন্তু মালিকরা তাদের কাজে যেতে বাধ্য করেন। স্বল্প মজুরির এই শ্রমিকরা চাকরি হারানোর ঝুঁকি নেবে বলে কেউ আশা করতে পারে না। মালিকদের নির্দেশ মেনে নিতে তারা বাধ্য হয়েছিল। মালিকরা বলেছেন, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা তাদের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে ভবনটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। ফ্যাক্টরিগুলোর এবং ভবনের মালিকের বিশেষ স্বার্থ ছিল সেদিন কাজে যেতে বাধ্য করায়। সেদিন ছিল বিএনপির আহূত ৩৬ ঘণ্টার হরতালের দ্বিতীয় দিন। হাজার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিককে কাজে যেতে বাধ্য করে মালিকরা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির হরতাল পুরোপুরি সফল হয়নি। জানা গেছে, এই শ্রমিকদের দিয়ে একটা হরতাল-বিরোধী মিছিল করানোরও পরিকল্পনা ছিল ভবন এবং কারখানা মালিকদের।
ট্র্যাজেডি নিয়ে রাজনীতি
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা দ্বিতীয়বার জাতিকে প্রতারিত করেছেন সংসদে দেয়া ভাষণে। সেখানে তিনি বলেছেন, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা যুবলীগের (অতএব আওয়ামী লীগেরও) কেউ নন। কিন্তু তার পরপরই ঝাঁকা ঝাঁকা প্রমাণ হাজির হয়। দেখা যায় সোহেল রানা প্রকৃতই যুবলীগের নেতা এবং ওই এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মুরাদ জংয়ের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। দেখা যাচ্ছে, সরকার ও আওয়ামী লীগ এবং কিছু পরিমাণে সংশ্লিষ্ট গার্মেন্ট কারখানাগুলোর মালিকদের গা বাঁচানোর চেষ্টাতেই প্রধানমন্ত্রী দুটি বিভ্রান্তির উক্তি করেছেন।
গার্মেন্ট উত্পাদক সমিতির সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক গভীর। হাতিরঝিলে সমিতির সুরম্য বহুতল ভবনটি অবৈধভাবে নির্মিত হলেও সরকার এতকাল তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং জানা গেছে, এ ব্যাপারে সমিতির সঙ্গে সরকারের একটা সমঝোতা হয়েছিল। সরকার হেফাজতে ইসলামের প্রভাব হ্রাসের আশায় ২৭ এপ্রিল মতিঝিলে একটা নারী সমাবেশ ডেকেছিল এবং সমিতিকে বলেছিল গার্মেন্ট কারখানাগুলোর হাজার হাজার নারী শ্রমিককে সে সমাবেশে হাজির করতে। পুরস্কার হিসেবে সরকার আশ্বাস দিয়েছিল যে উত্পাদক সমিতির অবৈধ হাতিরঝিল ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে না। এই সমাবেশটি অবশ্যি এখন পরিত্যক্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং নেতাদের অনেকেই গার্মেন্ট শিল্পের মালিক। তাদের সমিতির কাছ থেকে সরকার ও শাসক দল নানা ধরনের আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য পায় বলেও শোনা যায়। আগামী নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বিধান করার লক্ষ্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বে ১৮টি দল বর্তমানে যে আন্দোলন করছে তাতে ক্ষ্যান্ত দিতে গার্মেন্ট শিল্প সমিতির কর্তাব্যক্তিরা পরোক্ষ চাপ দিচ্ছিলেন বলেও শোনা যায়। পক্ষান্তরে নির্যাতন ও নিপীড়নের পথ পরিত্যাগ করতে তারা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়নি। বিচিত্র নয় যে, সাভারের বর্তমান ট্র্যাজেডি থেকেও উত্পাদকদের যথাসাধ্য রক্ষার চেষ্টা করবেন প্রধানমন্ত্রী।
তাছাড়া কিছু পরিমাণে হলেও এই ট্র্যাজেডিকে তিনি দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থেও ব্যবহার করতে চেয়েছেন। যেমন তিনি ‘এসময় হরতাল-ভাংচুরে বিরত থাকারও’ আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধী দলগুলোকে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী যখন ট্রেন উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া তখন উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যের সুবিধার জন্য তাদের হরতালের অবশিষ্টাংশ প্রত্যাহার করেছিলেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর চার দিন আগেই তিনি উদ্ধার কাজ দেখতে সাভারে গিয়েছিলেন।
ভাবমূর্তি—কিসের ভাবমূর্তি? কে ভাঙছে ভাবমূর্তি?
ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা খবর দিয়েছে, ট্র্যাজেডির খবর পাওয়ার পরপরই ব্রিটিশ সরকার উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যে সহায়তাদানের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। টেলিগ্রাফের খবর অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি নাকি বলেছেন যে, ধ্বংসস্তূপে আটক শ্রমিকদের উদ্ধারে বিদেশি সাহায্য নিলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। ভাবমূর্তির দোহাই পেড়েছেন তৈরি পোশাক উত্পাদক ও রফতানিকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আতিকুল ইসলামও। তিনি বলেছেন, ভবনধসের চিত্র ও প্রতিবেদন প্রচার করে মিডিয়া নাকি ‘দেশের ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ন করছে।
বর্তমান সরকারের শতবিধ অপকাণ্ডে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সর্বাঙ্গে বহু পরত আলকাতরা লেপে গেছে। ভাবমূর্তির এমন কী অবশিষ্ট আছে যা পৌনে চারশ’ লাশ আর নয়শ’রও বেশি নিখোঁজ ব্যক্তির অনন্যসাধারণ মানবিক কাহিনী প্রচারে ক্ষুণ্ন হতে পারে? এবং একথা বলে দেয়া প্রয়োজন যে, ভাবমূর্তির বারোটা বাজিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মো. আতিকুল ইসলামের সমিতির ভূমিকা সরকারের চাইতে কম নয়। মাত্র চার মাস আগে তাজরিন ফ্যাশন্সের গার্মেন্ট কারখানায় ১১২ জন শ্রমিক পুড়ে মারা গেছে। এর আগে স্পেকট্রাম ও অন্যান্য কারখানায়ও অনুরূপ ট্র্যাজেডি ঘটেছে। শ্রমিকরা কিছু চুরি করে নিয়ে যাবে এ ভয়ে আপত্কালে আত্মরক্ষার জন্য পলায়ন পথগুলো তালাবদ্ধ করে রাখা এই শত শত অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুর জন্য দায়ী। সরকার এসব কারখানার মালিকদের উপযুক্ত কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়নি। মো. আতিকুল ইসলামের সমিতির সদস্যদের এসব হত্যাকাণ্ডের পথ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেনি।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট উত্পাদকরা দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক। চীনের পরেই বাংলাদেশের স্থান। কিন্তু বিগত দু’তিন বছরে বিদেশিরা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ট্র্যাজিক দুরবস্থার সমালোচনায় মুখর। মার্কিন সরকার কয়েক বছর ধরেই পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন ও কাজের অবস্থার উন্নতি এবং তাদের ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দানের দাবি জানিয়ে এসেছে। শ্রমিকদের নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার রহস্য জানাতেও তারা মো. আতিকুল ইসলামের সমিতি এবং শেখ হাসিনার সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আসছে। মার্কিন সরকার কার্যত বলেই দিয়েছে, এসব দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির বর্ধিত কিংবা সংরক্ষিত কোটা নিরাপদ নয়।
তাজরীন ফ্যাশন্সের ট্র্যাজেডির পর যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহত্ রিটেইলার চেইন শপ ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। রানা প্লাজায় অবস্থিত কারখানাগুলো অন্যদের মধ্যে ব্রিটেনের প্রাইমার্ক ও ম্যাঙ্গো গ্রুপকে তৈরি পোশাক সরবরাহ করত। ব্রিটেনে এখন এদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছে। খদ্দেররাও বলাবলি করছেন, এ দুটি কোম্পানির উচিত বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি বন্ধ করা। চ্যারিটি সংস্থা ওয়ার অন ওয়ান্ট এবং অ্যাকশন এইড নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণদানের দাবি জানিয়েছে।
বিভিন্ন মহল থেকে প্রস্তাব এসেছে, যারা প্রাইমার্ক থেকে সস্তায় বাংলাদেশে তৈরি টি-শার্ট কিনেছিলেন তাদের উচিত কিছু পরিমাণ অর্থ নিহত শ্রমিকদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ বাবত দান করা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য সদস্য দেশেও একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বলে শুনেছি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের মূল বাজার। সাভার ট্র্যাজেডির জন্য দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তিদান এবং গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাজের শর্ত ও পরিবেশ উন্নত করা না হলে বাংলাদেশ শিগগিরই এই বাজার হারাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ভাবমূর্তি’ সেটা ঠেকাতে পারবে না।
গুরু পাপে লঘু দণ্ড?
কিন্তু সরকারের মতিগতি দৃষ্টে মনে হতে পারে যে, অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তিদানের কথা তারা ভাবছে না। বেনাপোল থেকে র্যাব হেলিকপ্টারে করে পলাতক সোহেল রানাকে ধরে এনেছে বলে মিডিয়ায় প্রচুর নাটক সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কী? ভেতরে ভেতরে জানা যাচ্ছে, সোহেল রানাকে বিধ্বস্ত ভবন থেকে গাড়িতে তুলে দিয়ে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার অফিসার ইনচার্জ। সেসব খবর অনুযায়ী রানা প্রথমে আত্মগোপন করেছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মুরাদ জংয়ের বাড়িতে। অবিলম্বে এসব শোনা খবরের সত্যতা যাচাই করা না হলে জনসাধারণের ক্রোধ বেড়ে যেতে বাধ্য।
তার পরেও শোনা গেছে, রানার বিরুদ্ধে শুধু অমনোযোগিতা এবং নির্মাণ বিধি লঙ্ঘনেরই অভিযোগ আনা হয়েছে। এ দুটো আইনে শাস্তি খুবই হালকা। শুনেছি সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু রানা ও কারখানা মালিকদের যারা অনিচ্ছুক শ্রমিকদের একটা ফাটল ধরা ভবনে কাজে যেতে বাধ্য করেছিলেন, তাদের প্রকৃত অপরাধ আরও বহু বহু গুণ বেশি গুরুতর। তাদের বিরুদ্ধে সঙ্গত অভিযোগ হওয়া উচিত ‘ম্যানস্লটার’ বা অনবধানতা বশত হত্যার। ব্রিটিশ আমলের যে ফৌজদারি দণ্ডবিধি আইনের অধিকাংশ প্রায় অবিকৃতভাবে বাংলাদেশের আইনে গৃহীত হয়েছে, তাতে এই ম্যানস্লটারের বিধান আছে। এ অপরাধের শাস্তি পরিকল্পিত হত্যার সর্বোচ্চ পর্যায়ের শাস্তির কিছুটা কম। সরকার যদি দলীয় বিবেচনায় শাস্তির ভণিতা করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সহজেই ছেড়ে দেয় তাহলে একদিকে তারা ক্রুদ্ধ শ্রমিকদের ও জাতিকে শান্ত করতে পারবে না, অন্যদিকে বিদেশে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের ক্রেতাদেরও আশ্বস্ত করতে পারবে না।
(লন্ডন, ২৯.০৪.১৩)
serajurrahman34@gmail.com
বিশ্ব মিডিয়া পরিস্থিতির এবং বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প সম্পর্কে অত্যন্ত করুণ একটা চিত্র তুলে ধরেছে দিনের পর দিন। দুর্ঘটনার পাঁচ দিন পর রোববার পর্যন্তও ব্রিটিশ রেডিও এবং টেলিভিশনের খবরে এটাই ছিল প্রধান শিরোনাম। পত্রিকাগুলোও খুবই বিস্তারিত খবর এবং প্রতিবেদন প্রচার করেছে দিনের পর দিন। ইউরোপ-উত্তর আমেরিকার মিডিয়াও মোটামুটি একই রকম গুরুত্ব দিয়ে এ খবরটা প্রচার করেছে। এই লন্ডনে অনেক অবাঙালিও ব্যক্তিগতভাবে শোক ও সহানুভূতি জানিয়েছেন বাংলাদেশীদের। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও এ রকম ট্র্যাজেডি ঘটতে দেয়া সম্ভব বলে তারা ভাবতে পারছিলেন না।
শেখ হাসিনা তার বর্তমান সরকারে এ যাবত্ দু’জন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন। শুনেছি তাদের উভয়ের সম্পর্কে চায়ের দোকানে কিংবা বৈঠকখানায় মানুষ ‘স্টুপিড’ এবং ‘ইডিয়ট’—এ দুটি ইংরেজি বিশেষণই ব্যবহার করে বেশি। এ দু’জন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজকর্ম এবং কথাবার্তাদৃষ্টে অধিকতর উপযুক্ত কোনো বিশেষণ খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই ভবন ধসের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় হীনমতি রাজনৈতিক ফায়দা আদায়েরই চেষ্টা করেছিলেন। বিরোধী দলগুলোকে অপবাদ দেয়ার আশায় তিনি বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াতের লোকেরা রানা প্লাজার পিলার ধরে নাড়াচাড়া করছিলেন, হয়তো সে কারণেও এই আটতলা ভবনটি ধসে পড়ে থাকতে পারে। শত শত মানুষের মৃত্যু নিয়ে এমন কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা অচিন্তনীয়।
মন্ত্রী নির্বাচনে শেখ হাসিনার সুখ্যাতি নেই, ছিল না কখনও। তার নিজের বিচারবুদ্ধি সম্পর্কেও প্রায়ই হতাশা প্রকাশ করা হয়। সাভারের এই মহা ট্র্যাজেডির ব্যাপারেও তিনি সেসবের ওপরে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষা এবং ত্রাণ প্রচেষ্টার চাইতেও নিজের সরকার, নিজের দল আর সে দলের মাস্তানদের রক্ষা করাই তার বিবেচনায় বড় হয়ে উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল অন্য সব অনুষ্ঠান-আয়োজন বাতিল করে উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের তদারকিতে মনোনিবেশ করা। সেটা তিনি করেননি। পাঁচ দিন বিলম্ব করে তিনি প্রথমে হাসপাতালে কয়েকজন আহতকে এবং তারও পর সাভারের বিধ্বস্ত ভবনটির ধ্বংসস্তূপ দেখতে গিয়েছিলেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া এবং শেখ হাসিনা
চরম মর্মবেদনার সঙ্গে আমাকে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের মহাসাইক্লোনের কথা স্মরণ করতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার সেই প্রলয়ের ক্ষয়ক্ষতিকে খাটো করে দেখাতে চেয়েছিলেন। ১৪ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের হয়ে দূতিয়ালি করতে পিকিং যাচ্ছিলেন। পথে সাত-আট ঘণ্টা ঢাকায় তিনি যাত্রাবিরতি করেন। কিন্তু ভোলা-মনপুরা-হাতিয়া অঞ্চলের সে প্রলয় সম্পর্কে কিছুই বলেননি তিনি, এমনকি হেলিকপ্টার কিংবা বিমান থেকেও ধ্বংসের ছবি দেখে আসার কথা তার মনে হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানকে সেজন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ক্রুদ্ধ মানুষ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছিল প্রতিশোধ হিসেবেই। তার জের ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে, পাকিস্তান ভেঙে যায়।
দুই হাজার তের সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ার পরও একটি ট্রেনের উদ্বোধন করতে যাওয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রকৃত তথ্যাদি সম্পর্কে খোঁজখবর না নিয়েই সেখানে তিনি ঘোষণা করেন যে, আগের দিন ভবনটিতে ফাটল দেখা যাওয়ার এবং পুলিশের হুশিয়ারি সত্ত্বেও গার্মেন্ট শ্রমিকরা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কর্মস্থলে ঢোকে এবং তার ফলেই সেখানে প্রাণহানি ঘটেছে।
অথচ প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। পাঁচটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা ফাটল ধরা ভবনের কারখানায় কাজে যেতে অনিচ্ছুক ছিল। কিন্তু মালিকরা তাদের কাজে যেতে বাধ্য করেন। স্বল্প মজুরির এই শ্রমিকরা চাকরি হারানোর ঝুঁকি নেবে বলে কেউ আশা করতে পারে না। মালিকদের নির্দেশ মেনে নিতে তারা বাধ্য হয়েছিল। মালিকরা বলেছেন, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা তাদের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে ভবনটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। ফ্যাক্টরিগুলোর এবং ভবনের মালিকের বিশেষ স্বার্থ ছিল সেদিন কাজে যেতে বাধ্য করায়। সেদিন ছিল বিএনপির আহূত ৩৬ ঘণ্টার হরতালের দ্বিতীয় দিন। হাজার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিককে কাজে যেতে বাধ্য করে মালিকরা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির হরতাল পুরোপুরি সফল হয়নি। জানা গেছে, এই শ্রমিকদের দিয়ে একটা হরতাল-বিরোধী মিছিল করানোরও পরিকল্পনা ছিল ভবন এবং কারখানা মালিকদের।
ট্র্যাজেডি নিয়ে রাজনীতি
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা দ্বিতীয়বার জাতিকে প্রতারিত করেছেন সংসদে দেয়া ভাষণে। সেখানে তিনি বলেছেন, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা যুবলীগের (অতএব আওয়ামী লীগেরও) কেউ নন। কিন্তু তার পরপরই ঝাঁকা ঝাঁকা প্রমাণ হাজির হয়। দেখা যায় সোহেল রানা প্রকৃতই যুবলীগের নেতা এবং ওই এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মুরাদ জংয়ের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। দেখা যাচ্ছে, সরকার ও আওয়ামী লীগ এবং কিছু পরিমাণে সংশ্লিষ্ট গার্মেন্ট কারখানাগুলোর মালিকদের গা বাঁচানোর চেষ্টাতেই প্রধানমন্ত্রী দুটি বিভ্রান্তির উক্তি করেছেন।
গার্মেন্ট উত্পাদক সমিতির সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক গভীর। হাতিরঝিলে সমিতির সুরম্য বহুতল ভবনটি অবৈধভাবে নির্মিত হলেও সরকার এতকাল তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং জানা গেছে, এ ব্যাপারে সমিতির সঙ্গে সরকারের একটা সমঝোতা হয়েছিল। সরকার হেফাজতে ইসলামের প্রভাব হ্রাসের আশায় ২৭ এপ্রিল মতিঝিলে একটা নারী সমাবেশ ডেকেছিল এবং সমিতিকে বলেছিল গার্মেন্ট কারখানাগুলোর হাজার হাজার নারী শ্রমিককে সে সমাবেশে হাজির করতে। পুরস্কার হিসেবে সরকার আশ্বাস দিয়েছিল যে উত্পাদক সমিতির অবৈধ হাতিরঝিল ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে না। এই সমাবেশটি অবশ্যি এখন পরিত্যক্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং নেতাদের অনেকেই গার্মেন্ট শিল্পের মালিক। তাদের সমিতির কাছ থেকে সরকার ও শাসক দল নানা ধরনের আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য পায় বলেও শোনা যায়। আগামী নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বিধান করার লক্ষ্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বে ১৮টি দল বর্তমানে যে আন্দোলন করছে তাতে ক্ষ্যান্ত দিতে গার্মেন্ট শিল্প সমিতির কর্তাব্যক্তিরা পরোক্ষ চাপ দিচ্ছিলেন বলেও শোনা যায়। পক্ষান্তরে নির্যাতন ও নিপীড়নের পথ পরিত্যাগ করতে তারা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়নি। বিচিত্র নয় যে, সাভারের বর্তমান ট্র্যাজেডি থেকেও উত্পাদকদের যথাসাধ্য রক্ষার চেষ্টা করবেন প্রধানমন্ত্রী।
তাছাড়া কিছু পরিমাণে হলেও এই ট্র্যাজেডিকে তিনি দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থেও ব্যবহার করতে চেয়েছেন। যেমন তিনি ‘এসময় হরতাল-ভাংচুরে বিরত থাকারও’ আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধী দলগুলোকে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী যখন ট্রেন উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া তখন উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যের সুবিধার জন্য তাদের হরতালের অবশিষ্টাংশ প্রত্যাহার করেছিলেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর চার দিন আগেই তিনি উদ্ধার কাজ দেখতে সাভারে গিয়েছিলেন।
ভাবমূর্তি—কিসের ভাবমূর্তি? কে ভাঙছে ভাবমূর্তি?
ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা খবর দিয়েছে, ট্র্যাজেডির খবর পাওয়ার পরপরই ব্রিটিশ সরকার উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যে সহায়তাদানের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। টেলিগ্রাফের খবর অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি নাকি বলেছেন যে, ধ্বংসস্তূপে আটক শ্রমিকদের উদ্ধারে বিদেশি সাহায্য নিলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। ভাবমূর্তির দোহাই পেড়েছেন তৈরি পোশাক উত্পাদক ও রফতানিকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আতিকুল ইসলামও। তিনি বলেছেন, ভবনধসের চিত্র ও প্রতিবেদন প্রচার করে মিডিয়া নাকি ‘দেশের ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ন করছে।
বর্তমান সরকারের শতবিধ অপকাণ্ডে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সর্বাঙ্গে বহু পরত আলকাতরা লেপে গেছে। ভাবমূর্তির এমন কী অবশিষ্ট আছে যা পৌনে চারশ’ লাশ আর নয়শ’রও বেশি নিখোঁজ ব্যক্তির অনন্যসাধারণ মানবিক কাহিনী প্রচারে ক্ষুণ্ন হতে পারে? এবং একথা বলে দেয়া প্রয়োজন যে, ভাবমূর্তির বারোটা বাজিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মো. আতিকুল ইসলামের সমিতির ভূমিকা সরকারের চাইতে কম নয়। মাত্র চার মাস আগে তাজরিন ফ্যাশন্সের গার্মেন্ট কারখানায় ১১২ জন শ্রমিক পুড়ে মারা গেছে। এর আগে স্পেকট্রাম ও অন্যান্য কারখানায়ও অনুরূপ ট্র্যাজেডি ঘটেছে। শ্রমিকরা কিছু চুরি করে নিয়ে যাবে এ ভয়ে আপত্কালে আত্মরক্ষার জন্য পলায়ন পথগুলো তালাবদ্ধ করে রাখা এই শত শত অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুর জন্য দায়ী। সরকার এসব কারখানার মালিকদের উপযুক্ত কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়নি। মো. আতিকুল ইসলামের সমিতির সদস্যদের এসব হত্যাকাণ্ডের পথ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেনি।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট উত্পাদকরা দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক। চীনের পরেই বাংলাদেশের স্থান। কিন্তু বিগত দু’তিন বছরে বিদেশিরা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ট্র্যাজিক দুরবস্থার সমালোচনায় মুখর। মার্কিন সরকার কয়েক বছর ধরেই পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন ও কাজের অবস্থার উন্নতি এবং তাদের ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দানের দাবি জানিয়ে এসেছে। শ্রমিকদের নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার রহস্য জানাতেও তারা মো. আতিকুল ইসলামের সমিতি এবং শেখ হাসিনার সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আসছে। মার্কিন সরকার কার্যত বলেই দিয়েছে, এসব দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির বর্ধিত কিংবা সংরক্ষিত কোটা নিরাপদ নয়।
তাজরীন ফ্যাশন্সের ট্র্যাজেডির পর যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহত্ রিটেইলার চেইন শপ ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। রানা প্লাজায় অবস্থিত কারখানাগুলো অন্যদের মধ্যে ব্রিটেনের প্রাইমার্ক ও ম্যাঙ্গো গ্রুপকে তৈরি পোশাক সরবরাহ করত। ব্রিটেনে এখন এদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছে। খদ্দেররাও বলাবলি করছেন, এ দুটি কোম্পানির উচিত বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি বন্ধ করা। চ্যারিটি সংস্থা ওয়ার অন ওয়ান্ট এবং অ্যাকশন এইড নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণদানের দাবি জানিয়েছে।
বিভিন্ন মহল থেকে প্রস্তাব এসেছে, যারা প্রাইমার্ক থেকে সস্তায় বাংলাদেশে তৈরি টি-শার্ট কিনেছিলেন তাদের উচিত কিছু পরিমাণ অর্থ নিহত শ্রমিকদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ বাবত দান করা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য সদস্য দেশেও একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বলে শুনেছি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের মূল বাজার। সাভার ট্র্যাজেডির জন্য দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তিদান এবং গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাজের শর্ত ও পরিবেশ উন্নত করা না হলে বাংলাদেশ শিগগিরই এই বাজার হারাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ভাবমূর্তি’ সেটা ঠেকাতে পারবে না।
গুরু পাপে লঘু দণ্ড?
কিন্তু সরকারের মতিগতি দৃষ্টে মনে হতে পারে যে, অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তিদানের কথা তারা ভাবছে না। বেনাপোল থেকে র্যাব হেলিকপ্টারে করে পলাতক সোহেল রানাকে ধরে এনেছে বলে মিডিয়ায় প্রচুর নাটক সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কী? ভেতরে ভেতরে জানা যাচ্ছে, সোহেল রানাকে বিধ্বস্ত ভবন থেকে গাড়িতে তুলে দিয়ে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার অফিসার ইনচার্জ। সেসব খবর অনুযায়ী রানা প্রথমে আত্মগোপন করেছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মুরাদ জংয়ের বাড়িতে। অবিলম্বে এসব শোনা খবরের সত্যতা যাচাই করা না হলে জনসাধারণের ক্রোধ বেড়ে যেতে বাধ্য।
তার পরেও শোনা গেছে, রানার বিরুদ্ধে শুধু অমনোযোগিতা এবং নির্মাণ বিধি লঙ্ঘনেরই অভিযোগ আনা হয়েছে। এ দুটো আইনে শাস্তি খুবই হালকা। শুনেছি সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু রানা ও কারখানা মালিকদের যারা অনিচ্ছুক শ্রমিকদের একটা ফাটল ধরা ভবনে কাজে যেতে বাধ্য করেছিলেন, তাদের প্রকৃত অপরাধ আরও বহু বহু গুণ বেশি গুরুতর। তাদের বিরুদ্ধে সঙ্গত অভিযোগ হওয়া উচিত ‘ম্যানস্লটার’ বা অনবধানতা বশত হত্যার। ব্রিটিশ আমলের যে ফৌজদারি দণ্ডবিধি আইনের অধিকাংশ প্রায় অবিকৃতভাবে বাংলাদেশের আইনে গৃহীত হয়েছে, তাতে এই ম্যানস্লটারের বিধান আছে। এ অপরাধের শাস্তি পরিকল্পিত হত্যার সর্বোচ্চ পর্যায়ের শাস্তির কিছুটা কম। সরকার যদি দলীয় বিবেচনায় শাস্তির ভণিতা করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সহজেই ছেড়ে দেয় তাহলে একদিকে তারা ক্রুদ্ধ শ্রমিকদের ও জাতিকে শান্ত করতে পারবে না, অন্যদিকে বিদেশে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের ক্রেতাদেরও আশ্বস্ত করতে পারবে না।
(লন্ডন, ২৯.০৪.১৩)
serajurrahman34@gmail.com
__._,_.___