জাতিসংঘ দূতের অভিমত নির্বাচন হতে হবে ॥ সাংবিধানিক পথে
* তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নয়
* সব দলের অংশগ্রহণের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড
* কোন ধরনের সহিংসতা মেনে নেবে না জাতিসংঘ
* সব দলের অংশগ্রহণের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড
* কোন ধরনের সহিংসতা মেনে নেবে না জাতিসংঘ
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সংবিধানের মধ্যে থেকেই সবার অংশগ্রহণে একটি শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন চায় জাতিসংঘ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নয়, জাতিসংঘ চায় সংবিধানকে সমুন্নত রেখেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য সব দলের জন্য যেন (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) সমান সুযোগ-সুবিধা থাকে। তবে জাতিসংঘ কোন ধরনের সহিংসতা মেনে নেবে না। সংস্থাটি চায়, সবাই সংঘাত পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমেই নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি ও চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে পাঁচ দিনের সফরে আসা জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো শনিবার দিনভর কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে জাতিসংঘ মহাসচিবের এমন বার্তাই পৌঁছে দিয়েছেন রাজনৈতিক ও কূটনীতিক মহলে। দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার কাছে মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ বার্তাও পৌঁছে দেন তারানকো। তিনি আসন্ন নির্বাচন কিছুদিন পেছানো সম্ভব কী না, তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে আলোচনা করেন তিনি।
নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কটের বরফ গলাতে আসা জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত উদ্যোগ নিলেও সরকার ও বিরোধী দল এখনও নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিশেষ দূতকে জানিয়ে দিয়েছেন, আমাদের চেষ্টা থাকবে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করা। তবে যা কিছু করা হবে, সবকিছুই সংবিধানের মধ্যেই করতে হবে। সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন তারানকোও।
তবে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে তাঁর দল ও জোটের অবস্থা তুলে ধরেন তারানকো'র সামনে। তবে বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন কিছু বলতে রাজি হননি দলটির নেতারা। শুধু এটুকু বলেছেন, সব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আবারও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে তারানকো'র বৈঠক হবে।
সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান ও সব দলকে নির্বাচনে আনতে প্রয়াস চালাতে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে শুক্রবার ঢাকায় আসেন মহাসচিবের এই বিশেষ দূত তারানকো। শনিবার দিনভর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ছাড়াও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ইউরোপীয় দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্কট নিরসনে জাতিসংঘের অবস্থান তুলে ধরেন তারানকো।
সফরের তৃতীয় দিন আজ রবিবার ফার্নান্দেজ তারানকো সকালে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন এবং বিকেলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ বিভিন্ন দল ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্কট সমাধানের এই উদ্যোগ সফল হবে কী না, এ নিয়েও রাজনৈতিক মহলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
সাত মাস আগেও জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত হিসেবে এসে সংলাপের তাগিদ দিয়ে যান ফার্নান্দেজ তারানকো। তবে তারপর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা এবং বিরোধী দলের টানা অবরোধে দূরত্ব আরও বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আবার ঢাকায় এলেন তিনি। নির্বাচনকে ঘিরে রাজপথে সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে তাঁর এই সফরকে দেখা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতার শেষ উদ্যোগ হিসেবে।
তারানকোর এবারের সফর নিয়ে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক নেইল ওয়াকার এর আগে এক বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে সংলাপে বসতে রাজনৈতিক দলগুলোকে উৎসাহিত করবেন তারানকো। গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের দুটি চিঠিও তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন জাতিসংঘের সহকারী এই মহাসচিব। এরপরে পরিস্থিতির কোন উন্নতি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী দুই নেত্রীকে চিঠিও লেখেন জাতিসংঘ মহাসচিব, যাতে সঙ্কট সমাধানে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়।
উল্লেখ্য, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে তারানকো শুক্রবার সন্ধ্যায় পাঁচ দিনের সফরে ঢাকায় এসে পৌঁছান। তাঁর সঙ্গে আসা পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলে সংস্থাটির রাজনৈতিক বিভাগের দু'জন, নির্বাচন বিভাগের একজন কর্মকর্তা ও একজন মধ্যস্থতা বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। শনিবার সকালে জার্মান রাষ্ট্রদূতের বাসায় নাস্তা করার মাধ্যমে কর্মকান্ড শুরু করেন ফার্নান্দেজ তারানকো। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপের দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তারানকোর দেড় ঘণ্টা বৈঠক ॥ সফররত জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো শনিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে প্রায় দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। প্রথম পর্বে প্রতিনিধি পর্যায়ে এবং পরে ঘণ্টাব্যাপী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন তারানকো। বৈঠকে তাঁদের মধ্যে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে বৈঠকে সংবিধানের মধ্যে থেকে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত পোষণ করেন জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ব্রিফিংকালে সাংবাদিকদের জানান, তারানকো জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ বার্তা নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। বার্তায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ উন্নয়ন গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ। জাতিসংঘ চায় বাংলাদেশ যেন তাদের স্ট্যাটাচ (মর্যাদা) বজায় রাখে। ডেমোক্র্যাটিক প্রসেসের (গণতান্ত্রিক পদ্ধতি) বিষয়টি স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ।
গওহর রিজভী আরও জানান, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার যা যা করেছে তা তারানকোর সামনে আবারও তুলে ধরেন। তিনি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও বলেন। বৈঠকে নির্বাচন প্রসঙ্গে আলোচনার কথা তুলে ধরে গওহর রিজভী বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব সব দলকে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বার বার সংলাপের যে উদ্যোগ নিয়েছেন তারও প্রশংসা করেছেন। আগামী নির্বাচন সংবিধানের মধ্যেই হবে এবং জাতিসংঘের মহাসচিব সংবিধানকে সমুন্নত রাখার কথাই বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনার দরকার নেই। কিন্তু নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড দেয়া যায় কিনা।
বৈঠকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন পেছানো যায় কি না? তারানকোর এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে গওহর রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে জিজ্ঞেস করতে হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সরকার এখানে কোন হস্তক্ষেপ করছে না। তবে যা কিছু করা হবে, সবকিছুই সংবিধানের মধ্যেই করতে হবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে সব দলকে নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা। কিন্তু সংবিধানের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।
একই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আরেক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, জাতিসংঘের বিশেষ দূত তারানকো বলেছেন, আমরা কোনো সহিংসতা মেনে নিতে পারি না। আমরা আশা করি, সবাই সংঘাত পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমেই নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। জবাব প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বার বার উদ্যোগ নিয়েছি সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করার। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে তারানকোকে জানানো হয়, এই নির্বাচন কমিশন বর্তমান সরকার গঠন করেনি। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াসহ সকল দলের সঙ্গে আলোচনা এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ দিয়েছেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেন তারানকো।
খালেদা জিয়ার সঙ্গেও দীর্ঘ বৈঠক ॥ পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত তারানকো সন্ধ্যা সাতটায় বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করতে তাঁর গুলশানের বাসভবনে যান। প্রায় দেড় ঘণ্টা বৈঠকে এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে চলে যাওয়ার সময় কোনো কথা বলেননি তারানকো। তবে জানা গেছে, আগামী সোমবার সন্ধ্যায় বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে ফার্নান্দেজ তারানকো দ্বিতীয় দফায় বৈঠকে বসতে পারেন।
বৈঠক শেষে মাত্র দেড় মিনিটের ব্রিফিংকালে শমসের মবিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘের বিশেষ দূত তারানকোর সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনা করেছি। এখন কোন কিছুই বলা যাবে না। আলোচনার অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অগ্রগতি হয়েছে কী না, তা এখন বলা যাবে না। তারানকোর সঙ্গে দু'একদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় দফা আলোচনা হবে। আর কোন বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
তারানকোর মিশন সফল হবে- সৈয়দ আশরাফ ॥ রাজনৈতিক সঙ্কট অবসানের লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা সফরে আসা জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রথম বৈঠক করেন শাসক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। দলটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে আসা সাত সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সোনারগাঁও হোটেলে তারানকো সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেন তিনি।
দুপুর দেড়টা থেকে শুরু হয়ে সোয়া তিনটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা সমঝোতার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর ফোন, আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে সহিংসতা-ধ্বংসযজ্ঞসহ সার্বিক বিষয় মহাসচিবের দূতের কাছে তুলে ধরেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দৃঢ় অবস্থান ব্যাখ্যা করে বিগত পাঁচটি বছরে প্রায় ৬ হাজার বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন হস্তক্ষেপমুক্ত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, আমরাও চাই সেভাবেই নির্বাচন হোক। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
জানা গেছে, জাতিসংঘও যে সংবিধানের মধ্যে থেকে হলেও সৃষ্ট সঙ্কটের সমাধান চায়, তা তুলে ধরেন তারানকো। তিনি সংবিধানের মধ্যে থেকে কীভাবে সৃষ্ট সঙ্কট সমাধান করা যায়, সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতাদের মতামত জানতে চান। এ সময় দলটি বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন জাতিসংঘের এই বিশেষ দূতের সামনে। এসব যুক্তি নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার পর আবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলে জানান তারানকো।
বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘ মহাসচিবের দূতের এই সফর সফল হবে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমরা খুবই আশ্বস্ত যে, জাতিসংঘের মহাসচিব উদ্যোগী হয়ে একটি দল বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় মহাসচিব বান কি মুন নিজেই এসেছিলেন। তখনও আমাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল। আজ যে রুমে আলোচনা হয়েছে সেদিন এই রুমেই বৈঠকটি হয়েছিল। ওই বৈঠকটি খুবই ফলপ্রসূ ছিল। সে জন্যই গত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
সৈয়দ আশরাফ আশা প্রকাশ করে বলেন, এবারের আলোচনাও ফলপ্রসূ হবে। আজকে প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আরও কয়েক দফা আলোচনা হবে। আমাদের একটু সময় দিতে হবে। জাতিসংঘ যেমন সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়, আমরাও তা চাই। এ ব্যাপারে আপনাদের (সাংবাদিক) ধৈর্য ধরতে হবে। সাংবাদিকদের উদ্দেশে করে তিনি বলেন, যেহেতু আপনারা দেশের মঙ্গল চান, গণতান্ত্রিক যাত্রা অব্যাহত থাকুক এটা চান, সুতরাং আমাদের কিছুটা সময় দিতে হবে, ওনাদেরও (প্রতিনিধি দল) কিছু সময় দিতে হবে। আশা করি আপনারা সহযোগিতা করবেন, যাতে করে সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে পারি। সবাই বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাঁরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন তাঁদের কথাই বলছি। সবাই তো আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না।
তারানকোর সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ও মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক লে. কর্নেল (অব) ফারুক খান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত শাহেদ রেজা উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে বৈঠক ॥ সকাল ১০টায় পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে সফরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত। সচিবের সঙ্গে এক ঘণ্টা বৈঠকের পর ১১টা থেকে শুরু হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক। আধা ঘণ্টা পরেই তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছেড়ে হোটেল সোনারগাঁও যান। মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে বৈঠকে তারানকো দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা করেন।
সূত্র জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তারানকো জানান, একটি শীর্ষস্থানীয় উন্নয়নকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে জাতিসংঘ। সেই উন্নয়নের ধারা যাতে কোনভাবে ব্যাহত না হয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যেন ভেঙ্গে না পড়ে সেজন্যই দু'দলকে শন্তিপূর্ণ সমাধানের তাগিদ দিয়েছেন জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত। তিনি জানিয়েছেন, সহিংস বাংলাদেশ দেখতে চায় না জাতিসংঘ। এর পর হোটেলে সোনারগাঁওয়ে তাঁর স্যুটে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনার সঙ্গেও বৈঠক করেন তারানকো।
নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কটের বরফ গলাতে আসা জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত উদ্যোগ নিলেও সরকার ও বিরোধী দল এখনও নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিশেষ দূতকে জানিয়ে দিয়েছেন, আমাদের চেষ্টা থাকবে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করা। তবে যা কিছু করা হবে, সবকিছুই সংবিধানের মধ্যেই করতে হবে। সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন তারানকোও।
তবে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে তাঁর দল ও জোটের অবস্থা তুলে ধরেন তারানকো'র সামনে। তবে বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন কিছু বলতে রাজি হননি দলটির নেতারা। শুধু এটুকু বলেছেন, সব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আবারও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে তারানকো'র বৈঠক হবে।
সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান ও সব দলকে নির্বাচনে আনতে প্রয়াস চালাতে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে শুক্রবার ঢাকায় আসেন মহাসচিবের এই বিশেষ দূত তারানকো। শনিবার দিনভর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ছাড়াও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ইউরোপীয় দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্কট নিরসনে জাতিসংঘের অবস্থান তুলে ধরেন তারানকো।
সফরের তৃতীয় দিন আজ রবিবার ফার্নান্দেজ তারানকো সকালে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন এবং বিকেলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ বিভিন্ন দল ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্কট সমাধানের এই উদ্যোগ সফল হবে কী না, এ নিয়েও রাজনৈতিক মহলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
সাত মাস আগেও জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত হিসেবে এসে সংলাপের তাগিদ দিয়ে যান ফার্নান্দেজ তারানকো। তবে তারপর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা এবং বিরোধী দলের টানা অবরোধে দূরত্ব আরও বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আবার ঢাকায় এলেন তিনি। নির্বাচনকে ঘিরে রাজপথে সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে তাঁর এই সফরকে দেখা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতার শেষ উদ্যোগ হিসেবে।
তারানকোর এবারের সফর নিয়ে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক নেইল ওয়াকার এর আগে এক বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে সংলাপে বসতে রাজনৈতিক দলগুলোকে উৎসাহিত করবেন তারানকো। গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের দুটি চিঠিও তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন জাতিসংঘের সহকারী এই মহাসচিব। এরপরে পরিস্থিতির কোন উন্নতি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী দুই নেত্রীকে চিঠিও লেখেন জাতিসংঘ মহাসচিব, যাতে সঙ্কট সমাধানে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়।
উল্লেখ্য, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে তারানকো শুক্রবার সন্ধ্যায় পাঁচ দিনের সফরে ঢাকায় এসে পৌঁছান। তাঁর সঙ্গে আসা পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলে সংস্থাটির রাজনৈতিক বিভাগের দু'জন, নির্বাচন বিভাগের একজন কর্মকর্তা ও একজন মধ্যস্থতা বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। শনিবার সকালে জার্মান রাষ্ট্রদূতের বাসায় নাস্তা করার মাধ্যমে কর্মকান্ড শুরু করেন ফার্নান্দেজ তারানকো। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপের দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তারানকোর দেড় ঘণ্টা বৈঠক ॥ সফররত জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো শনিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে প্রায় দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। প্রথম পর্বে প্রতিনিধি পর্যায়ে এবং পরে ঘণ্টাব্যাপী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন তারানকো। বৈঠকে তাঁদের মধ্যে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে বৈঠকে সংবিধানের মধ্যে থেকে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত পোষণ করেন জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ব্রিফিংকালে সাংবাদিকদের জানান, তারানকো জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ বার্তা নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। বার্তায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ উন্নয়ন গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ। জাতিসংঘ চায় বাংলাদেশ যেন তাদের স্ট্যাটাচ (মর্যাদা) বজায় রাখে। ডেমোক্র্যাটিক প্রসেসের (গণতান্ত্রিক পদ্ধতি) বিষয়টি স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ।
গওহর রিজভী আরও জানান, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার যা যা করেছে তা তারানকোর সামনে আবারও তুলে ধরেন। তিনি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও বলেন। বৈঠকে নির্বাচন প্রসঙ্গে আলোচনার কথা তুলে ধরে গওহর রিজভী বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব সব দলকে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বার বার সংলাপের যে উদ্যোগ নিয়েছেন তারও প্রশংসা করেছেন। আগামী নির্বাচন সংবিধানের মধ্যেই হবে এবং জাতিসংঘের মহাসচিব সংবিধানকে সমুন্নত রাখার কথাই বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনার দরকার নেই। কিন্তু নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড দেয়া যায় কিনা।
বৈঠকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন পেছানো যায় কি না? তারানকোর এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে গওহর রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে জিজ্ঞেস করতে হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সরকার এখানে কোন হস্তক্ষেপ করছে না। তবে যা কিছু করা হবে, সবকিছুই সংবিধানের মধ্যেই করতে হবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে সব দলকে নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা। কিন্তু সংবিধানের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।
একই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আরেক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, জাতিসংঘের বিশেষ দূত তারানকো বলেছেন, আমরা কোনো সহিংসতা মেনে নিতে পারি না। আমরা আশা করি, সবাই সংঘাত পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমেই নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। জবাব প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বার বার উদ্যোগ নিয়েছি সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করার। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে তারানকোকে জানানো হয়, এই নির্বাচন কমিশন বর্তমান সরকার গঠন করেনি। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াসহ সকল দলের সঙ্গে আলোচনা এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ দিয়েছেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেন তারানকো।
খালেদা জিয়ার সঙ্গেও দীর্ঘ বৈঠক ॥ পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত তারানকো সন্ধ্যা সাতটায় বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করতে তাঁর গুলশানের বাসভবনে যান। প্রায় দেড় ঘণ্টা বৈঠকে এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে চলে যাওয়ার সময় কোনো কথা বলেননি তারানকো। তবে জানা গেছে, আগামী সোমবার সন্ধ্যায় বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে ফার্নান্দেজ তারানকো দ্বিতীয় দফায় বৈঠকে বসতে পারেন।
বৈঠক শেষে মাত্র দেড় মিনিটের ব্রিফিংকালে শমসের মবিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘের বিশেষ দূত তারানকোর সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনা করেছি। এখন কোন কিছুই বলা যাবে না। আলোচনার অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অগ্রগতি হয়েছে কী না, তা এখন বলা যাবে না। তারানকোর সঙ্গে দু'একদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় দফা আলোচনা হবে। আর কোন বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
তারানকোর মিশন সফল হবে- সৈয়দ আশরাফ ॥ রাজনৈতিক সঙ্কট অবসানের লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা সফরে আসা জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রথম বৈঠক করেন শাসক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। দলটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে আসা সাত সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সোনারগাঁও হোটেলে তারানকো সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেন তিনি।
দুপুর দেড়টা থেকে শুরু হয়ে সোয়া তিনটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা সমঝোতার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর ফোন, আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে সহিংসতা-ধ্বংসযজ্ঞসহ সার্বিক বিষয় মহাসচিবের দূতের কাছে তুলে ধরেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দৃঢ় অবস্থান ব্যাখ্যা করে বিগত পাঁচটি বছরে প্রায় ৬ হাজার বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন হস্তক্ষেপমুক্ত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, আমরাও চাই সেভাবেই নির্বাচন হোক। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
জানা গেছে, জাতিসংঘও যে সংবিধানের মধ্যে থেকে হলেও সৃষ্ট সঙ্কটের সমাধান চায়, তা তুলে ধরেন তারানকো। তিনি সংবিধানের মধ্যে থেকে কীভাবে সৃষ্ট সঙ্কট সমাধান করা যায়, সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতাদের মতামত জানতে চান। এ সময় দলটি বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন জাতিসংঘের এই বিশেষ দূতের সামনে। এসব যুক্তি নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার পর আবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলে জানান তারানকো।
বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘ মহাসচিবের দূতের এই সফর সফল হবে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমরা খুবই আশ্বস্ত যে, জাতিসংঘের মহাসচিব উদ্যোগী হয়ে একটি দল বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় মহাসচিব বান কি মুন নিজেই এসেছিলেন। তখনও আমাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল। আজ যে রুমে আলোচনা হয়েছে সেদিন এই রুমেই বৈঠকটি হয়েছিল। ওই বৈঠকটি খুবই ফলপ্রসূ ছিল। সে জন্যই গত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
সৈয়দ আশরাফ আশা প্রকাশ করে বলেন, এবারের আলোচনাও ফলপ্রসূ হবে। আজকে প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আরও কয়েক দফা আলোচনা হবে। আমাদের একটু সময় দিতে হবে। জাতিসংঘ যেমন সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়, আমরাও তা চাই। এ ব্যাপারে আপনাদের (সাংবাদিক) ধৈর্য ধরতে হবে। সাংবাদিকদের উদ্দেশে করে তিনি বলেন, যেহেতু আপনারা দেশের মঙ্গল চান, গণতান্ত্রিক যাত্রা অব্যাহত থাকুক এটা চান, সুতরাং আমাদের কিছুটা সময় দিতে হবে, ওনাদেরও (প্রতিনিধি দল) কিছু সময় দিতে হবে। আশা করি আপনারা সহযোগিতা করবেন, যাতে করে সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে পারি। সবাই বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাঁরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন তাঁদের কথাই বলছি। সবাই তো আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না।
তারানকোর সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ও মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক লে. কর্নেল (অব) ফারুক খান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত শাহেদ রেজা উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে বৈঠক ॥ সকাল ১০টায় পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে সফরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত। সচিবের সঙ্গে এক ঘণ্টা বৈঠকের পর ১১টা থেকে শুরু হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক। আধা ঘণ্টা পরেই তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছেড়ে হোটেল সোনারগাঁও যান। মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে বৈঠকে তারানকো দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা করেন।
সূত্র জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তারানকো জানান, একটি শীর্ষস্থানীয় উন্নয়নকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে জাতিসংঘ। সেই উন্নয়নের ধারা যাতে কোনভাবে ব্যাহত না হয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যেন ভেঙ্গে না পড়ে সেজন্যই দু'দলকে শন্তিপূর্ণ সমাধানের তাগিদ দিয়েছেন জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত। তিনি জানিয়েছেন, সহিংস বাংলাদেশ দেখতে চায় না জাতিসংঘ। এর পর হোটেলে সোনারগাঁওয়ে তাঁর স্যুটে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনার সঙ্গেও বৈঠক করেন তারানকো।
__._,_.___