॥ অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন॥
মুসলমানদের ভারতে আগমন ছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অষ্টম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন-কাশিম সিন্ধু, মুলতান ও পাঞ্জাবের কিয়দংশ জয় করে সমগ্র ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্য স্থাপনের পথ সুগম করেছিলেন। পরবর্তীকালে একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে গজনীর সুলতান মাহমুদ, ঘোর রাজ্যের মুহাম্মদ ঘুরি ও দিল্লির প্রথম স্বাধীন সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক উত্তর ভারতের আজমীর ও দিল্লী জয় করে বিজিত রাজ্যে ইসলামী শিক্ষা ব্যাবস্থা চালু করেন।
সুলতানী শাসনামলের পূর্বে হিন্দু শিক্ষা মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণদের হাতে কুক্ষীগত ছিল। হিন্দু সমাজের মধ্যে বর্ণভেদের কারণে নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের শিক্ষার কোনো অধিকার ছিল না। তৎকালীন ব্রাহ্মণ শিক্ষকেরা নিম্ন হিন্দুদেরকে শিক্ষা দিতে কখনো রাজী হতোনা। সংস্কৃত ছিল বেদের ভাষা। তাই ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যেরা বেদের ভাষা স্পর্শ করতে পারতো না। এমতাবস্থায় মুসলমান সুলতানগণ ইসলামের শ্বাশ্বত উদার নীতি অনুসরণ করে নিম্ন হিন্দু সমাজের জন্যেও শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সুলতানী আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রত্যেক নাগরিক, হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষের সমান সুযোগ ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। বেদের ভাষা সংস্কৃত ছিল বলে সাধারণ হিন্দু নাগরিকগণ মোটেই পড়তে পারত না। তাই মুসলমানরা সংস্কৃত গ্রন্থ ফার্সিতে অনুবাদ করে স্কুল ও মক্তবে হিন্দু ছাত্রদেরকে সংস্কৃত পড়ার বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। ভারতের শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের অবদান অনস্বীকার্য। মুসলিম শাসকদের শিক্ষার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
গজনীর সুলতান মাহমুদ শিক্ষা ও শিক্ষিতের বড় পৃষ্টপোষক ছিলেন। তার দরবার ছিল জ্ঞানী-গুণীর মহা মিলন কেন্দ্র। সুলতান মাহমুদ তাঁর দরবারে দুই শতাধিক কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিকদের পৃষ্টপোষকতা করেছিলেন। বিখ্যাত পণ্ডিত আবু রায়হান আল বেরুনি, ঐতিহাসিক উৎবী, বিশ্ব বিখ্যাত শাহানামা রচয়িতা মহা কবি ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদের পৃষ্টপোষকতা ও আনুকূল্য লাভ করেছিলেন।
সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক ছিলেন একজন জ্ঞানী-গুণী ও শিক্ষিত ব্যক্তি। আরবী ও ফার্সি ভাষার একজন সু-পণ্ডিত ছিলেন কুতুবুদ্দিন আইবেক। ভারতবর্ষে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি ভারতে মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন কুতুব মিনার নিমার্ণ করেছিলেন। আজও কুতব মিনার স্থাপত্য শিল্পের এক অন্যন্য নিদর্শন।
সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী নিজে বিদ্যান না হলেও বিদ্যোৎসাহী ও বিদ্যানুরাগী ছিলেন। শিক্ষা ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের তিনি ভালোবাসতেন। সিংহাসনে আরোহণের পর তিনি ফার্সি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন। অল্প সময়ের ভিতরে তিনি ফার্সি ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্পের পৃষ্টপোষক হিসেবে আলাউদ্দিন খিলজী ভারতীয় ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। মুসলিম ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ভারতীয় তোঁতা পাখি বলে খ্যাত কবি আমির খসরু ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজীর রাজ দরবারের সবচেয়ে খ্যাতিমান কবি।
শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান তাপস। তিনি ইসলাম শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন।
মোহাম্মদ বিন-তুঘলক তাঁর রাজ্যে বহু বিদ্যালয়, মক্তব, মাদ্রাসা ও কলেজ স্থাপন করেছিলেন। মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ঘুরী ইসলাম প্রচারের জন্যে দিল্লিতে 'কুয়াতুল ইসলাম' নামে একটি মসজিদ স্থাপন করেছিলেন। দাস বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুদ্দিন আইবেক ছিলেন একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি সাহিত্যানুরাগীও ছিলেন। সুলতান ইলতুৎমিশ শিল্প ও সাহিত্যের একজন বড়মাপের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সুলতান ইলতুৎমিশের বিদুষী কন্যা সুলতানা রাজিয়া দিল্লিতে একটি উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর ছিলেন তৎকালীন সময়ের একজন বড়মাপের কবি ও সাহিত্যিক। সম্রাট বাবর অনেক কবিতা ও কাব্যগ্রন্থ রচনা করে প্রচুর খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন। তুর্কি ভাষায় লিখিত তার আত্ম জীবনী গ্রন্থ 'তুজুক-ই-বাবর' সাহিত্য জগতে তাঁর এক অমর কীর্তি। সম্রাট বাবর গদ্য রচনায়ও পারদর্শী ছিলেন। ফার্সি ও তুর্কি উভয় ভাষাতেই সম্রাট বাবর পদ্য ও গদ্য রচনা করতে পারতেন।
সম্রাট হুমায়ুনও ছিলেন একজন উচ্চমানের কবি। হুমায়ুন রচিত একটি রুবাই শুনে ইরানের বাদশাহ্ শাহ তামাশ তাঁকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিলেন। তার সাম্রাজ্যে সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে সম্রাটের পরই কবি সাহিত্যিক, জ্ঞানী-গুনী ও বিদ্যান ব্যক্তিদের স্থান নির্ধারিত ছিল। নারী শিক্ষার প্রতিও সম্রাট হুমায়ুন উদাসীন ছিলেন না। নারী শিক্ষার প্রতি তার ব্যাপক আগ্রহ ছিল। ইরানী শিক্ষয়িত্রীর তত্ত্বাবধানে গুলবদনের লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে সম্রাট তার পড়াশোনার জন্যে রাজপ্রাসাদের অন্দর মহলে একটি বড় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে লাইব্রেরিতে বিভিন্ন ভাষায় লিখিত বই সংরক্ষিত ছিল। চিত্রকলা ও সংগীতের প্রতি সম্রাট হুমায়ুনের গভীর আগ্রহ ও অনুরাগ ছিল।
সম্রাট আকবর কাগজে কলমে নিরক্ষর থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অসাধারণ জ্ঞানী ও প্রতিভাবান ছিলেন। রক্ষণশীল ভারতে আকবর এক উদার শিক্ষানীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সময়ে হিন্দু মুসলমান ছাত্রগণ একই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারতো। সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজে বিদ্বান ছিলেন। তিনি শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জাহাঙ্গীর ছিলেন ফার্সি সাহিত্যের একজন সু-পণ্ডিত।
সম্রাট শাহ্জাহান একজন শিক্ষিত রুচিবান ব্যক্তি ছিলেন। স্থাপত্য ও শিল্পকলার প্রতি তার প্রচুর আগ্রহ ছিল। সম্রাট শাহজাহানের নির্মিত তাজমহল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য শিল্প হিসেবে এখনো মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে।
সম্রাট আওরঙ্গজেব ওরফে বাদশা আলমগীর ছিলেন একজন বড় মাপের আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক। তিনি কুরআন তাফসির করতে পারতেন। হাদিস ও ফিকাহ্ শাস্ত্রে একজন সু-পণ্ডিত ছিলেন। তার আগ্রহ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ফতোয়ায়ে আলমগীরি নামক বিখ্যাত ফতোয়া গ্রন্থ রচিত হয়। মুসলিম পারিবারিক আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ফতোয়ায়ে আলমগীরি একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ। বাদশাহ্ আলমগীর শিক্ষকদের মর্যাদা দিতেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে সম্রাট আওরঙ্গজেবের অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মুসলিম শাসকেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বাংলা ভাষার বিস্তারে মুসলিম শাসকদের রয়েছে ব্যাপক অবদান। ভারতীয় উপমহাদেশে মক্তব, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার করেছিলেন মুসলিম শাসকগণ।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তারাগঞ্জ কলেজ,কাপাসিয়া, গাজীপুর।
__._,_.___