জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার আপিলে আসামীপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর শুনানি অব্যাহত
ঢাকা, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (বিডিএনএন২৪) :- ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় আজ তৃতীয়দিনের মতো আসামীপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ( স্টেট ডিফেন্স) শুনানি উপস্থাপন করেছে। আসামীপক্ষের আইনজীবী (স্টেট ডিফেন্স) ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন এ শুনানি উপস্থাপন করেন। এর আগে আপিল শুনানিতে সাতদিন রাষ্ট্রপক্ষয শুনানি ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছে। প্রধান বিচারপতি মো.মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় সদস্যের বেঞ্চে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। মামলার কার্যক্রম আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বিডিএনএন২৪'কে আজ এ কথা বলেন।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এটর্নি জেনারেলের মর্যাদায় নিযুক্ত এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী আনিসুল হক ও এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, সাক্ষীরা বলেছেন-শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এমপি হোস্টেলে বললেন বঙ্গবন্ধু মারা গেছে, কি হয়েছে ঘাবড়াবার কিছু নেই। পার্লমেন্ট তো আছে। আওয়ামী লীগের চার নেতাসহ ২৬ জন কারাগারে রয়েছে। মুশতাক সাহেব ১০/১৫ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। তোমরা তাকে সাপোর্ট করো। তা না হলে কনসিকুয়েন্স খারাপ হবে। জেলখানায় যারা আছে প্রয়োজনবোধে তারা শেষ হয়ে যাবে।'
আরেক সাক্ষীর উদ্ধৃতি দিয়ে মাহবুবে আলম বলেন, শাহ মোয়াজ্জেম, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, কেএম ওবায়দুর রহমানরা মনসুর আলীকে নিয়ে খন্দকার মোশতাকের কাছে যান এবং মনসুর আলীকে মন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি অস্বীকার করেন। এর আগে নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করেছিলো। তিনিও প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়াও কামরুজ্জামানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের জন্য প্রস্তাব দিলে তিনিও অস্বীকার করেন। মাহবুবে আলম বলেন, তৎকালীন ঢাকা জেলার এসপি মাহবুব তার স্বাক্ষ্যে বলেন, ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর কর্নেল ডালিম কেন্দ্রীয় কারাগারে আমার কক্ষের সামনে আসেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি তুই এখানে আসছিস? ও তখন বলে তোদের বাতি-বুতি ঠিক আছে কিনা দেখতে এসেছি। ঘটনার দিন সকালে মেজর রশিদ ক্যাপ্টেন মোসলেমকে জিজ্ঞাসা করে জেলখানায় কী বড় চারটা শেষ। উত্তরে ক্যাপ্টেন মোসলেম বলেন, স্যার সব শেষ।
এরপর দোষীদেরকে বিদেশে পাঠানো হয় এবং বেনগাজি এবং লন্ডনে বিদেশী মিশনে চাকরি এবং পদোন্নতিও দেয়া হয়। আর তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ওয়ালিউর ও শমসের মোবিন চৌধুরী তাদের দেখভাল করেন। এটর্নি জেনারেল বলেন, কিছু সেনা সদস্য ও রাজনৈতিক নেতার ষড়যন্ত্রে কেন্দ্রীয় কারাগারে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। অথচ বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট বিষয়টি আমলে নেননি। তিনি বলেন, জেলহত্যাকান্ডের চেয়ে জঘন্যতম ও ষড়যন্ত্র আর কিছু হতে পারে না। ন্যায় বিচারের স্বার্থে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের নোটিস দেয়া হোক। তাদের বক্তব্য শুনে তাদের সর্বোচ্চ দণ্ড দেয়ার আবেদন জানিয়েছি, যেন ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রকাশ পায়। এটা সম্ভব না হলে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এ হত্যাকান্ড করা হয়েছে, অন্তত রায়ে যেন এ বিষয়টি থাকে। এ মামলায় গত ১২ ফেব্র"য়ারি মঙ্গলবার এটর্নি জেনারেলের মর্যাদায় নিযুক্ত এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী আনিসুল হক শুনানি শেষ করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলী আনিসুল হক বলেন, ২০০২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ রাষ্ট্রপক্ষের ছিল না। তিনি বলেন, সে সময়ে এ মামলার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। এর ফলেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে খালাস দিয়েছিল হাইকোর্ট। আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, দুই আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন আজ শেষ হয়েছে। কাল বুধবার এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করবেন। গত ১৫, ২২ ও ২৩ জানুয়ারি আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দি উপস্থাপন করা হয় এবং ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায় উপস্থাপন শুরু করা হয়। এরপর যুক্তি উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
আনিসুল হক আরও বলেন, মামলাটির দু'টি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে, অপরাধ সংগঠন। অপরটি হলো ষড়যন্ত্র। সশস্ত্র সেনা কর্মকর্তারা কারাগারে এসে চার নেতাকে গুলি করে হত্যা করে। পরে অন্য একটি দল এসে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মুত্যু নিশ্চিত করে। তিনি বলেন, বঙ্গভবনে ষড়যন্ত্রের বৈঠকে এ দুই দল সেনা কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। তাই এদিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। কারা সেখানে যাবেন, সেটা নির্ধারণ হয় বঙ্গভবনের বৈঠকে। আনিসুল হক আরও বলেন, এ মামলায় হাইকোর্ট আপিলকারী সকল আসামিকে খালাস দিয়ে একমাত্র রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে বলেছি, হাইকোর্টের রায় বিকৃত, পক্ষপাতদুষ্ট ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। আমরা ন্যায় বিচারের জন্য আপিল দায়ের করেছি।
তিনি বলেন, সাক্ষীদের বক্তব্যে এসেছে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ সে সময়কার কারা মহাপরিদর্শককে ফোনে বলেছেন, মোসলেহ উদ্দিনসহ যে ক'জন গেছে, তাদের কাজ করতে দাও। এসময় কারা মহাপরিদর্শক রাষ্ট্রপতিকে বলেন, তারা জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করতে চায়। জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন, করতে দাও। তিনি বলেন, সেদিন মোসলেহ উদ্দিনের সঙ্গে ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ, দফাদার মারফত আলী ও দফাদার মারফত আলী শাহ ছিল।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের লিভ টু আপিল আবেদন (আপিল করার অনুমতি চেয়ে আবেদন) ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি সে ময়কার প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ মঞ্জুর করে। একইসঙ্গে ওই আদেশে দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ। অন্যথায় এ দু'জনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয় আদালত। এছাড়া আপিলের সংক্ষিপ্তসার তৈরি করে জমা দিতে নির্দেশ দেয়। আপিল শুনানির জন্য সারসংক্ষেপ (কনসাইজ স্ট্যাটমেন্ট) গত ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগে জমা দেয়া হয় এবং মামলায় আপিল শুনানির জন্য ২৫ পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ দাখিল করা হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। এ নির্মম ও বর্বরোচিত ঘটনার পরদিন তৎকালীন উপ-কারা মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই ঘটনায় মামলা দায়েরের ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর অভিযোগপত্র দেয়া হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান রায় ঘোষণা করেন। রায়ে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন (পলাতক), দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ও এল ডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে (পলাতক) মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত চার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদসহ ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা কেএম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে খালাস দেয়া হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাইকোর্ট ২০০৮ সালে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মারফত আলী ও হাশেম মৃধাকে খালাস দেয়। রায়ে মোসলেমের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকেও খালাস দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করে।
http://khabor.com/news/2013/02/26/201302999902275230443560.htm
Related:
জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার আপিলের শুনানি ১৫ জানুয়ারি
নিউজডেস্ক, বাংলাদেশনিউজ২৪x৭.কম
জেলহত্যা মামলায় আপিলে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ - নতুন বার্তা
Feb 12, 2013 – ঢাকা: ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় ষষ্ঠ দিনের মতো আপিল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষে ... এ নির্মম ও বর্বরোচিত ঘটনার পরদিন তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালের ...
জেলহত্যা মামলায় আপিলে অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি উপস্থাপন | law ...
Feb 13, 2013 – ঢাকা: ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় বুধবার সপ্তম দিনের মতো আপিল শুনানি হয়। ... আওয়ামী লীগের চার নেতাসহ ২৬ জন কারাগারে রয়েছে। মোশতাক সাহেব ১০-১৫ বছর ... এ ঘটনার পরদিন তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার ২৩ বছর পর ...
'জাতীয় চার নেতা হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল বঙ্গভবনে'
চার নেতা হত্যার ষড়যন্ত্র হয় বঙ্গভবনে: আনিসুল হক | law-court ...
__._,_.___