রাউজান প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর, ২০১৩
আতংক কাটেনি যুদ্ধের সময় সংঘটিত নৃশংসতম গণহত্যাস্থল রাউজানের বণিকপাড়া ও ঊনসত্তরপাড়ায়। এই দুই বধ্যভূমিতে যারা নিহত হয়েছেন তাদের স্বজনরা চারদিন ধরে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত বিএনপির শীর্ষ নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হবেÑ এই খবরের পর থেকেই শহীদ স্বজনদের পরিবারগুলো নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায় বলে স্থানীয়রা জানায়। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল গহিরা এলাকায় কুণ্ডেশ্বরীর নতুন চন্দ্র সিংহ হত্যাকাণ্ড এবং ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের বণিকপাড়ায় একাধিক হিন্দু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল উপজেলার ঊনসত্তরপাড়া এলাকায় ৭১ ব্যক্তিকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যাসহ উপজেলার একাধিক অভিযোগের মামলার এলাকার লোকজন আতংক ও উদ্বেগের মধ্যে আছে। এসব এলাকা অনেকটা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। আবার অনেকের চোখে-মুখে এখণও অজানা আতংক। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজন কেউ সাকা চৌধুরীর ফাঁসির বিষয়ে মুখ খুলতে চাচ্ছেন না। এসব জায়াগার অনেক মন্দির ও ঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়।
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদানের পর উপজেলার রাজপথে বিএনপি বা সাকার কর্মী-সমর্থকদের দেখা যায়নি।
যেসব কারণে সাকার ফাঁসি ও দণ্ড হয়েছে সেসব ঘটনাস্থলে মানুষের চোখে-মুখে আতংক থাকলেও উপজেলার বেশ কিছু এলাকা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে যেসব জায়গায় স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মানুষ হত্যা করেছেন এর মধ্যে অন্যতম ঊনসত্তরপাড়ার গণহত্যা। এ জায়গা রাউজানের ইতিহাসে করুণ অধ্যায় বলে ধরে নেয়া হয়। কারণ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী নিষ্ঠুর গণহত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে এই ঊনসত্তরপাড়ায়। এই গণহত্যার সাক্ষী ঊনসত্তরপাড়ার সতীশ মহাজনের সেই পুকুর, যার পাড়েই রচিত হয়েছে ঊনসত্তরপাড়ার গণকবর। এ নিষ্ঠুর গণহত্যা থেকে সেদিন ২ জন লোক অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, হানাদাররা ব্রাশ ফায়ার করার আগে এ দুজনকেও অন্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়েছিল। হানাদারদের উদ্যত অস্ত্রের মুখ থেকে বেঁচে যাওয়া এ দুজন হলেনÑ নরেশ চন্দ্র এবং কালি কুমার পাল। মূলত ১৩ এপ্রিল হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হলেও এই গণহত্যাই ষড়যন্ত্রের বীজ রোপণ হয় ১১ এপ্রিল। গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে ঊনসত্তরপাড়া এলাকার জনসাধারণ ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে এসে ঊনসত্তরপাড়ায় আশ্রয় নেয়া অনেকেও ছিলেন। জানা যায়, বেতাগী, রাঙ্গুনীয়া, কাট্টলী, আগ্রাবাদ, ফতেপুর, খেয়্যাখালী গ্রামেরও বেশ কয়েকজন গণহত্যার শিকার হন। নিহতদের বেশির ভাগই দিনমজুর হলেও কৃষি, চাকরি, কুম্ভকার, সুতার-মিস্ত্রি, ছাত্র, শিক্ষক ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী নিহত হন। গণহত্যায় নিহদের মধ্যে সবার নাম জানা না গেলেও কালি কুমার পাল ও অন্যান্য সূত্রে যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেনÑ যোগেশ চন্দ্র মহাজন, রণজিত কুমার মহাজন, নীরোদ বরণ ঘোষ, শক্তিপদ, মনীন্দ্রলাল, রণজিন কুমার রুদ্র, উমেশ চন্দ্র, ক্ষেত্র মোহন, স্বপন কুমার, শ্রী কৃষ্ণ চৌধুরী, মনি কুস্তলা, বাবুল, নিরঞ্জন, প্রতিমা, মধুসূদন, নির্মল চন্দ্র, ধীরেন্দ্রলাল, হেমন্ত কুমার, নুকুল চন্দ্র, উত্তম বালা, নিকুঞ্জ বিহারি, পুলিন বিহারি, তারাচরণ, বলরাম, ফনিন্দ্রলাল, শ্রী রাম, চন্দ্র কুমার, শক্তিবালা, দুর্গাচরণ, সুপ্রিয় পাল, সতীশ চন্দ্র পাল, হিমাংশু, বিমল, বিরজা বালা, ধীরেন্দ্রলাল, তারাপদ, বেনী মধাব, পাখি বালা, অভিশূন্য, উপেন্দ্রলাল, সন্তোষ আলী, বাবুল চন্দ্র, গোপাল চন্দ্র প্রমুখ। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় ঘোষণার আগের দিন থেকে শহীদদের পরিবার ও বেঁচে থাকা সাক্ষীরা পালিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কোনো সাক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বজনরাও অজানা আতংকে ঘর ছেড়ে পলাতক। এ ব্যাপারে স্থানীয় মেম্বার ইসমাইল বলেন, রায় ঘোষণার পর থেকে ঊনসত্তরপাড়ায় শহীদ পরিবারগুলোর মাঝে আতংক দেখা দিয়েছে। তবে এখানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ মামলার অন্যতম সাক্ষী পাশ্ববর্তী পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের বাড়ি আগে সেই জায়গায় ছিল, পরে পূর্ব গুজরায় এসে প্রতিষ্ঠিত হই এবং তিনবারের ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছি। এরপরও নিরাপত্তাহীনতায় আছি। মামলার রায়ের পর নিজে ও এলাকার লোকজন নিয়ে পাহারায় থাকতে হচ্ছে। তার রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এভাবে থাকতে হবে বলেও তিনি জানান।
Hindus in Raozan retreat into their shell; 10 vehicles torched, 5 others vandalised in Ctg and Dhaka