লন্ডনে হল ভাড়া নিয়ে তারেকের অর্থ কেলেঙ্কারি, তোলপাড়
জালিয়াতি তদন্তে নেমেছে লন্ডন পুলিশ
জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ বিএনপি নেতা তারেক রহমান। নামেই যার পরিচয়। তবে সেই পরিচয়টা মোটেও সুখদায়ক নয়। বিরোধী পক্ষের কেউ তাকে ডাকে 'দুর্নীতির বরপুত্র', কেউবা বলেন 'শীর্ষ দুর্নীতিবাজ।' আর এই দুর্নীতির তকমা মাথায় নিয়েই মুচলেকা দিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু প্রবাসে বসেও দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারছেন না হাওয়া ভবনের এক সময়ের দোর্দ- প্রতাপশালী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এই জ্যৈষ্ঠ পুত্র! গত ৭ এপ্রিল লন্ডনের যে ওয়েস্টমিনস্টার হলে 'সুধী সমাবেশের' নামে তারেক রহমান ইতিহাস বিকৃতির উদ্ভট তত্ত্ব হাজির করে সমালোচনার শিরোনাম হয়েছেন, সেই হলের ভাড়া পরিশোধে বড় ধরনের আর্থিক জালিয়াতি, অনুষ্ঠানের নাম করে বিপুল পরিমাণ চাঁদা উত্তোলন এবং অনুষ্ঠানের পর বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে মৃদু হাতাহাতি ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনা যুক্তরাজ্য জুড়েই তোলপাড়ের সৃষ্টি করেছে। বেগতিক অবস্থা থেকে উত্তরণে যুক্তরাজ্য বিএনপির শীর্ষ নেতারা বিষয়টি নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে ফেলতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। হল ভাড়া পরিশোধে অর্থ জালিয়াতির ঘটনা সেদেশের পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। যুক্তরাজ্য পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দোষীদের শনাক্ত করতে মাঠে নেমেছে। লন্ডনজুড়ে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে এই ঘটনায় তারেক রহমানকে নিয়ে নানা মুখরোচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলাবলি করছেন, তারেক রহমান থাকবেন আর সেখানে দুর্নীতি বা জালিয়াতি হবে না- সেটা কী করে হয়?
গত ৭ এপ্রিল মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের এই ওয়েস্টমিনস্টার হলেই 'সুধী সমাবেশের' ব্যানারে বিএনপি সমর্থকদের এক সভায় তারেক রহমান 'শেখ মুজিব ছিলেন অবৈধ প্রধানমন্ত্রী' এমন উদ্ভট তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন! তাঁর এই মন্তব্যে শুধু লন্ডন বা বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বে থাকা প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীরা তারেক রহমানকে 'অর্বাচীন, অর্ধশিক্ষিত বালক, হতাশাগ্রস্ত দুর্নীতিবাজের পাগলের প্রলাপ'সহ নানা বিশেষণে ভূষিত করে তার করা ওই উদ্ভট তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরেছেন জাতির সামনে।
লন্ডনে হল ভাড়া নিয়ে অর্থ জালিয়াতির ঘটনা সেদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রেও ফলাও করে প্রচার হয়েছে। সেদেশের ৪৬ বছরের পুরাতন বাংলা সাপ্তাহিক 'জনমত' পত্রিকাতেও বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে রিপোর্ট করেছে। জনমত পত্রিকার রিপোর্ট ছাড়াও লন্ডনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭ এপ্রিল ওয়েস্টমিনস্টার হল ভাড়া নিয়েছিলেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদ। অনুষ্ঠান শেষে হলের ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে বড় ধরনের আর্থিক জালিয়াতির আশ্রয় নেন তিনি।
জানা গেছে, কয়ছর আহমেদ অনুমতি ছাড়াই বিএনপির অন্য এক নেতার ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করে বড় অঙ্কের হলের ভাড়া পরিশোধ করেছেন। ওই নেতার ব্যাংক কার্ড কী ভাবে কয়ছর আহমদের কাছে গেল তা নিয়েও তৈরি হয়েছে বিরাট রহস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষতিগ্রস্ত ওই বিএনপি নেতা অর্থ জালিয়াতির ঘটনা লন্ডন পুলিশকে জানিয়েছেন। বিএনপির পদ হারানো আর তারেক রহমানের ভয়ে ওই বিএনপি নেতা তটস্থ থাকলেও রহস্য অনুসন্ধানে লন্ডন পুলিশ ইতোমধ্যে তদন্তে মাঠে নেমেছে। এ নিয়ে পুরো লন্ডনে তোলপাড় চলছে। বলাবলি হচ্ছে, লন্ডনে আশ্রয়ে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় পুত্র তারেক রহমানের অজ্ঞাতসারে বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এত বড় ঘটনা ঘটানোর সাহস পেত না।
সাপ্তাহিক জনমতের প্রতিবেদক ক্ষতিগ্রস্ত ওই বিএনপির নেতার সঙ্গে কথাও বলেছেন। রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্যাংক কার্ডের মালিক ওই বিএনপি নেতা নিজেই স্বীকার করেছেন, এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে এবং তিনি নিজে বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছেন। তদন্তের পর পুরো রহস্য উদঘাটিত হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে সবার সামনে মুখ খুলবেন। তবে বর্তমানে বিষয়টি যুক্তরাজ্যে পুলিশের তদন্তাধীন থাকায় তিনি এখন কোন মন্তব্য করতে চাইছেন না।
এ ঘটনা নিয়ে লন্ডনজুড়েই সমালোচনার ঝড় উঠলে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি শাইস্তা চৌধুরীর কথায় বড় ধরনের অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। একবার তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। কে হলের ভাড়া পরিশোধ করেছে তার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, আমরা পরিশোধ করেছি। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, তিনি এবং সাধারণ সম্পাদক কয়ছর আহমদ হলের ভাড়া পরিশোধ করেছেন। কার্ডের পিন নাম্বার কে টিপেছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাধারণ সম্পাদক কয়ছর আহমদ তা করেছেন। কিন্তু এ কার্ডটি কার ছিল? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি দাবি করেন, হলের ভাড়া বাবদ ৭ হাজার পাউন্ডের কিছু বেশি অর্থ তারা ক্যাশে (নগদ) পরিশোধ করেছেন। তবে হলের প্রকৃত ভাড়া কত তা তিনি ভুলে গেছেন।
তবে যুক্তরাজ্য বিএনপির অন্য নেতাদের অভিযোগের তীর কয়ছর আহমদের দিকেই। তাদের দাবি, সাধারণ সম্পাদক কয়ছর আহমদই কার্ড জালিয়াতি করেছেন। নেতাদের আরও অভিযোগ, হল ভাড়া ও সভার খরচ বাবদ বিভিন্ন শাখা কমিটি এবং নেতাকর্মীদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ চাঁদা তোলা হয়েছে। অনেককে তারেক রহমানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হবেÑ এ কথা বলেও অর্থ আদায় করা হয়েছে। এসব অর্থের কোন হিসাব কারও কাছে নেই। উত্তোলিত এসব অর্থের হিসাব দেয়া তো দূরে থাক, উল্টো হলের ভাড়া পরিশোধে সাধারণ সম্পাদক অর্থ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।
খোদ বিএনপি নেতারাই অভিযোগ করছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র তারেক রহমানকে নিয়ে ঘনঘন এসব অনুষ্ঠান আয়োজন করে যুক্তরাজ্য বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা অর্থ বানানোর মেশিন হয়ে উঠেছে। আর এসব অর্থের ভাগ অনেক জায়গাতেই যায়। জানা গেছে, তারেক রহমানের সম্মতি নিয়েই ওই দুই নেতা এমন ঘনঘন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। আর এসব অনুষ্ঠানেই 'জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি' আর 'শেখ মুজিব ছিলেন অবৈধ প্রধানমন্ত্রী'- এই দুই উদ্ভট তত্ত্ব আবিষ্কার করেন তারেক রহমান।
এই দুই উদ্ভট তত্ত্বের কারণে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও সমালোচনার ঝড় চলছে বাংলাদেশে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও দ্রুত সংবিধান লঙ্ঘনকারী এমন মন্তব্যের জন্য তারেক রহমান ও তাঁর মা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে 'রাষ্ট্রদ্রোহ' মামলা দায়ের এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়েস্টমিনস্টার হলে তারেক রহমানের ওই অনুষ্ঠানে অতিথিদের নাম ভুল উচ্চারণ নিয়েও বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। অনুষ্ঠান শেষে যুক্তরাজ্য প্রবাসী কয়েক বিএনপি নেতা এ বিষয়ে প্রকাশ্যই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠান শেষে কয়েক বিএনপির নেতাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, মৃদু হাতাহাতি ও গালিগালাজের ঘটনা ঘটলেও আয়োজকরা তা বরাবরের মতোই অস্বীকার করেছেন।
জানা গেছে, তারেক রহমানের উপস্থিতিতে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার বর্তমান কমিটি নিয়ে সেদেশে বসবাসরত দলটির পোড় খাওয়া নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ-অভিমানের কমতি নেই। এ ছাড়া লন্ডনে বিএনপি স্পষ্টত দুইভাবে বিভক্ত। একদিকে সাবেক সভাপতি মহিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এম এ মালেক, অন্যদিকে বর্তমান সভাপতি শাইস্তা চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক কয়ছর রহমান।
ত্যাগী নেতাদের অভিযোগ, বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কোন সময়ই বিএনপির বড় কোন নেতা ছিলেন না, তাদের বড় পরিচয় ব্যবসায়ী। বিএনপির ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে কেন তাদের এত বড় পদে আনা হলো এ নিয়েও লন্ডনে দলটিতে সমালোচনার কমতি নেই। প্রকাশ্য না বললেও আড়ালে-আবডালে কমিটি গঠনে বিপুল অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ যুক্তরাজ্যের সর্বত্র। বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে তারেক রহমানকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে বিএনপি সমর্থক প্রবাসী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে থেকে চাঁদা তুলে পরে উপঢৌকন হিসেব অনেক জায়গায় দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
__._,_.___