ভাসানী-ইন্দিরা পত্রবিনিময় এবং ফারাক্কা লংমার্চ
13 May 2014, Tuesday
আর দু'দিন পর ১৬ মে। এই দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেটা ছিল ১৯৭৬ সাল। এর ক'মাস পরই ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে মওলানা ভাসানী ইহলোক ত্যাগ করেন। তার জীবন ছিল দীর্ঘ, বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন করেছেন, পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন, সিলেট জেলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সিলেট রেফারেন্ডাম বা গণভোটে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠন করেছেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনেও তার ছিল গৌরবদীপ্ত ভূমিকা। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে এদেশে বিরোধীদলীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মাটিতে নির্বাচনী সংগ্রামের মাধ্যমে মুসলিম লীগের কবর রচনা করে। এ ছাড়া পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সিয়াটো-সেন্টো এবং পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবিতেও তিনি আন্দোলন করেছেন। বলতে গেলে জনঘনিষ্ঠ সব আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তিনি। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেও তার ভূমিকা ছিল অনবদ্য। বাংলাদেশ-উত্তরকালে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে তার নেতৃত্বে যে ফারাক্কা লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেটিও আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। মওলানা ভাসানী কখনোই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হননি। ক্ষমতার জন্য তার কোনো লোভও ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান-পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তনে তিনি এক শক্তিশালী অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে হরতাল পালন করে বরফ ভাঙার কাজটি তিনি করেছিলেন। এর ফলেই সম্ভব হয়েছিল ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে ১৯৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান। এ গণঅভ্যুত্থানই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণসোপান রচনা করেছিল।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করে গঙ্গার পানি ভাগীরথীর দিকে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল। ভারতের উদ্দেশ্য ছিল ভাগীরথী নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করে কলকাতা বন্দরকে পলিমাটির দ্বারা ভরাট হওয়া থেকে রক্ষা করা। ভারতের সেই চেষ্টা আজ পর্যন্ত কতটুকু সফল হয়েছে সেটা ভারতের বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন। তবে যতদূর জানা যায়, ভারতের সেই অভীষ্ট লক্ষ্য সফল হয়নি। কলকাতা বন্দরের নাব্য সমস্যা থেকেই গেছে। এই প্রেক্ষাপটে ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে ফিডার ক্যানেল চালুর ইতিহাসটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। বাংলাদেশের প্রথিতযশা পানি বিশেষজ্ঞ বিএম আব্বাস এটি ফারাক্কা ব্যারাজের ওপর দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। পরলোকগত এই পানি বিশেষজ্ঞের গ্রন্থ দুটির নাম হল 'ফারাক্কা ব্যারাজ ও বাংলাদেশ' এবং 'The Ganges Water Dispute'। দুটি গ্রন্থই বাংলাদেশের নামকরা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান The University Press Limited প্রকাশ করেছে। দুটি গ্রন্থই এখন আউট অব প্রিন্ট। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ পানি বণ্টন সমস্যা এবং এর কূটনৈতিক ইতিহাসের গবেষকদের জন্য গ্রন্থ দুটির মূল্য অপরিসীম।
গঙ্গার পানি বণ্টনের ইতিহাসে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ফিডার ক্যানেল চালু বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৫-এর এপ্রিলে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। এ বৈঠকের আগেই ভারত সরকার বাংলাদেশকে জানায়, আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা ব্যারাজের ফিডার ক্যানেল চালু করা প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে ১৫ এপ্রিল ১৯৭৫ বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী একটি বৈঠক করেন। মিটিং শেষে মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির জন্য বিএম আব্বাসকে একটি নোট তৈরি করতে বলেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সন্ধ্যায় গণভবনে একটি বৈঠক হয়। এ বৈঠকে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং এআর মল্লিকসহ বিএম আব্বাসও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট সচিবরা। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বিএম আব্বাসের তৈরি করা নোটটির ওপর চোখ বুলিয়ে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আপনারা টেকনিক্যাল লোকেরা সব সময় অসুবিধার সৃষ্টি করেন। তিনি আরও জানান, তিনি ইতিমধ্যে ফারাক্কা ক্যানেল চালু করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন এবং এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে একটি যৌথ জরিপের ব্যাপারেও রাজি হয়েছেন। তিনি একে একে উপস্থিত সবার মতামত জানতে চাইলেন। কিন্তু কেউ নিজস্ব মত ব্যক্ত করতে সাহস করল না। সবশেষে সেরনিয়াবাতের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বিএম আব্বাসের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বিএম আব্বাসকে তার মতামত ব্যক্ত করার আহ্বান জানান। জবাবে বিএম আব্বাস জানান, তিনি যদি সম্মতি দিয়ে থাকেন তাহলে এ ব্যাপারে আর কিছু বলার নেই। তা সত্ত্বেও বিএম আব্বাস তার অভিমতে জানান, ভারত কেন সব ব্যাপারে পার পেয়ে যাবে? এবং আমাদের মতামতকে কেন গ্রাহ্য করা হবে না? যদি পরীক্ষামূলকভাবে হুগলির জন্য ক্যানেল চালু করতে হয় তাহলে যেন ১০ হাজার কিউসেকের বেশি দিয়ে শুরু না করা হয়। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সম্মত হয়ে বললেন, এভাবেই শুরু করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফিডার ক্যানেল চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। যখন ফিডার ক্যানেল চালু করা হয়, তখন ভারত ও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা প্রায়শই পানি প্রবাহের পরিমাণ নিয়ে একমত হতে পারছিল না। বিএম আব্বাস ৪১ দিনের পরীক্ষামূলক সময়ের পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জানতে চান- এর পর কী হবে? জবাবে তিনি বলন, 'এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই।' কিন্তু ভারত ১৯৭৫-এর ৩১ মের পরেও ফিডার ক্যানেল বন্ধ করেনি (সূত্র : বিএম আব্বাস এটি, The GangesWater Dispute, 1982) ।
১৯৭৬-এর এপ্রিল নাগাদ গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা তীব্র বিরোধের আকার ধারণ করে। মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল এক খোলা চিঠিতে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে তিনি ওই খোলা চিঠি পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন। মওলানা সাহেব খোলা চিঠিতে জানান, 'দুর্ভাগ্যবশত এই অনুরোধ মিসেস গান্ধী ও তার সরকারের কাছে গৃহীত না হলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মরক্কো কর্তৃক অনুসৃত সাহারা নীতির ন্যায় আমি আগামী ১৬ মে রোজ রবিবার রাজশাহী হইতে লাখ লাখ বুভুক্ষু বাঙালিসহ অহিংস ও শান্তিপূর্ণ মিছিল লইয়া ফারাক্কার দিকে অগ্রসর হইব।' মওলানা ভাসানীর খোলা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মওলানা ভাসানীকে নিন্মোক্ত চিঠি লেখেন-
প্রিয় মওলানা সাহেব,
আপনার গত ১৯৭৬ সালের ১৮ই এপ্রিলে লেখা চিঠি পড়ে আমি ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি।
এ কথা কল্পনা করাও কষ্ট যে, এক ব্যক্তি যিনি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে সংগ্রাম করেছেন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নিজের জাতীয় স্বাধীনতার জন্য দুঃখ-কষ্টে শরিক হয়েছেন, তিনিই আমাদের এমন গুরুতরভাবে ভুল বুঝবেন এবং এমনকি আমাদের লক্ষ্যের আন্তরিকতায় প্রশ্ন তুলবেন।
বরং আমি এটাই বিশ্বাস করব যে, আপনি প্রকাশ্য বিবৃতিতে ভারতের বিরুদ্ধে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রাসী উদ্দেশ্যের যে অভিযোগ করেছেন এবং ফারাক্কা 'ধ্বংস' করতে পদযাত্রা করার যে হুমকি দিয়েছেন তা মুহূর্তের উত্তেজনাতেই।
যে ভারত দৃষ্টান্তহীন দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সে তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে বৈরী মনোভাব পোষণ করতে পারে বলে কোনো বাংলাদেশী কি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন? ভারতের সরকার ও জনগণ এটা কামনা করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠনে তাদের সমর্থন ও সহযোগিতার রেকর্ডের আলোকেই তাদের দেখা হবে।
আমাদের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি এবং আমাদের জনগণের উপর বোঝাও অনেক। কিন্তু আমাদের উভয় দেশের জনগণের কল্যাণ পরস্পরের সম্পর্কযুক্ত। উভয়ের অভিন্ন স্বার্থেই এতদঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব থাকা প্রয়োজন।
আপনি তো জানেন যে, ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ব ভারতের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় বলে বিবেচিত হয়ে আসছে, কাজেই এটা ত্যাগ করা যায় না। আপনি এটাও জানেন যে, গ্রীষ্মকালে আনুমানিক দুই মাসের মতো সময়ে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যায়। আমাদের উভয়ের প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারে ভবিষ্যতে কোনো ঘাটতি দেখা দিলে পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতা থাকলে অবশ্যই একটা উপায় বের করা যাবে। হুগলি নদীর নাব্য রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিমাণ পানিও আমাদের জন্য না রেখে আমরা বাংলাদেশে পানির প্রবাহ ঠিক রেখেছি।
আমার মনে হয়, আপনাকে ঘটনার একটি দিক এবং বাংলাদেশে ফারাক্কা বাঁধের ফিডার ক্যানেলের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অতিরঞ্জিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। আপনি চাইলে আমাদের হাইকমিশনার আপনাকে ঘটনার অপরদিক সম্পর্কে অবহিত করবেন।
প্রতিবেশীদের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সমস্যার সমাধান কামনা করাটাই বড় কথা। মোকাবেলা ও বৈরিতার পথ অনুসরণ করলে আমাদের উভয়েরই ক্ষতি।
আমি আবার আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে চাই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা সুসংহত করুক এবং শান্তির মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধিশালী হোক। বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী ও অগ্রগতির সাথী হিসেবে আমরা আমাদের অবদান রেখে যাব।
আপনি হয়তো অবগত আছেন যে, খরা মৌসুমে গঙ্গার পানি বরাদ্দ এবং এ সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে আমাদের দুই দেশের সরকার আবার আলোচনা শুরু করেছে। এ ব্যাপারে উভয় পক্ষের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উৎসাহ ও সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে।
আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, আমরা সঙ্গত যুক্তি ও ন্যায্য বক্তব্য মেনে নিতে রাজি আছি। কিন্তু কেউ যেন এটা আশা না করেন যে, ভারত হুমকি এবং অযৌক্তিক অথবা অন্যায় দাবির কাছে নতিস্বীকার করবে।
শ্রদ্ধান্তে
ভবদীয়
ইন্দিরা গান্ধী
ইন্দিরা গান্ধীর এ চিঠির জবাবে মওলানা ভাসানী লেখেন-
ভারতের প্রধানমন্ত্রী
প্রিয় মিসেস গান্ধী,
আপনার ৪ঠা মে, ১৯৭৫ এর পত্র ফারাক্কা প্রশ্নে সরকারি বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর নাতনি ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কন্যার নিকট থেকে এটা আমি আশা করিনি। আপনার প্রথিতযশা পূর্ব পুরুষগণ এবং আপনি নিজে সর্বদা বঞ্চিত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রাম করেছেন।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতাদানের জন্য আমি আপনার ও ভারতের মহান জনগণের নিকট অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
ফারাক্কা প্রশ্নে আমি পুনর্বার আপনাকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাসমূহ সফর এবং আমাদের শিল্প ও কৃষি উৎপাদনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুধাবনের অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনার অফিসারদের রিপোর্টের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করার জন্যও আমি আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ ওইসব রিপোর্টে সব সময় বিদ্যমান পরিস্থিতির সত্যিকার চিত্র প্রতিফলিত হয় না।
পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে আপনার মনোভাব আমি উপলব্ধি করেছি। তবে সমাধান হতে হবে স্থায়ী ও ব্যাপক। এটা শুষ্ক মৌসুমের দু'মাসে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, সারা বছরের প্রবাহ এর আওতায় আনতে হবে এবং ন্যায্য অংশ ভাগ করতে হবে।
এ লাইনে ফারাক্কা সমস্যার সমাধান উদ্ভাবনের জন্য এর আগে আমি আপনাকে কয়েকটি টেলিগ্রাম করেছি। এ সমস্যা, যা বাংলাদেশের সাড়ে ৩ কোটি মানুষের জীবনমরণ প্রশ্ন, তার সমাধান আমলাদের দ্বারা হতে পারে না। এ জন্য দু'দেশের নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই আলোচনায় বসতে হবে এবং উভয়ের গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছতে হবে।
কোনোরূপ মোকাবেলা ও বৈরী মনোভাব পোষণ না করে আমি আপনার নিকট এ ব্যাপারে আপনার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ এবং বাংলাদেশের ৮ কোটি মানুষের গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করার আবেদন জানাচ্ছি।
আমার অনুরোধ আপনার গ্রহণযোগ্য না হলে নির্যাতিত জনগণের নেতা আপনার পূর্বপুরুষ ও মহাত্মা গান্ধীর নিকট সংগ্রামের পথের যে শিক্ষা আমি পেয়েছি, তা অনুসরণ করে সমস্যা সমাধানের জন্য আমি ভবিষ্যৎ কর্মসূচি প্রণয়নে বাধ্য হব।
আমাদের দুই বন্ধু দেশের মৈত্রী বন্ধন শক্তিশালী করতে সংকটময় সমস্যা সমাধানে আপনাকে আমার সর্বাধিক সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
শুভেচ্ছাসহ
ভবদীয়
মোঃ আবদুল হামিদ খাঁ ভাসানী
মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও মওলানা ভাসানীর মধ্যে পারস্পরিক পত্রবিনিময় কূটনীতির ইতিহাসে অভিনব মাত্রা যোগ করেছে এবং বাংলাদেশের দাবিকে করেছে জোরালো। বাংলাদেশের জনগণও একাট্টা হয়েছে। মওলানা ভাসানীর এ সংগ্রামী প্রয়াস তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকারকেও শক্তি ও সাহস নিয়ে বিষয়টি মোকাবেলায় প্রণোদিত করেছে। আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, মওলানা ভাসানীর মতো ক্ষমতাপ্রত্যাশী নয় এমন কোনো জননন্দিত নেতা নেই যিনি সংকট মুহূর্তে জাতিকে দিশা দেবেন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
(যুগান্তর)
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করে গঙ্গার পানি ভাগীরথীর দিকে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল। ভারতের উদ্দেশ্য ছিল ভাগীরথী নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করে কলকাতা বন্দরকে পলিমাটির দ্বারা ভরাট হওয়া থেকে রক্ষা করা। ভারতের সেই চেষ্টা আজ পর্যন্ত কতটুকু সফল হয়েছে সেটা ভারতের বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন। তবে যতদূর জানা যায়, ভারতের সেই অভীষ্ট লক্ষ্য সফল হয়নি। কলকাতা বন্দরের নাব্য সমস্যা থেকেই গেছে। এই প্রেক্ষাপটে ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে ফিডার ক্যানেল চালুর ইতিহাসটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। বাংলাদেশের প্রথিতযশা পানি বিশেষজ্ঞ বিএম আব্বাস এটি ফারাক্কা ব্যারাজের ওপর দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। পরলোকগত এই পানি বিশেষজ্ঞের গ্রন্থ দুটির নাম হল 'ফারাক্কা ব্যারাজ ও বাংলাদেশ' এবং 'The Ganges Water Dispute'। দুটি গ্রন্থই বাংলাদেশের নামকরা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান The University Press Limited প্রকাশ করেছে। দুটি গ্রন্থই এখন আউট অব প্রিন্ট। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ পানি বণ্টন সমস্যা এবং এর কূটনৈতিক ইতিহাসের গবেষকদের জন্য গ্রন্থ দুটির মূল্য অপরিসীম।
গঙ্গার পানি বণ্টনের ইতিহাসে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ফিডার ক্যানেল চালু বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৫-এর এপ্রিলে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। এ বৈঠকের আগেই ভারত সরকার বাংলাদেশকে জানায়, আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা ব্যারাজের ফিডার ক্যানেল চালু করা প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে ১৫ এপ্রিল ১৯৭৫ বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী একটি বৈঠক করেন। মিটিং শেষে মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির জন্য বিএম আব্বাসকে একটি নোট তৈরি করতে বলেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সন্ধ্যায় গণভবনে একটি বৈঠক হয়। এ বৈঠকে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং এআর মল্লিকসহ বিএম আব্বাসও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট সচিবরা। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বিএম আব্বাসের তৈরি করা নোটটির ওপর চোখ বুলিয়ে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আপনারা টেকনিক্যাল লোকেরা সব সময় অসুবিধার সৃষ্টি করেন। তিনি আরও জানান, তিনি ইতিমধ্যে ফারাক্কা ক্যানেল চালু করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন এবং এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে একটি যৌথ জরিপের ব্যাপারেও রাজি হয়েছেন। তিনি একে একে উপস্থিত সবার মতামত জানতে চাইলেন। কিন্তু কেউ নিজস্ব মত ব্যক্ত করতে সাহস করল না। সবশেষে সেরনিয়াবাতের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বিএম আব্বাসের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বিএম আব্বাসকে তার মতামত ব্যক্ত করার আহ্বান জানান। জবাবে বিএম আব্বাস জানান, তিনি যদি সম্মতি দিয়ে থাকেন তাহলে এ ব্যাপারে আর কিছু বলার নেই। তা সত্ত্বেও বিএম আব্বাস তার অভিমতে জানান, ভারত কেন সব ব্যাপারে পার পেয়ে যাবে? এবং আমাদের মতামতকে কেন গ্রাহ্য করা হবে না? যদি পরীক্ষামূলকভাবে হুগলির জন্য ক্যানেল চালু করতে হয় তাহলে যেন ১০ হাজার কিউসেকের বেশি দিয়ে শুরু না করা হয়। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সম্মত হয়ে বললেন, এভাবেই শুরু করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফিডার ক্যানেল চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। যখন ফিডার ক্যানেল চালু করা হয়, তখন ভারত ও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা প্রায়শই পানি প্রবাহের পরিমাণ নিয়ে একমত হতে পারছিল না। বিএম আব্বাস ৪১ দিনের পরীক্ষামূলক সময়ের পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জানতে চান- এর পর কী হবে? জবাবে তিনি বলন, 'এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই।' কিন্তু ভারত ১৯৭৫-এর ৩১ মের পরেও ফিডার ক্যানেল বন্ধ করেনি (সূত্র : বিএম আব্বাস এটি, The Ganges
১৯৭৬-এর এপ্রিল নাগাদ গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা তীব্র বিরোধের আকার ধারণ করে। মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল এক খোলা চিঠিতে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে তিনি ওই খোলা চিঠি পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন। মওলানা সাহেব খোলা চিঠিতে জানান, 'দুর্ভাগ্যবশত এই অনুরোধ মিসেস গান্ধী ও তার সরকারের কাছে গৃহীত না হলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মরক্কো কর্তৃক অনুসৃত সাহারা নীতির ন্যায় আমি আগামী ১৬ মে রোজ রবিবার রাজশাহী হইতে লাখ লাখ বুভুক্ষু বাঙালিসহ অহিংস ও শান্তিপূর্ণ মিছিল লইয়া ফারাক্কার দিকে অগ্রসর হইব।' মওলানা ভাসানীর খোলা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মওলানা ভাসানীকে নিন্মোক্ত চিঠি লেখেন-
প্রিয় মওলানা সাহেব,
আপনার গত ১৯৭৬ সালের ১৮ই এপ্রিলে লেখা চিঠি পড়ে আমি ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি।
এ কথা কল্পনা করাও কষ্ট যে, এক ব্যক্তি যিনি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে সংগ্রাম করেছেন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নিজের জাতীয় স্বাধীনতার জন্য দুঃখ-কষ্টে শরিক হয়েছেন, তিনিই আমাদের এমন গুরুতরভাবে ভুল বুঝবেন এবং এমনকি আমাদের লক্ষ্যের আন্তরিকতায় প্রশ্ন তুলবেন।
বরং আমি এটাই বিশ্বাস করব যে, আপনি প্রকাশ্য বিবৃতিতে ভারতের বিরুদ্ধে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রাসী উদ্দেশ্যের যে অভিযোগ করেছেন এবং ফারাক্কা 'ধ্বংস' করতে পদযাত্রা করার যে হুমকি দিয়েছেন তা মুহূর্তের উত্তেজনাতেই।
যে ভারত দৃষ্টান্তহীন দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সে তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে বৈরী মনোভাব পোষণ করতে পারে বলে কোনো বাংলাদেশী কি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন? ভারতের সরকার ও জনগণ এটা কামনা করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠনে তাদের সমর্থন ও সহযোগিতার রেকর্ডের আলোকেই তাদের দেখা হবে।
আমাদের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি এবং আমাদের জনগণের উপর বোঝাও অনেক। কিন্তু আমাদের উভয় দেশের জনগণের কল্যাণ পরস্পরের সম্পর্কযুক্ত। উভয়ের অভিন্ন স্বার্থেই এতদঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব থাকা প্রয়োজন।
আপনি তো জানেন যে, ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ব ভারতের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় বলে বিবেচিত হয়ে আসছে, কাজেই এটা ত্যাগ করা যায় না। আপনি এটাও জানেন যে, গ্রীষ্মকালে আনুমানিক দুই মাসের মতো সময়ে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যায়। আমাদের উভয়ের প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারে ভবিষ্যতে কোনো ঘাটতি দেখা দিলে পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতা থাকলে অবশ্যই একটা উপায় বের করা যাবে। হুগলি নদীর নাব্য রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিমাণ পানিও আমাদের জন্য না রেখে আমরা বাংলাদেশে পানির প্রবাহ ঠিক রেখেছি।
আমার মনে হয়, আপনাকে ঘটনার একটি দিক এবং বাংলাদেশে ফারাক্কা বাঁধের ফিডার ক্যানেলের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অতিরঞ্জিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। আপনি চাইলে আমাদের হাইকমিশনার আপনাকে ঘটনার অপরদিক সম্পর্কে অবহিত করবেন।
প্রতিবেশীদের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সমস্যার সমাধান কামনা করাটাই বড় কথা। মোকাবেলা ও বৈরিতার পথ অনুসরণ করলে আমাদের উভয়েরই ক্ষতি।
আমি আবার আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে চাই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা সুসংহত করুক এবং শান্তির মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধিশালী হোক। বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী ও অগ্রগতির সাথী হিসেবে আমরা আমাদের অবদান রেখে যাব।
আপনি হয়তো অবগত আছেন যে, খরা মৌসুমে গঙ্গার পানি বরাদ্দ এবং এ সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে আমাদের দুই দেশের সরকার আবার আলোচনা শুরু করেছে। এ ব্যাপারে উভয় পক্ষের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উৎসাহ ও সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে।
আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, আমরা সঙ্গত যুক্তি ও ন্যায্য বক্তব্য মেনে নিতে রাজি আছি। কিন্তু কেউ যেন এটা আশা না করেন যে, ভারত হুমকি এবং অযৌক্তিক অথবা অন্যায় দাবির কাছে নতিস্বীকার করবে।
শ্রদ্ধান্তে
ভবদীয়
ইন্দিরা গান্ধী
ইন্দিরা গান্ধীর এ চিঠির জবাবে মওলানা ভাসানী লেখেন-
ভারতের প্রধানমন্ত্রী
প্রিয় মিসেস গান্ধী,
আপনার ৪ঠা মে, ১৯৭৫ এর পত্র ফারাক্কা প্রশ্নে সরকারি বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর নাতনি ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কন্যার নিকট থেকে এটা আমি আশা করিনি। আপনার প্রথিতযশা পূর্ব পুরুষগণ এবং আপনি নিজে সর্বদা বঞ্চিত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রাম করেছেন।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতাদানের জন্য আমি আপনার ও ভারতের মহান জনগণের নিকট অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
ফারাক্কা প্রশ্নে আমি পুনর্বার আপনাকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাসমূহ সফর এবং আমাদের শিল্প ও কৃষি উৎপাদনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুধাবনের অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনার অফিসারদের রিপোর্টের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করার জন্যও আমি আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ ওইসব রিপোর্টে সব সময় বিদ্যমান পরিস্থিতির সত্যিকার চিত্র প্রতিফলিত হয় না।
পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে আপনার মনোভাব আমি উপলব্ধি করেছি। তবে সমাধান হতে হবে স্থায়ী ও ব্যাপক। এটা শুষ্ক মৌসুমের দু'মাসে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, সারা বছরের প্রবাহ এর আওতায় আনতে হবে এবং ন্যায্য অংশ ভাগ করতে হবে।
এ লাইনে ফারাক্কা সমস্যার সমাধান উদ্ভাবনের জন্য এর আগে আমি আপনাকে কয়েকটি টেলিগ্রাম করেছি। এ সমস্যা, যা বাংলাদেশের সাড়ে ৩ কোটি মানুষের জীবনমরণ প্রশ্ন, তার সমাধান আমলাদের দ্বারা হতে পারে না। এ জন্য দু'দেশের নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই আলোচনায় বসতে হবে এবং উভয়ের গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছতে হবে।
কোনোরূপ মোকাবেলা ও বৈরী মনোভাব পোষণ না করে আমি আপনার নিকট এ ব্যাপারে আপনার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ এবং বাংলাদেশের ৮ কোটি মানুষের গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করার আবেদন জানাচ্ছি।
আমার অনুরোধ আপনার গ্রহণযোগ্য না হলে নির্যাতিত জনগণের নেতা আপনার পূর্বপুরুষ ও মহাত্মা গান্ধীর নিকট সংগ্রামের পথের যে শিক্ষা আমি পেয়েছি, তা অনুসরণ করে সমস্যা সমাধানের জন্য আমি ভবিষ্যৎ কর্মসূচি প্রণয়নে বাধ্য হব।
আমাদের দুই বন্ধু দেশের মৈত্রী বন্ধন শক্তিশালী করতে সংকটময় সমস্যা সমাধানে আপনাকে আমার সর্বাধিক সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
শুভেচ্ছাসহ
ভবদীয়
মোঃ আবদুল হামিদ খাঁ ভাসানী
মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও মওলানা ভাসানীর মধ্যে পারস্পরিক পত্রবিনিময় কূটনীতির ইতিহাসে অভিনব মাত্রা যোগ করেছে এবং বাংলাদেশের দাবিকে করেছে জোরালো। বাংলাদেশের জনগণও একাট্টা হয়েছে। মওলানা ভাসানীর এ সংগ্রামী প্রয়াস তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকারকেও শক্তি ও সাহস নিয়ে বিষয়টি মোকাবেলায় প্রণোদিত করেছে। আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, মওলানা ভাসানীর মতো ক্ষমতাপ্রত্যাশী নয় এমন কোনো জননন্দিত নেতা নেই যিনি সংকট মুহূর্তে জাতিকে দিশা দেবেন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
(যুগান্তর)
__._,_.___