আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ ভারতীয় রাহু থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য
১১ নভেম্বর 'দৈনিক আমাদের সময়' (অনলাইন সংস্করণ) জানিয়েছে, শেরপুরে এক সভায় মতিয়া চৌধুরী বলেছেন : আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যাবে। কোন সূত্র কিংবা আলামত থেকে মতিয়া চৌধুরী এমন তথ্য পেলেন তিনি তা বলেননি। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এ পর্যন্ত কেউই বলেননি যে, তারা বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে চান। বাংলাদেশের কোনো সেনাপ্রধান, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকের পক্ষ থেকেও এমন ধরনের কোন মন্তব্য কিংবা দুঃস্বপ্নের কথা কেউ শোনেননি।
তা সত্ত্বেও বর্তমানে ভারতের কোলে-বসা মরহুম সোভিয়েত ইউনিয়নের এককালীন বেতনভুক অ্যাকটিভিস্ট মতিয়া চৌধুরী বাংলাদেশের অস্তিত্ববিরোধী ভারতের স্বার্থবাহী একদলীয় শাসনে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের ক্ষমতায় রাখার জন্য নতুন ফতোয়া দিয়েছেন। তার মতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে বাংলাদেশ আবার পাকিস্তান হবে।
মিথ্যাচারিতা ও ভণ্ডামি কাকে বলে? এ ধরনের কথা ভারতের কট্টর স্বার্থবাহীদের মুখেই কেবল শোনা যায়। কোনো সুস্থ দেশপ্রেমিক এমনটি ভাবেন না। যারা দেশটাকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখতে চায়, এটা তাদেরই প্রচারণা। মতিয়া চৌধুরীসহ তাবত্ ভারতীয় চর ভালো করে জানেন বাংলাদেশ আর কখনোই পাকিস্তানে ফিরে যাবে না। ১৯৭১ সালে ভারত গমন ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে মতিয়ার কোনো ব্যক্তিগত অবদান ছিল না। এখন এরা বাংলাদেশকে ভারতের গোলাম বানানোর সব সড়ক তৈরি করে নিজেদের স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি হিসেবে জাহির করেন। কিন্তু ভারতপ্রীতি ও স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমান্তরালভাবে চলতে পারে না। দুটোই পরস্পরবিরোধী।
ভারত গত ৪৩ বছরে (১৯৭১ সাল থেকেই) তো বটেই, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার স্বার্থবাহীদের ক্ষমতায় আনার জন্য বাংলাদেশের ওপর যে দুর্যোগ বইয়ে দিচ্ছে, তাতে প্রমাণ হয়, ভারত বাংলাদেশের অস্তিত্বই মানতে রাজি নয়। গত ৪৩ বছরে, বিশেষত ২০০৯ থেকে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর, বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার জন্য বাংলাদেশের পৃথক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক বিষয়গুলো অবৈধভাবে ভারতের হাতে চলে গেছে । অবৈধভাবে পাওয়া সে সুবিধাগুলো ও হাসিনা-মতিয়াদের মতো ভারতীয় স্বার্থবাহীদের রক্ষা এবং বাংলাদেশের প্রকৃত দেশপ্রেমিক শক্তিকে পুরোপুরি নির্মূল করার জন্য শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ধরে রাখতে হবে—এটা ভারতীয়দের বক্তব্য। প্রভুর সে বক্তব্যের সুর ধরে মূলত গণবিচ্ছিন্ন মতিয়া বলছেন, দশম জাতীয় সংসদ নাকি তাদের জন্য দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের জন্য, ভারতীয় রাহুর গ্রাস থেকে মুক্তির জন্য গণতান্ত্রিক লড়াই। এই লড়াইয়ে ভারতীয় চরদের ভরাডুবি হবে বলেই এ নির্বাচনকে একদলীয়ভাবে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ কারণেই ভারতের স্বার্থবাহী শেখ হাসিনা এবং তার নয়াদিল্লির মুরুব্বিরা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নির্বাচনের বাইরে রাখছে।
মতিয়ার বক্তব্যকে আমি উল্টোভাবে দেখি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আবেদন ছিল বাংলাদেশকে ভারতের খপ্পর থেকে বের করে আনার শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক লড়াই। ভারত ও শেখ হাসিনা সে নির্বাচনকে তাই অবাধ নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হতে দিচ্ছে না। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের তথ্যমতে ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা শেখ হাসিনার সময়ে আমরা অনেকটাই হারিয়েছি। তা পুনরুদ্ধার করার জন্য আগামী নির্বাচন এ দেশের স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষ দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে মনে করেন। এ নির্বাচনে ভারতের চর ও স্বার্থবাহীরা আবার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের বাদবাকি অস্তিত্বও থাকবে না। তাই এ নির্বাচন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের চেয়েও মারাত্মক লড়াই বিশেষ। ভারত জানে তাদের বর্তমান চররা ক্ষমতা হারালে ভারত আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অকেজো এবং নিঃশেষ করতে যতদূর এগিয়ে গেছে, ভারতকে তা হারাতে হবে। তাই সারা বিশ্বের জনমতের বাইরে অবস্থান করে ভারত তার চরদের ক্ষমতায় রাখার জন্যই বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে।
ভারতের উদ্দেশ্য একেবারেই পরিষ্কার। ভারত ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। বাংলাদেশ কখনোই পাকিস্তানের অংশ হবে না, কিন্তু ইতিহাস এবং ভারতীয়দের স্বপ্ন, চক্রান্ত ও আগ্রাসী মন্তব্য প্রমাণ করে তারা বাংলাদেশকে গিলে ফেলতে চায়।
একেবারে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করা যাক। গান্ধী-নেহেরুরা উপমহাদেশ বিভক্তি সাময়িকভাবে মেনে নিলেও তারা যে অখণ্ড ভারতের জন্য মরিয়া তা প্রকাশ্যেই বলেছেন। ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ তত্কালীন ত্রিপুরার (বর্তমানে কুমিল্লা) কংগ্রেস সভাপতি আশরাফউদ্দিন চৌধুরীকে লেখা এক চিঠিতে নেহেরু বাংলাদেশকে ভারতে ফিরিয়ে নেয়ার কৌশল হিসেবে ভারত-পাকিস্তানের বাইরে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। নেহেরু উপমহাদেশ বিভক্তির শর্ত হিসেবে বাংলা ও পাঞ্জাবের বিভক্তি জুড়ে দিয়েছেন, যাতে তার মতে, পাকিস্তানে যোগ দেয়া এই দুই প্রদেশের খণ্ডিত অংশগুলো আবার ভারতে ফিরে আসে অবিভক্ত ভারত পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য।
ল্যাবি কলিন ও ডমিনিক ল্যাম্পিয়ার তাদের যৌথভাবে রচিত 'মাউন্ট ব্যাটন অ্যান্ড দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া' শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, নেহেরু অবিভক্ত বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দু মহাসভার আপত্তির প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন। ওই গ্রন্থে নেহেরুর ভূমিকাকে তারা এভাবে উপস্থাপন করেছেন : 'পণ্ডিত নেহেরু বলেছেন, বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হোক তাতে তিনি একমত হবেন না। ... তার মতে, পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের জন্য চরম বিব্রতকর হবে। বিনা প্রমাণেই তিনি মনে করতেন, পূর্ব বঙ্গ আজ হোক কাল হোক ভারতে পুনঃসংযুক্ত হতে বাধ্য।'
উপমহাদেশ বিভক্তির অব্যবহিত পরে ১৯৪৭ সালেই কংগ্রেসের তত্কালীন সভাপতি আচার্য কৃপালিনী সরাসরি বলেছেন : 'না কংগ্রেস না জাতি (হিন্দু) ঐক্যবদ্ধ ভারতের দাবি পরিত্যাগ করেছে।'
ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লব ভাই প্যাটেলের স্বপ্ন ছিল এ রকম : 'আজ হোক কাল হোক আমরা আমাদের জাতির (হিন্দু) প্রতি সাধারণ আনুগত্যতার মাধ্যমে আবার ঐক্যবদ্ধ হব।'
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয়দের কথাগুলো শুনুন। এতে বোঝা যাবে বাংলাদেশকে তারা আদৌ মনেপ্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে কিনা। ১৯৯২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ক এক সেমিনারে কংগ্রেস নেতা এবং কলকাতার দৈনিক আজকাল পত্রিকার তত্কালীন সম্পাদক মায়ারাম সার্জন বলেন : 'যদি ইউরোপ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, তবে আমরা কেন ১৯৪৭-পূর্ব ভারতে ফিরে যেতে পারি না।'
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক এম ভি ক্যামাথ ২০০৩ সালে এক প্রবন্ধে স্পষ্টভাবে বলেছেন : 'একেবারে সহজ-সরল ভাষায় সোজা-সাপটা কথা : বাংলাদেশের টিকে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের মতোই ১৯৪৭ সালে এর (পূর্ব পাকিস্তান) সৃষ্টিও ঐতিহাসিকভাবে ভ্রমান্তক ভুল ছিল। কার্জনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে, কারণ চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলার (জনগণের) মধ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকার বোধোদয় হয়েছিল। বাংলাদেশ যদি টিকে থাকতে চায় তবে তাকে অবশ্যই ভারতে ফিরে আসতে হবে এবং ভারত এর বিনিময়ে তা করতে (ভারতে ফিরিয়ে নিতে দালালদের) অবশ্যই সহযোগিতা করবে।'
শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কলকাতায় বইমেলা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী মোট তিনবার শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ঘোষক এমন চরম ভুলের জন্য ভুল স্বীকার করেননি কিংবা মাফ চাননি। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যের কোনো পর্যায়ে কিংবা পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা সরকার সরকারিভাবে কোনো প্রতিবাদ অথবা এমন ঘোষণা প্রত্যাহার করার দাবিও তোলেননি। অর্থাত্ বাংলাদেশ যে মূলত ভারতেরই একটা রাজ্য এবং শেখ হাসিনা সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তা-ই যেন মেনে নেয়া হয়েছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সাংবাদিকরা এমন ঘোষণার ব্যাপারে তার মন্তব্য জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বিষয়টিকে হালকা করার জন্য হাসি-ঠাট্টা করেই উড়িয়ে দেন। অথচ বিশ্লেষকরা এমন ঘোষণাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বাংলাদেশের জন্য আগাম অশনিসঙ্কেত বলে মনে করেছিলেন।
ভারতীয় বিএসএফ সদস্যরা ২০০১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবৈধভাবে প্রবেশের কারণে বিডিআরের হাতে চরম পিটুনি খাওয়ার পর ভারতীয় জনতা পার্টি তথা আরএসএস নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র ও উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি বোমা মেরে বিডিআর সদর দফতর উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন।
শেখ হাসিনা ভারতীয় সহায়তায় এবং মইন উ আহমেদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ও লোকসভার সদস্য শংকর রায় চৌধুরী ২০০৯ সালে ২৪ মার্চ (এর এক মাস আগেই পিলখানায় ভারতীয় চররা ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে বিডিআর সদর দফতরে হত্যা করে) দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা ও লন্ডন থেকে একযোগে প্রকাশিত ভারতীয় দৈনিক 'এশিয়ান এজ'-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন : 'বাংলাদেশ বারবার দিল্লির রাডারের বাইরে চলে যায়। এবার আর কোনো অবস্থাতেই এটা হতে দেয়া হবে না।'
বিজেপির অন্যতম নেতা ও তাত্ত্বিক এবং ভারতের সাবেক বাণিজ্য ও আইনমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম সোয়ামী ২০১১ সালের ১৬ জুলাই 'ডিএনএ' (ডেইলি নিউজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস) পত্রিকায় ভারত সরকারকে এ মর্মে পরামর্শ দিয়েছেন : 'বাংলাদেশের সিলেট থেকে খুলনা পর্যন্ত এক-তৃতীয়াংশ অবৈধ (কথিত) উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য দখল করে নেয়া হোক।'
সর্বোপরি, অতি সম্প্রতি ভারতীয় বিজেপি বাংলাদেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার হুমকি দিয়েছে।
বাংলাদেশকে গ্রাস করার ভারতীয়দের এমন হাজার হাজার প্রকাশ্য মন্তব্য রয়েছে। বাংলাদেশের অস্তিত্ববিরোধী চক্রান্ত তৈরি এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রতিনিয়ত গবেষণা, প্রকাশ্য ও গোপন সভা-সেমিনার, প্রবন্ধ-গ্রন্থ রচিত হচ্ছে। অথচ এর বিপরীতে পাকিস্তানে কিংবা বাংলাদেশে পাকিস্তানের সমর্থনে কোনো কাজ হচ্ছে কি না তা আমার জানা নেই। ভারতের বাংলাদেশবিরোধী অপকর্মে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ ভারতকে বাংলাদেশের স্বার্থ ও স্বাধীনতাবিরোধী বলে মনে করে। বাংলাদেশীদের মধ্যে এমন ভীতি ও সন্দেহ সৃষ্টির জন্য ভারতই দায়ী। বাংলাদেশীদের ভারতবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি কোনোভাবেই পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া নয়, বরং ভারতের আগ্রাসী থাবা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখা। বাংলাদেশীদের ভারত-ভীতি যে অমূলক নয়, উপরের মন্তব্যগুলো তো তারই সাক্ষী। সর্বোপরি, বাংলাদেশের সঙ্গে সাধারণভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি না করে ভারত কেন ব্যক্তি শেখ হাসিনাকে তাদের লোক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে তার অন্তর্নিহিত কারণও সারা বিশ্বের মানুষ বোঝে। ভারতের শেখ হাসিনা-প্রীতির নমুনা দেখুন :
বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারত প্রকাশ্যে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। আর গোপন বরাদ্দ কত হাজার কোটি রুপি তার হিসাব নেই। ফকির ভারতের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী চীন কিংবা আমেরিকা এক পয়সা খরচ করারও ঘোষণা দেয়নি, পাকিস্তান তো দূরের কথা। পাকিস্তানের কোনো সাবেক সেনাপ্রধান বলেননি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের হাতের মুঠোয় নিতে হবে, যেমনটি বলেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান শঙ্কর রায় চৌধুরী : 'বাংলাদেশকে আর ভারতের খপ্পর থেকে বের হতে দেয়া হবে না।' অন্যদিকে ভারতের উপ-সেনাপ্রধান শ্রীনিবাস সিং সিনহা বলেছেন : 'সম্ভবত শেখ হাসিনাই মুসলিম বিশ্বে একমাত্র মুসলিম নেতা যিনি একটি মুসলিম দেশের ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এ জন্য ভারতসহ আন্তজার্তিক মহলের উচিত হাসিনাকে উত্সাহিত করা ও তাকে সহযোগিতা করা।' পাকিস্তানি কোনো সেনাপ্রধান বা উপ-সেনাপ্রধান এমন আগ্রাসী মন্তব্য করেননি। বুদ্ধিজীবী নিতেন পেই শেখ হাসিনাকে 'পুরস্কৃত করার' পরামর্শ দেন। পহেলা নভেম্বর (২০১৩) টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের আরও নির্লজ্জ পরামর্শ হয়েছে : 'ভারতকে অবশ্যই একটি বন্ধুভাবাপন্ন (হাসিনা) সরকারকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার জন্য সবকিছু করতে হবে।' মতিয়াদের কাকাবাবু কিংবা দাদা অথবা দুলাভাই প্রণব মুখার্জি বলেছেন : 'শেখ হাসিনাকে ঢাকা থেকে উদ্ধার করার জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রস্তুত আছে।' কিংবা 'বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে রেড অ্যালার্টে রাখা হয়েছে।' অথবা 'শেখ হাসিনাকে বিব্রত করা হলে ভারত চুপচাপ বসে থাকবে না।' এমনকি আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা নয়াদিল্লি গেলে ভারত তাকে জানিয়েছে, ভারত বাংলাদেশে 'শেখ হাসিনার শাসনের ধারাবাহিকতার পক্ষে'। সুজাতা আমেরিকায় গিয়ে আমেরিকার হাত-পা ধরেছে শেখ হাসিনার অবৈধ নির্বাচন মেনে নেয়ার জন্য।
শেখ হাসিনাকে ভারতের স্বার্থবাহী বলেই ভারতীয়রা বারবার তা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিচ্ছে একেবারে প্রকাশ্যে। আবার অর্থ বরাদ্দ করেছে শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য। ভারতের এমন নির্লজ্জ ভূমিকা ও বক্তব্যের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। বাংলাদেশকে হাতের মুঠোয় নেয়ার জন্য ভারত শেখ হাসিনাসহ অন্য চরদের পেছনে প্রচুর অর্থ ঢেলেছে।
শেখ হাসিনা ৩০টি গোপন চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে এমন সব ছাড় দিয়েছেন যা বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে। এছাড়া ভারতের আরও কিছু চাহিদা আছে, যেগুলো আদায় করতে হবে। এ কারণে শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে। আবার ক্ষমতায় এলে শেখ হাসিনাকে দিয়ে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক-ধর্মপ্রেমিক শক্তিকে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশকে ভারতে খোঁয়াড়ে রাখার কিংবা গিলে ফেলার জন্য অপরিহার্য।
এ কাজে মতিয়ারা শেখ হাসিনার পরামর্শক ও সহযোগী। মতিয়ারা আজীবন পরজীবীই ছিলেন। যারা একবার মদ খায় তারা নাকি মদ ছাড়তে পারে না। যারা একবার অন্যের দালালিতে নিয়োজিত হয়ে পরজীবী হয়, তারা পরজীবী পেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। মতিয়া এ রোগের রোগী। এর কোনো চিকিত্সা নেই। তাই মস্কোর রুবল বন্ধ হলে মতিয়াকে ভারতীয় রুপি আকর্ষণ করে। আর 'র'-এর পরামর্শেই শেখ হাসিনা 'শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে এদেশের মানুষ ডুগডুগি বাজাবে' এমন জঘন্য ঘোষণাকারিনী মুজিবের প্রকাশ্য ও চিহ্নিত শত্রু মতিয়াকে তার (শেখ হাসিনার) ডাইনের হুজুর করতে বাধ্য হয়েছেন। দুর্মূখরা বলে, মনি সিংরা শেখ মুজিবকে একদলীয় বাকশালী শাসন প্রতিষ্ঠিত করে একনায়ক হতে প্ররোচিত করেছিলেন। আর মতিয়ারা শেখ হাসিনাকে মুখে গণতন্ত্রের 'জপ্' করে কমিউনিস্ট শাসকদের মতোই স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু রেখে বিরোধী দলের অধিকার ও অস্তিত্ব বিলীন করতে একদলীয় একব্যক্তির নির্বাচন করতে চান। আর এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যাবে বলে মতিয়া অবাস্তব ও উদ্দেশ্যমূলক 'ফতোয়া' দিয়েছেন। আসলে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই ক্ষমতায় আসার কথা নয়। তার এ বক্তব্য ভারতের আগ্রাসী চক্রান্ত বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস বিশেষ।
এ ধরনের আগ্রাসী বক্তব্য প্রকাশে লেখা কিংবা বলার পর সর্বোপরি বাংলার পূর্বাংশ এক সময়ে ভারতের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করার পর এবং বাংলাদেশকে সবদিক থেকে পঙ্গু ও ঘিরে ফেলার পর মতিয়ারা কি করে ভারতকে বন্ধু মনে করেন, তারা কি করে ভাবেন বাংলাদেশ পাকিস্তানে পরিণত হবে। মতিয়া-হাসিনারা বাংলাদেশকে ভারতের পেটে ঢুকানোর ফরমায়েশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের সহযোগিতা ছিল উদ্দেশ্যমূলক, অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাওয়া। ভারত চায় একটা ল্যাংড়া-লুলা বাংলাদেশ, যে সব সময় সব ব্যাপারে ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। বাংলাদেশ ভারতের অনুগত হয়ে থাকবে। ভারতের চাওয়াগুলো পূরণ করবে। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে গিলে ফেলবে। গত ৪৩ বছরে (১৯৭১-২০১৩) আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা বলে দেয় : বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের সহযোগিতার পেছনে বাংলাদেশের জনগণের জন্য তার ভালোবাসা কাজ করেনি। কাজ করেছে আগ্রাসী অখণ্ড ভারতনীতি। জাতশত্রু মুসলমানদের দুর্বল করার, গোলাম করার নীতি। শত্রুকে দুর্বল করার নীতি। শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু—এই সূত্র বাস্তবায়ন করার নীতি। এখন প্রমাণিত হয় : চিরশত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে ভারত আমাদের সাহায্যের নামে প্রতারণা করেছে। আমাদের স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করতে আমাদের মধ্যেই মতিয়া-হাসিনা-জয়-নানক-শাহরিয়ার কবির- মুনতাসীর মামুন তৈরি করেছে। আমাদের স্বাধীনতার জন্য ভারতের সহযোগিতা ছিল চক্রান্তের প্রতিফলন।
বাংলাদেশের মানুষ এখন এটা বুঝতে পারছে। তাই বাংলাদেশের মানুষ তা প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশ কোনোদিন পাকিস্তানের অংশ হবে না; আর যাতে ভারতের দখলেও চলে যেতে না পারে সেটাই হলো আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ অবিরাম চলবে। হাসিনা-মতিয়ারা ক্ষমতায় থাকলেও চলবে; খালেদা জিয়া কিংবা অন্য কেউ এলেও অব্যাহত থাকবে। এ প্রতিরোধ চিরন্তন যতদিন না ভারত ভেঙে না যায়, ভারতের দখলে থাকা আমাদের তিন দিকের অঞ্চল স্বাধীন হয়ে খণ্ডিত ভারতের সীমান্ত আমাদের দেশ থেকে অনেক দূরে চলে না যায়। তাই এ লড়াইকে অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক : বাংলাদেশী-আমেরিকান সাংবাদিক ও গবেষক
noa@gmail.com