নীলকান্ত চৌধুরী
প্রিয় সুধী! আজ আমরা যারা এখানে সমবেত, আমাদের সবার একটা বিশেষ পরিচয় হলো আমরা প্রবাসী বাংলাদেশী। আমরা নানা জন নানা কারণে প্রবাসী। কেউবা স্বেচ্ছায় কিংবা কেউবা অনিচ্ছায় এ প্রবাসজীবন যাপন করছি। কেউ অর্থনৈতিক, কেউ সামাজিক আর কেউবা রাজনৈতিক কারণে। একজন প্রবাসী যেভাবে উপলব্ধি করতে পারে তার স্বজন হারানোর বেদনা, একজন স্বদেশবাসী সেভাবে সেটাকে বুঝতে পারবে না। কারণ স্বদেশে বসবাসকারীদের পক্ষে তাদের চোখের সামনে প্রিয়জনের মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে দেখার মাধ্যমে তারা যে সান্ত্বনা পায়, সেটা আমরা প্রবাসীরা কখনই পাব না। একজন বিশিষ্ট স্বদেশীর প্রবাসে না-ফেরা দেশে চলে যাওয়াই ব্যথিত জনের আজকের এই সমাবেশ। এসমাবেশে উপস্থিত থেকে ব্যথিতদের সাথে নিজের একাত্মতা আর নিজের স্বজনদের চিরবিদায়ে কাছে না-থাকতে পারার বেদনায় তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি নৈতিক দায়ের প্রতিফলন করার চেষ্টা করছি।
আয়োজকদের কৃতজ্ঞতা জানাই একারণে যে, প্রবাসী একাডেমিকদেরকে তাঁরা একত্রিত করতে পেরেছেন জাতীয় দুর্যোগে একটি মেলবন্ধ তৈরী করার জন্য আর আমাকে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের সুযোগ দেয়ার জন্য। আপনারা সবাই জানেন আমাদের প্রিয় স্বদেশ আজ অপশক্তি কবলিত আর রক্তের হোলি খেলায় রঞ্জিত দেশের অগণিত মানুষের জীবন। তাই কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় বলতে হয়, 'অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ'। সেই বিপন্ন স্বদেশের প্রয়োজনে আমাদের সংঘবদ্ধতা আজ অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতিটি মৃত্যুই আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যাপিতজীবনের জৌলুস নয়, ত্যাগ আর ভালোবাসায় আপ্লুত জীবনই আমাদের সবার কাম্য। মরহুম জিয়াউর রহমান আর বেগম জিয়ার ছোট ছেলে পরলোকগত আরাফাত রহমানের বিদায়ী প্রার্থনা - যাকে আমরা জানাজা বলে থাকি, তাই আরেকবার প্র্রমাণ করল যে, মানুষের ভালবাসাই আমাদের কাম্য হওয়া উচিত। তাঁর জানাজায় উপস্থিত জন-স্রোত জাতীয় জীবনে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে এক সরব প্রতিবাদ।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর 'বিস্রস্ত জর্নাল'এর শুরুতেই লিখেছেন, 'ভাল সময় বলতে কী বুঝি আমরা? ভালো সময় মানে সেই সময় যখন ভালো মানুষেরা সংঘবদ্ধ আর খারাপেরা বিভক্ত এবং পরাজিত। এর উল্টোটা হলেই তাকে আমরা বলি দুঃসময়। আমাদের দেশে সব জায়গায় আজ অশুভের সংঘবদ্ধতা। কোথাও একটা দুর্বৃত্ত হাঁক দিলে মুহূর্তে সব দুর্বৃত্ত সংঘবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে আজ ভালো মানুষেরা বিচ্ছিন্ন, যোগাযোগহীন- যে-যার আলাদা ঘরে শুয়ে একা একা কাঁদছে। পরস্পরকে খুঁজে পাচ্ছে না। তারা পরস্পরের কাছে অপরিচিত আগন্তুক এবং প্রত্যেকের চারপাশে একরাশ অন্ধকার। তাদের মাঝখানকার এই বিচ্ছিন্নতার দেয়াল ভেঙে দিতে হবে। তাদের সকলকে একত্রিত করতে হবে- 'একত্রিত, সমবেত, আয়োজিত'।' আর এই আয়োজিত করার দায়িত্ব আপনার আমার- আমাদের সবার। নচেত এ অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বিজয় আসবে না।
রাহুর করালগ্রাস থেকে এ ক্রান্তিকালে দেশকে বাঁচানোর জন্য দরকার সঠিক নেতৃত্বের আর প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রতিরোধের। আজ আমরা কেবল আমাদের নিজেকে বাঁচানোর কথা ভাবছি, কিন্তু ভাবছি না যে একা আমরা বাঁচতে পারি না। এঅনিবার্য সত্যকে অনেক আগেই সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কবি ভারতচন্দ্র রায়। তিনি বলেছেন, 'নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়!' তাই আমাদের চারিপাশে প্রতিহিংসার যে দাবানল জ্বলছে, তার থেকে অব্যহতি পেতে হলে আমাদের প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে। এককভাবে তা থেকে বাঁচা সত্যিই অসম্ভব। আপনি আমি- এই আমরা; সাধু সেজে যদি দূরে অবস্থান করি- তবে কে রক্ষা করবে আমাদের জন্মভূমিকে?- আমার প্রিয় স্বদেশ- বাংলাদেশ- যার অবারিত দানে আজ আপনি আমি এখানে একত্রিত আপনার আমার নিজ নিজ পরিচয়ে। তার জন্য কি আমাদের কিছুই করনীয় নেই?
আজ আপনারা যারা আমাকে এখানে দেখছেন, সেটা রাজনৈতিক কারণে নয়। কারণ, আমি একজন একাডেমিক এবং ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি পেশাদারদের প্রকাশ্যে রাজনীতি করা পেশাগত নৈতিকতা বিরোধী। আমি আজ এখানে এসেছি এ জন্যই যে, একজন প্রবাসী হিসেবে আরেকজন প্রবাসী যখন তাঁর ভাইয়ের জানাজায় অংশ নিতে পারে না রাজনৈতিক বিবেচনায়, সেটার প্রতিবাদে, এবং দুর্দশাকবলিত আমার প্রিয় স্বদেশের অস্থিরতার অবসান হয়ে একটি সুস্থির পরিবেশ তৈরী হোক এ কামনায়। এমন একটি স্বদেশের প্রত্যাশায় যেখানে দেশের আমজনতার জীবন আর জীবিকার নিশ্চয়তা থাকবে, আমরা পাব স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা। আমাদের অসহায়তা থেকে উদ্ধার পেতে- যে উদ্ধারহীন বিশাল এক সর্বগ্রাসী অসহায়তার কাছে বারে বারে ফিরে আসার আত্মধ্বংসী দুর্ভাগ্যই আজ আমাদের বিধিলিপি হয়ে পড়েছে।
আপনারা সবাই জানেন যে, আমাদের দেশই পৃথিবীর এক অনন্য উদাহরণ যেখানে 'স্বাধীনতার অর্থ কীভাবে হয়ে দাঁড়ায় অকর্ষিত দস্যুতার বিবেকহীন অবাধ উপনিবেশ। চিরায়ত মূল্যবোধ এবং বৈদগ্ধ্যের গর্বোদ্ধত মাথা কীভাবে ধুলা আর কাদায় নিপতিত হতে পারে'। এপরিস্থিতি থেকে আমরা উদ্ধার চাই- কারণ আমাদের বিবেক রবীন্দ্রনাথের মতই দৃপ্ত কন্ঠে বলে, 'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তরে যেন তৃণসম দহে'। আমার বিশ্বাস, সে কারণেই সকল ব্যবধান ভুলে অন্যায়ের প্রতিবাদে একই কাতারে আপনারা সবাই এসে দাঁড়িয়েছেন।
অপ্রিয় সত্য হলো, জনগণের আত্মাহুতি আর নেতৃত্বের ব্যর্থতা- এই হলো আমাদের বর্তমানের বাংলাদেশ। আজ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কবলে নিপতিত দেশের প্রতিটি নাগরিক। আমরা যারা প্রবাসী কিংবা স্বদেশে গুহাবাসী হয়ে আছি- আমাদের প্রজন্মের রাজনৈতিক ব্যর্থতা তাই আমাদেরকে নিন্দুক করে তুলেছে। আমরা যখন একত্রিত হই- প্রবাসে কিংবা স্বদেশে, পরনিন্দাই হয়ে ওঠে আমাদের মুখ্য বিষয়। আমাদের এই পরনিন্দাগুলো আসলে আমাদের ব্যর্থতাজনিত কান্নার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, ছাড় দিতে দিতে সবাই আজ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, 'কেউ আর তার নিজস্ব মর্যাদার অবস্থানে দাঁড়িয়ে নেই। দেশ বা জাতির উত্থানকে কেউ আর তার নিজের কল্যাণ বা উত্থান বলে ভাবছে না। কেউ ভাবছেই না, জাতি এবং রাষ্ট্রের দৃঢ়প্রোথিত ভিত্তিই শুধুমাত্র হতে পারে সকলের মর্যাদাবান অস্তিত্বের একমাত্র নিশ্চয়তা।… বুঝতে পারছে না চারধার থেকে মৃত্যু-সাম্রাজ্য পরিবেষ্টিত হয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। ঘর থেকে বেরিয়ে চারপাশের শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম চালানো আজ তার প্রয়োজন; সকলের অস্তিত্বের স্বার্থে এবং সেই সঙ্গে নিজেরও'।
আমরা আমাদের ভবিষ্যতে সন্দিহান, সততায় দ্বিধাগ্রস্ত, আত্মপ্রতিষ্ঠায় বিপর্যস্ত। তাই আমাদের চারপাশের অধিকাংশ মানুষই বর্তমানে পলায়নপর সুযোগসন্ধানী। মাত্রাতিরিক্ত চাওয়াই আজ আমাদেরকে বিবেকহীন ভিক্ষুকে পরিণত করেছে। দুর্বৃত্তায়ণ যে এক প্রকারের ভিক্ষাবৃত্তি কিংবা ডাকাতির উন্নত সংস্করণ আমাদের অনেকেই সেটা বুঝতে পারছি না। ভিক্ষাবৃত্তিকে অপমানজনক না ভেবে আমরা মনে করছি সেটা আমাদের অধিকার, প্রাপ্তির সুবর্ণ সুযোগ। তাইতো আমরা দেখি অবৈধ ঐশ্বর্যের কী জৌলুশ আর ছড়াছড়ি! রাষ্ট্রীয় সম্পদকে যুদ্ধে জেতা গণিমতের মালের মতোই লুটে চলেছে লুটেরার দল, আর প্রতিটি সুদিনেই যারা নিজেদের আখের গোছানোতে মগ্ন থাকে, তারা কিভাবে জাতির দুর্দিনে অশুভের প্রতিরোধে রাস্তায় থাকবে? তাদের কাছে সেটা প্রত্যাশা করাটাই কী আমাদের নির্বুদ্ধির পরিচয় নয়? যুগে যুগে এই সুযোগ সন্ধানীরাই আমাদের জাতীয় জীবনের এই দুর্গতির জন্য দায়ী। প্রবাসী মন তাই বারবার চিৎকার করে বলতে চায়- 'আর কত কাল নিজেদের ছুরিতে আমরা এভাবে নিজেরা খুন হতে থাকব, হে জন্মভূমি'!
খোলা চোখে যদি আমরা আমাদের সমাজের দিকে তাকাই, তবে কি দেখতে পাই? দেখতে পাই- 'সব হিতের ওপর দিয়ে সারাদেশে শুধুমাত্র একটি হিতের মাথাই আজ দাঁতালের মতো চোয়াল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 'আমার হবে তো', 'আমি পাব তো', 'আমি খাব তো'- এই কদর্য অশ্লীল চিৎকারের নিচে আজ সারাদেশের সমস্ত কন্ঠস্বর নিষ্পিষ্ট।' তাই 'আজকের যুদ্ধ আমাদের নিজেদেরই বিরুদ্ধে; আমাদেরই পাপ ও পচনের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ- আমাদের অযোগ্যতা আর ক্লেদের বিরুদ্ধে। আমাদের ক্ষুদ্রতা, লোভ, দৈন্য এবং নিঃস্বতা এবার আমাদের প্রতিপক্ষ'। তাই রাবীন্দ্রিক উচ্চারণে বলতে চাই- 'সত্য যে কঠিন! কঠিনেরে ভালবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।' এসত্যকে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, আজ সারাদেশে সবখানে শুধু অশুভের সংঘবদ্ধতা। রাষ্ট্র, সরকার আর জনতার নামে স্বৈরাচারের এবং সন্ত্রাসের রাজত্ব। তাই আজকের শোক সভায় জড়ো হওয়া সবারই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে চেষ্টা করতে হবে কীভাবে দেশের শুভ চেতনার মানুষদেরকে একত্রিত করা যায়, সংঘবদ্ধ করা যায়- তাদেরকে প্রজ্জ্বলিত করতে পারা যায় একটি শক্তিশালী জাতীয় শক্তি হিসেবে; গড়ে তোলা যায় প্রতিরোধ সব অশুভের বিপরীতে। নচেত আমরা কেউই স্বদেশের কৃতজ্ঞতার দায়ভার মুক্ত হতে পরব না।
হতাশ হবার কিছুই নেই। ইতিহাসের অনিবার্য সত্য হলো যে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। গণতন্ত্রের নামে যারা স্বৈরাচারের শীর্ষ স্পর্শ করে, সরকারের নামে যারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে সন্ত্রস্ত আর দুর্বিসহ করে তোলে জনজীবনকে, তাদের পতন অনিবার্য। যুগ যুগ ধরে সেই ইতিহাসেরই পুনারাবৃত্তি হয়েছে। তাই কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতোই ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ অপশক্তির উদ্দেশ্যে বলতে হয়, 'অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?' তোমাদের পতন অনিবার্য এবং কালের বিবর্তনে এই দম্ভ ধুলায় ধুষরিত হবে, হবে অপাক্তেয় আর ঘৃণিত। ত্যাগ আর ভালবাসায় আপ্লুত রাজনৈতিক শাসন ছাড়া আমজনতার হৃদয় জয় করা যায় না। মরহুম আরাফাত রহমানের লাশের জানাজা কি সেই ইতিহাসের পুনারাবৃত্তির ইঙ্গিত দিয়ে যায়নি?
আজ আমাদের প্রয়োজন আত্মশক্তির উদ্বোধন। অতীতের ভুলত্রুটি থেকেই শিক্ষা নিয়ে, অভিজ্ঞার নানাস্তর পেরিয়ে আগামীর নেতৃত্ব পেশাজীবীদের দক্ষতা আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ আর সমৃদ্ধ স্বদেশ উপহার দেবে, এপ্রত্যাশায় নতুন সুর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকা স্বদেশীদের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-
এই ভাবে আর কত দিন,
এই ভাবে আর কত কাল;
কষ্টে কাটাব আমি নষ্টপ্রহর
হে বঙ্গজননী!
(প্রকাশিত মতামত একান্তই লেখকের নিজস্ব।শীর্ষ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির অন্তর্ভুক্ত নয়।)