প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, যারা ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করে, মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছে, এতিমের টাকা পর্যন্ত মেরে খেয়েছে- তাদের গলায় এখন বড় আওয়াজ শুনি! আর তার বিরুদ্ধে মামলা হলেই আমাদের দোষ। উনি যদি এতিমের টাকা মেরে না-ই খাবেন, তবে আদালত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? সাহস থাকলে মামলা মোকাবেলা করে প্রমাণ করুন, আপনি এতিমের টাকা মেরে খাননি। কথিত কিছু সুশীল সমাজের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আকাশে-বাতাসে, পত্রিকার পাতায় দেশের উন্নয়নে অনেকের অনেক থিওরি (তত্ত্ব) শুনি। কিন্তু উনাদের দেয়া তত্ত্বাবধায়ক থিওরি ডুবে গেছে। আমি অত শত থিওরি বুঝি না। আমি একটাই থিওরি বুঝি যে, কিভাবে সব মানুষের মুখে অন্ন, চিকিৎসা, বাসস্থান ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করব। এই থিওরি নিয়ে আমি দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। কেউ এই অগ্রযাত্রা রূখতে পারবে না।
শুক্রবার রাতে তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় সূচনা বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি আমাদের দুর্নীতি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। আমার বিরুদ্ধে ১০/১২টি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেও আমাদের দুর্নীতি খুঁজেছে, তারাও আমার বিরুদ্ধে ৪/৫টি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতির অজুহাত তুলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে পরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও দুর্নীতির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও বিশ্বব্যাংক আমাদের দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। কিন্তু যারা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল, দুর্নীতি করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছে, বিদেশে পাচার করেছে- সেই বিএনপির নেত্রী এখন আমাদের দুর্নীতি খুঁজে বেড়ান।
শেখ হাসিনা বলেন, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করে দেশকে ফেইল্ড (ব্যর্থ) রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। কারণ এরা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও কোনদিন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারে, সারাজীবন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে চলতে হয়- পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট সেই চেষ্টাই করে গেছে। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা বীরের জাতি। আমরা চাই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে চলবে, আত্মনির্ভরশীল হবে, বিশ্বের বুকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হবে। আমরা এই লক্ষ্য নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালন করছি। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে একমাত্র আওয়ামী লীগই যে দেশকে সবদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে- তা আমরা প্রমাণ করেছি। ইনশাল্লাহ এই অগ্রযাত্রা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
বিএনপি-জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরা ক্ষমতায় থেকে দেশের কোন উন্নয়ন করেনি। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করে মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছে। ধর্মের নামে রাজনীতি করলেও এরা জাতীয় মসজিদে আগুন দিয়েছে, শত শত কোরআন শরিফ পুড়িয়ে দিয়েছে। মসজিদে কোরআন শরিফ পড়া অবস্থায় আমাদের এক কৃষক লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে তারা। তিনি প্রশ্ন করেন, যারা ধর্মের নাম নিয়ে কোরআন শরিফ পোড়াতে পারে, তারা কি আদৌ মুসলমান?
খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ না করে তাঁকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, এতিমের টাকা মেরে খেয়ে এখন ধরা পড়ার ভয়ে আদালত থেকে উনি (খালেদা জিয়া) পালিয়ে বেড়ান। যদি তাঁর সৎসাহসই থাকত তবে এভাবে পালিয়ে বেড়াতেন না, আদালতে গিয়ে মামলা মোকাবেলা করতেন। আমার বিরুদ্ধেও বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনেক মিথ্যা মামলা দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাকে মামলা মোকাবেলা করতে যাতে না পারি, সেজন্য দেশে ঢুকতে বাঁধা দিয়েছে। আমি জোর করে দেশে ফিরে মামলা মোকাবেলা করেছি। উনারও যদি সাহস থাকে যে তিনি এতিমের টাকা মেরে খাননি, তবে আদালতে গিয়ে মামলা মোকাবেলা করুক। এতিমের টাকা মেরে খেয়ে এখন পালিয়ে বেড়ান, আবার আমাদের দুর্নীতি খোঁজেন! আসলে উনার (খালেদা জিয়া) অবস্থা হয়েছে 'চোরের মায়ের বড় গলা' প্রবাদের মতোই।
সারাদেশে কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সারাদেশে ওয়ার্ড, থানা, উপজেলা ও জেলার সম্মেলন চলছে। অনেক জেলার সম্মেলন ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সকল সহযোগী সংগঠনেরও সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছে। আর এই সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গঠন প্রক্রিয়ায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্ততায় অংশ নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা-বিশ্বাস থেকেই দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। কারণ তাঁদের বিশ্বাস ও আস্থা আছে যে, একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে দেশের সার্বিক উন্নয়ন করতে, দেশকে এগিয়ে নিতে। মাত্র ৫ বছরেই সারাদেশের অবিশ্বাস্য উন্নয়নে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যার জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশ বাংলাদেশের প্রশংসা করছে, উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে দেখছে। তাই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা বিশ্বের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সূচনা বক্তব্যের পর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এরপর স্বাগত বক্তব্যে রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বৈঠকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাড়াও আগামী ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবস, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর মহান বুদ্ধিজীবী দিবস এবং ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের দলীয় কর্মসূচী চূড়ান্ত করা হয়।
'সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গড়ুন'॥ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গঠনের ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিরা প্রভাব খাটিয়ে যাতে নিজেরা সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হতে না পারেন সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সতর্ক করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে এলাকার ত্যাগী, আদর্শবান ও সৎ নেতাদের মূল্যায়ন করার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, কোনভাবেই দলের পুরনো ও ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করা চলবে না।
রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত দলের কার্যনির্বাহী সংসদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এমন নির্দেশ দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। একইসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দলের বিদ্রোহী প্রার্থিতার কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্যে কেউ যোগ্য হলে ক্ষমার মাধ্যমে তাঁকে অবস্থান অনুযায়ী সম্মানজনক কোন পদ দিয়ে দলে ফিরিয়ে আনা যায় কিনা, তাও ভেবে দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশ দেন। তবে দলের আদর্শ ত্যাগকারী বা দলের ক্ষতিকারকদের কাউকে কমিটির কোন পদে না নেয়ারও নির্দেশ দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর এবং ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের বিভিন্ন কর্মসূচী চূড়ান্ত করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ১০ জানুয়ারি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে বড় শোডাউন করবে আওয়ামী লীগ। বৈঠক সূত্র জানায়, সভাপতিম-লীর সদস্য ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রস্তাব দেন, জানুয়ারিতে সরকারের দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে এই এক বছরসহ টানা দুই মেয়াদে বর্তমান সরকারের অর্জিত সাফল্যগুলো মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে কারাগারে থাকা বহিষ্কৃত নেতা লতিফ সিদ্দিকী বা এইচটি ইমাম প্রসঙ্গে কোন কথা না উঠলেও উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত হওয়ার পরও পদত্যাগী তানভীর ইমামের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফকে নির্দেশ দেন তিনি। বৈঠকে ডিসেম্বরে বিজয়ের মাসব্যাপী দলীয় কর্মসূচী পালনে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিলেও প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে কর্মসূচী সীমাবদ্ধ না রেখে ইউনিয়ন পর্যন্ত বিজয়ের মাসের কর্মসূচী ছড়িয়ে দিতে হবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, সাত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা ইতোমধ্যে জেলা ও উপজেলা কাউন্সিলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ পূর্ণাঙ্গ কমিটির একটি সম্ভাব্য তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। তালিকা গ্রহণ করে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে পরবর্তী বৈঠকে তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানান। বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছাড়াও বেগম মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, ওবায়দুল কাদের, সুভাষ ঘোষসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।
__._,_.___