বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল
পাকিস্তানের ঐক্য ঝুঁকিতে পড়ল
মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ দ্বিতীয় কিস্তি
একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনায় পাকিস্তানের ঐক্য ঝুঁকিতে পড়ল। ১৯৫২ সালের ৮ মার্চ করাচি থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় এ মন্তব্য করেছিলেন পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব চার্লস দ্য উইদার্স। তিনি আসলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পক্ষে ওই বার্তাটি পাঠান। পাঁচ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে (করাচি ডেসপ্যাচ ১০৭৮) ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সমগ্র পাকিস্তানে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য ঘটনার মূল্যায়ন ছিল।
ওই সময়ের মার্কিন কূটনীতিকেরা একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে নির্দিষ্ট করতে প্রধানত 'রায়ট' (দাঙ্গা) এবং 'ডিস্টারবেন্স (গোলযোগ) কথাটি ব্যবহার করেছেন।
চার্লস দ্য উইদার্সের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফেব্রুয়ারি মাসে দুটি ঘটনা ঘটে। একটি ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা প্রশ্নে বাঙালিদের ওপর গুলিবর্ষণ। আর দ্বিতীয়টি ২৪ ফেব্রুয়ারি লাহোরে গোলযোগ।
উইদার্সের বর্ণনায়, 'অভ্যন্তরীণভাবে পূর্ববঙ্গে বিক্ষোভ এবং পরে ভাষা প্রশ্নে ঢাকায় দাঙ্গা, যা মূলত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়। তাতে তিনি বাঙালিদের কাছে পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘটনার পর লাহোরে একটি গোলযোগ দেখা দেয়। সেটা ঘটে ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেখানকার বিক্ষোভকারীরা পাঞ্জাবের খাদ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'গত ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিম উদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় গোটা প্রদেশে বিক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। এর জের ধরে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দুদিনের দাঙ্গা বাধে। হামিদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী সংবাদপত্র পাকিস্তান অবজারভার, পূর্ববঙ্গের রাজনীতিক, ছাত্র এবং বামপন্থী সংগঠনগুলো প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি অবজারভার বন্ধ করে দেওয়া হয়। পূর্ববঙ্গের সরকার এ জন্য অবজারভার-এ প্রকাশিত একটি 'অ-ইসলামি' সম্পাদকীয় প্রকাশকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে এবং পত্রিকাটির মালিক চৌধুরী এবং তার সম্পাদক আবদুস সালামকে গ্রেপ্তার করে।
এখানে লক্ষণীয় যে, এই প্রতিবেদনে ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতি মার্কিন দূতাবাসের প্রচ্ছন্ন দরদ প্রকাশ পায়। উইদার্সের ভাষায়, '২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা একটি সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছিল। এবং তারা মিছিল ও সমাবেশের ওপর তার আগের দিন বহাল করা নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেছিল। ছাত্ররা এতটাই সহিংস হয়ে ওঠে যে পুলিশ গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। এতে কয়েকজন ছাত্র নিহত এবং অনেকেই আহত হয়। পরদিন পুলিশ পুনরায় গুলিবর্ষণ করতে বাধ্য হয় এবং তার একই ফলাফল ঘটে। পরদিন সেনাবাহিনীকে ডেকে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। এখনো প্রদেশটিতে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। ছোট আকারের প্রাদেশিক শহরগুলোতে সভা-সমাবেশ, ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে।'
তবে চার্লস উইদার্স মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পক্ষে এই মূল্যায়নও করেন, 'পেছন ফিরে তাকালে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে ফেব্রুয়ারির ওই দাঙ্গার গভীর ভিত্তি রয়েছে। ভাষা প্রশ্নে বাঙালিদের জনপ্রিয় ভাবাবেগ রয়েছে। এবং সেটার নেতৃত্বে ছিলেন প্রাদেশিকতাবাদী ব্যক্তিবর্গ।'
মার্কিন কূটনীতিক এরপরই উল্লেখ করেন, 'কমিউনিস্ট এবং হিন্দু সংখ্যালঘুরা দৃশ্যপটে এসেছেন পরে। পূর্ববঙ্গের সরকার এ ঘটনার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করতে সচেষ্ট হয়েছে। এবং পূর্ববঙ্গ সরকারের কথায়, এ ঘটনার জন্য তারাই (কমিউনিস্ট এবং হিন্দু সংখ্যালঘু) দায়ী, ''যারা তাদের পাকিস্তানের বাইরে থেকে উৎসাহ জুগিয়ে থাকে''। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ছাত্র ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ও কমিউনিস্ট অধ্যাপকেরা রয়েছেন।'
এ পর্যায়ে চার্লস উইদার্স মন্তব্য করেন, 'পাকিস্তানের ঐক্য ভাষা প্রশ্নে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিষয়টি মার্চ মাসে গণপরিষদের অধিবেশনে উত্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে। পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস বিশ্বাস করে যে যদিও ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারির দাঙ্গার পটভূমিতে পূর্ববঙ্গের আইনসভা সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব পাস করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভাষার বিষয়টি গণপরিষদে সম্ভবত কিছু সময় ধরে ঝুলিয়ে রাখা হবে।'
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
: ফেব্রুয়ারী ০২, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করন
__._,_.___