রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ১১ ফাল্গুন ১৪২০
এক রাজাকারের আত্মজীবনী ( ১২ - ১৫ )
মুনতাসীর মামুন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পরে পটভূমিকা সম্পূর্ণ বদলে গেল। দ্বিজাতিতত্ত্ব রইল; যুক্ত হলো ভারতবিরোধী প্রচারণা। এটিও সেই তত্ত্বেরই অন্য রূপ। এর অর্থ : পাকিস্তান = মুসলমান, হিন্দু = ভারত। যদিও পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র হলো নেপাল। অন্যদিকে সামরিক শাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একাংশের লোভ- সবকিছু মিলে আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ করে দিল। সেই কারণেই আমলাতন্ত্র ও ডানপন্থী দলগুলোর মধ্যে কমবেশি আঁতাত থাকে। এদের মাধ্যমেই আদর্শের মডেল ছড়িয়ে দেয়া হতে লাগল প্রচার মাধ্যম, পাঠ্যবই এবং সংস্কৃতিতে। সামরিক বাহিনীর আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কাকুল কালচারের বিষয়টিও যুক্ত হতে লাগল তত্ত্বে। কাকুলের সামরিক একাডেমিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এদের শিক্ষার মূল নির্যাস ছিল- সামরিক বাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে। ইসলামী পাকিস্তানের শত্রু ভারত। সামরিক বাহিনী সৎ, রাজনীতিবিদরা অসৎ ইত্যাদি। আসল বিষয় হলো কর্তৃত্ব। 'আদর্শ' এভাবে হয়ে ওঠে ক্ষমতা রক্ষার ঢাল।
পশ্চিম পাকিস্তানীদের ওপর শাসকদের তত্ত্ব বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। কারণ, সেখানে সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব ছিল বেশি। রাষ্ট্রযন্ত্রের সমস্ত কর্তৃত্ব করায়ত্ত ছিল সামন্ত প্রভুদের হাতে। হয়ত, অশিক্ষিত সমাজে ক্ষমতা অটুট রাখার জন্য এ ধরনের কর্তৃত্বপরায়ণ আদর্শের দরকার ছিল। যা গণতান্ত্রিক আদর্শের নয়।
অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানে এই আদর্শ শাসকবর্গ বার বার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। কারণ, পূর্ববঙ্গের সমাজ সামন্ত সমাজ নয়। উঠতি মধ্যবিত্ত ছিল গণতন্ত্রমনা। ফলে ঐ আদর্শ বার বার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছিল। ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, মণি সিংহ এবং সবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন সময় এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। এ চ্যালেঞ্জের বিপরীতে শাসক দল ও তাদের সহযোগীদের সামনে দু'টি পথ ছিল। এক. চ্যালেঞ্জ মেনে নেওয়া; দুই. চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করা। শাসকরা দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছিল এবং তাদের সহযোগীরাও তাদের সমর্থন যুগিয়েছিল। সমর্থন যোগানোর কারণ, তাহলে তাদের পক্ষে সম্ভব হবে ক্ষমতার প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা এবং সেখানে থাকতে হলেও মতাদর্শগত একটি ঢাল থাকতে হবে মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য। সুতরাং এখানে পাকিস্তানের সেই আদর্শটির রক্ষক হয়ে উঠল তারা। এটির একটি উদাহরণ পাঠ্যপুস্তক।
মার্কিন গবেষক ইয়েভেত রোজার এর ওপর গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন পাকিস্তান যে আদর্শ (অতীতে ও বর্তমানে) প্রচার করতে চায় সেখানে ঐতিহাসিক সত্য দরকার নেই। আগে ইতিহাসের পাঠ্যবইতে উপমহাদেশে প্রাচীন ইতিহাস ও বিশ শতকের ইতিহাসের কিছুটা থাকত। সামরিক শাসনের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সেসব বিষয় উধাও হয়ে যেতে লাগল। পাকিস্তানের ইতিহাসের শুরুই হয় মুহম্মদ বিন কাসেমের সময় থেকে। আমাদের এখানেও পাঠ্যবই সেভাবে বদলে যেতে লাগল। এ প্রসঙ্গে ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টির কথা মনে পড়ছে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকার বইটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিএনআর (ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন) গঠিত হয়। কিন্তু এ অঞ্চলে সচেতন মানুষের কারণে এ আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা পুরোপুরি সফল হতে পারেনি।
এই দ্বন্দ্ব বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এক সময় আওয়ামী লীগই শাসকদের বিরুদ্ধে প্রধান দল হয়ে ওঠে। ছয় দফা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাকিস্তান আদর্শের বিপরীতে বাংলাদেশ আদর্শের রূপটা স্পষ্ট হতে থাকে। এর প্রবক্তা হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর দলও আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে এ অঞ্চলে। শেখ মুজিব পরিণত হন বঙ্গবন্ধুতে। বাংলাদেশের স্বপ্নটা তখনই পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে।
॥ ১৩ ॥
১৯৫২ সালের পর পাকিস্তান আদর্শ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় ১৯৭১-এ। পাকিস্তানী নীতিনির্ধাকরা তাঁদের দেয়া সাক্ষাতকারে আমাকে জানিয়েছেন, বাঙালীর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আকর্ষণ তাঁদের পছন্দ হয়নি এবং তাঁরা জানতেন এক সময় পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত হয়ে যাওয়ার প্রশ্নটি প্রধান হয়ে উঠবে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান ঝেড়ে ফেলার জন্য ১৯৭১ সাল ছিল একটি অজুহাত। কিন্তু সেটি যে অজুহাত, এটি স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানী শাসকরা বুঝতে দিতে চায়নি। কারণ তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানও কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারে।
১৯৭১ সালে, বাংলাদেশ বিরোধীদের সামনে দু'টি পথ ছিল। বাংলাদেশ সমর্থন অথবা পাকিস্তান সমর্থন। বাংলাদেশ সমর্থন করলে রাজনৈতিকভাবে তাদের অস্তিত্ব থাকে না। আদর্শগত অবস্থানও নস্যাত হয়ে যায়। পাকিস্তান সমর্থনই ছিল স্বার্থগত দিক থেকে কাম্য। এছাড়া, তাদের পক্ষে এ কথা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করার ব্যাপার ছিল যে, তাদের আদর্শের ধারাবাহিকতা আছে। তারা সৎ, অন্যরা নয়। এ কথাটিই কিন্তু সাজ্জাদ হোসায়েন তাঁর আত্মজীবনীতে বার বার বলতে চেয়েছেন। বাংলাদেশবিরোধী আদর্শ ফলে ১৯৭১ সালে পরিণত হয় রাজাকারী আদর্শ। এ আদর্শ নিয়ে লড়াই করার আরেকটা বড় কারণ ছিল এই যে, তাদের অটুট বিশ্বাস ছিল পাকিস্তান বাহিনী অজেয়।
পাকিস্তান আদর্শ কিভাবে চুইয়ে পড়েছিল নিচে তার কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। পাকিস্তানী নীতিনির্ধারকরা পাকিস্তান ভাঙার জন্য যেসব কারণ উল্লেখ করেন, সেগুলো হলোÑ
১. হিন্দু শিক্ষকরা বাঙালীদের মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ফলে হিন্দুত্বের দিকে ঝোঁক ছিল বেশি।
২. ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে প্ররোচিত করেছে বিদ্রোহে এবং লড়াইটি ছিল ভারত ও পাকিস্তানের।
৩. ১৯৭১-এর যুদ্ধটা ছিল গৃহযুদ্ধ। আওয়ামী লীগ হলো ভারতের অনুগত একটি দল। আওয়ামী লীগার ও সমর্থকরা সে কারণে ভারতের এজেন্ট।
৪. সেনাবাহিনী সার্বভৌমত্বের প্রতীক। তারাই পাকিস্তান রক্ষা করবে।
৫. মুক্তিযোদ্ধারা দুষ্কৃতকারী।
৬. পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ইয়াহিয়া-ভুট্টো-মুজিব দায়ী।
রাজাকারদের ভাষ্যগুলো পড়লে দেখা যাবে উপর্যুক্ত কথাগুলোই তারা বলছে এবং এখনও তাদের ও তাদের সমর্থকদের বক্তৃতা-বিবৃতির ধাঁচ সেই একই রকম। তারাও বলছে, হিন্দু ভারত ভেঙ্গেছে পাকিস্তান। এটি ছিল বাংলাদেশের মুসলমানদের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ (অন্তিম লড়াই)। ১৯৭১ সালে যা ঘটেছিল তা'হলো গৃহযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা দুষ্কৃতকারী (সাজ্জাদ হোসায়েনের ভাষায় 'গ্যাংস্টার')। মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থকরা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ধামাধরা, ভারতের দালাল এবং পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী শেখ মুজিবুর রহমান। সুতরাং ভারতই হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র শত্রু।
॥ ১৪ ॥
একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য। যে সব রাজাকার আত্মজীবনী লিখেছেন, তাদের সবাই মাদ্রাসার ছাত্র। শুধু তাই নয়, রাজাকারী আদর্শের প্রতি যে সব শিক্ষিত অনুগত, তাদেরও প্রায় সবাই মাদ্রাসার ছাত্র। এ কারণে, রাজাকাররা মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা আগে যা ছিল, এখনও তাই আছে। তা আধুনিক যুগের সম্পূর্ণ অনুপোযোগী। কিন্তু সবসময় একে সমর্থন করা হয় এবং এ সমীকরণটি তুলে ধরা হয় ইসলাম = মাদ্রাসা। যে কারণে, এখনও মাদ্রাসার সমর্থনে অনেক রাজনৈতিক দল সোচ্চার, যদিও তাদের কারও সন্তান মাদ্রাসার ছাত্র নয়। তাদের ধারণা, গ্রামের অশিক্ষিত মানুষকে এভাবে উত্তেজিত রেখে দলে টানা যাবে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সহজ হয়ে যায়। অথচ, এ সমীকরণটি সম্পূর্ণ ভুল।
মাদ্রাসা সনাতনী ধারণার প্রতীক। এই ভুল ধারণার ফলে সমাজের একটি অংশে বিশেষ করে গ্রামীণসমাজে সনাতনী ধারণা চক্রবৃদ্ধি হারে আধিপত্য বিস্তার করছে। আবুল মোমেন মাদ্রাসা শিক্ষার ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছেন। তাঁর পুস্তিকায় তিনি লিখেছেনÑ "মাদ্রাসা শিক্ষিত মৌলানারা অধিকাংশ সামাজিকভাবে এমন এক রক্ষণশীলতার পক্ষাবলম্বন করে থাকে যা কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও নানারূপ কূপম-ূকতাকে প্রশ্রয় দেয়।" এই কারণে, আমরা দেখি, প্রাকচল্লিশের মাদ্রাসার ছাত্র সাজ্জাদ হোসায়েন ও ষাটপরবর্তী মাদ্রাসার ছাত্র খালেক মজুমদারের চিন্তার মধ্যে মৌলিক কোন তফাত নেই। থাকে না।
১৯৪১ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা কমিটির সদস্য মৌলভী মোজাম্মেল হক লিখেছিলেন, "সংস্কারের চেষ্টা চালিয়েও গত এক শ' বছরেও কোন ফল পাওয়া যায়নি। মাদ্রাসায় সবচেয়ে বড় সঙ্কট এখানেই যে, শিক্ষাঙ্গন হওয়া সত্ত্বেও এখানে তত্ত্ব ও তথ্যের অবাধ প্রবাহ, পর্যালোচনা, পরিমার্জনা, পরিবেশ অনুপস্থিত। নানা সংস্কার ও পরিমার্জন ও উন্নয়ন সত্ত্বেও সম্ভবত এ কারণেই মাদ্রাসা শিক্ষা সমাজ ও জাতীয় জীবনে কোন বড় অবদান রাখতে পারছে না।" [আবুল মোমেনের পুস্তিকায় উদ্ধৃত]
এ মন্তব্যের আরো ৫০ বছর পর এ কথা বলতে হয়- এখনও সংস্কারের চেষ্টা দূরে থাকুক বরং মাদ্রাসা শিক্ষা পরিপুষ্টির একটা প্রচেষ্টা সবসময় নেয়া হয়। কারণ, একে ঘিরে রয়েছে অবৈধ অর্থ রোজগার, ধর্ম ব্যবহার করে প্রতিপত্তি অর্জন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ ইত্যাদি। এসব কিছু আরও বেশি অর্থ লাভের উপায় করে দেয়। ফলে, জাতীয় জীবনে সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, পাবে। কারণ, মাদ্রাসা শিক্ষা কোন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে না।
মাদ্রাসা শিক্ষিতরাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বিরোধিতা করেছে, করছে এবং করবে। পাকিস্তান আদর্শের প্রতি তারা যতটা আত্মিক টান অনুভব করে, বাংলাদেশ আদর্শের প্রতি ততটা নয়। 'মাদ্রাসা ও মুক্তিযুদ্ধ' বিষয়ে একটি সমীক্ষায় লিখেছেন আবুল মোমেন, "জাতীয় চেতনাবিহীন এই শিক্ষার আরও ভয়াবহ বিকৃতির প্রকাশ ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। কি ওহাবী, কি সুন্নি বাংলাদেশের প্রায় সকল মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র ছিল স্বাধীনতার বিপক্ষে। এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম একেবারে হাতে গোনা দু'চারটি। অধিকাংশ মাদ্রাসা পাকিস্তান রক্ষার দুর্গ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরাকে জিহাদ হিসেবে ধরা হয়েছিল। ... এখনও মাদ্রাসার প্রবীণ শিক্ষকদের মধ্যে অনেককে পাওয়া যাবে, যারা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র নিয়েছিল। ... পরবর্তীকালে এর বিরোধী যে রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছে ছাত্র-শিক্ষকরা ব্যাপকভাবে তাতে শরিক হয়েছে এবং এই পরিবর্তনের ধারায় নৈতিক ও বস্তুগত সমর্থন যুগিয়েছে। তাই দেখা যায়, মাদ্রাসার বিকাশ ও বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও আদর্শের বিরোধী চেতনার যেন শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছে।"
মাদ্রাসার নামে টাকা আদায় বিদেশী অনুদান গ্রহণ, পীর সংস্কৃতির বিকাশÑ এ সমস্ত করে এক ধরনের শোষণ বজায় রেখেছিল এ চক্র। বাংলাদেশ হওয়ার পরও সে প্রক্রিয়া থামেনি। বরং আরো প্রশ্রয় পেয়েছে। কারণ সেই একইÑ ধর্মের জুজু। আবুল মোমেনের ঐ রিপোর্টেই উল্লেখ করা হয়েছে, "অধিকাংশ মাদ্রাসা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় ভরা। এই মাদ্রাসাসমূহ সরকারী অনুদান ছাড়াও প্রতিবছর বার্ষিক সভা, কোরবানির চামড়া ইত্যাদি থেকে ভাল অঙ্কের চাঁদা পেয়ে থাকে। তা ছাড়া অনেক মাদ্রাসা ছাত্রদের নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহের কাজে লাগায়।"
এ পরিপ্রেক্ষিতে দেখি, ১৯৭১ সালে অধিকাংশ মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র হানাদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা বিপাকে পড়ে। কারণ, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া তারা পরিবর্ধিত হতে পারে না। ১৯৭৫ সালের পর তারা অবলম্বন পেয়ে যায়। এর উদাহরণ, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সালের ভেতর মাদ্রাসা শিক্ষার প্রভূত বিস্তার। এবং এ কারণেই, মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বাংলাদেশ আদর্শের বিরোধীদের একটি শক্তিশালী কনসর্টিটিউন্সি তৈরি হয়েছে যা বাংলাদেশের আধুনিকায়নে একটি প্রতিবন্ধক।
॥ ১৫ ॥
রাজাকারদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, তারা কৌশলী। অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত, সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা করতে সে পিছপা হয় না। ১৯৭১ সালের ঘটনার মধ্যে তারা অমানবিকতা খুঁজে পায় না। পাকিস্তানীরা বলে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়নি। রাজাকাররাও তাই বলে। কিন্তু আজ প্রায় ২৯ বছর পর মিরপুরের মুসলিম বাজারে যে বধ্যভূমি পাওয়া গেছে তা কোন্ সত্য তুলে ধরে?
আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৭১ সালে গোলাম আযমের ভূমিকা কী ছিল, তা বাঙালী মাত্রেরই জানা। এমনকি কেউ যদি প্রমাণের কথা বলেন তাহলে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার খবরই বড় প্রমাণ। হানাদার বাহিনীর তিনি শুধু অন্যতম সহযোগীই ছিলেন না, হত্যা, খুন, ধর্ষণের জন্য প্ররোচিতও করেছিলেন। কিন্তু রাজাকাররা এ কথা কখনই স্বীকার করবে না। শেখ আখতার হোসেন জননেতা গোলাম আযম গ্রন্থে লিখছেনÑ "পাকিস্তানের সামরিক সরকার যখন দেশ ও জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে হত্যা, জুলুম ইত্যাদি শুরু করল তখন গোলাম আযম চুপ করে থাকেননি। মানুষ মরবে আর তিনি দেখবেন, সে রাজনীতি তিনি করেন না। তাঁর জন্মভূমি পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হেফাজত করার ক্ষেত্রে সে দেশের নাগরিক হয়ে যতটুকু দায়িত্ব ছিল, সে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। তাই বলে দেশের মানুষকে হত্যা করতে হবে, এমন চিন্তার তিনি ছিলেন ঘোরবিরোধী। এ সত্য কথা বিরোধীদের জানা থাকলেও তারা এখন তা স্বীকার করবে না। ১৯৭১ সালকে তারা গোলাম আযমের ঘাড়ে চাপাতে চায়। তারা এমনভাবে কথা বলে যেন গোলাম আযম তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর নির্দেশেই এদেশের নিরীহ নিরপরাধ জনগণকে হত্যা করা হয়েছে। এসব কথা যুগ কাল ধরে বলেও দেশের মানুষকে বোকা বানানো যায়নি। যে ভারত ১৯৭১ সালে দেশের বন্ধু হিসাবে পরিচিত ছিল ভারতের বন্ধুরাই পরে জনপ্রিয়তা হারাল। গোলাম আযম যেমন ছিলেন তেমনই আছেন। বরং আরও বলা যায় তিনি এখন দেশের ইসলামী জনতার প্রাণপ্রিয় নেতা। (চলবে)
প্রকাশ : রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ১১ ফাল্গুন ১৪২০