মুক্তির পথে কত বাধা কত রক্ত
ওয়াহিদ নবি
আহমদ শরীফ তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন- আমরা তো নিজের ইচ্ছায় পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিলাম। কাজেই সে অর্থে আমরা পরাধীন ছিলাম না। জিনিসটাকে অন্যভাবে দেখা যেতে পারে। ইংরেজরা যে পরিস্থিতিতে বলে, 'উই অয়ার ট্রিকড ইনটু ইট'- আমরা তেমন একটা পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম। এটা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা সরলতার পরিচয় দিয়েছিলাম। আরো একটা কথা এখানে বলা যেতে পারে। স্বইচ্ছায় যদি কোথাও প্রবেশ করে থাকি এবং যদি স্বাধীন থাকি, তবে সেই স্থান থেকে নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে আসার অধিকার আমার থাকা উচিত। আমাদের সে অধিকার ছিল কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আমরা স্বাধীন ছিলাম না। এখন এপ্রিল মাস। এই মাসের ১৭ তারিখে মেহেরপুরের আম্রকুঞ্জে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল। অস্থায়ী রাজধানীর নাম হয়েছিল মুজিবনগর- জাতির পিতার নাম অনুসারে।
আজকাল ইতিহাস নিয়ে খেলা চলছে। আমরা এই খেলাগুলোকে 'ছেলেখেলা' মনে করি। কিন্তু বোধ হয় এসব খেলার খেলোয়াড়রা এই খেলাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। সঙ্গে সঙ্গে আরো কেউ কেউ হয়তো সেভাবে দেখেন। আমরা মুজিবনগর গঠনের পটভূমি নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে চাই। এই পটভূমি দীর্ঘকালের। মুজিবনগর সরকার হুট করে এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। রক্ত ও অশ্রুর সুদীর্ঘ পারাবার পেরিয়ে মুজিবনগরে পৌঁছাতে হয়েছিল। শত-সহস্র বাধা পেরিয়ে আসতে হয়েছিল। এই সুদীর্ঘ পথের যাঁরা পথিক, তাঁদের বছরের পর বছর কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। তাঁদের অনেক সহকর্মী অকালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পরিবার-পরিজন অনিশ্চিত কষ্টসাধ্য জীবন যাপন করেছিল। এসব পথিকের আপনজনের অনেকেই তাঁদের ছেড়ে গিয়েছিল। ভুল বুঝেছিল অনেকে। ভ্রান্তপথে পরিচালিত করার ষড়যন্ত্র করেছে কুচক্রীরা। কিন্তু সঠিক পথে এগিয়ে গেছেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পথিকরা। কারো একটি ভাষণে জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় না। জাতি দীর্ঘদিনের সংগ্রামীদের চেনে। তাঁদের শ্রদ্ধা করে। তাঁদের দ্বারা পরিচালিত হয়। সুদীর্ঘ চলার পথে ভুল তো কিছু হতেই পারে। একপর্যায়ে কাঁটাও বিঁধতে পারে। এতে করে যারা চলার পথকে রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল, তাদের নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়ার অধিকার কেউ দেয় না।
জাতির এই পথচলা কবে শুরু হয়েছিল? বিভিন্নজন বিভিন্ন কথা বলবেন। পাকিস্তানকে ঘিরে যে সমস্যা আমাদের বিভ্রান্ত করেছিল, সেটি আলোচনা করতে হলে হয়তো আমাদের উচিত নিজের দেশের ইতিহাস আমরা যতদূর অতীত থেকে জানি, সেখান থেকেই শুরু করা। কোনো একটি প্রবন্ধে তা সম্ভব নয়। তবে রমেশ চন্দ্র মজুমদার, রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দিনেশ্চন্দ্র সেন, গোপাল হালদার, কাজী আবদুল ওদুদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, গোলাম মুরশিদ, মুনতাসীর মামুন প্রমুখ যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন আমাদের জন্য, তা থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। আসলে কোনো বিশেষ ব্যক্তির কোনো বিশেষ দেশে পদার্পণ করার দিনটি থেকে সে দেশের ইতিহাস শুরু হয় না। 'মুলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন' প্রবন্ধে বদরুদ্দীন উমর যা লিখেছিলেন, তা মনে রাখার মতো, 'নিজের দেশকে স্বদেশ মনে না করার জন্য মানুষের জীবনে যে দুর্যোগ, স্বাভাবিক মুসলমানরা সে দুর্যোগ রোধ করতে পারেননি।'
১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাব পাস হয় লাহোরে। পরে প্রস্তাবকেই দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়, সেই দ্বিজাতিতত্ত্বের সারবত্তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় জিন্নাহ সাহেবের তিনটি ভাষণের স্ববিরোধী বক্তব্যে। জনগণের বাস্তব সমস্যাগুলোকে অবজ্ঞা করে মানুষের দৃষ্টি আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত করা হয়। প্রথমে সেনা ও আমলা এবং পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সর্বেসর্বা হয়ে দাঁড়ায়। অর্থের বিনিময়ে দেশটির সার্বিক দায়িত্ব মার্কিনিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেনাকর্তা আইয়ুব মার্কিন প্রভুদের বলেছিলেন, 'পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আপনাদের সেনাবাহিনী।' প্রথম থেকেই সেনাকর্তারা ইমেজ সৃষ্টিতে মন দেন। কেউ কেউ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে বিশ্বের সেরা বলে মনে করতে লাগলেন। এই সেনাবাহিনী ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর দখলের চেষ্টা করে দেশকে বিপন্ন করে তুলেছিল। বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে যা-ই হোক, নিজের দেশ তাঁরা জয় করে ফেললেন। দেশের টাকা-পয়সা, সুযোগ-সুবিধা সেনাবাহিনীর পেছনে খরচ হতে থাকল। আয়েশা সিদ্দিকা তাঁর 'মিলিটারি ইঙ্ক : ইন সাইড পাকিস্তানস মিলিটারি ইকোনমি' বইতে 'মিলিবাস'-তত্ত্ব আলোচনা করেছেন। কিভাবে সেনাবাহিনীর কর্তারা হেঁয়ালিভরা হিসাবপত্রের সাহায্যে আর্থিক সুযোগসুবিধা ভোগ করেছেন, আয়েশা সিদ্দিকা সেটা আলোচনা করেছেন। রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিপরায়ণ বলে আইয়ুব ক্ষমতা দখল করেছিলেন আর তাঁর ক্ষমতার বলে তাঁর পরিবার গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক হয়ে গেল।
ক্ষমতাবলে সেনা শাসকরা শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয়, পশ্চিম পাকিস্তানেও নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে যায়। বঞ্চিত সিন্ধু প্রদেশের নেতা জি এম সাইদ 'জিইয়ে সিন্ধ' আন্দোলন করেন স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। পাকিস্তানের শাসকরা তাঁকে ৩০ বছর হয় কারাবন্দি, নয় গৃহবন্দি করে রাখেন এবং বন্দি অবস্থায়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বেলুচিস্তানের নেতা আবদুস সামাদ আচকজাইয়ের বাড়িতে বোমা মেরে তাঁকে হত্যা করা হয়। আবদুল গফফার খান ও তাঁর অনুসারীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়। ১৯৫০ সালে রাজশাহী কারাগারের খাপরা ওয়ার্ডে রাজবন্দিদের হত্যা করা হয়। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড অবশেষে বাঙালিদের মোহমুক্ত করে। বাষট্টি আর ঊনসত্তরে নিরস্ত্র জনতার রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। জনপ্রতিনিধিদের কারা অন্তরালে রাখা হয় বছরের পর বছর। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কর্তারা নির্বাচন দিলে বাঙালি জাতি তাদের মতামত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়। প্রমাদ গুনেন সেনা কর্তারা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন সেনাবাহিনীর সৃষ্ট রাজনীতিবিদ ভুট্টো। ভুট্টো ইয়াহিয়া খাঁকে উপদেশ দেন এই বলে যে ২০ হাজার বাঙালি হত্যা করলেই পূর্ব পাকিস্তান ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। স্বাধীনতা অর্জন না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়নি বাঙালি জাতি।
লাখ লাখ বাঙালিকে যখন খুন করছিল নরপশুরা, লাখ লাখ মুসলমান নারী যখন ধর্ষিতা হচ্ছিলেন মুসলমান নামধারী পশুদের হাতে, তখন তাদের মদদ জুগিয়েছিল আমাদেরই কিছু দেশবাসী। এই পরাজিত শক্তি নানা রকমের কারসাজির দ্বারা মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। একটা দেশের মানুষের চেতনা জাগ্রত হয় বহু সময় ধরে। এই চেতনা বৃদ্ধি হয় বহুজনের সাধনায় ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে। কোনো ভুঁইফোড় ব্যক্তির আকস্মিক আবির্ভাব কোনো ইতিহাস সৃষ্টি করে না। এসব ব্যক্তিকে শুধু ইতিহাস বিকৃতির কাজে ব্যবহার করা হয়।
লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো
http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2014/04/17/73551__._,_.___