Banner Advertise

Sunday, September 13, 2015

[chottala.com] বাংলাদেশের প্রচলিত ও একপেশে ইতিহাস বনাম প্রকৃত ও বাস্তব ইতিহাস



বাংলাদেশের প্রচলিত ও একপেশে ইতিহাস বনাম প্রকৃত ও বাস্তব ইতিহাস: 

ইঞ্জিনিয়ার আবু রামিন কর্তৃক সম্পাদিত


বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক কেন?

পৃথিবীর বহু দেশ রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সে সকল দেশের স্বাধীনতা ও বিপ্লবের ইতিহাস নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ কারো মধ্যেই সাধারণত কোনো দ্বিমত দেখা যায়নি। কারণ, বাস্তবে যা ঘটেছে, মানুষ যা ঘটতে দেখেছে, সেটাই হয়েছে তাদের ইতিহাসের অন্তর্গত। 

কিন্তু, ব্যতিক্রম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস। স্বাধীনতার প্রায় ৪২ বছর পরও এদেশের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য ইতিহাস রচনা করা সম্ভবপর হয়নি। তার কারণ,বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় নিরপেক্ষতা বজায় থাকেনি। বরং- বিভিন্ন কারণে প্রকৃত ইতিহাসের সত্য প্রায় সম্পূর্ণরূপে চাপা পড়ে যায়। ইতিহাস বিকৃতির কারণগুলো হলো:
১. মুক্তিযুদ্ধকালীন দুর্বলতাসমূহকে ঢাকার চেষ্টা
২. মুক্তিযুদ্ধের সকল কৃতিত্ব কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা
৩. গোষ্ঠী স্বার্থে দলীয় ও দলীয় নেতার কাল্পনিক মাহাত্ম্য প্রচার করা
৪. ক্ষমতা ও গোষ্ঠী স্বার্থকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা ইত্যাদি।

ইতিহাস বিকৃতির সেই ভূমিকা আজও অব্যাহত আছে এবং বর্তমান প্রজন্মের কিছু অংশ হলেও এ অপতৎপরতার ফলে বিভ্রান্ত হচ্ছে। 

এই ইতিহাস বিকৃতিকারীরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করেনি,অথচ মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত কৃতিত্ব এককভাবে আত্মসাৎ করতে উদ্যত হয়েছে।

বাংলাদেশের বিশেষ এক বা একাধিক গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে সত্যিকার ইতিহাস হলো সেটিই- যেটা তাদের স্বার্থ, গোঁয়ার্তুমি ও অহংকারের অনুকূলে; তা আদৌ বাস্তব কি অবাস্তব তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। 

ইতিহাসকে বিকৃত করতে সচেষ্ট এই গোষ্ঠীগুলো যেটাকে ইতিহাস বলে চালাতে চাইছেন, দেশের অনেক মানুষের দৃষ্টিতে তা নিতান্তই "উদ্দেশ্যমূলক গল্প"। তাই প্রকৃত ইতিহাস আর উদ্দেশ্যমূলক গল্পের মধ্যে পার্থক্য সূচীত হওয়া জরুরী।


মুক্তিযুদ্ধ কি পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ছিলো? নাকি ইসলামের বিরুদ্ধে? 

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আদৌ ইসলামের বিরুদ্ধে ছিলো না। এই যুদ্ধ ছিলো পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠীর ২৪ বছরব্যাপী উপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধ ছিলো জালিমের (বা অত্যাচারীর) বিরুদ্ধে মজলুমের (বা অত্যাচারিতের) মুক্তির সংগ্রাম; যা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ ন্যায় যুদ্ধ। এজন্যই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মসজিদে হানাদারদের ধ্বংস ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের জন্য দোয়া-মুনাজাত করা হয়েছিলো। 

অতএব, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে ইসলামের দ্বন্দ্বের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ,আওয়ামী লীগার আর বামপন্থীদের অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামকে পরস্পরবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করছেন। 

যদি মুক্তিযুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে না হয়ে থাকে তাহলে আজ যারা ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, তাদেরকে ঢালাওভাবে রাজাকার, আলবদর বলে উপহাস করার যুক্তি আছে কি? যারা উপহাস করেন বা করছেন তারা কি এটাই বুঝাতে চান যে- মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো ইসলামের বিরুদ্ধে? তা-ই যদি হয় তাহলে যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বলে দাবি করেন তারা প্রকাশ্যে ইসলাম ছেড়ে অমুসলিম হয়ে যাচ্ছেন না কেনো?

দেশের মানুষের মূল সমস্যা কোনটি? শোষণ-বৈষম্যে? না ইসলামী দল?

বাংলাদেশে আজ খুন, ডাকাতি, হাইজ্যাক, ঘুষ, দুর্নীতি, অশ্লীলতা, পতিতাবৃত্তি, শোষণ, বৈষম্য, শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য ইত্যাদি প্রায় সবগুলোই সর্বকালের সব রেকর্ড অতিক্রম করে গেছে। দ্রব্যমূল্য আজ সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, হতাশা আজ গগণচুম্বি। বাংলাদেশের সবার উপর আজ চেপে বসেছে বিশাল বিদেশী ঋণের বোঝা। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের রাজত্ব। এদেশের অনেক মানুষের জীবনমান দারিদ্র্য সীমার নীচে, লক্ষ-কোটি শিক্ষিত যুবক আজ বেকার, এখনো অনেক মানুষ নিরক্ষর, দেশের অনেক মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত, মুষ্টিমেয় লোকের কাছে প্রায় সব সম্পদ আজ কুক্ষিগত। আপামর জনগণের জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা আর কি হতে পারে? কিন্তু আওয়ামী লীগারদের কর্মকান্ড দেখে মনে হয়, এসব আসলে কোনো সমস্যাই নয়, দেশের একমাত্র সমস্যা হলো ইসলামী দল (যা সাধারণত সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণকারী)। তারা এরকম ঘোষণাও দিয়েছেন যে, "এবারের সংগ্রাম গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম"। কি আশ্চর্য! গোলাম আযম কি বাংলাদেশের সরকার, নাকি দখলদার পাকিস্তানী বা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে, তাদের এবারের সংগ্রাম তাঁরই বিরুদ্ধে? তবে হাঁ, তারা যদি এরকম নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে, অধ্যাপক গোলাম আযমের ফাঁসি হলে কিংবা তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে খুন, ডাকাতি, হাইজ্যাক, ঘুষ-দুর্নীতি, অশ্লীলতা ইত্যাদি নির্মূল হয়ে যাবে, দ্রব্যমূল্য কমে যাবে, বেকারত্ব দূর হবে, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস থাকবে না, গঙ্গা-তিস্তা- ব্রহ্মপূত্রের পানি অবারিত হবে, শান্তিবাহিনী-বঙ্গসেনার উৎপাত থাকবে না, ১৬ কোটি নিপীড়িত মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জিত হবে, তাহলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই গোলাম আযমের ফাঁসির দাবিতে তাদেরই নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু যদি তা না হয় তাহলে প্রশ্ন, ১৬ কোটি মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের বর্তমান মূল সমস্যা কোনটি? দুর্নীতি, শোষণ, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ইত্যাদি? নাকি অধ্যাপক গোলাম আযম? জনগণের বাঁচা-মরার সমস্যাকে ধামাচাপা দিয়ে কেনো তারা গোলাম আযমের মতো একটি নন-ইস্যুকে ইস্যু করে তুলেছেন? কেন তারা জনগণের দৃষ্টিকে মূল সমস্যাবলী থেকে অন্যদিকে ফিরিয়ে দিতে চাইছেন? কার স্বার্থে তারা এই মরণ খেলায় মেতে উঠেছেন?

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের আপামর জনগণ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এ চেতনাবোধ থেকে রুখে দাঁড়িয়েছিলো যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রাষ্ট্র পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটবে। অথচ, আওয়ামী লীগাররা জনগণের দৃষ্টিকে মূল সমস্যা থেকে অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নন ইস্যুকে ইস্যু করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। তাদের মূল আন্দোলন শোষণ-বৈষম্যের অবসানের জন্য নয়, দ্রব্যমূল্য হ্রাস বা রেকারত্ব দূরীকরণের জন্য নয়, গঙ্গা- তিস্তা- ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণ কিংবা তালপট্টি দ্বীপ দখলের বিরুদ্ধে নয়; এমনকি বিশ্বব্যাঙ্ক- আইএমএফ এর কবল থেকে দেশের অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বকে মুক্ত করার লক্ষ্যেও নয়।


বাংলাদেশের কথিত 'ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী'-দের আচরণ ও তাদের বক্তব্যের স্বরূপ:

অশালীন উক্তি:
মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি বেশ্যাদের খদ্দের আহ্বানের সমতুল্য (বলেছেন কবি শামসুর রাহমান), দীর্ঘক্ষণ যাবৎ আযান অসহ্য (বলেছেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী), মোহাম্মদ তুখোর বদমাশ- চোখেমুখে রাজনীতি (দাউদ হায়দারের কবিতা), আমাদের উচিত রবীন্দ্রনাথের এবাদৎ করা (বলেছেন কবি সুফিয়া কামাল), বেহেশত নারীদের কাঙ্খিত হওয়ার কথা নয়, বেহেশতে নারীদের শারীরিক ও মানসিক সুখের কোনো ব্যবস্থা নেই (তসলিমা নাসরীন, যায় যায় দিন, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সংখ্যা)।
ইসলামকে সংকুচিত করার প্রচেষ্টা:
কুরআন হাদীস এর যে সকল স্থানে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, আইনব্যবস্থা এবং জিহাদ (বা ন্যায়ের সংগ্রাম) এর কথা বলা হয়েছে, যেসব অংশ কোনো মসজিদে পড়া যাবে না।
ইসলামী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা:
মার্কস, লেলিন, মাও, হিটলার, মুসোলিনী, বুশ, ক্লিনটন,ওবামা, ইন্দিরাগান্ধী, নরসিমা রাও, আদভানী, বল থ্যাকারে প্রমুখ যে কারো আদর্শ ও মত-পথ অনুসরণে কোনো বাধা নেই। এদেশে শুধু একজনেরই জীবনাদর্শ ও মত-পথ অনুসরণ করা যাবে না, -তিনি হলেন মুহাম্মাদ (সা.)। আর 'ইতর' লোকেরা যদি নিতান্তই কুরআন সুন্নাহর চর্চা করতেই চায়, তবে তা করতে হবে, 'প্রগতিশীল', 'ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ' ও দলীয় বুদ্ধিজীবীদের নির্দেশ ও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী।



ইসলামী শক্তিকে দেশবিরোধীরূপে প্রমাণ করার প্রচেষ্টা:
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অনুসরণে যারা টুপি-দাঁড়ি রাখবে কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার কথা বলবে অথবা ভারত বা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো কথা উচ্চারণ করবে তারা সব রাজাকার, আলবদর; এমনকি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে থাকলেও।
ধর্মবিরোধিতাকে অধিকার হিসেবে উপস্থাপন:
রাসূলুল্লাহ (সা.) কে হেয় প্রতিপন্ন করে ''স্যাটানিক ভার্সেস'' লেখা সলমন রুশদীর গণতান্ত্রিক অধিকার। 
গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তার দুশমনরূপে ইসলামকে উপস্থাপনের চেষ্টা:
এক কথায়, নাস্তিকতা, ইসলাম-বিরোধিতা ও ভারত-ভক্তি গণতান্ত্রিক; এর বিপরীত সব কিছু অগণতান্ত্রিক ও রাজাকারী। কুরআন-সুন্নাহর প্রতি যার ঘৃণা যতো বেশি, তিনিই ততো বড়ো দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনার ধারক।
ইসলামপন্থীদের স্বাধীনতাবিরোধীরূপে প্রমাণের প্রচেষ্টা:
১৯৭১ –এর ঘটনাবলীর জন্য ইয়াহিয়া কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের দলীয় নেতাদের নিশ্চেষ্টতা ও পরিকল্পনাহীনতা ইত্যাদি আদৌ দায়ী নয়। ৭১ -এর যাবতীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ইসলামপন্থীরা- বিশেষ করে ইসলামী দলসমূহ ও এগুলোর নেতারা।
আসল সমস্যা এড়িয়ে ইসলামকে সমস্যারূপে উপস্থাপন:
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ঘুষ-দুর্নীতি, খুন-হাইজ্যাক-রাহাজানি, আইন-শৃঙ্খলার ক্রমবিলুপ্তি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, আকাশচুম্বি শোষণ-বৈষম্য ইত্যাদি আসলে কোনো সমস্যাই নয়। বাংলাদেশের একমাত্র (বা মূল) সমস্যা হলো কুরআন-সুন্নাহর চর্চা ও ইসলামী দল।
ভারত বিরোধিতাকে বাংলাদেশের বিরোধিতারূপে প্রমাণ করার চেষ্টা:
৭১-৭২ সালে ভারত যুদ্ধবিধ্বস্ত দরিদ্র বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়েছে, পাটের আন্তর্জাতিক বাজার দখল করেছে, বাবরী মসজিদ ধ্বংস করে তার বুকের উপর রাম মন্দির নির্মাণ করেছে, তালপট্টি দ্বীপ দখল করেছে, গঙ্গা-তিস্তায় বাঁধ দিয়েছে। তারপরও বাংলাদেশের প্রতিটি সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক মানুষের পবিত্র কর্তব্য হলো ভারত ও ভারতীয়দের এরূপ যাবতীয় কর্মকান্ডের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন প্রদান করা। আর যারা ভারত ও ভারতীয়দের উপরোক্ত 'প্রগতিশীল' কাজসমূহের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবে, তারা নিঃসন্দেহে 'প্রতিক্রিয়াশীল', মৌলবাদী, রাজাকার ও আলবদর।
১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত সময়কে বাংলাদেশের স্বর্ণযুগরূপে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা:
একথাও সবাইকে মানতে হবে যে, বিজয় দিবস থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত সময়টিই ছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ, এ সময়ে জনগণের সুখ-সমৃদ্ধির কোনো সীমা-পরিসীমা ছিলো না এবং গণতন্ত্রও ছিলো সম্পূর্ণ উন্মুক্ত ও অবাধ। বলা বাহুল্য, এটা যারা মানবে না, তারা অবশ্যই ঘৃণ্য রাজাকার- আলবদর।

এদেশে দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত বুর্জোয়া গণতন্ত্র, জনগণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সুবিধাতন্ত্র, নৈরাজ্যবাদ ইত্যাদি আপামর জনগণকে ক্রমবর্ধমান শোষণ, দুর্নীতি, দারিদ্র, বৈষম্য, প্রবঞ্চনা, হতাশা ও অশ্লীলতা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। এমতাবস্থায়, মানুষ যে ক্রমশঃ একমাত্র বিকল্প ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে থাকবে, এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। সম্ভবত, এ ইসলাম আতংক থেকেই তথাকথিত প্রগতিবাদী ও ধর্মরিপেক্ষতাবাদীরা (অর্থাৎ ধর্মহীনবাদীরা) যত্রতত্র ইসলামী দলের প্রতিচ্ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। 

প্রগতিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা হয়তো এটাও বিশ্বাস করেন যে, ছলে-বলে-কৌশলে প্রধান ইসলামী দল (বা দলসমূহ) কে একবার হীনবল করে দিতে পারলেই দেশের বাদবাকী অসংগঠিত বা কম সংগঠিত ইসলামী শক্তিসমূহকে নির্মূল করে দিতে তাদের তেমন একটা বেগ পেতে হবে না। এজন্যই তারা গোয়েবলসীয় পদ্ধতিতে বর্তমান প্রজন্মের মন-মগজে একথা ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন যে, যারাই টুপি-দাঁড়ি রাখেন, নামায-কালেমা পড়েন, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন- তারা সব ঢালাওভাবে রাজাকার-আলবদর। এটাও ক্রমশঃই সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, প্রগতিবাদী-ধর্মনিরপেক্ষতা-বাদীদের মূল লক্ষ্য আসলে কোনো ইসলামী ব্যক্তিত্ব নয়; মূল লক্ষ্য হলো ইসলাম। 


একদিকে মুসলিম চিহ্ন অপরদিকে ইসলামবিরোধিতা: এটা কি আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের স্ববিরোধিতা নয়?

আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী মুসলিমদের (?) পিতৃপ্রদত্ত নামসমূহও (সাধারণত) তো আরবি ও ইসলামী, যা তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী ঘোরতর 'মৌলবাদী' ও 'সাম্প্রদায়িক'। সুতরাং, এ সমস্ত মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক নাম ঘৃণার সঙ্গে ত্যাগ করে তারা 'ধর্মনিরপেক্ষ' ও 'প্রগতিশীল' নাম গ্রহণ করছেন না কেনো? তাদের পিতামাতা নিশ্চয়ই তাদের (মধ্যকার পুরুষদের) মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক 'খৎনা'-ও করিয়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারেই বা তারা এখন কি করবেন? তাদের পরবর্তী বংশধরদের কি আর সাম্প্রদায়িক 'খৎনা' করানো হবে না? বিয়ের সময় তাদের কোনো মৌলবাদী 'আকদ' 'কাবিন' 'দেনমোহর' ইত্যাদি হয়নি তো? হয়ে থাকলে এ ব্যাপারেই বা এখন তারা কি সিদ্ধান্ত নেবেন? এখন কি ঐ বিয়েকে নাকচ করে দিয়ে তারা ও তাদের বংশধররা "লিভ টুগেদার" করবেন? তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার পর তাদের কোনো মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক কাফন, জানাজা, দাফন ইত্যাদি হবে না তো? তাদের মধ্যে এ ন্যাক্কারজনক স্ববিরোধিতা কেনো? মৌলবাদের বিরুদ্ধে তারা যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু করেছেন, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রকাশ্য ও পূর্ণভাবে ইসলামবিরোধিতার বলিষ্ঠ ঘোষণা তারা দিতে পারছে না কেনো? মেরুদন্ডহীনতার জন্য? ভন্ডামীর জন্য? নাকি কাপুরুষতার জন্য?


ইসলাম কি প্রতিক্রিয়াশীল? আর প্রগতির দাবিদাররাও কি সর্বক্ষেত্রে প্রগতিশীল?

যে মতবাদ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিকাশ এবং সে কারণে সমাজ ও বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে খাপ খেয়ে চলতে সক্ষম, সেটাকেই বলা যায় প্রগতিশীল। আর যে মতবাদ এ ব্যাপারে অক্ষম, সে মতবাদই হলো প্রতিক্রিয়াশীল। 

সমাজবাদী- সাম্রাজ্যবাদীরা আজ গলাগলি করে আওয়াজ তুলছেন যে, তারাই প্রগতিশীল এবং মূলতঃ ইসলামই হলো মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল। কি আশ্চর্য! যে মতবাদ ৭০ বছরও টিকলো না, সে মতবাদ হলো প্রগতিশীল; আর যে মতবাদ ১৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবিকৃতভাবে টিকে থাকলো সেটা হলো প্রতিক্রিয়াশীল?

আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের অনেকেই জানেন না বা স্বীকার করতে চান না যে- ইসলামই হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র যথার্থ প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত ব্যবস্থা। এই শোষণমুক্ত ইসলামী সমাজের মডেল হলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও খুলাফায়ে রাশেদার আমলের সমাজব্যবস্থা। তাছাড়া, অমুসলিমের উপর কোনো প্রকার নিপীড়ণ, শোষণ বা হয়রানি সম্পূর্ণরূপে ইসলামবিরুদ্ধ। 

অথচ, আওয়ামী লীগার ও বামপন্থীরা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই না জেনে বা জানার কোনো তোয়াক্কা না করে, কুরআন-হাদীসে বিধৃত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক দর্শন এবং তার সঙ্গে পুঁজিবাদী-সমাজবাদী ব্যবস্থার তুলনামূলক বিচার না করে এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে অন্ধ-একগুঁয়েমীর সঙ্গে ইসলামের ওপর আঘাত হেনে চলেছেন এবং অন্ধভাবে ভারত ও ভারতীয়দের যাবতীয় কর্মকান্ডের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের এই অন্ধতাকে কি প্রতিক্রিয়াশীলতা বলা যায় না? 

মৌলবাদ ও সংকীর্ণতার রোগে রোগী কারা?

বস্তুত: কুরআন-সুন্নাহর সত্যিকার অনুসারীরা কখনোই 'মৌলবাদ' শব্দের উৎপত্তিগত অর্থে মৌলবাদী নন। আর যদি মৌলবাদের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় এবং কোনো জীবনদর্শনের মূলধারা বা মূলনীতির অনুসরণকেই "মৌলবাদ" বলে অভিহিত করা হয়, তাহলে সকল ইসলামপন্থী বা মুসলিমই মৌলবাদী। একই বিচারে, কার্লমার্ক্সের মূল মন্ত্রের অনুসারীরাও মার্কসীয় মৌলবাদী, মুক্ত অর্থনীতি বা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অনুসারীরাও পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী মৌলবাদী এবং ভারত-ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্ধ ভক্তরা ভারতপন্থী বা ব্রাহ্মণ্যবাদী মৌলবাদী।

অন্ধ মৌলবাদী কারা? যারা কুরআন হাদীসে বিধৃত জীবনদর্শন সম্পর্কে কিছুই জানার তোয়াক্কা না করে অন্ধভাবে ইসলামকে গালাগাল করছেন এবং বস্তুবাদী অগ্রগতির স্তর, বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি, বাংলাদেশ প্রেক্ষিত, আর্থসামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামোর ম্যাট্রিক্স ইত্যাদি বুঝার ধার না ধেরে বিভিন্ন মুখরোচক ইজম বা মতবাদ অন্ধভাবে ১৬ কোটি মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছেন- সেই অন্ধ একগুঁয়ে লোকেরাই কি মৌলবাদী ও সংকীর্ণ চিন্তার অধিকারী নয়?


ইসলাম আংশিক, না পূর্ণাঙ্গ?

কুরআন ও হাদীসে রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, আইনব্যবস্থা, যুদ্ধনীতি, বাণিজ্যনীতি, সম্পদের বন্টননীতি ইত্যাদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দেওয়া আছে এবং সেগুলো পুংখানুপুংখরূপে মেনে চলা সকল কালের সকল মুসলিমের জন্যই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম বা জিহাদকে। সচেতন মুসলিমরা এটা ভালো করেই জানেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) শুধু শ্রেষ্ঠ নবীমাত্রই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান, সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ, বিচারক, সমরবিদ ও সেনাপতি। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সকল দিকের অনুসরণও প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক। কোনো মুসলিম যদি বলে, ইসলামের এই (ফরয) নির্দেশ স্বীকার করবো, কিন্তু ওই ফরয নির্দেশ স্বীকার করবো না; তাহলে সংজ্ঞানুযায়ী সেই ব্যক্তি আর মুসলিম (বা আত্মসমর্পনকারী) হতে পারে না।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কি ভুল ছিলো?

শেখ মুজিবুর রহমান (ও নেতা-সহযোগীরা) ১৯৪৭ সালে যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন, তারই ভৌগলিক কাঠামো থেকে ১৯৭১ সালে বেরিয়ে আসে বর্তমান বাংলাদেশের কাঠামো। অথচ, অনেকে বলেন, পাকিস্তানের জন্মটিই ভুল ছিলো। তাহলে তারা কি বলতে চান- পাকিস্তান আন্দোলন করে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর নেতা-সহযোগীরা ভুল করেছিলেন? লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তানেরও তো মূলে ছিলো ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্ব। সেদিন যদি নেতারা অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না করতেন, তাহলে বর্তমান বাংলাদেশ আজ বঙ্গ প্রদেশের অংশ হিসেবে ভারতেরই অন্তর্ভুক্ত থাকতো। সেক্ষেত্রে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা কি আদৌ সম্ভবপর হতো? তাই, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে ভুল বলার দ্বারা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকেই কি অস্বীকার করা হয় না?

ঐতিহাসিক ৬ দফায় কি স্বাধীনতার বিষয় ছিলো?

১৯৭১ এর ২৬ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার উপর অবিচল ছিলেন। কিন্তু ৬ দফায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয় তো দূরের কথা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণ কিংবা দরিদ্র জনগণের শোষণ ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির ব্যাপারেও একটি শব্দমাত্র ছিলো না। 
বস্তুতঃ ৬ দফা ছিলো পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই অবাঙ্গালী পুঁজিপতি ও আমলাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পারা পূর্ব পাকিস্তানী উঠতি পুঁজিপতি ও আমলাদেরই শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার দলিল। 

স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা প্রথম কারা করেন?

প্রকৃত প্রস্তাবে, ১৯৬৩-৬৪ সালের দিকে যিনি সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা-ভাবনা করেন, তাঁর নাম বিচারপতি ইবরাহীম (১৯৬২ তে আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী সংবিধানে আইনমন্ত্রী হিসেবে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে বরখাস্তকৃত)। 
এরপর সশস্ত্র উপায়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রথম উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন পাকিস্তান নেভীর কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন এবং তার দুঃসাহসী সহযোদ্ধারা। 
রাজনীতির মঞ্চ থেকে স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
কিন্তু এসব উদ্যোগকে স্বীকার করলে স্বাধীন বাংলাদেশ এর কৃতিত্বের সিংহভাগই বিচারপতি ইব্রাহীম, কমান্ডার মোয়াজ্জেম, মাওলানা ভাসানী প্রমুখকে দিতে হয় বিধায় বর্তমান আওয়ামীলীগপন্থীরা এ ব্যাপারে কোনোদিনই উচ্চবাচ্য করেননি, আজও করেন না।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা কি আওয়ামী লীগের পূর্ব-পরিকল্পিত? পরিকল্পনাহীনতার জন্য দায়ী কে?

আওয়ামী লীগের কোন প্রকাশ্য বা গোপন বৈঠকে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলো? কারা উপস্থিত ছিলেন সেই বৈঠকে? বাস্তবতা হলো এই যে, এরকম কোনো সিদ্ধান্তই কখনো গ্রহণ করা হয়নি। 

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা যদি আওয়ামী লীগের পূর্ব পরিকল্পিত হয়েই থাকে, তাহলে তো পাকিস্তানী হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ুক আর নাই পড়ুক আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতোই। প্রশ্ন হলো, হানাদাররা ঝাঁপিয়ে না পড়লে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করবে বলে আওয়ামী লীগ সাব্যস্ত করেছিলো? এ প্রশ্নের সদুত্তর আওয়ামী লীগাররা দিতে পারবেন কি?

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পেছনে সিরাজুল আলম খান- আ.স.ম. আবদুর রব- শাজাহান সিরাজ প্রমুখের জঙ্গী আবেগ ছাড়া অপর কোনো পরিকল্পনাই ছিলো না। যুদ্ধের কোনো প্রকার স্ট্র্যাটেজী, ট্যাকটিকস, চেইন অব কমান্ড, মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি কিংবা পশ্চাদপসরণের কোনো পরিকল্পনা ইত্যাদির সার্বিক অনুপস্থিতিই তার প্রমাণ। এই পরিকল্পনাহীনতার জন্যই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দিশেহারা হয়ে সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে কোনো রকমে ভারতে পাড়ি দিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। 

যে কোনো যুদ্ধ শুরুরই অবশ্যম্ভাবী ও অপরিহার্য পূর্ব কাজ হলো যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজী, ট্যাকটিকস, স্ট্রাইকিং ফোর্স, সাপোর্টিং ফোর্স, কমান্ড স্ট্রাকচার, চেইন অব কমান্ড এবং গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্রে মুক্তাঞ্চল, পশ্চাৎভূমি ইত্যাদি নির্ধারণ করা। এগুলোকে বলা হয় পরিকল্পনা। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর দল কি আদৌ কোনো স্ট্র্যাটেজী বা কমান্ড স্ট্রাকচার নির্ধারণ করেছিলেন? এর বিস্তারিত বিবরণ কি আওয়ামী লীগারদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যদি পূর্ব পরিকল্পিত হয়েই থাকে, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি, মুদ্রানীতি, শিল্পনীতি, কৃষিনীতি, বাণিজ্যনীতি, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদির রূপ কি হবে তার আদৌ কোনো নীলনক্সা করা হয়েছিলো কি? হয়নি। 

আবদুল মালেক উকিল আগরতলায় পৌঁছেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন যে, গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু তাঁদের নির্দেশ দিয়ে যাননি (জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৬-১৯৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৫০০)। 

তাজউদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামও ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, মুজিবের আসল পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানতেন না। (শেখ মুজিবর রহমানের শাসনকাল, মওদুদ আহমদ, পৃষ্ঠা-৩৫৪) 

আওয়ামী লীগের অতি ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ-কূটনীতিবিদ কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর ''স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় ও অতঃপর'' গ্রন্থে লিখেছেন, ''আওয়ামী লীগের নেতারা এমনিভাবে দেশ ত্যাগ করায় এটাই পরিষ্কার হয়েছিলো যে, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য শেখ সাহেব বা আওয়ামী লীগের কোন প্রস্তুতি বা পরিকল্পনাই ছিলো না।'' (পৃষ্ঠা-১২১)?

শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং বিশ্ববরেণ্য সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের কাছে স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাঁর কোনোই প্রস্তুতি ছিলো না (Bangladesh Documenys, Vol II, Page 615) স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানের এই সরল স্বীকারোক্তির পর এ ব্যাপারে আর কোনো কথাই থাকতে পারে না; থাকা উচিত নয়। এককথায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পেছনে কোনো দল বা ব্যক্তির কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাই ছিলো না। 

বস্তুত: মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিলো ২৮ বছরব্যাপী পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠীর নির্মম উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, ৭১ এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি, নিরস্ত্র-অপ্রস্তুত জনগণের ওপর হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলা, বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য নরহত্যা-ধর্ষণ-ধ্বংসযজ্ঞ, তরুণ-ছাত্র-যুবক ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের তুলনাবিহীন বীরত্ব, হানাদারদের বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র জনগণের প্রতিরোধ সৃষ্টি, ভারতের স্বার্থ ও ভূমিকা ইত্যাদি ঘটনা প্রবাহেরই অনিবার্য ফলশ্রুতি।

বস্তুত হানাদার বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তৎকালীন মেজর জিয়া, মেজর রফিক, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর এম এ জলিল, মেজর নুরুজ্জামান, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী প্রমুখ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী বাঙ্গালী অফিসার ও জওয়ানরা। এছাড়া সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী টগবগে তরুণরাও গড়ে তুলেছিলো দুর্বার প্রতিরোধ। এর মধ্যে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলো কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম- এর নেতৃত্বাধীন বাহিনী। 
দলীয় নেতৃবৃন্দ ও আজকের উচ্চকন্ঠ বুদ্ধিজীবীরা প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আদৌ সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাঁদের কেউ কেউ ভারতের নিরাপদ মাটিতে অর্থ, নেতৃত্ব ও ভারত সরকারের আনুকূল্য লাভের ধান্ধায় ব্যস্ত ছিলেন, আর কেউবা এখানে সেখানে চাকরী করেছিলেন মাত্র।

স্বাধীনতা যুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার একাংশ:

২৮.০২.১৯৭১ তারিখে গভর্নমেন্ট হাউজে আলোচনা শেষে শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীণ গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে বলেছিলেন, ''আমার অবস্থা হলো- দু'পাশে আগুন, মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে। হয় সেনাবাহিনী আমাকে মেরে ফেলবে, নয় আমার দলের চরমপন্থীরা আমাকে হত্যা করবে। কেনো আপনারা আমাকে গ্রেফতার করছেন না? টেলিফোন করলেই আমি চলে আসবো'' (নিয়াজীর আত্মসমর্পনের দলীল, মেজর সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা:৫৬)।

১৯৭১ সালের ৬ মার্চ আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, ''বিচ্ছিন্নতা থেকে পূর্ব পাকিস্তান কিছুই পাবে না, রক্তপাত ও উৎপীড়ন ছাড়া।..আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেট স্বাধীনতার জন্য নয়, স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য'' (পাকিস্তান ক্রাইসিস, ডেভিড লোসাক, পৃষ্ঠা ৭১-৭২)
এটা সুস্পষ্ট যে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যেই এ অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্বশাসন চাইছিলেন (এবং ইয়াহিয়া-ভূট্টো চক্রই হঠকারিতা ও ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিলো।)

২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন বলেই যদি শেখ মুজিবুর রহমান সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে ঐ দিন সন্ধ্যায় তিনি তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে সমবেত শত শত দেশীবিদেশী সাংবাদিকদের সামনে কেনো ঘোষণা করলেন যে, পরবর্তী কমসূচী হলো ২৭ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল? এর অর্থ কি? কেনো রাত সাড়ে দশটার সময় শেখ মুজিবুর রহমান ডঃ কামাল হোসেনের কাছে ব্যগ্রতা প্রকাশ করলেন পরদিন (২৬ মার্চ) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠকে বসার জন্য (ডঃ কামাল হোসেন লিখিত প্রবন্ধ, 'দি ডেইলী নিউজ, ২৬ মার্চ, ১৯৮৭ সংখ্যা)? এই ব্যগ্রতা কি একথাই প্রমাণ করে না যে, মাত্র ৬০ মিনিট পরে কি ঘটতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ধারণাই ছিলো না?

শেখ মুজিবুর রহমান-ই যদি স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি ওই কালরাতে বাড়িতে বসে থাকলেন কোন যুক্তিতে? পৃথিবীর কোনো দেশের, কোনো কালের কোনো বিপ্লব বা মুক্তিযুদ্ধের নেতা কি এভাবে বীভৎস শত্রুর হাতে ধরা দেওয়ার জন্য আপন শোয়ার করে বসে ছিলেন? কেনো ইন্দিরা গান্ধী তিক্ত ক্ষোভের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে বলেছিলেন, ''ভূ-ভারতে কে কবে শুনেছে যে, যুদ্ধ আরম্ভ করে সেনাপতি শত্রুপক্ষের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়?"

আসলে, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার কথা বলতে আদৌ রাজী ছিলেন না। সিরাজুল আলম খান ও তাঁর সহযোগিরা শেখ মুজিবুর রহমান-এর উপর এ ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করলে, তিনি ৬ মার্চ দিবাগত রাত ২ টার সময় তৎকালীন জি.ও.সি. মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার কাছে বিশেষ দূত মারফত এই বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি চরমপন্থীদের পক্ষ থেকে চাপের মধ্যে রয়েছেন, তারা তাঁকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ দিচ্ছে। তাদেরকে উপেক্ষা করার শক্তি তাঁর নেই। অতএব তাঁকে যেনো সেই রাতেই সেনাবাহিনীর হাতে নিয়ে যাওয়া হয় (নিয়াজীর আত্মসমর্পনের দলীল, মেজর সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা:৬৪) জি.ও.সি. শেখ মুজিবুর রহমান-এর এই আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় অনন্যোপায় শেখ মুজিবুর রহমান-কে পরদিন (৭ মার্চ) তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উগ্রপন্থী তরুণদের শান্ত করার জন্য এটুকু বলতেই হয় যে, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এটাই কি প্রকৃত সত্য নয়?

ইয়াহিয়া-ভূট্টো চক্র যদি বাস্তবিকই মনে করতো যে, শেখ মুজিবুর রহমান-ই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক-রূপকার এবং (তাদের দৃষ্টিতে) পাকিস্তান ভাঙার মূল হোতা, তাহলে তারা কি সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও শেখ মুজিবুর রহমান-কে হত্যা না করে ছাড়তো? যখন পাকিস্তানী হানাদাররা মুটে-মজুর-রিক্সাওয়ালা নির্বিশেষে যে কোনো বাঙালীকে দেখামাত্রই হত্যা করছিলো, ঠিক তখনই তারা শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে ধানমন্ডির অপর একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে পরম যত্নে সমাদরে রাখলো কেনো?


কেনো রাজনীতিবিদদের প্রায় কেউই শহীদ হলেন না?

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের শ্রেণীবিভাগ নিম্নরূপঃ ছাত্র ৮%, কৃষক ২০%, শ্রমিক ১৪%, চাকুরীজীবী ১৩%, ব্যবসায়ী ১০%, গৃহবধূ ১৪%, শিক্ষক ৩%, অন্যান্য ১৭% (একাত্তুরের বধ্যভূমির সন্ধানে, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা-৯৩, পৃষ্ঠা-২১) লক্ষ্যণীয় এখানে শহীদ রাজনীতিবিদদের সংখ্যা শূণ্য। এর কারণ কি? এদের সকলেই কি অতুলনীয় অপরাজেয় দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন? নাকি আসলে এঁরা যুদ্ধের ময়দানের ধারে কাছেও কখনো যাননি? তখন এসমস্ত নেতা-এমএনএ-এমসিএ-রা প্রকৃত যুদ্ধের ময়দান থেকে অনেক দূরে, কোলকাতা-আগরতলা-দেরাদুন-দিল্লীতে বসে যৌবন উপভোগ করছিলেন, -এটাই কি কঠোর সত্য নয়?

বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কতজন মুক্তিযোদ্ধা?

১৯৭১ সালে, বিশেষতঃ ১৪ ডিসেম্বর তারিখে যেসব বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছিলেন, তারা কি মুক্তিযুদ্ধে আদৌ অংশগ্রহণ করেছিলেন? মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের কার কি অবদান ছিলো? নাকি তারা মুক্তিযুদ্ধে আদৌ অংশগ্রহণ করেননি? বরং এই ঢাকা শহরেই নিজ নিজ বাসাবাড়িতেই পরম নিশ্চিন্ত মনে বসে ছিলেন? এসব বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই কি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছিলেন না? স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে যোগসাজস না থাকলে এইসব বুদ্ধিজীবীরা ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরেই নিজ নিজ বাসাবাড়িতে বসবাস করছিলেন কিভাবে? কি ভরসায়? পরাজয়ের মুহূর্তে এইসব বুদ্ধিজীবীরা প্রাণ দিয়ে ন্যাক্কারজনক হানাদার- নির্ভরতার পায়শ্চিত্তই করে গিয়েছিলেন, এটাই কি মর্মান্তিক সত্যি নয়?

জহির রায়হান কেনো নিহত হলেন?
জহির রায়হান নিখোঁজ হন ৩০ জানুয়ারী ১৯৭২ তারিখে। কোলকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে, তিনি স্বাধীনতার একচ্ছত্র কৃতিত্বের দাবীদার দলটির নেতা-এমএনএ-এমসিএ-দের তাস-জুয়া-মদপান- নারীসম্ভোগ অধ্যুষিত জীবনধারার প্রামাণ্য চিত্র তুলে এনেছিলেন। এই জহির রায়হানকে কারা হত্যা করলো? তখনতো দেশে রাজাকার আলবদরের নাম-গন্ধও ছিলো না।

মুক্তিযুদ্ধে কর্তৃত্ব কার ছিলো? আওয়ামী লীগের, না ভারতের?

একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ যদি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলের উদ্যোগ ও নেতৃত্বেই হয়ে থাকে, তাহলে পাকিস্তানী জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী ভারতীয় জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পন করলো কেন? কেনো মুক্তি বাহিনীর চীফ অব স্টাফ এম.এ.জি. ওসমানী বা অন্য কোনো বাঙালী কর্তৃপক্ষের কাছে নয়? কেনো আত্মসমর্পনের দলীলে বাংলাদেশের কাউকে সাক্ষী হিসেবে রাখা হলো না? কেনো প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়া হলো বিজয়ের এক সপ্তাহ পর- ২২ ডিসেম্বর তারিখে? এইসব ঘটনা কি মুক্তিযুদ্ধের ওপর শেখ মুজিবুর রহমান-এর দলের কর্তৃত্ব প্রমাণ করে? প্রমাণ করে আওয়ামী লীগার ও বামপন্থীদের মুখ্য ভূমিকা?

ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো?

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে যখন প্রতিটি সেক্টরে সেক্টর ও ফোর্সসমূহের অধিনায়কদের সুযোগ্য নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সুসংগঠিত হয়ে ওঠে এবং হানাদারদের অনেকটা কাবু করে আনে, ঠিক তখনই নেতৃত্ব ও স্বার্থ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে- এই ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ভারত সরকার অক্টোবর মাসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে একটি ৭ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। যে চুক্তির শর্তসমূহের কয়েকটি ছিলো নিম্নরূপ:
১.যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত থাকতে পারবে। বাকীদের চাকুরীচ্যুত করা হবে এবং সেই শূণ্যপদ পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
২.বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে।
৩.বাংলাদেশের কোনো নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না।
৪.সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব করবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে।
এই চুক্তির ফলে মুক্তিযুদ্ধের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ভারত সরকার ও ভারতীয় জেনারেলদের করায়ত্তে এসে পড়ে এবং বাংলাদেশকে ভারতের সরাসরি উপনিবেশে পরিণত করার ব্যাবস্থা পাকাপাকি হয়ে যায়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লী মিশন প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর উপস্থিতিতেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং স্বাক্ষরদানের পরপরই সৈয়দ নজরুল ইসলাম মূর্চ্ছা যান। ("বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে 'র' এবং সিআইএ" মাসুদুল হক, পৃষ্ঠা-৬৬)
উপরোক্ত চুক্তি অনুযায়ীই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ভারতীয় জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পন করে, বাংলাদেশের কারো কাছে নয়। এই চুক্তি বলেই হানাদারদের পরাজয়ের পর পর বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এক এক জন ভারতীয় সামরিক অফিসারকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে। বিজয়ের পর পর ভারত যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নেয়, তখন এই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া বাংলাদেশ সরকার বা মুক্তিযোদ্ধাদের আর কিছুই করার থাকে না। এই চুক্তি বলেই ভারত বাংলাদেশ সরকারকে জিজ্ঞাসামাত্র না করে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সহ ৯৩০০০ হানাদার সৈন্যকে অবলীলায় পাকিস্তানের কাছে ফিরিয়ে দেয়।

শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের নিয়ন্ত্রণ পছন্দ করেননি:

শেখ মুজিবুর রহমান কখনোই এই ভারত কেন্দ্রিক, ভারত ভিত্তিক ও ভারত নিয়ন্ত্রিত মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিতে পারেননি। এজন্যই তিনি সত্বরতার সঙ্গে ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশের মাটি থেকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। এজন্যই তিনি ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল তাজউদ্দিন আহমদকে মন্ত্রীসভা থেকে অপসারিত করেছিলেন। এজন্যই তিনি ভারতের ক্ষোভ-উষ্মার তোয়াক্কা না করে ১৯৭৩ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ কি ভারতীয় লুন্ঠন মেনে নেওয়ার জন্য হয়েছিলো?

১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের পরপরই বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর এক এক জন অফিসারকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তারা ১৯৭২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করেছিলো। এ সময়ের মধ্যে পরাজিত পাকিস্তানী সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র, ওদের লুট করা সোনা-দানা, চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে যুদ্ধের ৯ মাসে জমে ওঠা বিশাল পরিমাণ আমদানীকৃত পণ্য সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স ও যন্ত্রপাতিস-সহ অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ভারতে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। 

এই লুন্ঠনে বাধা দেওয়ার অপরাধে, বাংলাদেশের সম্পদ বাংলাদেশে রাখতে চাওয়ার অপরাধে নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে কারারুদ্ধ করা হয়। অন্য সকল সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স অধিনায়ককে 'বীরোত্তম' উপাধিতে ভূষিত করলেও, ঐ অপরাধে মেজর এম এ জলিলকে সর্বপ্রকার খেতাব ও সম্মান থেকে বঞ্চিত করা হয়। 

এ ঘটনা কি এটাই প্রমাণ করে না যে, মুক্তিযুদ্ধের সর্বসত্বের দাবীদাররা ভারতীয় লুটপাটের একনিষ্ঠ সমর্থক ও প্রত্যক্ষ দোসর ছিলেন (এবং আজও আছেন)?

মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা: আবেগ, প্রতারণা না বাস্তবতা?


অনেকেই বলেন যে, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। এ হিসেব যদি সঠিক হয়, তাহলে প্রত্যেক বৃহত্তর জেলায় গড়ে প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার জন এবং প্রত্যেক ইউনিয়নে অন্ততঃ ৬০০/৭০০ জন মানুষ শহীদ হওয়ার কথা। অথচ আওয়ামী লীগের সাবেক এমসিএ জনাব এম এ মোহাইমেন লিখেছেন যে, তাঁরা বহু চেষ্টা করেও বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার (অর্থাৎ লক্ষীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী জেলার) সর্বমোট শহীদের সংখ্যাকে সাড়ে সাত হাজারের ওপরে নিতে পারেননি। অথচ আগরতলার অত্যন্ত নিকটবর্তী হওয়া এবং সুবিধাজনক যোগাযোগব্যবস্থার কারণে এ এলাকাতেই ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিলো সর্বাধিক। তবু, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, অন্যান্য বৃহত্তর জেলায়ও গড়ে ঐ পরিমাণ মানুষই শহীদ হয়েছেন, তাহলেও মোট শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৩০ হাজারের কাছাকাছি। 
শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ ভক্ত- মুক্তিযুদ্ধকালীন ''চরমপত্র''-এর লেখক ও পাঠক এম আর আখতার মুকুল পর্যন্ত তাঁর ''আমি বিজয় দেখেছি'' শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন যে, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ২ (দুই) লক্ষের মতো। 
অথচ, অনেকে বলছে- এই সংখ্যা ৩০ লক্ষ। যদি সত্যিসত্যিই তাইই হয়, তাহলে এই ৩০ লক্ষ শহীদের তালিকা কারো কাছে আছে কি? কোনো তালিকাই যদি করা হয়ে না থাকে তাহলে কম নয়, বেশি নয়, ঠিক ৩০ লক্ষ এই সংখ্যাটি কোথায় পাওয়া গেলো? 

স্বাধীনতার পর পর তো আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ছিলো। কেনো এ দল শহীদদের কোনো তালিকা তৈরি করলো না? 

আসল কথা কি এ নয় যে, ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারী সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবুর রহমান-ই সর্বপ্রথম শহীদের সংখ্যা ৩ লাখ বলতে গিয়ে ইংরেজিতে '৩ মিলিয়ন' শব্দটি বলে ফেলেন; এরপর আওয়ামী লীগের লোকেরা আর পূর্বাপর চিন্তা না করে ঐ সংখ্যাটিই বলতে থাকেন? 

তাদের এ ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই কি প্রমাণিত হয় না যে, জনগণের আবেগকে সংকীর্ণ দলীয় বা গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য তারা মহান শহীদ বা পবিত্র মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও যে কোনো দায়িত্বহীন গল্প ফাঁদতে দ্বিধা করেন না?

মুজিববাদের আবিষ্কার:

শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে, তাঁর সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে কে বা কারা 'মুজিববাদ' আবিষ্কার করলো? কি উদ্দেশ্যে করলো? এ বিষয়টি পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন।
মার্কসবাদ এসেছে মার্কস লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে; একইভাবে এসেছে লেলিনবাদ, মাওবাদ, নাৎসীবাদ ইত্যাদি। কিন্তু বিশ্বে একমাত্র মুজিববাদই এসেছে যাঁর নামে ''বাদ'' তাঁর অজ্ঞাতে এসেছে এবং তা এসেছে তাঁর লিখিত কোনো দর্শনের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে।


বিজয়ের পর অব্যবস্থাপনা, লুটপাট ও হত্যা:

৭১ এর ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগের লোকেরা যে প্রস্তুতিহীনতা, সমন্বয়হীনতা ও বিশৃংখলার পরিচয় দিয়েছিলেন, বিজয়ের পরও ঘটালেন ঠিক একই কাণ্ড। 

আতাউল গনি ওসমানী ও স্বরাষ্ট্র সচিব তসলিম উদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত মুক্তিযুদ্ধের সনদ বা সার্টিফিকেটসমূহ যত্রতত্র যাকে তাকে টোটকা ওষুধের বিজ্ঞাপনের মতোই বিলি করে দেওয়া হলো। মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট দিস্তা বা শ' হিসেবে বিক্রি হতেও দেখা গেলো যেখানে সেখানে। তারাই তো নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের 'মহান ধারক-বাহক' বলে মনে করেন। কেনো তারা সেদিন এভাবে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা সবাইকে একাকার করে দিয়েছিলেন? এটা কি তাদের মহত্ব? নাকি সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নির্মম পরিহাস? নিজেরা বাস্তবিকই অস্ত্র হাতে নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেননি বলেই তারা এই কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করতে পেরেছিলেন, এটাই কি সত্যি নয়? 

রাষ্ট্র-ক্ষমতার সাড়ে ৩ বছরে ক্ষমতাসীনরা বেপরোয়াভাবে ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণ করতে পারলেন, হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যাও করতে পারলেন, অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা তৈরি করতে পারলেন না কেন? রাজকার-আলবদরদের তারা গাল দেন। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা এসব কাণ্ড-কীর্তন করেছেন, তারা রাজাকার-আলবদরদের তুলনায় কোন দিক থেকে শ্রেষ্ঠতর?

বিজয় পরবর্তী লুটপাট ও আত্মসাতের বিরুদ্ধে যাতে কেউ টুঁ শব্দটিও করতে না পারে তার জন্য গঠন করা হয় লাল বাহিনী, রক্ষী বাহিনী (০৭.০৩.৭২) প্রভৃতি গেষ্টাপো বাহিনী। এদের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয় প্রতিবাদী মুক্তিযোদ্ধারা। এসব বাহিনী ও সরকারদলীয় গুন্ডাদের হাতে জাসদ ও সর্বহারা পার্টির হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে প্রাণ দিতে হয়। পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর বাহিনীর হাতে যে পরিমাণ মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়, এসব গেস্টাপো বাহিনীর হাতে নিহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিলো তার দ্বিগুণেরও বেশি। এসব হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে কোনো থানাকে কোনো মামলা নিতেও দেওয়া হয়নি।

বিজয়ের পরও উপনিবেশিক কাঠামো বহাল:

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিজয় অর্জনের পর সেই ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানী আমলের উপনিবেশিক প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনিক কাছামোকেই হুবহু বহাল রাখা হলো। বহাল রাখা হলো একই ব্যক্তিবর্গকে। কেন?
যারা জীবন বাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো, পৃথিবীর বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের পত্তন করেছিলো, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ও প্রশাসন কাঠামো কিংবা দেশ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে আত্মস্থ বা ইনস্টিটিউশানালাইজ করা হলো না। কেনো আওয়ামী লীগের লোকেরা উপনিবেশিক কাঠামোসমূহকে ভাঙার বদলে আরও মজবুত করলেন? কেনো তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আত্মস্থ ও পুনর্বাসিত করলেন না? এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কি তারা দিতে পারবেন?

বিজয় পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার প্রসঙ্গে কিছু আওয়ামী লীগারদের মন্তব্য:

শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত ঘনিষ্ঠ আওয়ামীলীগ দলীয় সাবেক এমসিএ জনাব এমএ মোহাইমেন বলেছেন, ''তাজউদ্দিন কর্তৃক সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন করে দেশ স্বাধীন করাকে শেখ সাহেব সন্তুষ্টির সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেননি।'' ''তাজউদ্দিন যে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশ স্বাধীন করে ফেলতে পারবে, এটা তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) কল্পনাই করতে পারেননি। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর, তাঁর গ্রেফতার হওয়ার পরে দেশ কিভাবে স্বাধীন হয়েছিলো, সে সময়ে কে কি ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো, কার কতোটুকু অবদান ছিলো- এ সম্পর্কে তিনি কোনোদিন কোনো খবরই জানতে চাননি। এ ব্যাপারে কখনো কোনো আলোচনাও হতে দেননি। (ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর, পৃষ্ঠা ১৩৪-১৩৫) 

ছয় (৬) দফার প্রণেতা ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস বলেছেন, ''তাঁর (শেখ মুজিবুর রহমানের) অবর্তমানে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, এটা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তিনি আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করেননি, কি কষ্ট আমরা করেছি অথবা কি যন্ত্রণা আমরা সয়েছি কিংবা যুদ্ধ করেছি কিভাবে'' (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে 'র' এবং সিআইএ, মাহমুদুল হক, পৃষ্ঠা-৯৮)। রুহুল কুদ্দুস আরও বলেছেন যে, অথচ এই বঙ্গবন্ধুই ''পাকিস্তানের জেল থেকে দেশে ফিরেই ক্যান্টনমেন্টে চলে যান পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৯৮)

কেনো শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিভীষিকাময় নয় মাসের কথা জানতে চাইতেন না? কেনো তাঁর শাসনকালে মুক্তিযুদ্ধের আলোচনা রেডিও-টেলিভিশনে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো? কেনো পাকিস্তান থেকে ফিরেই তিনি ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে গিয়েছিলেন? কেনো তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পটভূমি মুজিবনগরে নিজেও কোনোদিন যাননি, অন্য কাউকে যেতেও দেননি? শেখ মুজিবুর রহমান কি আসলেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা চেয়েছিলেন? নাকি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা? নাকি পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার? কেনো আওয়ামী লীগের লোকেরা শেখ মুজিবুর রহমান যা ছিলেন না, তাঁর ওপর তাইই চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের যথার্থ অবদানসমূহকেও বিতর্কিত করে তুলছেন?

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের আচরণ:

১৯৭১ সালে রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটিসমূহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো। কারা ছিলো এই রাজাকার-আলবদর? এদের প্রতি কি ছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গী? এ ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম বিশ্বস্ত কর্মী, তৎকালীন পাবনা জেলা গভর্ণর ও আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ রচিত ''ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টসঃ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড'' শীর্ষক গ্রন্থে বিবৃত তথ্যসমূহ পর্যালোচনা করে দেখা যাক। এই গ্রন্থের ৮৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, ১৯৭০ সাল থেকেই পাকিস্তান আর্মির প্যারামিলিটারী হিসেবে গঠিত হয়েছিলো আলবদর বাহিনী। এর অন্যতম সংগঠক জনাব মুসলেহ উদ্দিনকে শেখ মুজিবুর রহমান-ই এনএসআই-এর গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। 
এটা সুস্পষ্ট যে, রাজাকার আলবদর ছিলো পাকিস্তানের সরকারী বাহিনীরই অংশ, সেখানে আওয়ামী লীগাররা এই রাজাকার-আলবদরদের দায়-দায়িত্ব ইসলামপন্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায় কেনো? শেখ মুজিবুর রহমানের উপরোক্ত ভূমিকা সম্পর্কেই বা তাদের মূল্যায়ন কি?

যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া: 

মুক্তিযুদ্ধের পর পর ক্ষমতাসীনরা ১৫০০ জন পাকিস্তানীকে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এতোজন পাকিস্তানীকে শাস্তি দেওয়ার সাধ্য তাদের নেই- একথা বুঝতে পেরে পরবর্তীতে তারা যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা কমিয়ে ১৯৫ জনে নিয়ে আসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ১৯৫ জনের একজনেরও কেশাগ্র স্পর্শ তাদের সাধ্যে কুলোয় না। 
বাংলাদেশের মতামতের কোনো তোয়াক্কাই না করে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সিমলা চুক্তি সম্পাদিত করে এবং তদনুযায়ী ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীসহ আত্মসমর্পনকারী ৯৩০০০ পাকিস্তানী সৈন্যের সকলকেই পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করে দেয় এবং বিনিময়ে বন্দী ভারতীয় সৈন্যদের মুক্ত করে নেয়। 

আওয়ামী লীগারদের দ্বারা চিহ্নিত মূল অপরাধীদের স্পর্শ পর্যন্ত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর তারা লেগে পড়লেন রাজাকার-আলবদর ধরার নামে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত জিঘাংসার কাজে। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারী জারি করা হলো বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) আদেশ ১৯৭২। এর আইনে ৩৭,৪৩১ জন ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে বিচার হয় ২৮৪৮ জনের। বিচারে মাত্র ৭৫৬ জন দন্ডপ্রাপ্ত হয় এবং ২০৯৬ জন বেকসুর খালাশ পায়। অর্থাৎ দেখা যায় যে, দালাল আইনে বন্দীদের শতকরা ৭০.৬ জনই ছিলো নিরপরাধ। 

এই প্রহসন বুঝতে পেরে শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন সকল ব্যক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তাঁরই ব্যক্তিগত নির্দেশে সকলকে এক সপ্তাহের মধ্যে মুক্ত করে দেওয়া হয়, যাতে তারা তৃতীয় বিজয় দিবসে অংশগ্রহণ করতে সমর্থ হয়। মোট কথা, ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান স্বহস্তেই এই ইস্যুর কবর দিয়ে দেন।

লুটপাটের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা :

বিজয়ের পর পর সম্ভবতঃ লুটপাটের তান্ডবকে আড়াল করার জন্যই রাজাকার-আলবদর ইস্যু নিয়ে এমন প্রচন্ড ক্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয় যে, যেনো কেউ ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সীমাহীন অপকর্মের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করার সাহস না পায়। তখন কেউ যদি অন্যায় অবিচারের সামান্যতম প্রতিবাদও করতো, অমনি তাকে রাজাকার-আলবদর বলে আখ্যায়িত করে তার ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালানোর পর জেলখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হতো কিংবা সাদা জীপে তুলে নেওয়া হতো। সাদা জীপে একবার যাদের তোলা হতো, আর কোনোদিন তাদের খোঁজ পাওয়া যেতো না। 

এই শ্বেতসন্ত্রাসের ছত্রছায়ায় যে কাজগুলো করা হয়েছিলো তার আংশিক মোটামুটি নিম্নরূপঃ
ক.প্রতিটি পরিত্যক্ত শিল্প-কারখানায় ক্ষমতাসীন দলের এক এক জনকে প্রশাসক হিসেবে বসিয়ে দেওয়া হলো; শতকরা প্রায় ৯৯টি ক্ষেত্রেই এসব প্রশাসকদের না ছিলো কোনো অভিজ্ঞতা, না ছিলো তেমন শিক্ষাদীক্ষা।
খ.আন্তর্জাতিক পাটের বাজার চিরতরে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হলো।
গ.পরিত্যক্ত সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকান-পাট, গুদাম-আড়ৎ, সিনেমা হল সবই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর নেতা-কর্মীরা দখল করে নিয়েছিলো।
ঘ.পারমিট, রাস্তাঘাট-ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণের কন্ট্রাক্ট, ডিলারশীপ-ডিস্ট্রিবিউটরশীপ ইত্যাদির একচেটিয়া মালিক হয়েছিলো ক্ষমতাসীন দলের লোক।

এই পটভূমিতে দেশীবিদেশী পত্রপত্রিকায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর লুটপাট ও রিলিফ চুরির খবরাখবর ছাপা হতে থাকলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি স্নেহ-মমতা বশতঃ প্রকাশ্য জনসভা ডেকে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, ''এতোদিন অন্যেরা খাইছে, এইবার আমার লোকেরা খাইব''। তাঁর দলের লোকদের যারা সমালোচনা করতো, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি কঠোর ভাষায় বলেছিলেন, ''লালঘোড়া দাবড়াইয়া দিমু"। দিয়েছিলেনও! কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও দলীয় নেতা-কর্মীদের মাত্রাহীন লুটপাট ও জাতীয় সম্পদ আত্মসাতে অতিষ্ট হয়ে গেলেন এবং প্রকাশ্য জনসভায় পরম আক্ষেপে বলে ফেললেন, "চাটার দল সব খেয়ে শেষ করে ফেলেছে"। কারা এই চাটার দল? কারা দেশটাকে খেয়ে শেষ করে ফেলেছিলো? আওয়ামী লীগই নয় কি?

১৯৭২-৭৫: স্বর্ণযুগ, না কালো যুগ?

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি ও শ্বেত সন্ত্রাসের এই দুঃসময়কেই অনেকেই বলতে চায় 'স্বর্ণযুগ'। স্বর্ণযুগই বটে। কিন্তু কাদের স্বর্ণযুগ? জনগণের? না আওয়ামী লীগারদের? 

বিজয়ের পর থেকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত সময়ে ক্ষমতাসীনরা সিরাজ সিকদার, এডভোকেট মোশারফ হোসেন সহ অন্তত ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক নেতা-কর্মী হত্যা করেছিলেন এবং কোনো থানাকে এসব হত্যার বিরুদ্ধে একটি মামলাও গ্রহণ করতে দেননি। এছাড়া কতো বাড়ি-ঘর যে তারা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, কতোজনকে যে সর্বস্বান্ত করেছিলেন, কতো মানুষকে যে পঙ্গু করে দিয়েছিলেন তার তো কোনো সীমাসাক্ষ্যই নেই। 

ক্ষমতাসীনরা ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাশ করেন এবং এর ১১৭ ক (৪) ধারা অনুযায়ী ২৪-০২-৭৫ তারিখে দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একক দল ''বাকশাল'' গঠন করেন এবং হুবহু হিটলার ও মুসোলিনীর নাৎসী দলের অনুকরণে আওয়াজ তোলেন, ''এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ''।

১৯৭৫ সালের জুন মাসে চারটি মাত্র পত্রিকাকে সরকারী মালিকানায় নিয়ে, বাদবাকি সমস্ত পত্র-পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং বিরোধী মতামতকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। অগণতান্ত্রিক চতুর্থ সংশোধনীর প্রতিবাদ করার দরুন এবং বাকশালে যোগদান না করার ফলে মুক্তিযুদ্ধে প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানী এবং ব্যারিষ্টার মাঈনুল হোসেনের সদস্যপদও বাতিল হয়ে যায়। 

সব দল নিষিদ্ধ করে একদল গঠন করা এবং তাতে সবাইকে যোগ দিতে বাধ্য করা কোন ধরণের গণতন্ত্র? কোন ধরণের গণতন্ত্র সমস্ত পত্র-পত্রিকা নিষিদ্ধ করে দেওয়া? এগুলোই যদি গণতন্ত্র হয়, তাহলে নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার ও বর্বরতার সংজ্ঞা কি?

শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর পর তাঁর সমর্থকদের বীরত্ব কোথায় ছিলো?

দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল, রিলিফ আত্মসাৎ, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ধনীক শ্রেণী সৃষ্টি, হত্যা, নির্যাতন, হাইজ্যাক, কালাকানুন, সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ, একদলীয় স্বৈরাচার, অন্ধ ভারত ভক্তি, দুর্ভিক্ষ, পাচার ইত্যাদির মাধ্যমে আওয়ামী লীগাররা দেশকে এক মহা বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলো। 

পরে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন। তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার কোথাও শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদে ৫ জন লোকের একটা মিছিল পর্যন্ত বের করা হলো না। কেনো? কর্ণেল ফারুক রশীদ ডালিমের ভয়ে? কুড়িগ্রাম, কক্সবাজার কিংবা পটুয়াখালীতে ফারুক রশীদদের তখন কি শক্তি ছিলো? ঢাকা শহরের বাইরে কোথায় তাদের ট্যাংঙ্ক-কামান ছিলো? কেনো আওয়ামী লীগাররা সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান এর পক্ষে একটি বুলেটও ছুঁড়লেন না? তারা তো দাবি করেছেন, তারাই ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করে ফেলেছেন। সেদিন তাদের তথাকথিত বীরত্ব কোথায় ছিলো? নাকি রক্ষীবাহিনীর নীরবতার পেছনেও ছিলো তাদের গভীর ষড়যন্ত্র? 

শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদ না করতে পারলেও একটি কাজ কিন্তু তারা ঠিকই করতে পারলেন। শেখ মুজিবুর রহমান এর রক্তাক্ত লাশ তখনও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির সিঁড়ির ওপর পড়ে আছে; সেই লাশের প্রতি ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের কাজে, নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের প্রতিযোগিতায়। কি ব্যাখ্যা তাদের এই আচরণের?

বাকশাল না ফ্রি ইকোনোমি?

কেনো আওয়ামী লীগাররা বাকশাল কনসেপ্টের সম্পূর্ণ বিপরীত ''ফ্রি ইকোনোমি''র কর্মসূচী হাজির করেছেন? তাহলে তারা কি বলতে চান শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কায়েম করে ভুল করেছিলেন?

আওয়ামী লীগ না করলে কি জীবনের মূল্য নেই?

শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবার ও দলীয় নেতাদের হত্যা যেমন অপরাধ, ঠিক তেমনি অপরাধ বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক হত্যা। আওয়ামী লীগাররা কি মনে করেন যে, শুধু তাদের দল ও গোষ্ঠীর লোকদের হত্যাকান্ডেরই বিচার হওয়া উচিত? কিন্তু তাদের হাতে নিহতদের হত্যাকান্ডের বিচার হওয়া উচিত নয়? তাহলে কি ব্যাপারটি এই যে, তারা কাউকে হত্যা করলে সেটা বৈধ; কিন্তু তাদের কাউকে হত্যা করা হলে সেটা অবৈধ? 

তাদের বিচারও অবশ্যই করতে হবে, যারা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র হনন করেছে, পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ, লাইসেন্স পারমিটবাজী, রিলিফ চুরি, ভারতে সম্পদ পাচার ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেরা সম্পদের পাহাড় বানিয়েছে এবং গোটা জাতিকে দুঃসহ শোষণ ও দারিদ্রের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, ভারতে ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ পাচার করেছে অথবা পাচারে সহায়তা করেছে, ভারতে পাট পাচার করে শূণ্য গুদামে আগুন লাগিয়েছে, কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, একদলীয় স্বৈরাচার কায়েমের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এবং সেনাবাহিনী ও সরকারী কর্মকর্তাদের জবরদস্তিমূলকভাবে রাজনীতিতে টেনে এনেছে। যারা এসব কান্ড করেছে তাদের অপরাধ রাজাকার কিংবা আলবদরদের তুলনায় কোন অংশে কম? 

আজ যদি বিএনপির সমর্থকরা কিংবা ইসলামপন্থীরা আরেকটা গণ আদালত বা জনতার মঞ্চ গঠন করে সমান সংখ্যক জনতার উপস্থিতিতে সিআর দত্ত, শেখ হাসিনা, ইনু, মেনন প্রমুখের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে দেয়- তাহলে কি হবে?

স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ, পাকিস্তানের চেয়ে সর্বদিক দিয়ে এগিয়ে যেতে পারলো না কেনো?

স্বাধীনতার এতো বছর পর বাংলাদেশের অবস্থা তো পাকিস্তানের তুলনায় অনেক ভালো হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু বাস্তবে কি ঘটেছে? পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় কি বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এর চেয়ে আজও বেশি নয়? পাকিস্তান আজ জঙ্গীবিমান ও পারমানবিক বোমা পর্যন্ত তৈরি করছে, অথচ আমরা মোটর গাড়ির একটা প্লাগও তৈরি করতে পারছি না। পাকিস্তানের তুলনায় আমাদের সম্পদ ও সম্ভাবনা তো অনেক গুণ বেশি ছিলো। তবু কেনো এমন হলো? কারা এই পশ্চাৎপদতার জন্য দায়ী? 
ইসলামপন্থীরা, অর্থাৎ যাঁরা কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে বদ্ধপরিকর, তাঁরা তো কখনোই যাননি বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায়। আজ পর্যন্ত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কোনো সংবিধানই কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ছিলো না। স্বৈরাচার প্রণীতই হোক আর গণতন্ত্রী প্রণীতই হোক, প্রতিটি সংবিধানই ছিলো পুঁজিবাদভিত্তিক- সুতরাং ইসলাম বিরোধী। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান, পেনাল কোড, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড, সিভিল কোড, টর্ট, আদালতের বিন্যাস, প্রশাসন ব্যবস্থা ইত্যাদির সঙ্গে কুরআন-সুন্নাহর কোনোই সম্পর্ক নেই। 
আজ যে বিশ্বে বাংলাদেশের প্রায় সর্বনিম্ন মাথাপিছু আয়, বিপুল সংখ্যক মানুষ যে দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করছে, অনেক কর্মক্ষম মানুষ যে বেকার, ১ শতাংশ মানুষের হাতে যে মোট জাতীয় সম্পদের সিংহভাগ পুঞ্জীভূত- এর জন্য দায়ী কারা? যারা ক্ষমতায় ছিলো তারা? নাকি যে-ই ইসলামপন্থীরা কখনো রাষ্ট্রক্ষমতার ধারে কাছেও যায়নি- তারা?

ইসলামপন্থীদের অনেকেই স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো না কেনো?

১৯৭১ সালে ইসলামপন্থীদের একটা বড় অংশ সম্ভবতঃ দু'টি কারণে ভারতকেন্দ্রিক, ভারতভিত্তিক ও ভারতনিয়ন্ত্রিত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। 
প্রথমতঃ তাঁদের ভয় ছিলো যে, বিশ্বের (তৎকালীন) বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে এ অঞ্চলে ইসলামের অধিকতর বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। 
দ্বিতীয়তঃ তাঁরা আশংকা করেছিলেন যে, ভারতের আশ্রয়, সহায়তা, ট্রেনিং ও নিয়ন্ত্রণে অনুষ্ঠিত যুদ্ধের ফলে অর্জিত বাংলাদেশ কার্যত ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও ভারতীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থেরই লীলাভূমিতে পরিণত হবে। 
বলাবাহুল্য, ইসলামপন্থীদের প্রথম ভয়টি যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়নি। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশে ইসলাম আদৌ বিপন্ন হয়নি; বরং ইসলামের প্রতি মানুষের নিষ্ঠাই বৃদ্ধি পেয়েছে। 

কিন্তু তাঁদের দ্বিতীয় শংকাটি? সেটাও কি ভুল প্রমাণিত হয়েছে? বিজয়ের পর বাংলাদেশ সরকারকেই বাংলাদেশে আসতে না দেওয়া, ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট, আন্তর্জাতিক পাটের বাজার দখল, ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীসহ ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যকে বাংলাদেশের মতামতের তোয়াক্কা না করে পাকিস্তানের হাতে সমর্পণ, বাংলাদেশের বাজেট বাংলাদেশের পার্লামেন্টে পেশ হওয়ার আগেই আকাশবাণীর দিল্লী কেন্দ্র থেকে ঘোষণা, তালপট্টি দ্বীপ দখল, গঙ্গা-তিস্তা ইত্যাদিতে বাঁধ নির্মানের মাধ্যমে একতরফা পানি প্রত্যাহার, তিন বিঘা করিডোরের উপর ভারতের একক নিয়ন্ত্রণ, বাংলাদেশকে ভারতের বৈধ-অবৈধ পণ্যের একচেটিয়া বাজারে রূপান্তর, বাংলাদেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে আমদানীকৃত পণ্য ভারতে পাচারের ব্যবস্থা, অপারেশন পুশ ব্যাক, বঙ্গসেনা ও শান্তিবাহিনী ইত্যাদির সৃষ্টি ও সযত্নে লালন প্রভৃতি কি একথাই প্রমাণ করে না যে, ১৯৭১ সালে ইসলামপন্থীদের ভয় বা আশংকা সম্পূর্ণ অমূলক ছিলো না? 

তাছাড়া ইসলামপন্থীদের ভারত যাওয়ার কোনো পথই কি আওয়ামী লীগাররা রেখেছিলেন? ভারতের হিন্দু সরকারও কি ইসলামপন্থীদের আদৌ আশ্রয়, অস্ত্র ও ট্রেনিং দিতো? আওয়ামী লীগাররা সবাই ভালো করে জানেন, ইসলামপন্থীদের ভারতের মাটিতে পেলে আওয়ামী লীগাররা তাদের এক মুহূর্তও বরদাস্ত করতেন না; আশ্রয়, অস্ত্র ও ট্রেনিং দেওয়া তো দূরের কথা, আওয়ামী লীগাররা এবং দাদারা মিলে তাদের দেখামাত্রই কচুকাটা করে ছাড়তেন। 

এ অবস্থায়, প্রাণে বাঁচতে হলে ইসলামপন্থীদের এদেশে থেকে যাওয়া ছাড়া অপর কোনো উপায় ছিলো কি? অবশ্যই ছিলো না। আর ইয়াহিয়া-ভূট্টো চক্র এখানে অবস্থানকারী কাউকে নিরপেক্ষ থাকার কোনো অবকাশই দিচ্ছিলো না। এটাই কি কঠোর সত্য নয়?

গণ আদালত আর জনতার মঞ্চ:

"গণ আদালত" বা "জনতার মঞ্চ" স্বাধীনতার এতো বছর পর গঠিত হলো কেনো? ন্যুরেমবার্গের আদালতের মতো বিজয়ের ঠিক পর পরই আদালত গঠন করা হলো না কেনো?

যারা "গণ আদালত" বা "জনতার মঞ্চ" ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন জনের ফাঁসির রায় ঘোষণা করছেন সেই অভিযুক্ত লোকগুলো তো অনেক বছর ধরে নিজ নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছেন এবং প্রকাশ্যভাবে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বও পালন করেছেন। এটা কি আওয়ামী লীগাররা এতো বছরেও টের পাননি? বিগত কোনো এক নির্বাচনের সময় তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বিচারপতি বদরুল হুদা চৌধুরীকে অনুকম্পা ভিক্ষার জন্য অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে যখন পাঠানো হয় তখন বুঝি তারা জানতেন না যে তিনিই ৭১ এর 'ঘাতক-দালাল' এবং অনাগরিক? অধ্যাপক গোলাম আযমের সংগঠন যখন বিগত কোনো এক নির্বাচনে ৪২ লক্ষ ভোট এবং পার্লামেন্টে ১৮ টি আসন পেয়ে গেলো, এই সংগঠন যখন সরকার গঠনের সময় আওয়ামী লীগারদের সমর্থন না দিয়ে বিএনপিকে সমর্থন দিলো এবং সর্বোপরি যখন অধ্যাপক গোলাম আযম তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে সমর্থন দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন, ঠিক তারপরই বুঝি তারা টের পেলেন যে, তিনিই ৭১ এর ঘাতক-দালাল ও অনাগরিক? 

তাছাড়া জামায়াতের ভোট ব্যাংক ১৮ দলের পক্ষে ব্যবহৃত হবে; তখন আর ১৪ দল বিজয়ী হতে পারবে না এই আশংকার কারণেই ইদানীং এ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে হঠাৎ এতো জোর প্রচার- একথাই কি সঠিক নয়?

সব বীরাঙ্গনাকেই কি সমান দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়?

যেসব হতভাগিনী সীমান্তের ওপারে গিয়ে নেতা-তস্যনেতাদের রক্ষিতা হতে বাধ্য হয়েছিলেন কিংবা ভারতীয়দের দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিলেন, তাঁদের সংখ্যাও তো বিশাল-বিপুল। হানাদারদের দ্বারা নির্যাতিতা বীরাঙ্গনাদের পাশাপাশি এসব বীরাঙ্গনাদের কথাও আওয়ামী লীগারদের মনে পড়ে কি?

দেশদ্রোহিতা কারো জন্য বৈধ; আর কারো জন্য কি অবৈধ?

আওয়ামী লীগাররা অধ্যাপক গোলাম আযম এর শাস্তি চাইছেন, খুব ভালো কথা। কিন্তু মেজর জেনারেল সি আর দত্ত যে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ আহুত প্রকাশ্য সম্মেলনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য ভারতের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানালেন,তখন তারা ঐ আহ্বানের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন দিলেন কেনো? কেনো প্রতিবাদের একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না? অথচ সি আর দত্তের এই আচরণ যে কোনো বিচারেই চূড়ান্ত দেশদ্রোহিতা বা হাই ট্রিজন। 

ভারতের কোনো মুসলিম নাগরিক যদি ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতেরই অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য পাকিস্তান কিংবা ইরানের প্রতি আহ্বান জানাতো,তাহলে সেই মুসলিম ব্যক্তিটির পরিণতি কি হতো? ভারত সরকার বা ভারতের কোনো নাগরিক কি তা সহ্য করতো? সবাই ভালো করেই জানেন, বরদাস্ত তো দূরের কথা পরিণতিতে ওই মুসলিম ব্যক্তিটির শরীরের হাড়মাংস ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা তো হতোই, উপরন্তু এই ঘটনাকে উপলক্ষ করে মুসলিম বিরোধী একটি দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়ে হাজার হাজার মুসলিমের প্রাণ হরণ করা হতো। 

অথচ, আওয়ামী লীগাররা এখানে সি আর দত্তের পক্ষই অবলম্বন করলেন। সি আর দত্তদের সকল কর্মকান্ডের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন না দিলে বিদেশী প্রভুরা রাগ করবেন,এটাই কি তাদের ভয়? নাকি তারা মনে করেন যে, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ, ভারতের দাসত্ব এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের যুপকাষ্ঠে আত্মবলিদানই হলো সত্যিকার প্রগতিশীলতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও দেশপ্রেম?

বাংলাদেশ-ভক্তরা, ভারত-ভক্ত হওয়ার কোনো কারণ আছে কি?

সমগ্র ভারতব্যাপী কি বিশাল পরিমাণ মসজিদ হিন্দুরা দখল করেছে তা প্রায় সবার জানা। ভারত ১৯৪৭ সাল থেকে এ যাবৎ কাশ্মীরের মুক্তিকামী মুসলিমদের ওপর লাগাতার নির্যাতন চালিয়ে আসছে, হাজার হাজার মুসলিমকে হত্যা করেছে, ভারতীয় সৈন্যেরা অসংখ্য কাশ্মিরী মুসলিম রমণীর শ্লীলতা হানি ঘটিয়েছে এবং এই নির্যাতনের প্রক্রিয়াকে দিনে দিনে ভয়াবহতর করে তোলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগাররাও কি মনে করেন, হিন্দুদের দ্বারা মসজিদ দখল, মুসলিম হত্যা ও মুসলিম নারী ধর্ষণ খুবই ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল কাজ?

১৯৩৩ সালে লিখিত ''হিন্দু মুসলিম মিলন'' শীর্ষক প্রবন্ধে শরৎচন্দ্র বলেছেন, ''হিন্দুস্তান হিন্দুদের দেশ। সুতরাং এদেশকে অধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব একা হিন্দুদের''। বিমলানন্দ শাসমল ''ভারত কি করে ভাগ হলো'' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, হিন্দুরাই মুসলিম বিদ্বেষের দরুন ভারতকে বিভক্ত করেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতির একচ্ছত্র দাবিদার, উপরোক্ত বিষয়সমূহ সম্পর্কে তাঁদের মতামত কি?

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা- সভাপতি মানবেন্দ্র নাথ রায় ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত "Historical Role of Islam" গ্রন্থে বলেছেন, ''ভারতের বেশির ভাগ মানুষই গোঁড়া হিন্দু। মুসলিম মাত্রই তাদের কাছে ''ম্লেচ্ছ'', ''অশুচি'' ''বর্বর''।

ভারতে মুসলিমদের যে সংখ্যা তাতে সরকারী-বেসরকারী কর্মকান্ড ও ব্যবসা বাণিজ্যে মুসলিমদের যে অংশ থাকার কথা (প্রায় ১৫%) বাস্তবে তার ৫ ভাগের ১ ভাগও (প্রায় ৩%) মুসলিম খুঁজে পাওয়া যায় না। আওয়ামী লীগাররা কি বলতে চান, এ অবস্থা আসলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতারই অনাবিল ফলশ্রুতি? ভারতের অসাম্প্রদায়িকতারই অব্যর্থ লক্ষণ? তাই, সার্বিক বিচারে, বাংলাদেশের ভক্তরা স্বাভাবিক কারণেই ভারত-ভক্ত হতে পারে না।

শেখ মুজিবুর রহমান কি অতোটা 'ধর্মনিরপেক্ষ' ছিলেন?
আওয়ামী লীগাররা নিজেদেরকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সৈনিক বলে দাবি করেন; কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান কি আদৌ তাদের মতো ধর্মনিরপেক্ষ তথা ধর্মহীন ছিলেন? 
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেই তাঁর প্রথম ভাষণে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশই হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম (বর্তমানে তৃতীয়) মুসলিম দেশ। তিনিই কথিত রাজাকার-আলবদরদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন; তিনিই ভূট্টোকে দাওয়াত করে এনেছিলেন বাংলাদেশে। 
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, আওয়ামী লীগাররা কি সত্যি সত্যিই শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী?


শেখ মুজিবুর রহমান কি অতোটা ভারতপ্রেমী আর পাকিস্তানবিদ্বেষী ছিলেন?

ভূট্টো-ইয়াহিয়া চক্রই বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পৈশাচিক উল্লাসে হত্যা করেছে, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে আশ্রয়, খাদ্য, নিরাপত্তা দিয়ে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে। ৩ লক্ষাধিক বাঙালিকে পাকিস্তানে আটকে রেখে, ৮ জানুয়ারী ১৯৭২ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানকে এই ভূট্টোই মুক্তি দিয়ে দেয়। 

ভারতের আপত্তিকে উপেক্ষা করে শেখ মুজিবুর রহমানই ১৯৭৩ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান গমন করেন এবং এতে ভারত বিক্ষুব্ধ হয় ও কোলকাতায় প্রকাশ্য রাজপথে হিন্দুরা শেখ মুজিবুর রহমান এর কুশপুত্তলিকা ভস্মীভূত করে। এখানেই শেষ নয়। শেখ মুজিবুর রহমানই ৭১ এর গণহত্যার মূলনায়ক জুলফিকার আলী ভূট্টোকে বাংলাদেশ সফরে আসার দাওয়াত দিলে, ১৯৭৪ সালের ২৪ জুন জুলফিকার আলী ভূট্টো ১০৭ জন সদস্যের এক বিশাল বহর নিয়ে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফের আসে এবং এই ভূট্টোকে ইন্দিরা গান্ধিরই সমকক্ষ রাজকীয় সম্বর্ধনা প্রদান করা হয়। এমতাবস্থায়, শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কন্যা সম্পর্কে আওয়ামী লীগাররা কি মন্তব্য করবেন? 

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের জন্য ইন্দিরাজীর প্রতি এবং সপরিবারে জীবন রক্ষার জন্য ভূট্টোর প্রতি শেখ মুজিবুর রহমান এর ছিলো প্রায় সমতুল্য কৃতজ্ঞতাবোধ এবং এজন্যই তিনি ইন্দিরাকে সন্তুষ্ট করার জন্য সই করেছিলেন ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তিতে, আর ভূট্টোকে খুশি করার জন্য যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে।

মসজিদে রাজনীতি করার ব্যাপারে কোনটি গ্রহণীয়? ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি; না আওয়ামী লীগের?

আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) যেখানে ঈমান-ইবাদাতকে ইসলামী রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থব্যবস্থা ইত্যাদির সঙ্গে পরস্পর গ্রথিত, সম্পূরক ও অবিচ্ছেদ্য করে দিয়েছেন, সেখানে এর কোনো একটি দিককে বাদ দেওয়ার অধিকার আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদেরকে কে দিয়েছে? 

স্বয়ং মহানবী (সা.) মসজিদে নববীতে বসে ইসলামী রাষ্ট্রের যাবতীয় শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন। এরপরও ইসলামী রাজনীতির আলোচনা মসজিদে করা যাবে না কেনো? কোন যুক্তিতে? 

আওয়ামী লীগাররা কি ইসলামপন্থীদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী 'সমাজতন্ত্র' বা 'লিংকনীয় গণতন্ত্র' এর চর্চা করতে রাজি হবেন? যদি তা না হন, তাহলে মুসলিমরাই বা তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ইসলামী দর্শনের চর্চা করবে কেনো? কোন যুক্তিতে? কেনো আল্লাহ-রাসূল (সা.) এর নির্দেশ বাদ দিয়ে কোনো সত্যিকার মুসলিম তাদের নির্দেশ ও প্রেসক্রিপশন মানতে যাবে? এটা কি একটি অতি অর্বাচীন দাবি নয়? 

আর তারা যদি মনে করেন যে, কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ মানতে তারা রাজি নন- তাহলে ড. আহমদ শরীফ এর মতো স্পষ্ট ভাষায় তারা কেনো বলতে পারছেন না যে, তারাও আল্লাহতে তথা আস্তিক্যে বিশ্বাস করেন না এবং তারাও কাফের (বা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) ?

সমাজতন্ত্রের পতনের পর সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধানতম টার্গেট হলো ইসলাম:

সমাজতন্ত্রের পতনের পর আজ সাম্রাজ্যবাদী আঘাতের মূল লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছে ইসলাম এবং মুসলিম বিশ্ব। এদিকে আওয়ামী লীগারর ও বামপন্থীরাও তাদের সর্বশক্তি নিয়ে আঘাতের পর আঘাত হেনে চলেছেন ইসলামের (বা ইসলামী শক্তি বা দলের) ওপর। 

তাহলে, ব্যাপারটা কি এই দাঁড়ায় না যে, সাম্রাজ্যবাদী-ইহুদীবাদী- ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এবং আওয়ামী লীগারদের স্বার্থ ও লক্ষ্য সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন? এটাই কি সরল সত্য নয় যে, প্রগতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামাবলীর আড়ালে তারাই বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ ইহুদিবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের চর, তল্পিবাহক ও ক্রীড়নক?


দোষ কি শুধু ইসলামী দলেরই?

ইসলামের ওপর আথাত হানার অন্যতম কৌশল হিসেবে, বাংলাদেশে যেখানে যতো খুন-খারবী হচ্ছে- তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব ইসলামপন্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের এই অদ্ভুত আচরণের দ্বারা দেশের প্রকৃত আততায়ী ও দুষ্কৃতিকারীদের যে শুধু আড়াল করা হচ্ছে তাইই নয়- তাদের সরাসরি প্রশ্রয়, লালন ও পৃষ্ঠপোষকতাও প্রদান করা হচ্ছে। দেশের সমস্ত খুনী-দুষ্কৃতিকারীরা আজ উপলব্ধি করছে যে, তারা যতো অপকর্মই করুক না কেনো, 'প্রগতিবাদী-ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী'রা তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব ইসলামপন্থীদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেবেন; ফলে দেশের প্রকৃত পেশাদার খুনী দুষ্কৃতিকারী অপরাধীরা সন্দেহ ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে এবং তারা একের পর এক খুন-খারাবী-দস্যুতা নির্বিবাদে চালিয়ে যেতে সমর্থ হবে। বাস্তবে হচ্ছেও তাই। 

এভাবে আওয়ামী লীগাররা যে দেশের তাবৎ খুনী-দস্যু-সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাতে জাতির কোনো কল্যাণ সাধিত হচ্ছে? ইসলামপন্থীদের ওপর আঘাত হানার এই অপকৌশল চালাতে গিয়ে কেনো তারা ১৬ কোটি মানুষের সুখ-শান্তি ও স্বস্তিকে বিপন্ন করে তুলেছেন? কেনো সন্ত্রাস-দুর্নীতি-অরাজকতায় দেশটাকে ভরে দিচ্ছেন? এটা কোন ধরনের দেশপ্রেম? কি রকম জনদরদ?

বাংলাদেশের জনগণ কত শতাংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক?

আওয়ামী লীগারদের দাবি শুনে মনে হয়- দেশের ১৬ কোটি লোক তাদের পক্ষে। কিন্তু বিগত নির্বাচনসমূহের গড় ফলাফল পর্যালোচনা করলে কি এটাই বুঝা যায় না যে, দেশের অধিকাংশ লোক তাদের কার্যক্রম ও ভূমিকাকে প্রত্যাখ্যান করেন? বাংলাদেশের বেশির লোক কি আদৌ স্বীকার করে যে-মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আওয়ামী লীগের একক কৃতিত্ব? তারা কি স্বীকার করে যে, আওয়ামী লীগাররাই স্বাধীনতার চিন্তা-চেতনার একমাত্র ধারক? তারা কি স্বীকার করে যে, ১৬.১২.৭১ থেকে ১৫.০৮.৭৫ পর্যন্ত সময়টাই বাংলাদেশের স্বর্ণযুগ? তারা কি স্বীকার করে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা ধর্মহীনতার তত্ত্বই দেশের জন্য কল্যাণকর?

ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা করেছিলো মমত্ববোধ থেকে? না স্বার্থচিন্তা থেকে?

ভারত যদি সেদিন পলায়নপর নেতা-কর্মীদের আশ্রয় না দিতো, তাহলে যে প্রস্তুতি মুক্তিযুদ্ধের একচ্ছত্র কৃতিত্বের দাবিদারদের ছিলো, তাতে একমাসের মধ্যেই তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হানাদার বাহিনীর পক্ষে আদৌ কষ্টসাধ্য হতো না। তারপর বাঙালী সামরিক কর্মকর্তা জওয়ান ও নতুন তারুণ্যের সংমিশ্রণে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠতো, দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের সূচনা ঘটতো, বাংলাদেশের আপামর জনগণ সত্যিকার অর্থেই মুক্তির স্বাদ পেতে পারতো। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে, আজ যাঁরা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত কৃতিত্ব কুক্ষিগত করতে চাইছেন- তাঁদের অস্তিত্ব তো নি:সন্দেহে মুছে যেতো। 
ভারত সেদিন পলায়নপর বাঙ্গালীদের আশ্রয়, অস্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলো বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের প্রতি কোনো মমত্ববোধ থেকে নয়, বরং ভারতেরই নিরংকুশ স্বার্থবোধ থেকে। হিন্দু ভারত প্রবল মুসলিম প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে ধ্বংস বা হীনবল করার এই সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিলো।

আজকের উচ্চকন্ঠ বক্তারা কি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা?

আজ যে দল ও গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সমস্ত কৃতিত্ব আত্মসাৎ করতে চাইছে, এই দল ও গোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় বা জেলা পর্যায়ের তেমন কোনো নেতা বা সাংসদই মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেননি। বাংলাদেশের অকুতভয় তরুণ ও জওয়ানরা যখন হানাদারদের সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত, তখন এঁরা যুদ্ধের ময়দান থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে জীবন-যৌবনকে উপভোগ করছিলেন এবং সম্পদ ও ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ব্যস্ত ছিলেন। 

সাহিত্যিক ও চিত্র পরিচালক জহির রায়হান এঁদের ভারতে অবস্থান কালীন যাবতীয় কর্মকান্ডের প্রামাণ্য চিত্র তুলে আনেন এবং তাই-ই হয়ে দাঁড়ায় বিজয়ের দীর্ঘদিন পর (৩০.০৭.৭২) তাঁর অকাল মৃত্যুর একমাত্র কারণ। তাঁর দালিলিক রীল সমূহও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

অপরদিকে অধিকাংশ শহীদ বুদ্ধিজীবীরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, তারা ঢাকা শহরেই স্ব স্ব বাসাবাড়িতেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছিলেন; অনেকে ক্লাস নেওয়ার জন্য রীতিমতো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতও শুরু করে দিয়েছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের তালিকা করা হলো না কেনো?

১৯৭০-এর নির্বাচনের বিজয়ের ধারাবাহিকতার সূত্র ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারা না তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তালিকা, না তৈরি করে শহীদদের কোনো তালিকা। 

মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলাদেশে কি করবে তার কোনো তোয়াক্কা না করে সেই উপনিবেশিক আমলাতন্ত্র ও প্রতিরক্ষা কাঠামোকেই পুনর্বহাল করা হয়। ফলে দিগদর্শনহীন মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ সম্পদ আহরনে নেমে পড়ে, কেউ সামান্য জীবিকার সন্ধানে যত্রতত্র ঘুরতে থাকে, কেউ মুটে-মজুর-রিক্সা চালকে পরিণত হয়, কেউ যোগ দেয় সরকার বিরোধী রাজনীতিতে। জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই হয়ে পড়ে অসহায় বেকারত্বের শিকার। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই রাজাকার-আলবদরদের ভূমিকার চেয়েও ছিলো অনেক বেশি ক্ষতিকর।


বাংলাদেশ পেয়েছিলো তলাবিহীন ঝুঁড়ির বদনাম: 

হেনরী কিসিঙ্গার ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ঘোষণা করেছিলেন, "বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে তলাহীন ঝুড়িতে"। এভাবে জন্মলগ্নেই বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর যে আঘাত হানা হয়, তার রেশ আজও কাটিয়ে ওঠা সম্ভবপর হয়নি।


শেখ মুজিবুর রহমান: বক্তা হিসবে আর শাসক রূপে

শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র বা অন্যতম দুর্বলতা ছিলো, তিনি তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের আপন প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসার জন্যই তিনি তাদের যাবতীয় অপকর্মের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারেননি। তাঁর এই উদারতাই পরিণত হয়েছিলো তাঁর নিমেসিসে। তাঁর এই দিকটির কারণে তাকে শাসক হিসেবে অতোটা সফল বলা যায় না; যদিও বক্তা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা অসামান্য। 


মুখে ভ্ক্ত হলেই কাজে নয়:

শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি একচ্ছত্র ভক্তির দাবিদাররাই ১৯৭৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রণয়ন ও জারি করেন কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, যাতে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচার না হয় এবং তাঁদের সম্পদ ও ক্ষমতা নিরাপদ ও অব্যাহত থাকে।


ধর্ম ব্যবসা কি? কারা ধর্মব্যবসায়ী?

কোনো আদর্শকে বাস্তবায়িত করার কর্মসূচীকে ওই আদর্শ নিয়ে ব্যবসা- একথা বলা যায় না। যেমন- কেউ যদি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে, বাংলাদেশের জন্য ওয়েস্ট মিনিস্টার বা লিংকনীয় গণতন্ত্রই সর্বোত্তম এবং সেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যদি সংগ্রামে অবতীর্ণ হন, তাহলে তিনি বা তাঁরা গণতন্ত্র নিয়ে ব্যবসা করছেন একথা বলা যাবে না। একই বিচারে যাঁরা কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থব্যবস্থা কায়েমে বদ্ধপরিকর, তারা কখনোই ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা করছেন না। 

ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা করছেন তাঁরাই, যাঁরা ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের ওপর সর্বসময় বেপরোয়া আঘাত হানেন অথচ নির্বাচন এসে পড়লেই জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ধর্মের কথা বলেন; "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ" জাতীয় শ্লোগান ও জিগির তোলেন। ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা করেন তাঁরাই, যাঁরা অষ্ট প্রহর ইসলামকে নিয়ে বিদ্রূপ-উপহাস করেন, নামায-রোজাকে ব্যঙ্গ করেন, অথচ রামযান মাস এলেই "ইফতার পার্টির" প্রতিযোগিতা শুরু করেন। 

মার্কসবাদের অনুসরণ যদি মার্কসবাদকে নিয়ে ব্যবসা না হয়, পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অনুসরণ যদি এই গণতন্ত্রকে নিয়ে ব্যবসা না হয়, তাহলে কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতির দর্শনের অনুসরণও ইসলাম বা ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা হতে পারে না।


আওয়ামী লীগাররা যখন যেটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলবেন তখনই কি তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয়ে যাবে?

আওয়ামী লীগাররা সদাসর্বদাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের বা স্বাধীনতার এই চেতনা জিনিসটা কি? আর সেটা কায়েমই বা হবে কিভাবে? তারা তো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত বলেছেন, সমাজতন্ত্রের কথা। সমাজতন্ত্রের দোহাই দিয়ে কায়েমও করেছিলেন একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা। অথচ, এখন বলছেন, ফ্রি ইকোনোমির কথা। তাদেরকে স্পষ্ট করে বলা উচিত- মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার চেতনা বলতে তারা আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছেন?


মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনা:

মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও চেতনাটি হলো- শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি ইত্যাদির কবল থেকে আপামর জনগণের মুক্তি। স্বাধীনতার প্রায় ৪২ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনা বাস্তবায়িত হয়নি বরং আপামর জনগণের অবস্থার আরও শোচণীয় অবনতি ঘটেছে। 

শোষণ, বৈষম্য, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুর্নীতি আজ সমগ্র জাতিকে গ্রাস করেছে। মূল্যবোধকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। ঝাঁঝরা করে দিয়েছে প্রতিটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ইনস্টিটিউশনকে। আর জাতির এই চরম বিড়ম্বনার মূল্যে গড়ে উঠেছে একচেটিয়া সম্পদ ও ক্ষমতা ভোগকারী এক শক্তিশালী মাফিয়াচক্র। 

গত প্রায় ৪২ বছরের অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, এতোদিন ধরে যে ধরনের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চলে এসেছে, তার মাধ্যমে সমগ্র জনগণের সার্বিক মুক্তি অর্জন কোনোদিন কোনোক্রমেই সম্ভবপর নয়।

বাংলাদেশে আজ যে চূড়ান্ততম আদর্শ, দিগদর্শন ও মূল্যবোধের সংকট, এই সংকট থেকে জাতিকে রক্ষার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি ও আইন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। একমাত্র এই ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমেই সম্ভব শোষণ-বৈষম্যের মূলোৎপাটন করা, অমুসলিমদের স্বার্থ ও অধিকার সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা (ধর্ম নয়) নিশ্চিহ্ন করা, স্থিতিশীল আর্থ-সামাজিক কাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও সুষম বন্টন সুনিশ্চিত করা, ঘুষ-দুর্নীতি- ভেজাল- খুন- রাহাজানি- সন্ত্রাস- অশ্লীলতা- পতিতাবৃত্তি ইত্যাদির মূলোৎপাটন করা, সুস্থ সাহিত্য- সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করা এবং এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও চেতনাকে ১৬ কোটি মানুষের জীবনে মূর্ত- করে তোলা, লাখো শহীদের জীবন এবং নিযুত মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের ঋণ শোধ করা। সর্বোপরি, ইহ-পরকালীন তথা সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে এই ইসলামী ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই।


জনগণই খুঁজে নেবে শান্তির ঠিকানা:

জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে, শতকরা প্রায় ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত এই বাংলাদেশে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) কর্তৃক আদিষ্ট ও প্রদর্শিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হবে, নাকি কুরআন-সুন্নাহবিরোধী তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ (অর্থাৎ ধর্মহীন) রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাই কায়েম হবে।



তথ্যসূত্র: 

ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী সাম্রাজ্যবাদ-ইহুদিবাদ-ব্রাহ্মণ্যবাদের গুণমুগ্ধদের প্রতি খোলা চিঠি। লেখক: হারুনুর রশীদ (সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও চেয়ারম্যান- জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা সংস্থা)। প্রকাশক: পরিচালক, ইতিহাস পরিষদ, ১৭১, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। প্রথম প্রকাশ: জুন-১৯৯৩। ষষ্ঠ প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৯৯৭। মুদ্রক: শহীদ সুলতান প্রেস, মগবাজার, ঢাকা।


__._,_.___

Posted by: Shahadat Hussaini <shahadathussaini@hotmail.com>


[* Moderator�s Note - CHOTTALA is a non-profit, non-religious, non-political and non-discriminatory organization.

* Disclaimer: Any posting to the CHOTTALA are the opinion of the author. Authors of the messages to the CHOTTALA are responsible for the accuracy of their information and the conformance of their material with applicable copyright and other laws. Many people will read your post, and it will be archived for a very long time. The act of posting to the CHOTTALA indicates the subscriber's agreement to accept the adjudications of the moderator]





__,_._,___