ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও পুনর্গঠন
ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী২০ জুন, ২০১৭ ইং
দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে দ্রুত এগিয়ে চলছে, গত সাড়ে আট বছরে অর্থনীতি যখন যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো, সে সময়ে ব্যাংকিং সেক্টর কিন্তু সরকারের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ২০১১-১২ থেকে শুরু করে ২০১৬-১৭ সময়কালে পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকগুলোতে সরকারের মোট অর্থায়নের পরিমাণ হচ্ছে ১১ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে দু'হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং বেসিক ব্যাংকের জন্য। কষ্টার্জিত করের অর্থ এভাবে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া কতটুকু উচিত্ হচ্ছে একমাত্র অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগই তা বলতে পারে।
সরকার দেশের উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থে সাতটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর, মেট্রো রেলসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নে কেবল পরিকল্পনা নয় বরং তা বাস্তবায়িতও হচ্ছে। অথচ এ সময়ে দেশের পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকগুলো সরকারের কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করা দূরে থাক, বরং বোঝায় পরিণত হয়েছে। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত এবং দুটো বিশেষায়িত ব্যাংকে মোট পুঁজির অভাব ছিল ১৩ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এ বিশাল অঙ্কের বোঝা অবশ্য একদিনে হয়নি। ব্যাংকিং কোম্পানি অ্যাক্টের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে এ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দেশের জন্য শ্বেতহস্তী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকিং কোম্পানি অ্যাক্টে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর ন্যস্ত থাকলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব আর্থিক বিভাগের ব্যাংকিং ডিভিশনের উপর ন্যস্ত। আশা করব ব্যাংকিং সেক্টরকে সচল করার বৃহত্তর স্বার্থে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পরিচালনা পর্ষদকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর ন্যস্ত করা হবে। নচেত্ জনগণের কষ্টার্জিত করের টাকা বছরের পর বছর এ ব্যাংকগুলো গিলে খাবে।
বাজারে বন্ড ছেড়ে ব্যাংকগুলো যাতে তাদের পুঁজি সংগ্রহ করতে পারে সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ জন্য একজন দক্ষ, সত্ ও প্রবীণ ব্যাংকারের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন যার মাধ্যমে এ ব্যাংকগুলো কীভাবে পুনর্গঠন করা যায় তার একটি দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাবে। উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন বৈশ্বিক মন্দার কবলে পড়েছিল, তখন বেইল আউটের জন্য মার্কিন সরকার অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু সেই অর্থ যখন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা বোনাস হিসেবে নিতে শুরু করেছিলেন তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল যেন কেউ বেইল আউটের অর্থে বোনাস নিতে না পারেন। যে-হারে পাবলিক লিমিটেড ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো সরকারের কাছ থেকে ক্রমাগত অর্থ নিচ্ছেন তাতে প্রতীকী অর্থে হলেও বোনাস দেওয়া বন্ধ করার বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গ্রাহক সেবার মান নিম্নমুখী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্পিডমানি ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রে কাজ হয়। এ জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন। অথচ সুশাসনের অভাব ব্যাংকিং খাতকে কুরে কুরে খাচ্ছে। মনে হয় গ্রাহককে তাড়াতে পারলেই বাঁচে। গ্রাহকরা কাকুতি-মিনতি করে সেবা নিতে ব্যস্ত রয়েছে। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবশ্যই গ্রাহক সেবাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য বিশেষ নির্দেশনা জারি করা উচিত্। কেননা ব্যাংকিং খাত হচ্ছে সেবা খাত— কেবল দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করলেই চলে না।
এদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা যে খুব ভালো তা নয়। আরো বেশি গ্রাহকমুখী সেবা প্রদান করা উচিত্। প্রথমে আসা যাক অর্গানোগ্রামের ব্যাপারে। ব্যাংকগুলোর সমন্বিত অর্গানোগ্রাম নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ব্যাপারে নির্বিকার। এ সুযোগটি নিয়েই যখন যা খুশি পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে জনগণ প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছে না। এদিকে বেসরকারি ব্যাংকে যে হারে বেতন দেওয়া হচ্ছে, তা কোনোমতেই প্রতিযোগিতামূলক নয়। দেখা যাচ্ছে ব্যাংকের সেবা প্রদানের চার্জসমূহ খুবই উচ্চ হারে নির্ধারণ করা হচ্ছে। আবার আমানত ও ঋণের সুদের হারে ব্যবধান ২% থাকার কথা থাকলেও তা ৫% বা তার অধিক। এ ব্যাপারে কেবল অনুশাসন নয়, বরং কঠোর ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সিএসআর-এর অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকে নয়-ছয় হলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই ধোয়া তুলসি পাতা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ফলে উদ্ভাবনমূলক ব্যাংকিং-এর বদলে এক ধরনের মনোপোলিস্টিক কম্পিটিটিভ ব্যাংকিং ব্যবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চাই সুশাসন। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার কমাতে বললে, ব্যাংকাররা পাল্টা ৫% হারে সুদ বসানোর আবদার করে। অথচ তারা সত্য চেপে গেছেন। সেটি হলো, প্রতি ১০ হাজার টাকা চেকে ট্রানজেকশন করলে একশ টাকা করে কেটে নেওয়া হয়। পাশাপাশি ভ্যাট তো আছেই। আবার যদি ক্রেডিট কার্ডে ট্রানজেকশন করা হয় তাহলে বিক্রেতার কাছ থেকে ২% রেখে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকাররা কে কত বেশি মুনাফা নিতে পারবেন তার অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। লাভ নেওয়ার একটি সীমা থাকা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ধীরে ধীরে অন্যায়কারীদের অপকর্মে সায় দিচ্ছে। অন্যদিকে সুযোগসন্ধানীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এদিকে ১০ টাকার যে সমস্ত একাউন্ট খোলা হয়েছিল, সেগুলো এখন আর তেমন বেশি সক্রিয় নয়। বরং অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকারপ্রধান আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকাণ্ড চাইলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আর এ বিষয় নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না যা সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
যে সমস্ত বিদেশি ব্যাংক এদেশে কাজ করে সেগুলো যত বেশি ট্রেড ফিন্যান্সিং-এ যত বেশি উত্সাহী, টার্ম লোন দেওয়ার ব্যাপারে ঠিক তার বিপরীত। এটি আসলে উচিত নয়। মনে পড়ে কিবরিয়া সাহেবের আমলে বিদেশি ব্যাংকগুলোকে টার্ম লোন দিতে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কেবল প্রফিট নিতে ব্যস্ত রয়েছে। দেশের জনকল্যাণের বৃহত্তর স্বার্থে যে সমস্ত ব্যাংক সঠিকভাবে কাজ করছে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। উপরের দিকে যারা আছেন তারা যেন দুর্নীতিমুক্ত হন সে ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। কিছু কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা সীমিত আকারে বিদ্যমান রয়েছে। জনগণের করের টাকা নয়-ছয় করে বছরের পর বছর জবাবদিহিতা ছাড়া ব্যবসা করার অধিকার কারো নেই। অন্যান্য দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুরো কাজ করতে পারলে আমাদের দেশে কেন পারবে না? এর উত্তর কিন্তু অর্থমন্ত্রণালয়কেই খুঁজে বের করতে হবে। এদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শাখা অফিসগুলো যেভাবে সাজানো এবং যেসব মূল্যবান গাড়ি তারা ব্যবহার করছে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পরিপন্থি। এই অতিরিক্ত অর্থের জোগানও কিন্তু আসে ঋণ গ্রহণকারীদের কাছ থেকে। অন্যদিকে পাবলিক লিমিটেড ব্যাংক এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা যেভাবে গাড়ি ব্যবহার করছেন তাও কিন্তু মোটেই আইনসঙ্গত নয়। এ ব্যাপারে একটি অনুশাসন জারি করা উচিত। অবস্থা যেন এমন না হয়— 'যে যায় লংকায়, সে রাবণ হয়'। বিদেশি ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই টার্ম লোন প্রদানে উত্সাহিত করতে হবে। ব্যাসেল-৩ অনুসারে ব্যাংকগুলো যাতে সঠিকভাবে ক্যাপিটাল এডুকেসি অর্জনে সক্ষমতা লাভ করে সেজন্য জবাবদিহি ব্যবস্থা, দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ ও মানব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। দেশে ব্যাংকিং কাঠামোর সংস্কার সাধন ও পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। এদিকে ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে বিদেশি ব্যাংকগুলো বাদ দিয়ে বাকিগুলোর অর্গানোগ্রাম ঠিক করে দেওয়া উচিত। ব্যাংকের বেতনক্রম বিশেষত বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে একটি সর্বোচ্চ সিলিং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঠিক করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে জোর কদমে এগিয়ে যাবার পূর্বে ব্যাংকগুলোকে সঠিকভাবে কাজ করার সক্ষমতা দিতে হবে যাতে ন্যায় বিচার ও সমতাভিত্তিক উন্নয়ন সম্ভব হয়। এদিকে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে সংগৃহীত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আনয়নের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। কমিউনিটি ব্যাংকিং-এর জন্য পৃথক রেগুলেটর প্রয়োজন যাতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে বিনিয়োগে রূপান্তর করে দরিদ্রদের জীবনমান উন্নয়ন করা যায়।
n লেখক: ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনোমিস্ট।
ই-মেইলঃ pipulbd@gmail.com
__._,_.___