Banner Advertise

Friday, September 4, 2015

[chottala.com] নজরুলগীতি সম্ভার



নজরুলগীতি সম্ভার

এবনে গোলাম সামাদ

মানুষ তার কণ্ঠস্বরকে বিশেষভাবে ওঠা-নামা করে গান করে। গান শব্দ (Sound) দিয়ে রচিত। কিন্তু তা বলে সব শব্দ গান নয়। কণ্ঠস্বর বিভিন্নভাবে উঁচু-নিচু করে, অর্থাৎ বিভিন্ন তরঙ্গমাত্রার শব্দ উৎপন্ন করে গান করা হয়। যাকে তুলনা করা চলে কতকটা সিঁড়ির ধাপের সাথে। সিঁড়ির ধাপ যেমন খুব উঁচু উঁচু হলে তা দিয়ে উঠতে নামতে অসুবিধা হয়, শব্দের ধাপের ক্ষেত্রেও ঘটে তেমনি। গানের এই সিঁড়িকে বলে স্বরগ্রাম। স্বরগ্রাম ছাড়া কোনো গান হতে পারে না। গানকে তুলনা করা চলে ভাষার সাথে। সব ভাষারই ব্যাকরণ থাকে। কিন্তু কোনো ভাষারই উদ্ভব হয়নি ব্যাকরণ অনুসরণ করে। ভাষার উদ্ভব হয়েছে আগে, আর তার ব্যাকরণ পণ্ডিতেরা ভাষাটিকে অনুশীলন করে রচনা করেছেন অনেক পরে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু কথাটি আসলে ভিত্তিহীন। কেননা, সব গানই কোনো-না-কোনো শব্দসারণি বা স্কেল (Scale) অনুসরণ করে চলে। কথাগুলো মনে রাখতে হয়, কেননা বাংলা গানকে অনেকে বলতে চান অশাস্ত্রীয়। যে ধারণাটা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। যাকে বলে ওস্তাদি গান, তার বৈশিষ্ট্য হলো গানের মূল সুর (Melody Pattern) বজায় রেখে উপসুর (Improvise) রচনা করে গলার কাজ দেখাতে পারা। উপসুর সুরের ধারার বিঘ্ন ঘটাবে না। বাংলা গানে উপসুর তৈরির সুযোগ ছিল না। নজরুলের অনেক গানে উপসুর তৈরির সুযোগ আছে। অর্থাৎ গায়ক বা গায়িকা এখানে গলার কাজ দেখাতে পারেন। বিখ্যাত মারাঠি গায়িকা আশা ভোঁসলে (লতা মুঙ্গেশকরের ছোট বোন) নজরুলের গান সম্পর্কে ১৯৯১ সালে কিছু মন্তব্য করেছিলেন, যা এখনো মনে হয় যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। আশা ভোঁসলে বলেছেন, নজরুলের গানে আছে কণ্ঠশিল্পীর স্বাধীনতা। কণ্ঠশিল্পী এখানে মূল সুরকে বজায় রেখে নিজের সুরও কিছুটা যোগ করতে পারেন। দেখাতে পারেন গলার কাজ। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে এটা পারা যায় না। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গিয়ে তিনি আড়ষ্টতা বোধ করেছেন। পাননি তার নিজস্ব সুর বিস্তারে অধিকার। কিন্তু নজরুলের গান গেয়ে তিনি পেয়েছেন বিশেষ আনন্দ। কারণ একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এ ক্ষেত্রে তিনি যোগ করতে পেরেছেন তার আপন কারুকলাকেও। তার নিজের কথায়Ñ নজরুলগীতিতে বন্ধন নেই। আছে সুরের মিষ্টতা। গাইতে গাইতে যদি কোথাও একটু আলাপ বা বিস্তারের ইচ্ছা জাগে, তাহলে সেটা করার স্বাধীনতা নজরুলসঙ্গীতে আছে। শিল্পীর নিজের ইন্টারপ্রিটেশন বা ব্যাখ্যার সুযোগ আছে এই গানে। আর সেটাই নজরুলের গানের প্রতি আকর্ষণের বিশেষ কারণ। ভোঁসলে রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে তার যথেষ্ট অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু নজরুলের গান করতে তার সে অসুবিধা হয়নি। আশা ভোঁসলের মাতৃভাষা মারাঠি। তিনি তার মাতৃভাষা ছাড়া এই উপমহাদেশের ১৮টি ভাষায় গান গেয়েছেন; যার মধ্যে বাংলা হলো একটি। আশা ভোঁসলে নজরুলের ১৬টি গান গেয়েছেন (সানন্দা, কলকাতা, জুলাই, ১৯৯১)। আশা ভোঁসলে বাংলাভাষী নন। গায়িকা হিসাবে তার রয়েছে এই উপমহাদেশে নানা ভাষার গানের অভিজ্ঞতা। নজরুলের গানের বিচারে তার মন্তব্যকে ধরতে হয় যথেষ্ট গুরুত্ববহ ও নিরপেক্ষ বলে। ধর্মের দিক থেকে আশা ভোঁসলে মুসলমান নন। তাই ধর্মীয় কারণে নজরুলের প্রতি তার যে কোনো দুর্বলতা আছে, এমন কথা ভাবারও অবকাশ নেই। নজরুলকে বিচার করতে গিয়ে ধর্মীয় চেতনার সঙ্কীর্ণতা অনেকে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু নজরুলের গীতিসম্ভার ঐশ্বর্যময়।

নজরুল গানের সুর রচনা করেছেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে। হারমোনিয়াম বিদেশী বাজনা। ব্রিটিশ খ্রিষ্টান মিশোনারিরা হারমোনিয়াম এ দেশে নিয়ে আসেন গির্জার গানের সাথে বাজানোর জন্য। হারমোনিয়াম আবিষ্কৃত হয়েছিল ফরাসি দেশে। এতে যে স্বরসারণি অনুসরণ করা হয়, তাকে বলা হয় সমভাবে সমীকৃত স্বরসারণি (Equally tempered scale)। এই স্কেল অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের প্রাচীন সুরের ধারা হয়তো বেশ কিছুটা বদলে গেছে। কিন্তু একেবারেই যে বদলে গেছে তা বলা যায় না। বিদেশী খ্রিষ্টান মিশনারিরা এ দেশে প্রথমে যে হারমোনিয়াম নিয়ে আসেন, তা বাজানোর জন্য দু'পায়ে বেলো করতে হতো। আর তা বাজাতে হতো দু'হাত দিয়ে। প্রয়োজনে এ হারমোনিয়াম বাজানো যেত, যাকে বলে কড (Cord) করে বাজানো। কড বলতে বোঝায়, কয়েকটি স্বরকে একত্রে বাজানো। যেমন, সাগাপা এবং এর সাথে চড়া সা একত্রে বাজালে হবে একটা কড। ইউরোপীয় গানে বাজনা বাজানো হয় এভাবে কড করে। কিন্তু বাংলা গানে তা বাজানো হয় না। বাংলা গানে হারমোনিয়াম বাজানো হয় সুর-সরল প্রথায়। অর্থাৎ মেলোডির ধারা অনুসরণ করে। কলকাতায় কোনো এক বাদ্যযন্ত্র কোম্পানি বিদেশী হারমোনিয়ামকে রূপান্তরিত করে আমরা বর্তমানে যে হারমোনিয়াম বাজাই, তার উদ্ভব করে। এই হারমোনিয়াম এক হাতে বেলো করে আরেক হাতে বাজানো হয়। নজরুল তার গানের সুর দিয়েছেন এই দেশী হারমোনিয়াম ব্যবহার করে। নজরুল তানপুরাতে তান সাজেননি। রবীন্দ্রনাথ তার গানের সাথে হারমোনিয়াম বাজানো পছন্দ করতেন না। রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে বিশেষভাবে প্রভাব রেখেছে মধ্যবাংলার (কুষ্টিয়া অঞ্চলের) বাউল সুর। বাউলরা একতারা বাজিয়ে গান করেন। তারের বাজনায় স্বরনির্ভর করে তারের দৈর্ঘ্য, তারের ভার এবং তারের ওপর কতটা টান আছে, তার ওপর। বাউলরা গান করার সময় একতারার দুই ধারে চাপের তারতম্য ঘটিয়ে বিভিন্ন স্বর উৎপাদন করে থাকেন। কিন্তু হারমোনিয়াম হলো বাঁধা স্বরের বাজনা। এখানে ইচ্ছামতো স্বর উৎপাদন করা চলে না। গলাকে অনুসরণ করতে হয় যন্ত্রকে। তাই সুরকে বেশ কিছুটা বাঁধা করতে হয় যন্ত্রের সাথে। রবীন্দ্রনাথ এ কারণে হারমোনিয়াম পছন্দ করতেন না। কিন্তু সাধারণত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া হয় হারমোনিয়াম বাজিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের গানকে বলা হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত। পক্ষান্তরে নজরুলের গানকে বলা হয় নজরুলগীতি। কেন এরকম বলা হয়, সেটা পরিষ্কার নয়। কেননা, সংস্কৃত ভাষায় সঙ্গীত বলতে বুঝিয়েছে, নাচ, গান ও বাজনাকে একত্রে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নাচ গান কখনো কখনো করা হয় কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে নয়। বাংলা ভাষায় গান শব্দটা কিভাবে উৎপন্ন হয়েছে তা আমার জানা নেই। আমরা যাকে বলি গান, তাকে আরবিতে বলে 'গিনা'। গান শব্দটা গিনা শব্দ থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকতে পারে। তবে আমি যথেষ্ট নিশ্চিত নই। বাজনাকে আরবিতে বলে 'ম্যুজিক'। ম্যুজিক শব্দটা আরবি ভাষার নয়, গ্রিক ভাষার। শব্দটা আরবি ভাষায় নেয়া হয়েছে গ্রিক ভাষা থেকে। তুর্কি মুসলমানেরা এই উপমহাদেশের উত্তরভাগে নিয়ে আসেন গানের একটি বিশেষ ধারাকে। নিয়ে আসেন বেশ কিছু বাজনাকেও। যেমন- সেতার, সরোদ (সাহরুদ), সানাই (সারনাই), তবলা। সেতারে থাকে সাতটি তার। থাকে ঘাট। বলা হয় বর্তমান সেতারের উদ্ভব করেছিলেন আমির খসরু। আর সেতার বাজাতে গিয়ে তিনি বেঁধে দেন বিশেষ কম্পন মাত্রার সপ্তস্বর। কিন্তু ইংরেজ আমলে বিদেশ থেকে আসে Equally tempered scale। আমরা গান গাইতে শুরু করি এই বিশেষ স্বরসারণি অনুসরণ করে। নজরুরের গান এই সারণিকে অনুসরণ করেছে। এর মধ্যে নেই কোনো বিশেষ আধ্যাত্মিকতা। আছে শব্দবিজ্ঞানের নিয়ম।
নজরুল নানা সুরে গান বেঁধেছেন। নজরুলের গানে সুর এসেছে আগে। কথা বা কবিতা এসেছে পরে। রবীন্দ্রনাথ কথা বা কবিতাকে দিয়েছেন সুর। অন্য দিকে, নজরুল সুরকে দিয়েছেন বাণী। অর্থাৎ সুর অনুসারে রচনা করেছেন গানের কবিতাংশ। গান একটি মিশ্র শিল্পকলা। কবিতা ও সুরে মিলে হয় গান। নজরুল যেকোনো সুর শুনে সেই সুরের উপযোগী কবিতা রচনা করেছেন। নজরুল ছিলেন একজন পেশাদার গীতিকার ও সুরকার। নজরুল যেভাবে গান রচনাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, আর কেউ তা করেননি। নজরুল যেমন রচনা করেছেন ইসলামি সঙ্গীত অতি দক্ষতার সাথে, তেমনি আবার রচনা করেছেন শ্যামাসঙ্গীত, অনুরূপ দক্ষতারই সাথে। নজরুলের ইসলামি গানের রেকর্ড যেমন বিক্রি হয়েছে, তেমনি বিক্রি হয়েছে শ্যামাসঙ্গীতের রেকর্ড। এটা তার গীত রচনা ও সুরশৈলী রচনার দক্ষতার পরিচয় বহন করে।
নজরুল জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলে। যেখানে আছে কয়লার খনি। কয়লা খনিতে কাজ করে সাঁওতালরা। সাঁওতালরা গান গায় বিশেষ সুরে, যাকে বলে ঝুমুর। নজরুল ঝুমুর সুরে গান বেঁধেছেন-
হলুদ গাঁদার ফুল
রাঙা পলাশ ফুল
এনে দে এনে দে, নইলে বাঁধবো না বাঁধবো না চুল।
কিন্তু নজরুলের গান কেবল ঝুমুর সুরে নিবদ্ধ হয়ে থাকেনি। নজরুলের গানে সারা বাংলার সুর রণিত হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিশেষ সুর হলো ভাওয়াইয়া। নজরুল ভাওয়াইয়া সুরে গান বেঁধেছেন-
কুঁচ বরণ কন্যারে তার মেঘ বরণ কেশ
আমায় নিয়ে যাওরে নদী সেই কন্যার দেশ।
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের বিশেষ সুর হলো ভাটিয়ালি। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মাঝিমাল্লাদের মাধ্যে উদ্ভব হতে পেরেছে এই সুরের। নজরুল ভাটিয়ালি সুরে গান বেঁধেছেন-
পদ্মার ঢেউরে
মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যারে।
এই পদ্মে ছিলরে যার রাঙা পা
আমি হারিয়েছি তারে।
নজরুল যেকোনো সুর শুনলে তার উপযোগী কবিতা রচনা করতে পারতেন। তিনি তুর্কি সুরে গান বেঁধেছেন-
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
নাচিছে ঘূর্ণি বায়
জল তরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল
ঢেউ তুলে সে যায়।
নজরুল প্রাচীন রাগভিত্তিক গান লিখেছেন, যা চলত বিশেষভাবে রাজদরবার ও উচ্চবিত্ত মহলে। যেমনÑ 
শূন্য এই বুকে পাখি মোর
ফিরে আয়, ফিরে আয়
তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল
অকালে ঝরিয়া যায়।
এই গানটিতে ওস্তাদি দেখানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। আর গায়করা তা দেখিয়েছনও।
নজরুল রাজশাহীতে একবার এসেছিলেন। সেটা ১৯২৯ সাল (কোনো কোনো বইতে লিখেছেন ১৯২৮)। নজরুল রাজশাহীতে এসেছিলেন রাজশাহী নগরবাসীর আমন্ত্রণে। বিশেষ করে রাজশাহীর তদানীন্তন মুসলমান তরুণ সমাজের একাংশের ডাকে। রাজশাহী খুব রক্ষণশীল জায়গা। রাজশাহীতে একসময় হয়েছিল প্রবল ওহাবী আন্দোলন। গান ওহাবীদের পছন্দ নয়। কিন্তু এই রাজশাহীতেই তিনি হতে পেরেছিলেন আমন্ত্রিত। আর তাকে দেয়া হয়েছিল বিশেষ মানপত্র। এ সময় তখনকার বাংলার আর কোনো শহরের লোকে নজরুলকে এরকম মানপত্র দিয়েছিল কি না, সেটা আমার জানা নেই। নজরুল রাজশাহীতে এসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন তরুণদের অনুরোধে। হারমোনিয়াম বাজানোতে কিছু আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু যেহেতু ওই সভায় উদারমনা তরুণ বেশি ছিলেন, তাই নজরুলকে বন্ধ করতে হয়নি তার গান গাওয়া। ইসলামে গানের সাথে বাজনা বাজানো সাধারণভাবে অনুমোদন করা হয় না। কিন্তু কেবল ইসলামেই যে গানের সাথে বাজনা বাজাতে নিষেধ করা হয়েছে, তা নয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লাটো (খ্রিষ্টপূর্ব-৪২৭-৩৪৭) গানের সাথে বাজনা বাজাতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, বাজনা ঢেকে দিতে চায় মানুষের কণ্ঠস্বরকে। কণ্ঠস্বরের মাধুর্য চাপা পড়ে যায় বাজনার আড়ালে। বোঝা যায় না, গায়কের কৃতী। প্লাটোকে আরবি ভাষায় বলে 'আফলাতুন'। আফলাতুন এ ক্ষেত্রে মুসলিম চেতনাকে প্রভাবিত করেছেন বলে মনে হয়। প্লাটো বলেছেন, আদর্শ রাষ্ট্রে সব রাগে গান গাওয়া যাবে না। আদর্শ রাষ্ট্রে লিডিয়ান ও আয়নিয়ান রাগে গান গাওয়া যাবে না। কারণ, লিডিয়ান রাগভিত্তিক সুর মানুষকে করে তুলতে চায় দুঃখ ভারাক্রান্ত। অন্য দিকে, আয়নিয়ান রাগভিত্তিক সুর মানুষকে করে তুলতে চায় অলস। তিনি বলেছেন, আদর্শ রাষ্ট্রে মানুষকে গান গাইতে হবে ডরিয়ান আর ফ্রিজিয়ান রাগে। কারণ এই দু'টি রাগ মানুষকে জোগায় সাহস ও কর্ম উদ্দীপনা। এ ছাড়া ফ্রিজিয়ান রাগ মানুষকে করে তোলে সংযমী। প্লাটোর মতে, গানের ভালোমন্দের বিচারের সময় ভাবতে হবে সমাজজীবনে তার প্রভাব নিয়ে। গানকে সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভালো মন্দের বিচার করা উচিত নয়। নজরুল তরুণ সমাজকে প্রায় একই রকম কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, হারমোনিয়াম কোনো সমস্যা নয়। দেখতে হবে গানের ভাববস্তুকে। আর মানুষের ওপর তার প্রভাব কী হচ্ছে সেটাকে। নজরুল অনেক গান গেয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল-
বাজলো কিরে ভোরের সানাই নিদ-মহলের আঁধার পুরে।
শুনছি আজান গগন-তলে অতীত রাতের মীনার চূড়ে ॥
সরাই-খানার যাত্রীরা কি
'বন্ধু জাগো' উঠলো হাঁকি?
নীড় ছেড়ে ঐ প্রভাত-পাখি
গুলিস্তানে চচ্ল উড়ে।
এখন বাংলাদেশে রবীন্দ্র-নজরুল নিয়ে একসাথে আলোচনা করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু রাজশাহীতে নজরুল এসে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন কান্ত কবি রজনীকান্তের (১৮৬৫-১৯১০) স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। রজনীকান্তের সাহিত্যচর্চার জীবন কেটেছিল রাজশাহীতে। ধরা যেতে পারে কান্ত কবির ভক্তিমূলক ও স্বদেশী গান নজরুলকে গান লিখতে করেছিল অনুপ্রাণিত; রবীন্দ্রনাথ নন। আসলে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশবিরোধী কোনো গান তখনো রচনা করেছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের একজন পরম ভক্ত।
বাংলা গানের ইতিহাস অনুসরণ করলে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ নন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) প্রথম দেশপ্রেম উদ্দীপক গান লেখেন। তিনিই প্রথম প্রবর্তন করেন কোরাস গান। নজরুল এ ক্ষেত্রে হয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দ্বারাও প্রভাবিত। কিন্তু এখন আমাদের দেশে অনেক বুদ্ধিজীবী প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নজরুলের গানের গুরু। যেটা আদৌ সত্য নয়। অন্তত আমরা বাংলা গানের যে ইতিহাস জানি, তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ২৯ আগস্ট ২০১৫, প্রথম আলো পত্রিকায় রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্কের টুকরো গল্প বলে একটি ছোট ফিচার লেখা হয়েছে, যা পড়লে অনেকের মনে হবে, রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে করে তুলেছিলেন গীতিকার ও সুরকার। তাই আমি বিশেষভাবে এ কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছি। রবীন্দ্রনাথের বিরাট প্রতিভাকে অস্বীকার করার কোনো প্রশ্ন উঠছে না। কিন্তু নজরুল রবীন্দ্র বলয়ের সঙ্গীত-সাধক ছিলেন না। তিনি একটি পৃথক সঙ্গীত ভুবন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন প্রায় ৬১ বছর ধরে। একটি হিসাব অনুসারে রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। অন্য দিকে, নজরুলের সঙ্গীত জীবন ছিল মাত্র ২০ বছর। নজরুলের গানের সংখ্যা এখনো সঠিকভাবে নির্ণীত হয়নি। তবে একটি হিসাব অনুসারে প্রায় তিন হাজার। সংখ্যা দিয়ে কারো শিল্পকৃতীর মূল্যায়ন করা চলে না। কিন্তু এত গান লিখতে ও সুর দিতে নজরুলকে করতে হয়েছিল যথেষ্ট পরিশ্রম, যা আমাদের বিস্ময় জাগায়। এই হিসাবে নজরুল প্রতি বছর প্রায় ১৫০টি করে গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বছরে গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন প্রায় ৪০টি। রবীন্দ্রনাথকে এই সময় গান লিখতে ও সুর দিতে সাহায্য করেছেন অনেকে। কিন্তু নজরুলকে সাহায্য করার কোনো ব্যক্তি ছিল না।
এবারের নজরুল মৃত্যুবার্ষিকীতে পত্র-পত্রিকায় ব্যক্তি নজরুলকে নিয়ে অনেক আলোচনা হতে দেখলাম। এসব আলোচনায় গীতিকার ও সুরকার নজরুলের চেয়ে নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কাহিনীকে বড় করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে নজরুলের প্রেমিকা ছিলেন অনেক। তাদের প্রেম নজরুলকে প্রেমের গান লিখতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। কিন্তু প্রেমের গান লিখতে বাস্তব জীবনে যে রক্তমাংসের প্রেমিকার প্রয়োজন হয়, এমন নয়। এসব কাহিনী নজরুলের কাব্যউৎসকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে না। বরং বলতে হয়, নজরুলের জীবনে অনেক নারী হয়েছেন তার ক্ষতির কারণ। যেমন- যে বিশেষ রোগটির কারণে নজরুলের জীবনে স্নায়বিক বিপর্যয় নেমে আসে, অনেকের মতে তার জীবাণু এসেছিল কোনো প্রসিদ্ধ নজরুল গানের কণ্ঠশিল্পীর দেহ থেকে। সে সময় যেসব নারী গান গাইতেন, তাদের অনেকে ছিলেন দূষিতা। তবে বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। আমি তাই বিশদ হতে চাই না।
নজরুলের মাতা ছিলেন খুবই স্নেহশীলা। তিনি চেয়েছিলেন পুত্রকে আগলে রাখতে। কিন্তু নজরুল করেছিলেন তার বিধবা স্নেহময়ী মাতার সাথে অকল্পনীয় দুর্ব্যবহার। নজরুলের ব্যক্তিজীবনে অনেক অসঙ্গতি ছিল। মানুষ নজরুলের চেয়ে শিল্পী নজরুল ছিলেন অনেক বড়। ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে কবিদের বিচার হতে পারে না। বিখ্যাত ফরাসি কবি ভিয়ঁ ছিলেন দুর্ধর্ষ ডাকাত। কিন্তু ভিয়ঁ এখন ফরাসি মনে টিকে আছেন, তার কবিতার জন্য; তার দস্যু জীবনের কাহিনীর জন্য নয়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

- See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/51608#sthash.pEBwEIbo.dpuf


__._,_.___

Posted by: Shahadat Hussaini <shahadathussaini@hotmail.com>


[* Moderator�s Note - CHOTTALA is a non-profit, non-religious, non-political and non-discriminatory organization.

* Disclaimer: Any posting to the CHOTTALA are the opinion of the author. Authors of the messages to the CHOTTALA are responsible for the accuracy of their information and the conformance of their material with applicable copyright and other laws. Many people will read your post, and it will be archived for a very long time. The act of posting to the CHOTTALA indicates the subscriber's agreement to accept the adjudications of the moderator]





__,_._,___