মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক চেতনা এবং নিউইয়র্কের সভায় আমার বক্তব্য
শারমিন আহমদ
সম্প্রতি ৮ নভেম্বর, ২০১৪ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত প্রোগ্রেসিভ ফোরামের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে আমি যে কথাগুলি বলেছিলাম তা প্রায় সকল সংবাদ মাধ্যমে খণ্ডিত ও কোন কোন মাধ্যমে বিকৃত ভাবে উপস্থাপিত হওয়ায় এই লেখার অবতারনা। জেল হত্যাকাণ্ডর বিবরনে আমি উল্লেখ করেছিলাম যে ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে জেলে হত্যা একই ধারাবাহিকতায় এবং মুক্তিযুদ্ধর চেতনাকে বিনষ্ট করার জন্য সুপরিকল্পিত ভাবে সংঘটিত হয়। খন্দকার মোশ্তাক আহমেদ অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখল করে অর্ডিন্যান্স জারী করে যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবেনা। জেনারেল জিয়াউর রহমান মোশ্তাককে অপসারন করে প্রেসিডেন্ট হবার পর ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সেই অবৈধ অর্ডিন্যান্সকে বৈধতা দিয়ে স্থায়ী করে নেন। এর ফলে বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৭ সালে আমি যখন বাংলাদেশে জেল হত্যার উপর তথ্য যোগাড় করছি তখন এরশাদ সরকারের আমলে হত্যাকারীদের দুজন ফারুক ও রশীদ দেশে ফিরে রাজনৈতিক দল গঠন করার অনুমতি লাভ করে। তাই জেল হত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও সাক্ষাৎকার গ্রহন সে সময় সহজ ব্যাপার ছিলনা। সেই ১৯৮৭ সালে আমি আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ, জেল হত্যা তদন্ত কমিশনের সদস্য বিচারপতি কে এম সোবহান,মহসীন বুলবুল, ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক বীর উত্তম প্রমুখের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সংগৃহীত সব সাক্ষাৎকার ও তথ্যের ভিত্তিতে জেল হত্যা সম্পর্কে রচনাটি খুব সম্ভবত ছিল ঐ বিষয়ে প্রথম গবেষণা ভিত্তিক প্রবন্ধ। ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর সহ জেল হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত অভিযুক্ত বিএনপির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেই প্রথম বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকাণ্ডর বিচার শুরু হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার যে অধিকাংশ মিডিয়ায় ফলাও করে জেল হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমার বক্তব্যের যেসব খবর প্রচারিত হোল তার মধ্যে বিএনপির সময়ে বিচারের পথ রুদ্ধ করবার বিষয়টি একেবারেই অনুল্লেখিত। এতে করে মনে হতে পারে যে কোন বিশেষ কারনে বিএনপিকে আড়ালে রেখে আমি কথাগুলি বলেছি। কিন্তু তাতো নয়। আমি শ্রোতাদের কাছে ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডর পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান ও দলের বিচারের পথ অবৈধভাবে রুদ্ধ করার ধারাবাহিক একটি চিত্রকেই তথ্যর আলোকে তুলে ধরেছিলাম। কোন অজ্ঞাত কারনে মিডিয়ায় তা খণ্ডিত ভাবে প্রচারিত হয়। কোন কোন পত্রিকায় " আমি বঙ্গবন্ধুকে মানুষ হিসেবে দেখতে চাই দেবতা নয়" আমার বক্তব্যরুপে প্রকাশিত হয়েছে। আমি একথা বলিনি। আমি বলেছিলাম " আমরা খুব এককেন্দ্রিক হয়ে গেছি। আমরা মানুষকে দেবতার পর্যায়ে তুলে দিয়েছি। এটার ফল হচ্ছে কি? আমি কিন্তু মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে আগ্রহী। কারন তার মনুশত্যের বিচারে, তার দোষ ত্রুটি নিয়েও সে যখন মহাকাশটা ছুঁতে যায় তখুনি সে পরিনত হয়, ফেরেশতা নয়, দেবতা নয়, মহা মানবে।" টিভি নিউজে সম্প্রচারিত আমার বক্তব্যের ভিডিও লিংকটি তুলে ধরা হোল। https://www.youtube.com/watch?v=6xmkJMMnMAc&feature=youtu.be
আমাদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দল মতের উরধে উঠে যুক্তিনিষ্ঠ ভাবে মুক্ত আলোচনা চর্চার ক্ষেত্রটি অতি দুর্বল হওয়ায় যে কোন আলোচনাকেই খণ্ডিত ও অতিরঞ্জিত করে কোন বিশেষ দলভুক্ত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
"তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা" গ্রন্থটি যার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, পাক-মারকিন এবং গনহত্তাকারী মৌলবাদী চক্রের বিরুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের নিরন্তর সংগ্রামের কথা, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের পরিপূরক সম্পর্ক, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রেরনা ও তাজউদ্দীনের বাস্তবায়ক ভূমিকার কথা, সে বিষয় গুলো না পড়েই অনেকে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। বইটি যথাসম্ভব নির্মোহ ও যুক্তিতথ্যর ভিত্তিতে লেখা হলেও তার কোন কোন অংশ পছন্দ না হওয়ায় মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়। মতের সাথে না মিললেই বা অপ্রিয় সত্য বললে তার বিপরীতে যুক্তিবুদ্ধির কোন অবতারনা না ঘটিয়ে মিথ্যা অপ্প্রচারনার ভয়াবহ ধারা থেকে জাতীয় স্বার্থেই বেরিয়ে এসে সত্যের সাধনা ও মুক্ত চিন্তার চর্চা অব্যাহত রাখার কথা আমি বলেছিলাম। সমাজের দিক নির্দেশক বুদ্ধিজীবীরা যাদের এক বড় অংশ দলীয় হয়ে গিয়েছেন, তারা দলের উরধে উঠে জাতি ও বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করবেন, সে আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেছিলাম। আরও বলেছিলাম যে মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধারন করে জাতীয় কল্যাণে দল মত নির্বিশেষে আমরা যেন রঙধনুর মত বৈচিত্র্যময় নানা রঙের সমাহারে একটি একতার সেতু গড়ে তুলতে পারি।
আমাদের দেশে প্রকট রাজনৈতিক বিভাজন, অন্ধপক্ষপাতিত্ব, সত্যের অন্নেশার চাইতে স্বার্থ ও সুবিধার দৃষ্টিকোন থেকে খণ্ডিত ভাবে ঐতিহাসিক বিষয়গুলিকে উপস্থাপন করার যে দুঃখজনক রীতি দীর্ঘকাল ধরেই চালু হয়েছে তার থেকে উত্তরনের জন্য নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ, মুক্ত চিন্তা এবং যুক্তিবুদ্ধির চর্চার বিকল্প নেই। সেই কাঙ্খিত, সুন্দর এবং সবল গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন এই প্রত্যাশা হতেই আজকের এই প্রত্যুত্তরটি বিশেষ করে দেয়া হল।
__._,_.___