রেজোয়ান সিদ্দিকী rezwansiddiqui@yahoo.com |
শেষ পর্যন্ত পুলিশই নিলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত
28 March 2015, Saturday
আফ্রিকার একেবারে পশ্চিম দিকে আটলান্টিক মহাসাগরের গা ঘেঁষে লক্ষাধিক বর্গকিলোমিটার এলাকার দেশ লাইবেরিয়া। জনসংখ্যা বেড়ে চলার হার চমৎকার। জাপান কিংবা সিঙ্গাপুরের মতো এ দেশে শাসকদের মাইক নিয়ে রাস্তায় 'মানুষ বাড়াও' 'মানুষ বাড়াও' বলে হল্লাচিল্লা করতে হয় না। সন্তানের জন্ম দাও, ছুটি দেবো-পয়সা দেবো-সুবিধা দেবো। জনসংখ্যার দিক থেকে বড় উর্বর দেশ লাইবেরিয়া। এখানকার শাসকেরা ভুদু সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। কে কোথায় শাসক, তারা কোথায় ঘুমায়, কোন পথে চলে, এসবের খবর খুব কম লোকই রাখে। জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে চল্লিশ বছরে লাখ তিনেক থেকে তা ৪১ লাখে পৌঁছেছে। ব্যবসা বলতে জাহাজ। প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। কিন্তু তা ব্যবহার করার কথা কেউ খুব একটা ভাবে না। হলে হলো। না হলে নাই।
লাইবেরিয়ান সাধারণ মানুষ নানা উপজাতীয় দলে বিভক্ত। কামড়াকামড়ি, হানাহানি তাদের জীবনের অঙ্গ। আধুনিক জীবনের চাহিদা খুব বেশি আছে বলেও মনে হয় না। লাইবেরিয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থাও নেই। যেটুকু আছে, তা ব্যবহার করেন শাসক শ্রেণী। এর পরেও যদি কারো বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় তাহলে তিনি নিজে জেনারেটর কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু মানুষ বড় ভালো। এরা বিদ্যুতের জন্য আমাদের দেশের হাড়-হাভাতে লোকদের মতো সড়ক অবরোধ করে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালিয়ে দেয় না। রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে নর্তন-কুর্দনও করে না। সেখানে নির্বাচন-টির্বাচন মাঝে মধ্যে হয়। ওগুলোও খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জোর করে ক্ষমতা দখলের জন্য মিলিটারিরও প্রয়োজন হয় না। পুলিশের সার্জেন্টও নির্বাচিত সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে। সেভাবেই সেখানে ১৯৮০ সালে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন সার্জেন্ট ডো।
বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মোটামুটি এমনই এক জায়গায় পৌঁছেছে। এখানে এখন র্যাব-পুলিশ-বিজিবি প্রধানরাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। রাজনীতিবিদদের যা বলার কথা সেগুলো এসব বাহিনীপ্রধানেরা গলা উঁচিয়ে বলতে কসুর করছেন না। মনে হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায় এরা আছেন চালকের ভূমিকায়, সরকার আছে পেছনে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সন্ত্রাসী বললেও এরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার ধার ধারছেন না। এরা একেবারেই বিরোধী দলকে নির্মূল করার ঘোষণা দিয়ে বসছেন এবং জানান দিচ্ছেন যে, ২০১৯ সালের আগে আর কোনো সাধারণ নির্বাচন হবে না। আর এ নিয়ে যদি কেউ আন্দোলন করে তবে এরা এক্কেবারে গুল্লি করে দেবে। কারণ তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে, তা খেলনা নয়।
যেখানে সরকারের মন্ত্রীরা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখতে যান, সেখানে থাকেন পুলিশ বাহিনীর প্রধানেরা। যে অপরিসীম ঔদ্ধত্যে তারা কথা বলেন, মন্ত্রীদের যদি ন্যূনতম কোনো ব্যক্তিত্ব থাকত, তাহলে ঘটনাস্থল থেকেই তাকে এরা এই বাহিনী থেকে চিরতরে বিদায় করে দিতেন। কিন্তু আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র। পুলিশপ্রধান যা বলেন, পুলিশের মন্ত্রী তার প্রতিধ্বনি করেন মাত্র। এসব মন্ত্রীকে ধিক্কার দেওয়াও অর্থহীন। কারণ এদের মন্ত্রী হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। শিক্ষা নেই। পারিবারিক ভিত্তি ভূমি নেই। মাঠের খিস্তি-খেউরের এরাই বাদশা। এবারের অনেক অনির্বাচিত এমপিই পুলিশের ওসি, এএসআইকে 'স্যার' 'স্যার' করেন। তেমন পুলিশনির্ভর একটি সরকারের কাছে খুব বেশি কিছু আশা করাও বাতুলতা মাত্র।
আর তাই যা ঘটার সেটাই ঘটছে। সরকার বেজায় চালাক। সরকার অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা কোনো দায়ই নিতে চাইছে না। বরং বলছে এটা আদালতের আদেশ। ওটা পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভাতিজির বাসা থেকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। তাদের সঙ্গে ছিল র্যাবের গাড়িও। কিন্তু প্রথম থেকেই র্যাব পুলিশের লোকেরা অস্বীকার করতে শুরু করল যে, তাদের কেউ মান্নাকে গুম বা অপহরণ করেনি। সরকারের প্রতিমন্ত্রীও ওই হুজুরদের সঙ্গে একমত হয়ে বলতে থাকলেন, না না, তারা কেউ মান্নাকে তুলে নিয়ে যায়নি। এ নিয়ে দেশজুড়ে ভয়াবহ আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। তবে কি মান্নার মতো একজন লোক রাতারাতি হাওয়া হয়ে গেলেন? সরকার তেমনি নির্বিকার ছিল। কিন্তু ২১ ঘণ্টা পর র্যাব স্বীকার করল, তারা মান্নাকে আটক করেছে, তবে ঘটনাস্থল বনানী নয়, ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডের স্টার কাবাবের সামনে থেকে। এইটুকু মিথ্যা না বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না। কিন্তু মিথ্যা না বললে যে সরকারের চলেই না। কিন্তু আমরা এখনো জানতে পারিনি, এই ২১ ঘণ্টা মান্না কোথায় ছিলেন।
এরপর ১০ মার্চ রাত ৯টা সাড়ে ৯টার দিকে উত্তরার একটি বাসা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর দায় স্বীকার করেনি। তার আগেও ২০১২ সালে এভাবেই র্যাব পরিচয়ে রাস্তা থেকে টেনে হেঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে। তারও আগে গুম হয়েছেন বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ আরো অনেকে। সরকার এসব গুমের ঘটনা কেবলই অস্বীকার করে গেছে। সালাহউদ্দিন, ইলিয়াস আলী , চৌধুরী আলমসহ কারো সন্ধান মেলেনি। সালাহউদ্দিনের গুমের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। কিন্তু সরকার সেই মিথ্যার আশ্রয়েই আছে। মিথ্যা তো সরকার মান্নার ক্ষেত্রেও বলেছিল। সেই সরকারি বাহিনীর কাছেই কিভাবে মান্নাকে পাওয়া গেল। এ থেকে সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো, এ সরকার মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ও মিথ্যা আশ্রয়ী।
উপরন্তু জনগণের ওপর এই সরকারের বিন্দুমাত্র আস্তাও নেই। কেননা এরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়। এ সরকার সম্পূর্ণরূপে জবরদখলকারী একটি সরকার। এরা ক্ষমতায় আসীন হয়েছে পুলিশি শক্তির জোরে। পুলিশ বাহিনীও জানে যে, তাদের শক্তি ছাড়া এই সরকারের পক্ষে সাত দিনও ক্ষমতায় আসীন থাকা সম্ভব নয়। ঠিক সে কারণেই এই বাহিনী নরহত্যার সব দায়মুক্তি চাইতে সাহস করেছে। সেজন্য আইন পরিবর্তনেরও দাবি তুলেছে। ধারণা করি, সরকার সে দাবিও শিগগির মেনে নিয়ে একচ্ছত্র পুলিশি শাসন প্রতিষ্ঠা করবে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে যে নির্বাচনী প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে প্রহসন দেশে বিদেশে কেউই মেনে নেয়নি। সবাই বলেছে, সবার অংশগ্রহণমূলক আরেকটি নির্বাচনের আয়োজন করা হোক। সরকার তার থোড়াই পরোয়া করেছে। যদিও ওই নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশী-বিদেশী চাপে সরকার ঘোষণা করেছে যে, শিগগিরই তারা সবার অংশগ্রহণমূলক আরেকটি নির্বাচন দেবে। কিন্তু এখন সে কথা অস্বীকার করছে সরকার। বলছে, ২০১৯ সালের আগে কোনো অবস্থাতেই আর কোনো নির্বাচন তারা করবে না।
ইতোমধ্যে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে তারা কারাগারে পুরেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজ অফিস ভবনে গত আড়াই মাস ধরে অন্তরীণ আছেন। সেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতা কারাগারে বন্দী। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষস্থানীয় সব নেতার নামে শত শত মামলা। খালেদা জিয়ার নামেও মামলার শেষ নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর তথাকথিত ঋণখেলাপি মামলায় খালেদা জিয়া, কোকোর স্ত্রী ও তার দুই নাবালিকা মেয়ের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। নিষ্ঠুরতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার এমন ইতর নজির আধুনিক বিশ্বে কমই আছে।
একটি নতুন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে গত আড়াই মাস ধরে সারা দেশে অবরোধ পালন করা হচ্ছে। এর মধ্যে আসছে সপ্তাহের পাঁচ দিন হরতাল। এই আন্দোলন থেকেই জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে এখন সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ডাক দিয়েছে। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনগুলোকেও সরকার ইতোমধ্যেই একেবারে প্রহসনে পরিণত করেছে। এর আগে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারবিরোধীরা জয়লাভ করে। কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত হয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দফায় দেখা গেছে, সরকার দলের লোকেরা ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়েছে। বাকি তিন দফা নির্বাচনে সরকার পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সব কিছু একেবারে মেরে কেটে দখল করে নিয়েছে। এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যারা জয়লাভ করেছিলেন তাদের বেশির ভাগকেই নানা ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়েছে এবং কৌশলে সরকার দলের প্যানেল মেয়রদের সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের ওপর আবার অনির্বাচিত এমপিদের খবরদারি তো আছেই। এই হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিস্থিতি।
তার মধ্যে সরকার যখন এই তিন সিটি করপোরেশনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত জানাল, তখন নির্বাচন কমিশন বলল, জুনের আগে এ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কিন্তু এর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই পুলিশ বাহিনী প্রধান যখন বললেন, না, এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচন করা সম্ভব। আশ্চর্য ঘটনা এই যে, যে পুলিশ বাহিনীর নির্বাচনকালে সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের হুকুমে চলবার কথা, সে পুলিশ বাহিনীর প্রধানের হুকুমে নির্বাচন কমিশন এপ্রিলের ২৮ তারিখেই নির্বাচন ঘোষণা করে দিলো। ধিক নির্বাচন কমিশন। সেইসাথে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটাও জানান দিলেন যে, কোনো রাজনৈতিক দল না এলেও নির্বাচন করতে তিনি বদ্ধপরিকর। হাঃ!
যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট শুধু এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের ভাষায় সরকার কিছুতেই এ নির্বাচন করতে সাহস পাবে না। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
লাইবেরিয়ান সাধারণ মানুষ নানা উপজাতীয় দলে বিভক্ত। কামড়াকামড়ি, হানাহানি তাদের জীবনের অঙ্গ। আধুনিক জীবনের চাহিদা খুব বেশি আছে বলেও মনে হয় না। লাইবেরিয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থাও নেই। যেটুকু আছে, তা ব্যবহার করেন শাসক শ্রেণী। এর পরেও যদি কারো বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় তাহলে তিনি নিজে জেনারেটর কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু মানুষ বড় ভালো। এরা বিদ্যুতের জন্য আমাদের দেশের হাড়-হাভাতে লোকদের মতো সড়ক অবরোধ করে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালিয়ে দেয় না। রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে নর্তন-কুর্দনও করে না। সেখানে নির্বাচন-টির্বাচন মাঝে মধ্যে হয়। ওগুলোও খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জোর করে ক্ষমতা দখলের জন্য মিলিটারিরও প্রয়োজন হয় না। পুলিশের সার্জেন্টও নির্বাচিত সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে। সেভাবেই সেখানে ১৯৮০ সালে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন সার্জেন্ট ডো।
বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মোটামুটি এমনই এক জায়গায় পৌঁছেছে। এখানে এখন র্যাব-পুলিশ-বিজিবি প্রধানরাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। রাজনীতিবিদদের যা বলার কথা সেগুলো এসব বাহিনীপ্রধানেরা গলা উঁচিয়ে বলতে কসুর করছেন না। মনে হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায় এরা আছেন চালকের ভূমিকায়, সরকার আছে পেছনে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সন্ত্রাসী বললেও এরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার ধার ধারছেন না। এরা একেবারেই বিরোধী দলকে নির্মূল করার ঘোষণা দিয়ে বসছেন এবং জানান দিচ্ছেন যে, ২০১৯ সালের আগে আর কোনো সাধারণ নির্বাচন হবে না। আর এ নিয়ে যদি কেউ আন্দোলন করে তবে এরা এক্কেবারে গুল্লি করে দেবে। কারণ তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে, তা খেলনা নয়।
যেখানে সরকারের মন্ত্রীরা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখতে যান, সেখানে থাকেন পুলিশ বাহিনীর প্রধানেরা। যে অপরিসীম ঔদ্ধত্যে তারা কথা বলেন, মন্ত্রীদের যদি ন্যূনতম কোনো ব্যক্তিত্ব থাকত, তাহলে ঘটনাস্থল থেকেই তাকে এরা এই বাহিনী থেকে চিরতরে বিদায় করে দিতেন। কিন্তু আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র। পুলিশপ্রধান যা বলেন, পুলিশের মন্ত্রী তার প্রতিধ্বনি করেন মাত্র। এসব মন্ত্রীকে ধিক্কার দেওয়াও অর্থহীন। কারণ এদের মন্ত্রী হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। শিক্ষা নেই। পারিবারিক ভিত্তি ভূমি নেই। মাঠের খিস্তি-খেউরের এরাই বাদশা। এবারের অনেক অনির্বাচিত এমপিই পুলিশের ওসি, এএসআইকে 'স্যার' 'স্যার' করেন। তেমন পুলিশনির্ভর একটি সরকারের কাছে খুব বেশি কিছু আশা করাও বাতুলতা মাত্র।
আর তাই যা ঘটার সেটাই ঘটছে। সরকার বেজায় চালাক। সরকার অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা কোনো দায়ই নিতে চাইছে না। বরং বলছে এটা আদালতের আদেশ। ওটা পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভাতিজির বাসা থেকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। তাদের সঙ্গে ছিল র্যাবের গাড়িও। কিন্তু প্রথম থেকেই র্যাব পুলিশের লোকেরা অস্বীকার করতে শুরু করল যে, তাদের কেউ মান্নাকে গুম বা অপহরণ করেনি। সরকারের প্রতিমন্ত্রীও ওই হুজুরদের সঙ্গে একমত হয়ে বলতে থাকলেন, না না, তারা কেউ মান্নাকে তুলে নিয়ে যায়নি। এ নিয়ে দেশজুড়ে ভয়াবহ আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। তবে কি মান্নার মতো একজন লোক রাতারাতি হাওয়া হয়ে গেলেন? সরকার তেমনি নির্বিকার ছিল। কিন্তু ২১ ঘণ্টা পর র্যাব স্বীকার করল, তারা মান্নাকে আটক করেছে, তবে ঘটনাস্থল বনানী নয়, ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডের স্টার কাবাবের সামনে থেকে। এইটুকু মিথ্যা না বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না। কিন্তু মিথ্যা না বললে যে সরকারের চলেই না। কিন্তু আমরা এখনো জানতে পারিনি, এই ২১ ঘণ্টা মান্না কোথায় ছিলেন।
এরপর ১০ মার্চ রাত ৯টা সাড়ে ৯টার দিকে উত্তরার একটি বাসা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর দায় স্বীকার করেনি। তার আগেও ২০১২ সালে এভাবেই র্যাব পরিচয়ে রাস্তা থেকে টেনে হেঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে। তারও আগে গুম হয়েছেন বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ আরো অনেকে। সরকার এসব গুমের ঘটনা কেবলই অস্বীকার করে গেছে। সালাহউদ্দিন, ইলিয়াস আলী , চৌধুরী আলমসহ কারো সন্ধান মেলেনি। সালাহউদ্দিনের গুমের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। কিন্তু সরকার সেই মিথ্যার আশ্রয়েই আছে। মিথ্যা তো সরকার মান্নার ক্ষেত্রেও বলেছিল। সেই সরকারি বাহিনীর কাছেই কিভাবে মান্নাকে পাওয়া গেল। এ থেকে সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো, এ সরকার মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ও মিথ্যা আশ্রয়ী।
উপরন্তু জনগণের ওপর এই সরকারের বিন্দুমাত্র আস্তাও নেই। কেননা এরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়। এ সরকার সম্পূর্ণরূপে জবরদখলকারী একটি সরকার। এরা ক্ষমতায় আসীন হয়েছে পুলিশি শক্তির জোরে। পুলিশ বাহিনীও জানে যে, তাদের শক্তি ছাড়া এই সরকারের পক্ষে সাত দিনও ক্ষমতায় আসীন থাকা সম্ভব নয়। ঠিক সে কারণেই এই বাহিনী নরহত্যার সব দায়মুক্তি চাইতে সাহস করেছে। সেজন্য আইন পরিবর্তনেরও দাবি তুলেছে। ধারণা করি, সরকার সে দাবিও শিগগির মেনে নিয়ে একচ্ছত্র পুলিশি শাসন প্রতিষ্ঠা করবে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে যে নির্বাচনী প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে প্রহসন দেশে বিদেশে কেউই মেনে নেয়নি। সবাই বলেছে, সবার অংশগ্রহণমূলক আরেকটি নির্বাচনের আয়োজন করা হোক। সরকার তার থোড়াই পরোয়া করেছে। যদিও ওই নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশী-বিদেশী চাপে সরকার ঘোষণা করেছে যে, শিগগিরই তারা সবার অংশগ্রহণমূলক আরেকটি নির্বাচন দেবে। কিন্তু এখন সে কথা অস্বীকার করছে সরকার। বলছে, ২০১৯ সালের আগে কোনো অবস্থাতেই আর কোনো নির্বাচন তারা করবে না।
ইতোমধ্যে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে তারা কারাগারে পুরেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজ অফিস ভবনে গত আড়াই মাস ধরে অন্তরীণ আছেন। সেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতা কারাগারে বন্দী। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষস্থানীয় সব নেতার নামে শত শত মামলা। খালেদা জিয়ার নামেও মামলার শেষ নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর তথাকথিত ঋণখেলাপি মামলায় খালেদা জিয়া, কোকোর স্ত্রী ও তার দুই নাবালিকা মেয়ের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। নিষ্ঠুরতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার এমন ইতর নজির আধুনিক বিশ্বে কমই আছে।
একটি নতুন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে গত আড়াই মাস ধরে সারা দেশে অবরোধ পালন করা হচ্ছে। এর মধ্যে আসছে সপ্তাহের পাঁচ দিন হরতাল। এই আন্দোলন থেকেই জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে এখন সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ডাক দিয়েছে। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনগুলোকেও সরকার ইতোমধ্যেই একেবারে প্রহসনে পরিণত করেছে। এর আগে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারবিরোধীরা জয়লাভ করে। কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত হয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দফায় দেখা গেছে, সরকার দলের লোকেরা ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়েছে। বাকি তিন দফা নির্বাচনে সরকার পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সব কিছু একেবারে মেরে কেটে দখল করে নিয়েছে। এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যারা জয়লাভ করেছিলেন তাদের বেশির ভাগকেই নানা ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়েছে এবং কৌশলে সরকার দলের প্যানেল মেয়রদের সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের ওপর আবার অনির্বাচিত এমপিদের খবরদারি তো আছেই। এই হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিস্থিতি।
তার মধ্যে সরকার যখন এই তিন সিটি করপোরেশনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত জানাল, তখন নির্বাচন কমিশন বলল, জুনের আগে এ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কিন্তু এর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই পুলিশ বাহিনী প্রধান যখন বললেন, না, এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচন করা সম্ভব। আশ্চর্য ঘটনা এই যে, যে পুলিশ বাহিনীর নির্বাচনকালে সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের হুকুমে চলবার কথা, সে পুলিশ বাহিনীর প্রধানের হুকুমে নির্বাচন কমিশন এপ্রিলের ২৮ তারিখেই নির্বাচন ঘোষণা করে দিলো। ধিক নির্বাচন কমিশন। সেইসাথে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটাও জানান দিলেন যে, কোনো রাজনৈতিক দল না এলেও নির্বাচন করতে তিনি বদ্ধপরিকর। হাঃ!
যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট শুধু এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের ভাষায় সরকার কিছুতেই এ নির্বাচন করতে সাহস পাবে না। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
__._,_.___