বারোই মার্চের পর তাদের বিদায় করে দেব :খালেদা
লেখক: চাঁদপুর থেকে আনোয়ার আলদীন/গোলাম কিবরিয়া জীবন | মঙ্গল, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২, ২ ফাল্গুন ১৪১৮
++ সরকারকে লুলা ও ল্যাংড়া বানিয়ে ছাড়ব
++ আগামী নির্বাচনে জয়লাভের ষড়যন্ত্র করছে সরকার
++ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না
চাঁদপুরের বিশাল জনসভায় দাঁড়িয়ে বিএনপি চেয়ার-পারসন বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার আহবান জানিয়ে বলেছেন, এই ব্যর্থ সরকারের যদি বোধোদয় না হয় তাহলে যা করার আমরা করবো। ১২ মার্চের পর গণভিত্তিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দেব, ঢাকায় সবাইকে অবস্থান করতে হবে। আমিও আপনাদের সঙ্গে থাকবো। তাদেরকে বিদায় করে দেব। বেগম জিয়া বলেন, এই ব্যর্থ সরকার খুঁড়িয়ে চলতে পারে। আমরা তাদেরকে ফেলতে চাই না। দেখি তারা খুঁড়িয়ে কতদূর যেতে পারে। সরকারকে লুলা ও ল্যাংড়া বানিয়ে ছেড়ে দিতে চাই।
খালেদা জিয়া বলেন, আগামীতে অবশ্যই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। আপনাদের যদি তত্ত্বাবধায়ক নামটি পছন্দ না হয় তাহলে অন্য যে কোনো নামে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন আমাদের আপত্তি থাকবে না। গতকাল সোমবার বিকালে চাঁদপুর স্টেডিয়াম মাঠে জেলা বিএনপি আয়োজিত বিশাল সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন চাঁদপুর জেলা বিএনপি’র সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মুমিনুল হক। অন্যান্যের মধ্যে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এমকে আনোয়ার, হান্নান শাহ, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাসসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
খালেদা জিয়া চারটা ৫০ মিনিটে বক্তৃতা শুরু করে ৫টা ২৫ মিনিটে বক্তব্য শেষ করেন।
বেগম জিয়া ঢাকা থেকে বেলা সোয়া এগারোটায় রওয়ানা করে বিকাল পৌনে চার টায় চাঁদপুর পৌঁছান। আধা ঘন্টা চাঁদপুর সার্কিট হাউসে বিশ্রাম নিয়েই তিনি সোয়া চারটায় মঞ্চে ওঠেন। এসময় স্টেডিয়ামের সমাবেশে যোগ দেয়া হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিতে দিতে তাকে বরণ করে নেয়।
খালেদা জিয়া বলেন, ১২ মার্চ ঢাকা চলো কর্মসূচিতে মানুষের ঢল নামবে ইনশাল্লাহ। মন্ত্রীরা আবোল-তাবোল বকতে শুরু করেছে। তারা নাকি ঢাকা দখল করবে। আমরা দখল করতে চাই না। আমাদের সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। তারা যদি দখল করতে চায় তাহলে দেখা যাক! তবে আমি সাবধান করে দিতে চাই ওই দিন পাল্টা কোনো কর্মসূচি দেবেন না। দিলে তার দায়িত্ব আপনাদের নিতে হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, ২৯ জানুয়ারি গণমিছিলে দুই জন ছাত্রনেতাকে সরকারের নির্দেশে পুলিশ গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তিন বছরে তারা কিছুই দিতে পারেনি। প্রতিনিয়ত লাশ উপহার দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে আইন-শৃঙ্খলা নাকি ভালো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত ছিলো অনেক আগেই পদত্যাগ করা।
তিনি বলেন, এই সরকার হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার পর আবার মাফ করে দেয়। এদেশে গণতন্ত্র আইনের শাসন নেই। তারা মানুষ হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি করে। আওয়ামী লীগের অতীত কলঙ্কময়। তারা কখনোই গণতন্ত্রের চর্চা করেনি। তারা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলো। চারটি সংবাদপত্র রেখে সব বন্ধ করে দিয়েছিলো। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তাদের নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করেছিলো।
লাল বাহিনী নীল বাহিনী রক্ষী বাহিনী ঘর থেকে মানুষ তুলে নিয়ে হত্যা করতো। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো প্রতিদিন মানুষ হত্যা হচ্ছে। গত তিন বছরে তারা ১২ হাজার মানুষ হত্যা করেছে। দুদিন আগে ঘরে ঢুকে দুই জন সাংবাদিককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘরেও এখন মানুষ নিরাপদ নয়। সেই হত্যাকারীদের এখনো পুলিশ ধরতে পারেনি। নিরীহ কাউকে ধরে বলবে এইতো ধরেছি।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, সরকার গলাবাজি আর মানুষ খুন ছাড়া কিছু পারে না। দেশে কোনো উন্নয়ন নেই। চাল, ডাল, লবণ, তেল, ডিমের দাম বেশি। তারা কথা দিয়েছিলো ঘরে ঘরে চাকরি দেবে। দিয়েছে? দেয়নি।
বিদেশে এখন লোক যেতে পারছে না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে মানুষ শূন্যহাতে ফেরত আসছে। সরকার এখন বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। বন্ধুহীন কখন হয়—যখন সরকার দুর্বল হয় ও অন্ধভাবে কোনো দেশের আনুগত্য করে।
চাঁদপুরের জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের জেলার মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন না, কেনো সীমান্তে পাখির মতো মানুষ হত্যা করছে। ফেলানী আপনাদের বোন, আমাদের মেয়ে তাকে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। একজনকে কাপড় খুলে পিটিয়েছে। পাথর ছুঁড়ে মানুষ হত্যা করছে। তারা বলে, হত্যা আরো করবে। কিন্তু এর কোনো প্রতিবাদ হয় না।
তিনি বলেন, এই হত্যা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে আমাদের সীমান্ত রক্ষী যারা আছে তাদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
যুবকদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, যুবকদের কাজ নেই। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিছু করবে কিন্তু ব্যাংকে টাকা নেই। সব টাকা সরকার ঋণ নিয়ে গেছে। সরকার চাকরি দিতে পারে না। ব্যাংক দেউলিয়ার পথে। তিন বছরে নতুন কোনো শিল্প কলকারখানা বেড়ে ওঠেনি। বেকারত্ব বেড়েছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ার বাজার লুট হয়। আমাদের সময় এমন হয়নি। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শেয়ার বাজার লুট করেছিলো। এবারো হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর দেড় কোটি পরিবার আজ নিঃস্ব। এর জন্য তারা প্রতিবাদও করতে পারবে না। প্রতিবাদ করলে জেলে নেয়া হয়। নির্যাতন করা হয়। অনেকে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে।
তিনি বলেন, এই সরকারের আমলে দেশের মানুষ কিছু পায়নি। পেয়েছে শুধু লাশ আর লাশ। সরকারের উদ্দেশে বলেন, আপনারা আর কত লাশ চান। আর কত রক্ত চান। আর কত মায়ের বুক খালি করতে চান। কত বোনকে বিধবা করতে চান। কত শিশুকে পিতৃহারা করতে চান? আপনাদের কি খুনের পিপাসা মেটেনি।
বেগম জিয়া চাঁদপুরে নিহতদের আলোকচিত্র দেখিয়ে বলেন, তারা শুধু গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি। এই ছবিতে দেখেন কিভাবে উলঙ্গ করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তে যেভাবে উলঙ্গ করে পিটিয়েছে পুলিশও তাই করছে। এরা কি বাংলাদেশের পুলিশ? আগে কখনো এরকম দেখিনি।
পুলিশের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু বাড়াবাড়ি করবেন না। গুলি করে হত্যা করে অতীতে আন্দোলন দমন করা যায়নি। এখনো যাবে না। বরং আরো বেগবান হয়। আমি চাঁদপুরবাসীকে কথা দিলাম হত্যাকারীদের বিচার করবো। এখন না হলেও একদিন বিচার হবেই ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি। তাই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়েছি। তবুও তারা বাধা দেয়। জনগণ হরতাল করে আমাদের পিকেটিং করার দরকার হয় না। হত্যা করে ভয় দেখিয়ে কর্মসূচি দমন করা যায়নি। আগামীতেও যাবে না।
তিনি বলেন, সারা দেশে শান্তিপূর্ণ রোডমার্চে মানুষের ঢল দেখে সরকারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তারা ভীতু হয়ে গেছে। গণমিছিলে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করার জন্য ২৯ জানুয়ারি তারা পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছিলো। আমরা একদিন পিছিয়ে ৩০ জানুয়ারি কর্মসূচি দিয়েছিলাম। সেই গণমিছিলে জনজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিলো।
আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ষড়যন্ত্র করছে সরকার এমন অভিযোগ এনে তিনি বলেন, আগামীতে ফখরুদ্দিন-মইন উদ্দিন নেই তাদের আবার ক্ষমতায় বসাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কোর্টের দোহাই দিয়ে উঠিয়ে দিয়েছে। কোর্ট বলেছে, আরো দুইটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তারা একথা না শুনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে।
তিনি বলেন, সরকার চায় নিজেরা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও এমপি থেকে নির্বাচন করবে। তবে তা নির্বাচন হবে না। এই আওয়ামী লীগ সেই আওয়ামী লীগ যারা হেলিকপ্টারে করে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে এনে গণভবনে বসে ফল ঘোষণা করেছিলো।
খালেদা জিয়া বলেন, সরকার বিজয় নিশ্চিত করতে ইভিএম দিয়ে নির্বাচন করতে চায়। এই মেশিন আমেরিকা, জার্মানীসহ বিশ্বের বড় দেশ বাতিল করেছে। তারা বলেছে, এই মেশিন দিয়ে কারচুপি করা যায়। আপনি ভোট দেবেন ধানের শীষে যাবে নৌকায়। আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। ইভিএম-এ কোনো নির্বাচন হবে না। হাতের টিপ সই দিয়ে আগের মতোই ভোট দেবে মানুষ।
খালেদা জিয়া বলেন, দ্রুত টাকা বানানোর জন্য তারা কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট বানিয়েছে। বিদ্যুত্ সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি। কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়েছে। সামনে গরম আসছে কেমন লোডশেডিং হয় বুঝতে পারবেন।
তিনি বলেন, আমরা যে পরিকল্পনা নিয়েছি তাতে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। দেশের মানুষ সুখে থাকতে পারবে। দেশকে অর্থনৈতিভাবে সুখি সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলবো।
চাঁদপুর জেলা বিএনপি আয়োজিত স্টেডিয়ামের বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথি খালেদা জিয়া ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এমকে আনোয়ার, আসম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম-মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, বরকত উল্লাহ বুলু, মিজানুর রহমান মিনু, মো. শাহজাহান, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খন্দকার, এম ইলিয়াস আলী, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী নুরুল হুদা, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এমপি, হারুন অর রশীদ এমপি, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন, সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া এমপি, রাশেদা বেগম হীরা এমপি, সাবেক এমপি জিএম ফজলুল হক, যুবদলের সভাপতি এডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মহিলা দলের সভাপতি নুরী আরা সাফা, সেক্রেটারি শিরিন সুলতানা, তাঁতী দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি এম এ তাহের, শ্রমিক দলের আমীর হোসেন, সফিকুর রহমান কিরন, জামায়াতের চাঁদপুর জেলা আমীর মাওলানা আহমদ উল্লাহ, বিএনপি’র জেলা সেক্রেটারি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক, সফিকুর রহমান ভুঁইয়া, বিল্লাল হোসেন মিয়াজী, আনোয়ারুল করিম, আবদুল হামিদ মাস্টার, জহির উদ্দিন বাবর প্রমুখ।
অভিনব প্রতিবাদ
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার জগতপুর বাজারে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে কয়েদীর পোশাক গায়ে দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ জানায়। পোশাকে ডিজিটাল হাসিনার উপহার, সারা কচুয়া কারাগার কয়েদী নম্বর... উত্কীর্ণ ছিলো।
এ সময় কয়েক হাজার মানুষ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে নানা শ্লোগান দিতে থাকে। তাদের সঙ্গে ছিলেন আ ন ম এহসানুল হক মিলন।
জগতপুর বাজারটি সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আ ন ম এহসানুল হক মিলনের নির্বাচনী এলাকা।
__._,_.___