মগবাজার টি এন্ড টি মসজিদের গলিতে আমার বাসা হওয়ায় আমার ভোটকেন্দ্র টি এন্ড টি হাই স্কুলে। সবাই জানেন যে, ওয়্যারলেস মোড় থেকে নয়াটোলা হয়ে মধুবাগ, মিরবাগ অঞ্চল জামায়াতে ইসলামী অধ্যুষিত এলাকা। তাই টি এন্ড টি ভোটকেন্দ্রে বিএনপি-জামায়াত জোট শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পাবে। ভোটের দিনেও দেখা গেল সারাদিন আনন্দে হই চই করে ধানের শীষ মার্কায় ভোট দিলাম। কিন্তু রাতে রেজাল্ট শুনে আক্কেল গুড়ুম। নৌকা মার্কা জিতে গেছে। অথচ ভোটকেন্দ্রে কেউ জোর করে জাল ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরেছে সেরকম ঘটনাও ঘটতে দেখিনি। তাহলে কোথায় এই শভঙ্করের ফাঁক!
আমার বাসা থেকে ২০০/২৫০ গজের মধ্যেই তো আমাদের ভোটকেন্দ্র টি এন্ড টি স্কুল। তাই সকাল সকাল নাস্তা সেরেই হেঁটে চলে এলাম কেন্দ্রের পরিবেশ দেখতে। দেখলাম নীচতলায় ৫টি এবং দোতলায় ৬টি বুথ করা হয়েছে। কিন্তুু তখনও বুথের সামনে ভোটারদের লাইন ধরে দাঁড়ানো শরু হয়নি। স্কুল মাঠের মধ্যে ২০/৩০ জন লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং আড্ডা দিচ্ছে। সবাই আমার পরিচিত এবং ধানের শীষ মার্কার লোকজন।
সকাল সাড়ে সাতটার দিকে একটি জীপ এবং একটি ট্রাক এসে স্কুল-মাঠের পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত বড় ঘরটির সামনে দাঁড়ালো। সবাই বলাবলি করতে লাগলো যে, প্রিজাইডিং অফিসার এসেছেন। উনি জীপ থেকে নেমে সরাসরি বড় ঘরটিতে গিয়ে ঢুকলেন। পুলিশ ও আনসাররা ট্রাক থেকে ভোটের সরঞ্জামাদি অর্থাৎ ব্যালট বাক্স (অন্তত ৩০/৩৫টি হবে), ব্যালট পেপার, সীলমোহর, স্ট্যাম্প প্যাড ইত্যাদি অতি দ্রুত প্রিজাইডিং অফিসারের রুমে নিয়ে গেল। দরজায় দাঁড়ানো দু'জন পুলিশ। কেউ ভিতরে ঢুকতে না পারে সেজন্য।
বুথগুলো আগে থেকেই প্রস্তুত করা ছিল। পোলিং অফিসাররা তাদের নিজ নিজ বুথে ঢুকে বসলেন। পুলিশ ও আনসাররা বুথের প্রয়োনীয় সরঞ্জামাদি প্রিজাইডিং অফিসারের রুম থেকে নিয়ে প্রতিটি বুথে পৌঁছে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোটগ্রহণ শুরু হবে। ভোটারদের মধ্যে যাদের অন্য কোন কাজ আছে তারা বুথের সামনে লাইন ধরে দাঁড়াতে লাগলো। মাঠের মধ্যে ততক্ষণে শতখানিক লোকের সমাগম হয়ে গেছে। অনেকের বুকে ধানের শীষ মার্কা পিন দিয়ে আটকানো দেখা গেল কিন্তু নৌকা মার্কা কাউকে তখনো দেখা গেল না। ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে গেল।
আমি দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর ভোট দিব। তাই এর ওর সাথে আড্ডা দিতে লাগলাম। ইতোমধ্যে স্কুল বাউন্ডারির বাইরে বাদামওয়ালা, ঝালমুড়িওয়ালা, চিপস ও চা-বিস্কুটওয়ালারা তাদের পসার সাজিয়ে বসেছে বা ফেরি করতে শুরু করছে। আমরাও ২/৩ জন মিলে কখনো বাদাম, কখনো বিস্কুট, কলা, চা ইত্যাদি খেলাম। আস্তে আস্তে ভোটারদের লাইন লম্বা হতে লাগলো। একটা বুথের ভোটবাক্স ভরে গেলে সেই ভোটবাক্স প্রিজাইডিং অফিসারের রুমে পোঁছানো হচ্ছে, নতুন আর একটি সেই বুথে দিয়ে আসা হচ্ছে। দুপুরের দিকে বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে পুনরায় ভোট দিতে আসলাম। এবারও ঐ রকম দৃশ্যই চোখে পড়লো। নিজের বুথে যেয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়াই ভোট দিলাম। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা শুনতে পেলাম না।
আসল ঘটনা হলো- প্রথমে যে ৩০/৩৫টি ভোটবাক্স প্রিজাইডিং অফিসারের রুমে রাখা ছিল, পরে প্রতিটি বুথের ব্যালটবাক্স ভোট দেয়ার পর ঐ অফিসের মধ্যে রাখা হচ্ছিল। এখানেই শুভঙ্করের ফাঁক! প্রিজাইডিং অফিসার প্রথমে যে ৩০/৩৫টি ব্যালট বাক্স নিয়ে রুমে ঢুকেছিলেন তার মধ্যে ৬/৭টি বাক্স নৌকা মার্কা ব্যালটে ভর্তি করাই ছিল। তখন ১৫/২০টা ভোট দেয়া ভোটবাক্স অন্যান্য ভোট নেয়া বাক্সের মধ্যে মিলিয়ে ফেলা হলো। ভোটাররা কেউ জানতেও পারলেন না যে কি সর্বনাশ হয়ে গেল। রাতে ভোটগ্রহণ শেষ হলে উভয় পার্টির এজেন্টদের সামনে ভোটবাক্স খুলে স্তূপ করা হলো। আবার আর একটি কা- করা হলো- ব্যাটের স্তূপকে ২/৩ জন লোক উছলিয়ে, উছলিয়ে একাকার করে ফেললো। যাতে নৌকামার্কা ব্যালট পেপার একের পর এক না হয়ে যায়। সে জন্যই পরে শোনো গিয়েছিল যে, এখানে ওখানে অনেক ব্যালট পেপার জনগণ কুড়িয়ে পেয়েছিলন। তখন কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যার চেয়েও বেশি ভোট কাস্ট হয়েছিল যার পরিমাণ শতকরা ১০৫ ভাগ। এভাবেই ২০০৮ সালের ভোট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চিচিং ফাঁক হয়েছিল।
আনোয়ার হোসেন, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭
__._,_.___