Banner Advertise

Friday, February 28, 2014

[chottala.com] স্বাধীন রাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ



স্বাধীন রাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ

আ বু রূ শ্ দ


জেনারেল গিয়াপ। সামরিক ইতিহাসে এক কিংবদন্তি। ইতিহাসবিদদের অনেকেই তাকে তুলনা করেছেন ফিল্ড মার্শাল রোমেল, অ্যাডমিরাল ওয়েলিংটনের সঙ্গে। ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন ভিয়েতমিন ও পিপল্স আর্মির কমান্ডার, পরবর্তীকালে স্বাধীন ভিয়েতনামের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তার মাপের একজন সমরনেতা এই উপমহাদেশে তো বটেই, পৃথিবীতেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ১৯৫৪ সালে দিয়েন বিয়েন ফু'র যুদ্ধে তার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে উপনিবেশবাদী ফরাসিরা লজ্জাজনক পরাজয়ের মুখোমুখি হয়। গত বছরের ২৫ আগস্ট জেনারেল গিয়াপের বয়স একশ' পূর্ণ হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও আইন বিষয়ে তিনি ছিলেন হ্যানয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। শিক্ষকতা করতেন, একইসঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। যৌবনের পুরোটা সময় কেটেছে ফরাসি ও মার্কিনিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। স্বাভাবিক সংসার জীবন কাটাতে পারেননি। তার মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা ও ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো যুদ্ধের গৌরব পৃথিবীতে সম্ভবত আর কোথাও নেই।

মহাপরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধ দমনের জন্য কি না করেছে। লাখ লাখ টন নাপাম বোমা ফেলেছে বি-৫২ বোমারু বিমান দিয়ে, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে যত্রতত্র, মাইলাই হত্যাকাণ্ডের মতো অবর্ণনীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে কোনো ভাবান্তর ছাড়া। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পুরো পৃথিবীতে যত বোমাবর্ষণ করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি বোমা ফেলা হয়েছে ভিয়েতনামে। ওই যুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ভিয়েতকংদের মূল সহায়তাকারী ছিল চীন। তারা ভিয়েতকংদের অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহসহ প্রশিক্ষণ সহায়তা প্রদান করেছে। চীনের অনেক সৈন্য, পাইলট মার্কিনিদের বিরুদ্ধে লড়েছে ও জীবন দিয়েছে। নৈতিক সমর্থন তো ছিলই। সেই বিবেচনায় ভিয়েতনামের রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে 'বন্ধুরাষ্ট্র' হিসেবে চীনের একটা বড় অবস্থান থাকার কথা।

আরও একধাপ বাড়িয়ে বললে বলতে হয়, চীনের ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতাই ছিল ভিয়েতনামের ললাটলিপি। চীন যেহেতু মহাশক্তি তাই দুর্বল ভিয়েতনামের ওপর প্রভাব বিস্তার করাটাও হতো স্বাভাবিক। বাংলাদেশ যেমন আজ কথায় কথায় 'মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার ঋণ পরিশোধের' নামে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে প্রতিবেশী ভারতকে, 'কৃতজ্ঞতা প্রকাশের' বাণী শুনতে হয় স্বাধীনচেতা বাংলাদেশীকে রাতদিন প্রতিদিন, তেমনি ভিয়েতনামেও সেরূপ চিত্রটিই হয়তো দেখতে হতো ভিয়েতনামীদের। কিন্তু কি আশ্চর্য! ভিয়েতনামীরা যেন সব 'রাজাকার', 'অকৃতজ্ঞ' হয়ে গেছে! ভুলে গেছে 'বন্ধুপ্রতিম' রাষ্ট্রের অবদান! যদি তাই না হবে তাহলে যে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে লড়েছে ভিয়েতনাম তারা কীভাবে 'শত্রু রাষ্ট্রের' সহায়তা চাইতে পারে 'বন্ধু রাষ্ট্রের' বিরুদ্ধে?

২০১১ সালের জুলাই মাসে ভিয়েতনাম যৌথ নৌ মহড়া পরিচালনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন নৌবাহিনীর তিনটি যুদ্ধজাহাজ রিয়ার অ্যাডমিরাল টম কার্নির নেতৃত্বে ভিয়েতনামের দানাং শহরের তিয়েন নৌ ঘাঁটিতে এসে পৌঁছায় ৯ জুলাই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঠিক এখানেই ছিল মার্কিন নৌ বাহিনীর বিশাল ঘাঁটি। মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলো সাত দিনব্যাপী যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়া ছাড়াও ভিয়েতনাম নৌবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভিয়েতনাম হুট করেই কিন্তু মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলোকে আমন্ত্রণ জানায়নি। বরং জুন মাসে দক্ষিণ চীন সাগরে একটি বিরোধপূর্ণ এলাকা নিয়ে ভিয়েতনাম নৌবাহিনী চীনা নৌবাহিনীর বিপরীতে মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু শক্তিশালী চীনা নৌবাহিনীর সঙ্গে ভিয়েতনাম পেরে উঠতে পারবে না বলে তাদের সরকার পরাশক্তি মার্কিনিদের সহায়তা নেয় ওই এলাকায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য।

আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভিয়েতনামের রফতানি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভিয়েতনামে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক নম্বরও ওই মার্কিনিরা! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন 'বন্ধুরাষ্ট্র' চীনকে মোকাবিলার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করে ভিয়েতনাম কি স্বাধীনতাবিরোধী হয়ে গেছে? যতটুকু বুঝি তাতে দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশের 'স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির' দাবিদারদের কেউ যদি আজ ভিয়েতনামে থাকতেন তাহলে অতি অবশ্যই এ ধরনের সিদ্ধান্তকে রাজাকারী সিদ্ধান্ত বলে চিত্কার-চেঁচামেচি শুরু করে দিতেন। এবং তাদের 'সপক্ষের' মিডিয়ার প্রচারণার ফ্রিকোয়েন্সি হতো বিশ্ব রেকর্ড করার মতো।

আরেকটি খবরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করছি। বছর দেড়েক আগে ভিয়েতনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি সই করেছে। এছাড়া লাখ লাখ মার্কিনি ছুটে যাচ্ছে ভিয়েতনামে পর্যটনের নেশায়। ভিয়েতনামও মার্কিন পর্যটকদের জন্য দিয়েছে বিশেষ সুবিধা। হায়, ভিয়েতনামের স্বাধীনতার চেতনা গেল বলে! কিমাশ্চর্যম, স্বাধীনতা পাওয়ার কয়েক বছরের মাথায় ভিয়েতনাম সীমান্ত ইস্যু নিয়ে যুদ্ধ করেছে মহাচীনের মহাশক্তিধর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এবং তাদের প্রবল বিক্রমে রুখেও দিয়েছে।

এই তো মাত্র বছর তিনেক হলো চীন বাধ্য হয়েছে ভিয়েতনামের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে ভিয়েতনামের শর্তে চুক্তি করতে। ভিয়েতনামীরা কি সব 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র বিপক্ষে চলে গেছে! কি জানি, হতেও পারে! তবে এটুকু বলা অসঙ্গত হবে না যে, ভিয়েতনাম চীনের বিপরীতে ক্ষুদ্র শক্তি হলেও তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতিগত মান-মর্যাদা বজায় রাখার জন্য যা করেছে তা তাদের জন্য ন্যায়সঙ্গত। এমন সিদ্ধান্ত না নিলে তারা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল করত। ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকত না। তাদের জাতীয় স্বার্থ হতো বিঘ্নিত। তারা ভালো করেই জানে ও বুঝে, আজকের শত্রু কালকের মিত্র হতে পারে, বন্ধু হতে পারে বৈরী শক্তি। পারিপার্শ্বিকতার দৃষ্টিতে, কৌশলগত বিবেচনায় তাই শত্রু মিত্র সময় সময় পরিবর্তন হয়। কিন্তু পৃথিবীতে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে আমাদের মাতৃভূমি। সুনিশ্চিত করে বললে বলতে হয়, একটি বিশেষ শ্রেণী যারা মহান মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে অহরাত্রি তাদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত তারা ফারাক্কা, সীমান্ত হত্যা, ৫৪ নদীতে বাঁধের কথা বেমালুম চেপে গিয়ে 'একমাত্র বন্ধুরাষ্ট্রের' থিয়োরি দাঁড় করিয়েছেন। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের চেয়ে তাদের কাছে বড় হচ্ছে 'বন্ধুরাষ্ট্রের' স্বার্থ! বাংলাদেশ আজ কি করছে তা বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। 'বন্ধুরাষ্ট্র, বন্ধুরাষ্ট্র' বলে যেসব নসিহত আমাদের প্রতিদিন শুনতে হচ্ছে তা কী কারণে আল্লাহই জানেন।

যা হোক, একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথায় আসি। মিডিয়া টিমের সদস্য হিসেবে ২০০৬ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। আমাদের দলনেতা ছিলেন দ্য ডেইলি স্টারের স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্স এডিটর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম খান। তিনি প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক মাওলানা আকরম খাঁ'র নাতি। শহীদ অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী (অব.) তার স্ত্রীর বড় ভাই। এদের মাঝে কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী পাকিস্তানেই থেকে গেছেন। ওই দেশ সফরকালে মিডিয়া টিমের সবাই তার সঙ্গে সাবেক জয়েন্ট চিফস্ অব স্টাফ জেনারেল আজিজ খানের বাসায় দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত পেয়েছিলাম। সেখানে আরও ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, কর্নেল কামাল। এরা উভয়েই জাতিগত পরিচয়ে বাঙালি। কর্নেল কাইয়ুম তো পাকিস্তানের ইন্টেলেকচুয়াল সার্কেলে রীতিমত নমস্য ব্যক্তি।

যতসব 'অদ্ভুত' বিষয় নিয়ে আমার বরাবরই আগ্রহ। তাই কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী সম্পর্কে আগে থেকেই জানতাম। সেনাবাহিনীতে থাকাকালে আমার একজন সিও—কমান্ডিং অফিসার যার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, তিনি দ্বিতীয়বারের মতো স্টাফ কলেজ কোর্স করেছিলেন পাকিস্তানের কোয়েটায়। সেখানে লেকচার দিতে গিয়েছিলেন কর্নেল কাইয়ুম। তার কাছে আমার সিও বাংলায় বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলেন। এখানে সেসব আর নাইবা বললাম। এক ভাই পাকিস্তানে থেকে গেলেন সেদেশের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে, আরেক ভাই শহীদ হলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, অন্য ভাই বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি হলেন একসময়; আর বোন ফেরদৌসী মজুমদার তো বাঙালি সংস্কৃতি জগতের ধ্রুবতারা! পৃথিবীটাই এমনসব 'অদ্ভুত' বিষয় নিয়ে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। ইতিহাসও ঘুরছে, মাঝে মাঝে উগ্রতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এসএসজি বা দুর্ধর্ষ কমান্ডো বাহিনীর জনক ছিলেন মেজর জেনারেল এ ও মিঠা, আবুবকর ওসমান মিঠা। তদানীন্তন বোম্বের বিখ্যাত মেমন পরিবারের সন্তান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ভারত ছেড়ে পাক সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তার পরিবারের অন্যসব সদস্য থেকে যান ভারতে। তার স্ত্রী ইন্দু চ্যাটার্জি ছিলেন ভারতীয়। ১৯৭১-এ বাঙালিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অমানবিক সামরিক অ্যাকশনের অন্যতম পরিকল্পক ছিলেন মিঠা। তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে তার স্ত্রী একজন বাঙালি! মিঠার শ্বশুর প্রফেসর গণেশ সি চ্যাটার্জি ও শাশুড়ি থাকতেন ভারতের দিল্লিতে। মিঠা যখন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির কমান্ড্যান্ট তখন শ্বশুর-শাশুড়ি কাকুলে তার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন, অনেকদিন পর তারা তাদের মেয়েকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন (আনলাইকলি বিগেনিংস—মে.জে. এ ও মিঠা)।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেকশ' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন মেজর হিসেবে। তার একই ইউনিটে অফিসার ছিলেন পরবর্তীকালে পাক সেনাবাহিনীর বাঘা অফিসার লে.জে. এম আতিকুর রহমান। যুদ্ধের একপর্যায়ে মানেকশ' আহত হলে তাকে কাঁধে করে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলেন আতিকুর রহমান। ১৯৭১ সালের পর মানেকশ' যখন অফিশিয়াল আলোচনার লক্ষ্যে পাকিস্তানে যান তখন তিনি আতিকুর রহমানের সঙ্গে একান্তে বেশকিছু সময় কাটান একসময়ের সহযোদ্ধার প্রতি সম্মান দেখিয়ে (ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন—লে.জে. এম আতিকুর রহমান)। মানেকশ' এখানেই ক্ষান্ত হননি। পাকিস্তান যাওয়ার আগে তিনি পাক সেনা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন খাবার জন্য যেন তার প্যারেন্ট ইউনিট (যে রেজিমেন্টে তিনি কমিশন পান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করেন) ৬ এফএফ'র পুরনো ঐতিহ্যবাহী সিলভার কাটলারির ব্যবস্থা করা হয়। ৬ এফএফ তখন ছিল ওকারায়। পাক কর্তৃপক্ষ ততদিনে স্টোররুমে রেখে দেয়া সেইসব পুরনো কাটলারিজ খুঁজে এনে মানেকশ'র সামনে হাজির করে লাহোরে।

আরও মজার ব্যাপার, ওই ইউনিটের অফিসার মেজর শাব্বির শরীফ ১৯৭১-এর যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। তাকে দেয়া হয়েছিল পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব—'নিশান ই হায়দার' যা আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ'র সমতুল্য। মানেকশ' সেই বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মন্তব্য করেন, তিনি খুবই গর্বিত যে একসময় যে ইউনিটে তিনি কর্মরত ছিলেন সেই ইউনিটের একজন অফিসার হিসেবে শাব্বির শরীফ তার (মানেকশ') নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিশান-ই হায়দার খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। (Cry The Beloved Country- Details Crucial Facts From Our History By Hamid Hossain, Bangladesh Defence Journal, December 2008 Issue)। আরেকজন বিখ্যাত জেনারেলের কথায় আসি। তিনি হচ্ছেন ১৯৭০-৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে.জে. সাহাবজাদা ইয়াকুব খান। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ দিয়ে তিনি বাঙালিদের ওপর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়ার নির্দেশ অমান্য করে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খান তাকে মেজর জেনারেল পদে পদাবনতি দিয়ে সামরিক বাহিনী থেকে বের করে দেন। এখনও তিনি বেঁচে আছেন। থাকেন লাহোরে। এই সাহাবজাদা ইয়াকুব খান ভারতের রামপুরের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। তিনি ভারতের দেরাদুনে অবস্থিত রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি (বর্তমানে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি) থেকে কমিশন লাভ করেন। তার আপন বড় ভাই সাহাবজাদা মুহাম্মদ ইউনুস খান কমিশনপ্রাপ্ত হন ব্যাঙ্গালোরের অফিসার্স ট্রেনিং স্কুল—ওটিএস থেকে। ১৯৪৭ সালে ইয়াকুব চলে আসেন পাকিস্তানে। কিন্তু তার ভাই থেকে যান ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। ১৯৪৮ সালে প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধের সময় একই রণাঙ্গনে এপার-ওপারে দুই ভাই তার দেশের সেনাবাহিনীর পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে ইউনুস খান ভারতের রাষ্ট্রপতির ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারি হয়েছিলেন ও কর্নেল পদে অবসর লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী চাইলে ইউনুস খানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার ভাই হিসেবে 'পাকি রাজাকার'র সিল মেরে দিতে পারতো। পাক সেনাবাহিনীও পারতো ইয়াকুব খানকে তার ভাইয়ের পরিচয়ের সূত্রে প্রমোশন না দিতে।

এসব কি 'অদ্ভুত' বিষয় নয়, অন্তত আমাদের দেশে?! মানেকশ'র এই ঔদার্যকে বলা হয়, শিভালরি। পেশাদার যোদ্ধারা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, কিন্তু তার থাকে যোদ্ধাসুলভ মনোভাব, বীরকে তিনি শ্রদ্ধা করেন। তাই ওই ১৯৭১-এর যুদ্ধেই পূর্ব পাকিস্তান রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাক সেনাবাহিনীর চার সদস্যকে বীরত্বের জন্য পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় দাফন করে। এটা এক কথায় অভূতপূর্ব। পাক বাহিনীর মেজর আনিস চাঁদপুরের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। মিত্র বাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল দলবীর সিং ওই পাক সেনা কর্মকর্তার লাশ পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় কবর দিয়েছিলেন (Tragedy of Errors- Lt Gen Kamal Matinuddin, p. ৩৮১)। আমরা কি মানেকশ', দলবীর সিংকে 'রাজাকার' বলব? কবীর চৌধুরী, ফেরদৌসী মজুমদারকে বলব 'রাজাকারের ভাই-বোন'?

আর মার্কিনিদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা যদি বলি তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে মার্কিনিরা একসময় স্বাধীনতা যুদ্ধ লড়েছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ২০০০ সালে তৈরি মেল গিবসন অভিনীত ও রোলান এমিরিখ পরিচালিত ছবি 'দি প্যাট্রিয়ট'-এর ডিভিডি কিনে দেখতে পারেন ব্রিটিশরা কী ভয়াবহ নির্যাতন করেছিল স্বাধীনতাকামী মার্কিনিদের ওপর। ওই ছবিতে মেল গিবসন অভিনয় করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বেনজামিন মার্টিন চরিত্রে। অথচ যারা পৃথক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গড়ার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল তারাও বেশিরভাগ ছিল ব্রিটিশদেরই বংশধর, তাদের ধমনীতে ছিল ব্রিটিশ রক্ত। স্বাধীনতা পাওয়ার পর বিশ্ব রাজনীতি ও স্ট্র্যাটেজিক ইস্যুগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তীকালে সবসময় ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করেছে, এখনও করছে।

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশদের যখন কাহিল অবস্থা তখন মার্কিনিরা তাদের গণ্ডা গণ্ডা যুদ্ধজাহাজ উপহার দিয়েছিল ব্রিটিশ নৌ বাহিনীকে। সে সময় মার্কিনিরা যুদ্ধে না নামলে জার্মানদের সঙ্গে পেরে ওঠা ব্রিটিশদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও একই পলিসি অনুসরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমদিকে যুদ্ধে সরাসরি যোগ না দিলেও ব্যাটল অব ইংল্যান্ডে জার্মান বিমানবাহিনী 'লুফত্ওয়াফে'র বোমারু হামলায় ব্রিটেন যখন বিপর্যস্ত প্রায় তখন আমেরিকা রয়্যাল এয়ারফোর্সকে বাঁচাবার জন্য অসংখ্য পাইলট প্রেরণ করে ডেপুটেশনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও নিয়েছিল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ। মাত্র বছর দুয়েক হলো সেই ঋণ শোধ করেছে ব্রিটিশরা। ইরাক, আফগানিস্তান, ইসরাইল নিয়ে মার্কিনিদের যে স্ট্যান্ড, ব্রিটিশদেরও তাই। পররাষ্ট্রনীতি, কৌশলগত ইস্যুতে দুই দেশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার দৃষ্টান্ত দিতে গেলে রীতিমত বিশালাকৃতির বই লিখতে হবে। কিন্তু এসব কী ধরনের সমীকরণ? মেলানো যায় কি? মেলাতে গেলে বলতেই হবে, 'রাজাকারে, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি' দিয়ে ভরে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র! সহজ হিসাব কি তাই নয়, যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মেলানো যায়?

একসময় যারা নিতান্ত পছন্দনীয় জায়গায় পোস্টিং পাওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক অজনপ্রিয় গভর্নর মোনায়েম খানের পা জড়িয়ে ধরেছিলেন সেসব মেরুদণ্ডহীন, জেলিফিশদের অনেকেই সুযোগ বুঝে পরবর্তীকালে অতি প্রগতিশীল, সুপার ভারতপ্রেমী সেজেছেন। এদের কাছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা কোনো কিছুই বড় নয়। নিজের প্রমোশন, ভালো জায়গায় পোস্টিং, অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জনই হচ্ছে প্রাধিকারের বিষয়। তাইতো আজ দেখা যায়, নিজ মাতৃভূমির কৌশলগত অপমৃত্যু ঘটিয়ে 'বন্ধুরাষ্ট্রের' লালসা পূরণে একটি বিশেষ শ্রেণীকে রাতদিন ব্যস্ত থাকতে। এদের ষণ্ডামির বিরোধিতা করলেই বলা হয় 'স্বাধীনতাবিরোধী', 'প্রগতির শত্রু', 'অসভ্য' আরও কত কী। জানি না আমরা কখনও যুক্তি দিয়ে, বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ভিয়েতনামের মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব কিনা? মাথা উঁচু করে চলতে শিখবন কিনা? আমার ভয়, এসব অদ্ভুত সমীকরণ তুলে ধরায় 'বন্ধুরাষ্ট্রের বন্ধুগণ' আমাকে স্বাধীনতাবিরোধী বলবে কিন?

আজ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করা ছাড়া 'বন্ধুরাষ্ট্র' আমাদের সঙ্গে আর কোনো বন্ধুত্বমূলক আচরণ করেছে কি? যদিও একাত্তরে তারা এমনিতেই সহায়তা করেনি। বরং তাদের স্ট্র্র্যাটেজিক স্বার্থ থেকেই তারা এগিয়ে এসেছে। আমরা যদি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াতাম তাহলে 'বন্ধুরাষ্ট্র'কে তাদের কৌশলগত স্বার্থ উদ্ধারে অনন্তের পানে চেয়ে থাকতে হতো। তাই শুধু তারাই সহায়তা করেনি, আমরাও তাদের জাতীয় স্বার্থে বিশাল উপকার করেছি। এই অঞ্চলে পরাশক্তি হওয়ার পথ সুগম করে দিয়েছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা তাদের আসল চেহারা দেখেছি ও দেখছি।

যদি কেউ একথার বিরুদ্ধাচারণ করেন তাহলে তাকে উত্তর দিতে হবে—আজ সীমান্তে গুলি করে, পাথর ছুড়ে যেসব বাংলাদেশীকে হত্যা করা হচ্ছে তা কি পাকিস্তানি বা চীনারা করছে? আর যদি ভারতীয় বিএসএফ পাকি ও চীনাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওইসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে তাহলে বলার কিছু নেই! বাংলাদেশের সব নদীতে বাঁধ কে দিয়েছে তা কি আমরা মনমোহন সিংকে জিজ্ঞেস করব, না বেইজিং গিয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইব? শান্তি বাহিনী কি আইএসআই বা চীনা গুপ্তচর সংস্থা লাওজাই তৈরি করেছিল নাকি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং ছিল এর মদতদাতা? বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলো ভারতে প্রচারে কে বাধা দেয়? আইএসআই, সিআইএ, এমআই সিক্স, না ভিন্ন কেউ? বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডিভিশনগুলো তৈরি ও সমরাস্ত্র সরবরাহ করেছে কে? নয়াদিল্লি না বেইজিং? ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর ডিভিশন ছিল একটি। ১৯৮১ সালে তার সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচটিতে। এখন সাতটি। এগুলো সংগঠনে কোন দেশ সহায়তার হাত বাড়িয়েছে? কেন এগুলো তৈরি করা হয়েছে?

যদি 'বন্ধুরাষ্ট্রের' পক্ষ থেকে হেজিমনির আশঙ্কা না থাকে তাহলে হয়তো 'বন্ধুরাষ্ট্রের বন্ধুরা' একসময় এগুলো ডিসব্যান্ড করার কথা বলতে পারেন, যেমন বহুদিন তারা বলেছেন। আর যদি দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার পথে চীনের সাহায্যের প্রসঙ্গ আসে তাহলে সমীকরণটি মেলানো যায় কীভাবে? যশোর, বগুড়া, রংপুর, ঘাটাইল, কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর যেসব ডিভিশন আছে সেগুলোর কামান, ট্যাংক, মর্টার, রিকয়েললেস রাইফেলের গোলায় কি আমরা বারুদ ফেলে দিয়ে ফুল দিয়ে ভরে রাখব 'বন্ধুরাষ্ট্রের' দিকে 'বন্ধুত্বের নিদর্শন' হিসেবে পাপড়ি-বৃষ্টি নিক্ষেপের জন্য? হয়তো একদিন তাই বলা হবে! অবশ্য পররাষ্ট্রনীতি, জাতীয় স্বার্থে স্বকীয়তা না থাকলে একশ'টি ডিভিশন রেখেইবা কি লাভ? সমান্তরাল আদর্শে তো এগুলোর প্রয়োজনীয়তা থাকবে না! নিউট্রালাইজ হয়ে যাবে এম্নি এম্নি। যদি ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা আসে, ভিন্ন সংস্কৃতি, জাতীয়তাবোধের প্রয়োজন হয় তাহলে সাতটি কেন, বিশটি ডিভিশন রেইজ করতে হবে। এখন আমরা কোনদিকে যাব সেটা ভেবে দেখার বিষয়। কারণ সমীকরণটি মেলাতে হবে বাংলাদেশীদের, ভিন্ন কারও নয়।
লেখক : সাংবাদিক, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক

http://www.onbangladesh.org/opiniondetail/detail/1600


__._,_.___


[* Moderator�s Note - CHOTTALA is a non-profit, non-religious, non-political and non-discriminatory organization.

* Disclaimer: Any posting to the CHOTTALA are the opinion of the author. Authors of the messages to the CHOTTALA are responsible for the accuracy of their information and the conformance of their material with applicable copyright and other laws. Many people will read your post, and it will be archived for a very long time. The act of posting to the CHOTTALA indicates the subscriber's agreement to accept the adjudications of the moderator]





__,_._,___