জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দিতে সরকারকে বোঝান
মার্কিন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে প্রধানমন্ত্রী
মাহমুদুল আলম নয়ন, নিউইয়র্ক থেকে ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশী পণ্যের অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে বোঝানোর জন্য দেশটির ব্যবসায়ী নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি স্থগিত করায় শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিতের বদলে তাঁদের স্বার্থ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শ্রমিকদের কল্যাণ, নিরাপত্তা এবং কমপ্লায়েন্সের নামে জিএসপি সুবিধা স্থগিত সমর্থনযোগ্য নয়। শিল্প ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্ঘটনা বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এমনকি উন্নত বিশ্বেও অনবরত ঘটে থাকে।
বৃহস্পতিবার তাঁর হোটেল সুইটে যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্সের যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপের একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাত করতে এলে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এ বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফরের আজকের দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জন্মদিনের পাশাপাশি দিনটি সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে নিউইয়র্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের সঙ্গে আজকের বৈঠকটি ঘিরে। ঘটনাচক্রে জন্মদিনেই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসবেন শেখ হাসিনা। দুই দেশের নির্বাচন যখন আসন্ন, তখন প্রতিবেশী দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের এ বৈঠক ঘিরে দুই দেশের মানুষের ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতায় বহুল আকাক্সিক্ষত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে আস্থার সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে, দুই শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে সমাধানের পথ বের হয় কি না, সেদিকেই দৃষ্টি এখন সবার।
ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী ॥ নিউইয়র্কে হোটেল হায়াতের তাঁর সুইটে সাক্ষাত করতে আসা যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্সের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আবারও তাঁদের বেতন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। তিনি এ প্রসঙ্গে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত গার্মেন্ট শ্রমিকদের পরিবার ও আহতদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কথাও মার্কিন ব্যবসায়ীদের তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিদের ব্রিফিং দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব বিজন লাল দেব ও মহাপরিচালক (জাতিসংঘ) সাদিয়া মুনা তাসনিম উপস্থিত ছিলেন। ইকবাল সোবহান চৌধুরী জানান, গত বছর মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব আলোচনার ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসায়ীদের এ বৈঠক।
বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন যে, তাঁরা জিএসপি-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। কারণ, তাঁরা মনে করেন, নীতিগত দিক থেকে জিএসপি বাতিল সঠিক হয়নি। শীঘ্রই জিএসপি সুবিধা বাতিলের আদেশ প্রত্যাহারের আশাবাদ ব্যক্ত করে চেম্বার নেতৃবৃন্দ বলেন, তাঁরা ইতোমধ্যে মার্কিন সরকারকে তাঁদের মতামতের কথা জানিয়েছেন। ইকবাল সোবহান জানান, বৈঠকে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এগিয়ে নিতে সরকারী ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি জানান, মূলত মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দল বলছে, বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যের ক্রমবর্ধমান বাজার। তাই তাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। সাক্ষাত করতে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলটি 'মার্কিন-বাংলাদেশ' বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। এ ছাড়া তাঁরা ব্যবসা ও সরকারী নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠানে তাঁদের আগ্রহের কথাও প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশের বিদ্যুত, জ্বালানি ও সমুদ্র উপকূলে ড্রিলিংয়ে মার্কিন বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করে মার্কিন ব্যবসায়ীরা বলেন, মার্কিন কোম্পানিগুলো জ্বালানি খাতে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে তাঁরা আশা প্রকাশ করেন।
মার্কিন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মনোভাবের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার বিশ্বাস করে, বেসরকারী খাতই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, যেখানে সরকার সহায়কের ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার বিদ্যুত ও টেলিযোগাযোগসহ কিছু খাত বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। অথচ এর আগের সরকারের আমলে এসব খাত সুবিধাভোগীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বাংলাদেশে বর্তমান বিনিয়োগ পরিবেশ আগের যে কোন সময়ের তুলনায় চমৎকার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সরকার প্রতিযোগিতামূলক বেসরকারী ও বিদেশী বিনিয়োগের জন্য এসব খাত উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বাংলাদেশে উদার বিনিয়োগ নীতির পরিবেশ তৈরি করাই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। তিনি আশা করেন, মার্কিন বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা উদার বিনিয়োগ নীতির এ সুযোগ গ্রহণ এবং বিভিন্ন খাতে আরও বিনিয়োগ করবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সরকার আঞ্চলিক যোগাযোগের ওপরেও গুরুত্বারোপ করেছে। এর ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে আঞ্চলিক ব্যবসায় উপকৃত হবেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে মার্কিন ব্যবসায়ীরা কাজ করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ মার্কিন বিনিয়োগ প্রায় আড়াই কোটি ডলার ছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সরকারের গত ৫ বছরে এ পরিমাণ ১শ' কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া গত বছর প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ১শ' ৩০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে যার অধিকাংশই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিক অগ্রগতির লক্ষণ।
মার্কিন প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ও বিনিয়োগ পরিবেশে সন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী আগামী ডিসেম্বর নাগাদ দুটি বোয়িং বিমানের সরবরাহ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বোয়িং প্রতিনিধিকে অনুরোধ করেন। উল্লেখ্য, এ জন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ক্রয় নির্দেশ জারি করেছে। বাংলাদেশ ৪টি বোয়িং বিমান কেনার জন্য বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে। ইতোমধ্যে ২টি বিমান সরবরাহ করা হয়। আরও ২টি সরবরাহের অপেক্ষায় আছে।
মার্কিন চেম্বার নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজতে শীঘ্রই ঢাকা সফর করবেন বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানান। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যের ক্রমবর্ধমান বাজার এবং কাঁচামালের ভাল আমদানিকারক। সুতরাং তাঁরা মনে করেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে দুই দেশের সম্পর্ক আরও উন্নত হওয়ার প্রয়োজন। তাঁরা আরও বলেন, এ প্রেক্ষিতে মার্কিন ব্যবসায়ীরা ইউএস চেম্বার অব কমার্সের যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপের আওতায় আলোচনা অব্যাহত রাখতে চান। তাঁরা বলেন, মার্কিন চেম্বার আগের বছরের মতো এ বছরেও ব্যবসায়িক আলোচনার বিষয়টি বিবেচনা করছে। প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে খুব শীঘ্রই তাঁরা বাংলাদেশে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে।
এ সময়ে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, এ্যাম্বাসেডর এ্যাট লার্জ এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ এম ওয়াহিদুজ্জামান, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। মার্কিন চেম্বার নেতৃবৃন্দ 'ইউএসএ এ্যান্ড বাংলাদেশ টুয়ার্ড দ্য ফিউচার : পলিসি রিকমেন্ডেশন টু স্ট্রেন্থ দ্য ইউএস বাংলাদেশ কমার্শিয়াল রিলেশনশিপ' নামে একটি রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন।
আজ হাসিনা-মনমোহন বৈঠক ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের দৃষ্টি আজ নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের মধ্যে অনুষ্ঠেয় সাইডলাইন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের দিকে। আজ ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের এক ফাঁকে তাঁরা দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা দিকের পাশাপাশি অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর ও সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভারত সরকার সম্পর্কে কিছুটা হলেও আস্থাহীনতার সৃষ্টি করেছে। আর সে কারণেই মনমোহন-হাসিনা বৈঠককে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ভারত। গত কয়েক বছর ধরে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়েছে দুই দেশের সরকার। এবারের বৈঠকে এই দুই চুক্তি নিয়ে শেষবারের মতো চেষ্টা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বাড়ানো এবং বিদ্যুত ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়গুলোও তুলে ধরা হবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
আভাস পাওয়া গেছে, শেখ হাসিনাকে দেয়া ভারতের প্রতিশ্রুতি ড. মনমোহন সিংহও পূরণ করতে চাইছেন। কিন্তু বিরোধী দলের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের বাধার মুখে বার বার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে হোঁচট খাচ্ছেন মনমোহন সরকার। তবে নিরাশ না করে ভারত সরকার বার বার বলছে সমস্যা সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। ফলে আজকের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অমীমাংসিত ওই প্রধান দুই ইস্যুতে সঙ্কটের সমাধান ঘটবে কি না, সেদিকেই দৃষ্টি এখন দুই দেশের জনগণের।
বৃহস্পতিবার তাঁর হোটেল সুইটে যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্সের যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপের একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাত করতে এলে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এ বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফরের আজকের দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জন্মদিনের পাশাপাশি দিনটি সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে নিউইয়র্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের সঙ্গে আজকের বৈঠকটি ঘিরে। ঘটনাচক্রে জন্মদিনেই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসবেন শেখ হাসিনা। দুই দেশের নির্বাচন যখন আসন্ন, তখন প্রতিবেশী দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের এ বৈঠক ঘিরে দুই দেশের মানুষের ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতায় বহুল আকাক্সিক্ষত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে আস্থার সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে, দুই শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে সমাধানের পথ বের হয় কি না, সেদিকেই দৃষ্টি এখন সবার।
ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী ॥ নিউইয়র্কে হোটেল হায়াতের তাঁর সুইটে সাক্ষাত করতে আসা যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্সের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আবারও তাঁদের বেতন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। তিনি এ প্রসঙ্গে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত গার্মেন্ট শ্রমিকদের পরিবার ও আহতদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কথাও মার্কিন ব্যবসায়ীদের তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিদের ব্রিফিং দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব বিজন লাল দেব ও মহাপরিচালক (জাতিসংঘ) সাদিয়া মুনা তাসনিম উপস্থিত ছিলেন। ইকবাল সোবহান চৌধুরী জানান, গত বছর মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব আলোচনার ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসায়ীদের এ বৈঠক।
বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন যে, তাঁরা জিএসপি-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। কারণ, তাঁরা মনে করেন, নীতিগত দিক থেকে জিএসপি বাতিল সঠিক হয়নি। শীঘ্রই জিএসপি সুবিধা বাতিলের আদেশ প্রত্যাহারের আশাবাদ ব্যক্ত করে চেম্বার নেতৃবৃন্দ বলেন, তাঁরা ইতোমধ্যে মার্কিন সরকারকে তাঁদের মতামতের কথা জানিয়েছেন। ইকবাল সোবহান জানান, বৈঠকে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এগিয়ে নিতে সরকারী ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি জানান, মূলত মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দল বলছে, বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যের ক্রমবর্ধমান বাজার। তাই তাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। সাক্ষাত করতে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলটি 'মার্কিন-বাংলাদেশ' বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। এ ছাড়া তাঁরা ব্যবসা ও সরকারী নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠানে তাঁদের আগ্রহের কথাও প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশের বিদ্যুত, জ্বালানি ও সমুদ্র উপকূলে ড্রিলিংয়ে মার্কিন বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করে মার্কিন ব্যবসায়ীরা বলেন, মার্কিন কোম্পানিগুলো জ্বালানি খাতে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে তাঁরা আশা প্রকাশ করেন।
মার্কিন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মনোভাবের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার বিশ্বাস করে, বেসরকারী খাতই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, যেখানে সরকার সহায়কের ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার বিদ্যুত ও টেলিযোগাযোগসহ কিছু খাত বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। অথচ এর আগের সরকারের আমলে এসব খাত সুবিধাভোগীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বাংলাদেশে বর্তমান বিনিয়োগ পরিবেশ আগের যে কোন সময়ের তুলনায় চমৎকার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সরকার প্রতিযোগিতামূলক বেসরকারী ও বিদেশী বিনিয়োগের জন্য এসব খাত উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বাংলাদেশে উদার বিনিয়োগ নীতির পরিবেশ তৈরি করাই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। তিনি আশা করেন, মার্কিন বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা উদার বিনিয়োগ নীতির এ সুযোগ গ্রহণ এবং বিভিন্ন খাতে আরও বিনিয়োগ করবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সরকার আঞ্চলিক যোগাযোগের ওপরেও গুরুত্বারোপ করেছে। এর ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে আঞ্চলিক ব্যবসায় উপকৃত হবেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে মার্কিন ব্যবসায়ীরা কাজ করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ মার্কিন বিনিয়োগ প্রায় আড়াই কোটি ডলার ছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সরকারের গত ৫ বছরে এ পরিমাণ ১শ' কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া গত বছর প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ১শ' ৩০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে যার অধিকাংশই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিক অগ্রগতির লক্ষণ।
মার্কিন প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ও বিনিয়োগ পরিবেশে সন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী আগামী ডিসেম্বর নাগাদ দুটি বোয়িং বিমানের সরবরাহ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বোয়িং প্রতিনিধিকে অনুরোধ করেন। উল্লেখ্য, এ জন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ক্রয় নির্দেশ জারি করেছে। বাংলাদেশ ৪টি বোয়িং বিমান কেনার জন্য বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে। ইতোমধ্যে ২টি বিমান সরবরাহ করা হয়। আরও ২টি সরবরাহের অপেক্ষায় আছে।
মার্কিন চেম্বার নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজতে শীঘ্রই ঢাকা সফর করবেন বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানান। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যের ক্রমবর্ধমান বাজার এবং কাঁচামালের ভাল আমদানিকারক। সুতরাং তাঁরা মনে করেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে দুই দেশের সম্পর্ক আরও উন্নত হওয়ার প্রয়োজন। তাঁরা আরও বলেন, এ প্রেক্ষিতে মার্কিন ব্যবসায়ীরা ইউএস চেম্বার অব কমার্সের যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপের আওতায় আলোচনা অব্যাহত রাখতে চান। তাঁরা বলেন, মার্কিন চেম্বার আগের বছরের মতো এ বছরেও ব্যবসায়িক আলোচনার বিষয়টি বিবেচনা করছে। প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে খুব শীঘ্রই তাঁরা বাংলাদেশে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে।
এ সময়ে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, এ্যাম্বাসেডর এ্যাট লার্জ এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ এম ওয়াহিদুজ্জামান, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। মার্কিন চেম্বার নেতৃবৃন্দ 'ইউএসএ এ্যান্ড বাংলাদেশ টুয়ার্ড দ্য ফিউচার : পলিসি রিকমেন্ডেশন টু স্ট্রেন্থ দ্য ইউএস বাংলাদেশ কমার্শিয়াল রিলেশনশিপ' নামে একটি রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন।
আজ হাসিনা-মনমোহন বৈঠক ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের দৃষ্টি আজ নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের মধ্যে অনুষ্ঠেয় সাইডলাইন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের দিকে। আজ ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের এক ফাঁকে তাঁরা দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা দিকের পাশাপাশি অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর ও সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভারত সরকার সম্পর্কে কিছুটা হলেও আস্থাহীনতার সৃষ্টি করেছে। আর সে কারণেই মনমোহন-হাসিনা বৈঠককে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ভারত। গত কয়েক বছর ধরে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়েছে দুই দেশের সরকার। এবারের বৈঠকে এই দুই চুক্তি নিয়ে শেষবারের মতো চেষ্টা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বাড়ানো এবং বিদ্যুত ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়গুলোও তুলে ধরা হবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
আভাস পাওয়া গেছে, শেখ হাসিনাকে দেয়া ভারতের প্রতিশ্রুতি ড. মনমোহন সিংহও পূরণ করতে চাইছেন। কিন্তু বিরোধী দলের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের বাধার মুখে বার বার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে হোঁচট খাচ্ছেন মনমোহন সরকার। তবে নিরাশ না করে ভারত সরকার বার বার বলছে সমস্যা সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। ফলে আজকের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অমীমাংসিত ওই প্রধান দুই ইস্যুতে সঙ্কটের সমাধান ঘটবে কি না, সেদিকেই দৃষ্টি এখন দুই দেশের জনগণের।
__._,_.___