জার্মানির নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধ
জার্মানিতে নির্বাচনের মাসেই কাকতালীয়ভাবে যুদ্ধাপরাধবিষয়ক একটি রহস্যময় দলিলের কথা জানা গেল, দলিলটিতে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানি কর্তৃক দখল করা পোল্যান্ডের আউসসুৎস বন্দিশিবিরে কর্মরত এসএস বাহিনীর প্রহরীদের নাম-পরিচয়। আর দলিলের সূত্র ধরে এখনো বেঁচে থাকা ৩০ জন অশীতিপর যুদ্ধাপরাধীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬৮ বছর পর একসঙ্গে এতজন যুদ্ধাপরাধীর জার্মানজুড়ে বিচারের প্রক্রিয়া বিগত বছরগুলোতে দেখা যায়নি।
তবে যুদ্ধাপরাধীদের নাম-পরিচয় বা এখন কোন দলের অনুসারী, সেসব নিয়ে বা বিচারবিষয়ক ঘোষণা নিয়ে জার্মানির নির্বাচনে কোনো দল পানি ঘোলাও করতে চায়নি বা হরতাল তো দূরে থাক, কোনো বিক্ষোভের ঘোষণা দেয়নি। এই অশীতিপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারগুলো হবে সাংবিধানিক আইন মেনে অভ্যন্তরীণ আদালতেই, এখানে প্রশ্ন আসবে না, কীভাবে ৬৮ বছর পর তাদের অপরাধ প্রমাণিত করা যাবে, প্রশ্ন আসবে না জাতিসংঘের সম্পৃক্ততার বা খবরদারি হবে না মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের, যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর করতে তরুণদের গড়তে হবে না গণজাগরণ মঞ্চ।
জার্মানিতে এটা সর্বজনবিদিত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পালিয়ে থাকা সব যুদ্ধপরাধীর বিচার করা সম্ভব হয়নি। কারণ নানাবিধ, কেউ অর্থের জোরে বা প্রতিপত্তি দিয়ে নিজের পরিচয় গোপন করে জার্মানি ত্যাগ করেছে, কেউ কেউ বিশেষ কাজে পারদর্শী বিধায় যুদ্ধ চলাকালে চরম শত্রু মার্কিন সেনাদের সঙ্গে বা পুরোনো চাকরিতেই বহাল হয়েছিলেন বা যুদ্ধের পর পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহনীয় প্রশাসনের অবহেলা ও তদবিরের জোরে বেঁচে গেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই চার বিজয়ী মিত্রশক্তির দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত জার্মান নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য দক্ষিণ জার্মানির নুরেমবার্গে স্থাপন করেছিল আন্তর্জাতিক সামরিক আদালত, যেখানে শীর্ষস্থানীয় ২৪ জন নাৎসি নেতার বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী পাঁচ বছরে জার্মানিতে পাঁচ হাজার ১০ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল এবং বিচারে ২১ জন নারী যুদ্ধাপরাধীসহ প্রায় ৫০০ জনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই আদালতের পরও বিগত ৬৮ বছর বিভিন্ন বন্দিশিবির ও যুদ্ধবিষয়ক অপরাধের জন্য নানা নামে আদালত গঠিত হয়েছে এবং বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। এই বিচারিক ব্যবস্থাপনাগুলোতে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই সাক্ষী বা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আইনের সুযোগ অনেক কম, সে ক্ষেত্রে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীরা অনেক বেশি আইনি সুযোগ পাচ্ছেন।
জার্মানিতে নতুন করে শুরু হওয়া ৩০ জন যুদ্ধাপরাধীর মধ্য সব থেকে বয়োজ্যেষ্ঠের বয়স ৯৭ আর সবচেয়ে কনিষ্ঠের বয়স ৮৭। তবে এখানে আইনবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ বিচারে বয়স কোনো বিষয় নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এসএস বাহিনীর সদস্য, যারা মূলত হিটলারের বন্দিশিবিরগুলোতে প্রহরী এবং বন্দীদের হত্যার কাজে নিযুক্ত হয়েছিল। এই অভিযুক্ত ৩০ জনের সম্পৃক্ততা ছিল পোল্যান্ডের আউসসুৎস বন্দিশিবিরে। যুদ্ধকালে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সারা ইউরোপে বিভিন্ন স্থান থেকে ১০ লাখের কিছু বেশি বন্দী ধরে আনা হয় এই আউসসুৎসে। তাদের মধ্য নয় লাখ বন্দীকে এই বন্দিশিবিরে পৌঁছামাত্র রাসায়নিক গ্যাস চেম্বারে প্রবেশ করিয়ে হত্যা করা হয়।
আউসসুৎস বন্দিশিবিরের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিচার হয় ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে, বিচার চলাকালে একজন সাক্ষী একটি ফাইলে রক্ষিত হত্যার কাজে জড়িত ব্যক্তিদের নামের তালিকার কথা বলেন। যদিও যুদ্ধ শেষে নাৎসিরা বন্দিশিবিরের অধিকাংশ তথ্য নষ্ট করে ফেলা হয়, তথাপি বাডেনভুর্টেনবের্গ রাজ্যের লুডভিগবুর্গ শহরে অবস্থিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধবিষয়ক কেন্দ্রীয় মহাফেজখানায় দলিলটির খোঁজ চলতে থাকে। অবশেষে দলিলটির খোঁজ মেলে লুডভিগবুর্গ মহাফেজখানাতে রাখা একটি পুরোনো ফাইলে।
এ ব্যাপারে মহাফেজখানার পরিচালক কুর্ট স্রিম ১০ সেপ্টেম্বর বলেছেন, ফাইলে রাখা আউসসুৎস বন্দিশিবিরে নানা কাজে জড়িত ছয় হাজার নামের মধ্য ৩৯ জন জীবিত যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে তাঁরা তদন্ত চালিয়ে দেখতে পান, এঁদের মধ্যে ৯৭ থেকে ৮৭ বছর বয়সী ৩০ জন, যাঁদের মধ্যে কিছু মহিলাও রয়েছেন, তাঁরা জার্মানিতেই বসবাস করছেন, আর নয়জন জার্মানি ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়েছেন।
পরিচালক কুর্ট স্রিম আরও বলেন, আউসসুৎস বন্দিশিবিরে হত্যাযজ্ঞে সহায়তায় এঁদের প্রত্যেকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও মদদ ছিল। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধীর তথ্য সংগ্রহ করতে মহাফেজখানার বিশেষজ্ঞরা রাশিয়া, বেলারুশ এবং ব্রাজিল সফর করছেন।
আমাদের বাংলাদেশে হয়তো যুদ্ধবিযয়ক মহাফেজখানা নেই, ততটা অর্থবল বা কাঠামো নেই, তবু প্রায় ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা আশা করব, এই প্রক্রিয়া ভবিষ্যতেও চলবে আর সঙ্গে সঙ্গে জাগরূক থাকবে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি, হ্যানোভার, জার্মানি।
__._,_.___