|
ছবি: দেলোয়ার হোসেন বাদল / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম |
ঢাকা: ওরা আমাকে পরিকল্পিতভাবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল। সহকর্মীরা এগিয়ে না আসলে ওরা আমাকে মেরে ফেলতো। পল্টন মোড় থেকে বিজয়নগর পর্যন্ত ওরা আমাকে মারতে মারতে ছয় থেকে সাত বার ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি লাথি মারে। উঠে দৌড়ানো শুরু করলে পেছন থেকে আবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, মাথায় লাথি মারে। বারবার তারা আমার কাপড় টেনে হিঁচড়ে কিল ঘুষি মারে।
শনিবার দায়িত্ব পালনকালে হেফাজতে ইসলামের লোকজনের নির্মমতার শিকার একুশে টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার নাদিয়া শারমিন এভাবে বাংলানিউজের কাছে হামলার ঘটনার বর্ণনা দেন।
শুধু নাদিয়া নন, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের চিফ ল করেসপন্ডেন্ট জাকিয়া আহমেদ, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর স্টাফ রিপোর্টার আরাফাত আরাসহ বেশ কয়েকজন নারী সাংবাদিক হেফাজতে ইসলামের লোকজনের নানা নিগ্রহের শিকার হন।
নাদিয়া জানান, হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ ও সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহের জন্য শনিবার বেলা ১২টা থেকে পল্টন মোড় এলাকায় পুলিশের ব্যারিকেডের পাশে অবস্থান করছিলেন তিনি। বিকেল আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে লম্বা সাদা আলখেল্লা (লম্বা পাঞ্জাবি) পরা কয়েক জন এসে নাদিয়া কে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, "আপনি মহিলা মানুষ, আপনার এখানে কি? আপনি এখান থেকে চলে যান।"
উত্তরে নাদিয়া বলেন, "আমি মহিলা না, একজন সাংবাদিক। সংবাদ সংগ্রহ করতে এখানে এসেছি। একথা শেষ হওয়া মাত্র হেফাজতের ৫০ থেকে ৬০ জন কর্মী আমার দিকে তেড়ে আসে, আমাকে আচমকা চর-খাপ্পড় মারতে থাকে। আমি সেখান থেকে দ্রুত চলে আসার চেষ্টা করি, এরপরও তারা পেছন থেকে তাকে লক্ষ্য করে পানির বোতল ও ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে লাথি মারতে থাকে।"
নাদিয়া অভিযোগ করেন, ঘটনার শুরু থেকে সেখানে উপস্থিত বিপুলসংখ্যক পুলিশ সবকিছু দেখলেও তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি।
তিনি নিগ্রহ হওয়ার বর্ণনা দিয়ে বলেন, পল্টন মোড় থেকে মারতে থাকলে বাঁচার জন্য নাদিয়া ড্যাবের (ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) একটি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা কেন্দ্রের মাইক্রোবাসে উঠে পড়েন। কিন্ত তারপরও হেফাজতের লোকজন তাকে সেখান খেকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে এসে বেধড়ক পেটায়। এরপর নাদিয়া কয়েকজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দৌড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পেছন থেকে হেফাজত কর্মীরা বার বার তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে মারধর করে। এ সময় তারা নাদিয়াকে বলছিলো, "আমাদের ১৩ দফা পড়নি? সেখানে নারী নীতিতে মেয়েদের অবাধ চলাফেরা নিষেধ করা হয়েছে।" একথা বারবার বলতে থাকে আর মারধর করতে থাকে।
এ সময় নাদিয়া ছয় থেকে সাত বার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে উঠে দাঁড়ানোর পর সহকর্মীরা ও দিগন্ত টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন খলিলের সহযোগিতায় তার অন্য সহকর্মীরা তাকে একটি মাইক্রোবাসে তোলেন। এরপর হেফাজতের কর্মীরা গাড়িটি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। এসময় নাদিয়া মাথায়, বাম পা, বাম পাঁজর, বাম বাহুতে আঘাত পান।
আহত অবস্থায় নাদিয়াকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়।
নাদিয়ার বড় বোন অ্যাডভোকেট সাদিয়া আফরিন অভিযোগ করে বলেন, "নাদিয়া একুশে টেলিভিশনে অপরাধ বিষয়ক রিপোর্ট করে। শাহবাগ জাগরণ মঞ্চ হওয়ার পর থেকে নাদিয়া মঞ্চের সংবাদ সংগ্রহ করতো।" তিনি জানান, হামলার সময় হামলাকারীরা নাদিয়াকে বলতে থাকে, তোরা প্রজন্ম চত্বরের দালাল, আজ তোকে মেরে ফেলা হবে।
তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার সময় সেখানে কয়েকশ পুলিশ থাকলেও তারা নাদিয়াকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি। উল্টো তার সহকর্মীরা যখন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল তখন পুলিশ সদস্যরা নাদিরাকে উদ্দেশ্য করে বলছিল "মাথায় কাপড় দিয়ে যান"।
অ্যাডভোকেট সাদিয়া আফরিন জানান, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা নাদিয়ার মাথায় সিটিস্ক্যান এবং এক্স-রে করেছেন। বর্তমানে তিনি শঙ্কামুক্ত বলে তারা জানিয়েছেন। তবে তাকে আরো ১০ দিন বিশ্রামে থাকতে হবে।
বাংলানিউজের চিফ ল করেসপন্ডেন্ট জাকিয়া আহমেদ জানান, শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির কাছে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির সামনের রাস্তার সড়ক বিভাজনের উল্টো পাশ দিয়ে মারকাজুল ফিকরিল ইসলামী বাংলাদেশের ব্যানারে একটি মিছিল আসছিল। জাকিয়া মিছিলের ব্যানারের স্লোগানগুলো টুকে নিচ্ছিলেন সড়ক বিভাজনের পাশে দাঁড়িয়ে। এ সময় মিছিলের মাঝখান থেকে একজন তর্জনী তুলে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে জাকিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, 'ওই মাইয়্যা, মাথায় কাপড় নাই ক্যান?'
জাকিয়া বলেন, "আমি এ ধরনের বক্তব্য শোনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তাদের আচরণ এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে রীতিমতো আমি ভয় পেয়েছি। সেই সময় কথা বলতে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আর কথা বলিনি।" জাকিয়া জানান, এ সময় মিছিলের অন্যরা খুব মজা পাচ্ছিল। নারী সাংবাদিকদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করছিল অন্যরা।
এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর স্টাফ রিপোর্টার আরাফাত আরা অফিসে যাওয়ার জন্য বিজয়নগর থেকে হেঁটে আসছিলেন। পল্টন মোড়ের কাছাকাছি গেলে প্যান্ট-শার্ট পরা একজন 'কথা আছে' বলে তাঁর পথ রোধ করেন। পরে টুপি পরা আরও তিন-চারজন আসেন। তিনি কোথায় যাচ্ছেন তা জানতে চান। আরাফাত জানান, তিনি অফিসে যাচ্ছেন। এ সময় একজন আরাফাতকে মাথায় কাপড় দিয়ে তারপর যেতে বলেন।
আরাফাত আরা বলেন, "আমি তাঁদের বলি, দেশটা তো আমার। আমি কীভাবে চলব, তা কি আপনারা বলে দেবেন?" আরাফাত বলেন, "তখন সেই লোকগুলো বলেন, দেশের পরিস্থিতি খারাপ। আমার নিরাপত্তার জন্যই নাকি তারা এ পরামর্শ দিয়েছেন।"
নাদিয়াকে দেখতে প্রজন্ম চত্বরের নেতারা
শনিবার রাতে গণজাগরণের মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার হেফাজতে ইসলাম কর্মীদের হামলায় আহত নাদিয়া শারমিনকে দেখতে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে যান। এ সময় তিনি তার চিকিৎসার খবর নেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "যারা একজন মহিলাকে হেফাজত করতে পারে না, তারা ইসলামের কি হেফাজত করবে?"
নারী সাংবাদিক নিগ্রহের প্রতিবাদ জানিয়েছেন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, "নারী সাংবাদিকদের কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও হামলার প্রতিবাদে রোববার ৩টার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নারীদের প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছে।"
বাংলাদেশ সময়: ১২২৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৩
জেএস/আরআর
http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=11ec302aa0da18be3fe87f447644e0e7&nttl=07042013187227
নাদিয়া শারমিনের উপর হামলার ঘটনায় মামলা
সিনিয়র ও স্টাফ করেসপন্ডেন্টবাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=a127bdbf215a390d782ecd4526068047&nttl=12042013188482