শ্রীমানদের কবলে শ্রীহীন বিশ্ব
জয়নুল আবেদীন
২০ এপ্রিল ২০১৫,সোমবার, ০০:০০
৩১ মার্চ সিআইটি বিশ্বের শীর্ষ ১০ বিপজ্জনক দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকার শীর্ষে ইরাক। উত্থান-পতন হয় স্রষ্টার অমোঘ নিয়মে। হারুন-অর-রশীদ আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নরপতিদের অন্যতম। তার রাজত্বকালে বাগদাদ বিশ্বের জাঁকজমকপূর্ণ ও ঐশ্বর্যশালী নগরীতে পরিণত হয়েছিল। রূপকথার স্বপ্নপুরী বাগদাদের ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্য বহু কবি-সাহিত্যিকের রচনার বিষয়বস্তু ছিল। ঐতিহাসিক পি কে হিট্টির ভাষায়, During the period of Harun-ar-Rashid Baghdad became a city with no peer throughout the whole world.
৮০৯ (হারুন-অর-রশীদের মৃত্যু) থেকে ১২৫৩ সাল। আব্বাসীয় শেষ খলিফা আল-মুতাসিম বিল্লাহ আমির-মোসাহেব পরিবেষ্টিত হয়ে দেশ চালাতেন। তাদের পরামর্শে সারা দেশে ছদ্মবেশে ছড়িয়ে থাকত গুপ্তচর। পোষা হতো গুপ্তঘাতক। খলিফার বিরুদ্ধে সমালোচনাকারী হয়তো গুম, নয়তো লাশ হয়ে পড়ে থাকত। গুপ্তঘাতকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য খলিফার কাছে পত্র পাঠান মোঙ্গল নেতা হালাকু খান। খলিফা ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে পত্রের উত্তর পাঠান। পরিণামে হালাকু খান সপরিবারে খলিফাকে হত্যাসহ বাগদাদ ধ্বংস করেন। বাগদাদের ৫০০ বছরে আহরিত শিল্প ও সাহিত্য মাত্র পাঁচ দিনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। মোঙ্গলেরা ষোলো লাখ নর-নারী, বৃদ্ধ ও শিশুকে কেটে অথবা পিষে মেরেছিল। কথিত আছে, দজলায় বহু দূর পর্যন্ত পানির পরিবর্তে রক্তের স্রোত বয়ে গিয়েছিল।
১২৫৩ থেকে ২০০৩ সাল। তরল স্বর্ণের দেশ খেতাব পায় ইরাক। প্রাচ্যের একটি বড় শক্তি হিসেবে আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ইরাক। এ কারণে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল পড়ে হুমকির মুখে। গোয়েন্দা সূত্র আমেরিকাকে এই মর্মে অবগত করে যে, ইরাকে মারাত্মক ক্ষতিসাধনকারী রাসায়নিক অস্ত্রের গোপন কারখানা (WMD) রয়েছে। ইরাকরাজ অস্বীকার করা সত্ত্বেও শুরু হয় সম্মিলিত আক্রমণ। পরাশক্তির বোমারু বিমান ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাগদাদে। দীর্ঘ আট বছর ঝাঁঝরা করাসহ চিরুনি অনুসন্ধান চালিয়েও ইরাকে এ মারণাস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতে ব্যর্থ হয়ে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে আনা হয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ। সেই চির পরিচিত 'নেকড়ে ও মেষশাবক' নীতির আওতায় বিচার করে সাদ্দামের ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। ইরাকযুদ্ধে দুই লক্ষাধিক মায়ের বুক খালি হওয়া ছাড়াও ব্যাপক ধ্বংসলীলা চলে বাগদাদে। বিশ্বমোড়লেরা গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ১২ বছরের মাথায় ইরাককে বিশ্বের ১০টি বিপজ্জনক দেশের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ৫৫ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে ১৯৪৮ সালে ঘোষিত হয় কৃত্রিম ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। ইসরাইল রাষ্ট্রে হু হু করে বাড়তে থাকে ইহুদি। ১৯২২ থেকে ২০১৪ সাল ফিলিস্তিন এলাকায় মুসলমান সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ লাখ থেকে ১৭ লাখ। ১৯২৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইসরাইলে ইহুদি সংখ্যা ৩৫ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৮০ লাখ। এ দিকে ফিলিস্তিনিদের শুরু হয় মানবেতর জীবন। অন্য দিকে ইসরাইল পরিণত হয় বিশ্বের ষষ্ঠ সামরিক শক্তিতে। বিশ্বমোড়লির দু'মুখো নীতির প্রতিবাদ করতেন পিএলও প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত। সামান্য পেটের পীড়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ভালো চিকিৎসার কথা বলে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় ফ্রান্স। সেখানে হাসপাতালে স্ত্রীকেও কাছে থাকতে না দিয়ে ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর আরাফাতের মৃত্যু ঘোষণা করা হয়। মৃত্যুর কারণ নিয়ে শুরু হয় ধূম্রজাল। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের মতে, মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল নাÑ তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।
শিশুদের ডাংগুলি খেলার মতো একধরনের খেলা থেকে আধুনিক ক্রিকেট। ১৫ শতকের আগেও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের কেন্ট, সাজেক্স ও সারে কাউন্ট্রিগুলোতে ক্রিকেট খেলার প্রচলন ছিল। ১৭ শতকে শ্রমিকেরা এটি খেলতে শুরু করে। রাজা প্রথম চার্লসের সময় অভিজাত শ্রেণী এ খেলার প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেন। ক্রিকেট খেলার চেয়ে ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে জুয়া খেলা তাদের বেশি আকৃষ্ট করত। ক্রমে ক্রমে ক্রিকেটে প্রচুর বিনিয়োগ শুরু হয়। দক্ষিণ ইংল্যান্ডে এটি একটি জনপ্রিয় বিনোদনে পরিণত হয়ে যায়। এ সময় বড় বড় কাব এবং পেশাদার ক্রিকেট খেলোয়াড়ের আবির্ভাব ঘটে। ক্রিকেটের জন্ম ইউরোপের একটি দেশে হলেও ইউরোপ মহাদেশে এর প্রসার নেই। কারণ হিসেবে একটি গল্প প্রচলিত আছে। অফিসে আসা-যাওয়ার পথে এক মাঠে ভিড় দেখে হিটলার কারণ জানতে চান। উত্তরে জানতে পারেন, ক্রিকেট খেলা। বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে, খেলার ফলাফল জানতে চান। উত্তরে জানতে পারেন, খেলা চলছে। প্রতিদিন আসা-যাওয়ার পথে একই প্রশ্ন, একই উত্তরের পর পঞ্চম দিন জানতে পারেন, ফলাফল ড্র। এ কথা শুনে হিটলার বলেন, 'খেলা বন্ধ করো, এ খেলা দেশকে কুঁড়ের রাজ্য বানিয়ে ফেলবে।'
ইউরোপ বন্ধ করে দিলেও খেলাটি ভীষণ জনপ্রিয়তাসহ শুরু হয়ে যায় বহির্বিশ্বে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে ১৯০৯ সালে গঠিত হয় 'ইম্পেরিয়েল ক্রিকেট কনফারেন্স' (ICC) নামে একটি সংগঠন। ১৯৬৩ সালে লিখিত গঠনতন্ত্রসহ গঠিত হয় 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল' (ICC)। এর পরিচালনা পর্ষদ টেস্ট খেলুড়ে ১০টি দেশ নিয়েÑ যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে ওঈঈ-এর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। কনিষ্ঠ হয়েও ক্রিকেট পাগল বাঙালি কয়েকটি গরিষ্ঠ দেশকে ধরাশায়ী করে ক্রিকেটবিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছে। দু'বার বিশ্বকাপজয়ী ইন্ডিয়া ২০০৭ সালে বাংলাদেশের কারণে কোয়ার্টার ফাইনালের মুখও দেখেনি। অনেক ভারতীয়র মতে, নেপাল, ভুটান ও সিকিমের মতো বাংলাদেশ পুঁচকে রাষ্ট্র এবং 'বাংলাদেশ' পাক-ভারত যুদ্ধের 'বাই প্রোডাক্ট'। শনৈঃশনৈ অগ্রগতি থেকে পাক-ভারত বাংলাদেশকে অনুজের দৃষ্টিতে না দেখে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে শুরু করে। পুঁচকে প্রতিপক্ষ কুলে উঠে গেলে পাক-ভারতের জাত-কুল-মান পাংচার হয়ে পড়বে।
এই জাত-কুল-মান বাঁচাতে বিশ্বের কোটি কোটি চোখের সামনে স্পাইডার ক্যামেরা ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একটি খেলা সম্পন্ন হলো। মানুষ মাত্রই ভুল-বিচ্যুতি হতে পারে। আম্পায়ারদের সূক্ষ্ম ভুল-চ্যুতি ধরার জন্যই ব্যবহার করা হয় স্পাইডার ক্যামেরা। থার্ড আম্পায়ার স্পাইডার ক্যামেরার সাহায্যে সঠিক বিষয়টি তুলে ধরেন। দর্শকেরা স্পাইডারের রিপ্লেতে চোখ রেখে থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের আগেই সঠিক বিষয়টি দেখতে পান। স্পাইডার না থাকার কারণে এক দিকে, সে দিনের খেলায় তর্কিত কোনো বিষয়ই রিপ্লেতে দেখানো হয়নি, অপর দিকে সংরক্ষিত হয়নি অপরাধের আলামতও। মুস্তফা কামাল (আইসিসির সভাপতি) এসব অনিয়মের সমালোচনা করেছেন। এ কারণে ফাইনালের আগের দিন আইসিসির সভায় কামালকে, হয়তো ক্ষমা চাইতে হবে নয়তো বিবৃতি প্রত্যাহার করতে হবেÑ না হলে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে তার ঠাঁই হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়।
'আইসিসির ৩.৩ (বি) ধারানুসারে সভাপতি ছাড়া ট্রফি দেয়ার অধিকার কারো নেই, এটা আইসিসির গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী' মর্মে প্রতিবাদ করার পর গঠনতন্ত্রের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে ভারতের নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন বলেন, 'দেখি কিভাবে আপনি ট্রফি প্রদান করেন।' কোটি কোটি মানুষ দেখেছে, ট্রফি দেয়া দূরের কথা, পুরস্কার বিতরণী মঞ্চেও তার ঠাঁই হয়নি। গঠনতন্ত্র অনুসারে ১০ সদস্যের অধিকাংশের সম্মতিতে আইসিসি পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও মূলত পরিচালিত হয় ইন্ডিয়ার ইশারায়। ১৯৬৩ সালে ঘরোয়া 'ইম্পেরিয়েল' শব্দটি 'ইন্টারন্যাশনাল' পরিচয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বে। বিনোদনের দিক দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। শ্রীমানদের বিষাক্ত ছোবলে 'ইন্টারন্যাশনাল' শব্দটি 'ইন্ডিয়া' পরিচয়ে সঙ্কুচিত হয়ে জনধিক্কারে পৌঁছতে বেশি দিন সময় লাগবে না।
শৈশবে পাড়াগাঁয়ে কুস্তি খেলার প্রচলন ছিল। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রতিযোগিতা চলত। আমাদের এলাকায় বিখ্যাত কুস্তি খেলোয়াড়ের নাম 'ফকিরা'। জাতে কৈবর্ত, পেশায় জেলে ও নেশায় কুস্তিখেলোয়াড়। রাতে ছন পাতার ঘরে মাদুর পেতে ঘুমায়। কুঁড়েবাসী ফকিরার কদর বেড়ে যায় বর্ষার শুরুতে। ঢাকা বনাম ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) খেলা হলে আমরা অপেক্ষায় থাকতাম, কখন ফকিরা নামবে। ফকিরার হার-জিতের সাথে জড়িত ছিল আমাদের জেলার মানসম্মান। খেলা শুরু হলেই হিন্দু-মুসলিম এক। জয়ের জন্য হিন্দু মন্দিরে, মুসলমান মসজিদে প্রার্থনা করে। শুধু প্রার্থনা নয়, নিগ্রোর মতো কালো ফকিরাকে একনজর দেখার জন্য মানুষ উন্মুখ হয়ে পড়ত।
খেলোয়াড়দের স্থান-কাল-পাত্র নেইÑ নেই বর্ণ, গোত্র ও ধর্ম। খেলোয়াড় শুধুই খেলোয়াড়। তাই বিশ্বজুড়ে 'ম্যারাডোনা' নাম রয়েছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের। বিশ্বকাপের শুরুতেই পছন্দের পতাকায় পতাকায় আকাশ ঢেকে যায়। খেলোয়াড় শুধুই খেলোয়াড় বলে, এ দেশে সাকিব আল হাসানের ভক্তের চেয়ে শচীন, গাঙ্গুলীর ভক্ত কম নয়।
নকলের জোয়ার শুরু হলে শিক্ষার্থীর সাধনায় যে কারণে ভাটা পড়তে শুরু করে, সে কারণে খেলার ফলাফলে হস্তক্ষেপ শুরু হলে খেলোয়াড়দের সাধনায় ভাটা পড়ে যায়। সাধনাহীন খেলোয়াড়ের খেলা দর্শক দেখে না। খেলা না দেখলে বিজ্ঞাপন কমে যাবে। বিজ্ঞাপন কমে গেলে মরুপথের নদীর মতো একদিন আইসিসিও হারিয়ে যাবে। এখন ঘোর কলিকাল, অন্যায়কারী সিঁড়ি পায় স্বর্গেরÑ প্রতিবাদকারী ছিটকে পড়ে গর্তে। শ্রীমানদের কবলে শ্রীহীন বিশ্ব ইতিহাস হয়ে থাকবে।
মাথায় যখন পচন ধরে, চিকিৎসক তখন জবাব দেন। চিকিৎসক যখন জবাব দেন, তখন বিধিমোতাবেক সবাই সৎকারের চিন্তা শুরু করেÑ বিশ্ব ভিআইপিদের মাথার পচন নিরাময়ের সাধ্যাতীত। ভুলক্রমে রাজা দশরথের তলের কাপড় পড়ে থাকতে দেখে সভাসদ ইচ্ছে করে তলের কাপড় ফেলে রেখে ছিলেন। বিশ্ব ভিআইপিরা ইচ্ছে করে তলের কাপড় ফেলে রাখলেÑ সভাসদ জন্মদিনের পোশাক পরতে শুরু করলেও বারণ করার কেউ থাকবে না। হজরত মুহাম্মাদ সা: নিজে মিষ্টি খাওয়া বন্ধ রেখে অন্যকে মিষ্টি খেতে বারণ করেছিলেন।
লেখক : আইনজীবী
__._,_.___