এপার বাংলা ওপার বাংলা
24 March 2014, Monday
এখন 'এপার বাংলা ওপার বাংলা' কথাটা ব্যাপকভাবে শোনা যায়। কিন্তু কথাটার বাস্তব অর্থ আমার কাছে মোটেও স্বচ্ছ হতে পারেনি। কারণ, এপারে আমরা হলাম বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশ হলো স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। সে জাতিসঙ্ঘের সদস্য। নানা দেশের সাথে আছে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক। বাংলাদেশ ইচ্ছা করলেই বিভিন্ন দেশের সাথে তার জাতীয় স্বার্থে আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে পারে। যত দূর বুঝি, 'ওপার বাংলা' বলতে বুঝায় পশ্চিম বাংলাকে। আসামেও অনেক বাংলাভাষী আছে। তাদের ধরা হয় না 'ওপার বাংলা'র ধারণার মধ্যে। কিন্তু পশ্চিম বাংলা কি আমাদের বাংলাদেশের মতো একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ? কেন তাকে তুলনা করা হবে আমাদের সাথে? 'এপার বাংলা ওপার বাংলা' ধারণাটা তাই আমার উপলব্ধিতে ধরা পড়তে চায় না। ভারতকে এখন সাধারণভাবে ধরা হয় একটি ইউনিয়ন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থে একটি ইউনিয়ন, ভারতকে সেই অর্থে কি একটা ইউনিয়ন বলা যেতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাষ্ট্রগুলো যে পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে, ভারতের প্রদেশগুলো তা করে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাষ্ট্রে আছে নিজেদের গভর্নর নির্বাচনের মতা। এই গভর্নরদের হতে হয় তাদের নিজ নিজ অঙ্গরাষ্ট্রের নাগরিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো দ্বি-নাগরিক প্রথা বর্তমান। প্রত্যেক মার্কিন নাগরিক প্রথমে হলেন তার নিজের অঙ্গরাষ্ট্রের নাগরিক। পরে আবার হলেন সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছা করলেই তার কোনো অঙ্গরাষ্ট্রের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের অধিকার রাখে না। অপরদিকে, ভারতে কোনো প্রদেশই তার গভর্নর বা রাজ্যপাল নির্বাচন করতে পারে না। গভর্নর বা রাজ্যপাল নিযুক্তি পান কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক। এক সময় কাশ্মিরের অধিবাসীদের অধিকার ছিল তাদের নিজস্ব গভর্নর যাকে বলা হতো 'সদর-ই-রিয়াসৎ', তাকে নির্বাচনের ক্ষমতা। কিন্তু এই ক্ষমতা আর কাশ্মিরবাসী রাখেন না। কাশ্মিরবাসী হারিয়ে ফেলেছেন তাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার। এখন তাদের রাজ্যপাল নিযুক্ত হন কেন্দ্র থেকেই; যিনি কাশ্মিরি নাও হতে পারেন। ভারতে যেকোনো প্রদেশের সীমানা কেন্দ্র সরকার ইচ্ছা করলেই বদলাতে পারে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল সরকার তা পারে না। ক'দিন আগেই আমরা ভারতে দেখলাম সাবেক অন্ধ্র প্রদেশকে ভাগ করে তেলেঙ্গানা প্রদেশ গঠন করতে। এর ফলে তেলেগুভাষীরা হয়ে পড়লেন দুই প্রদেশে বিভক্ত। ইচ্ছা করলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলকে নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করতে পারে। যেমন চাচ্ছে বর্তমানে কামতাপুরী আন্দোলনকারীরা। ওপার বাংলার মানুষের সবাই যে চাচ্ছেন বাংলা ভাষার ভিত্তিতে এক হয়ে থাকতে, তা নয়। কামতাপুর আন্দোলন হয়ে উঠেছে যথেষ্ট শক্তিশালী। তাই 'এপার বাংলা ওপার বাংলা' কথাটা, এই বিশেষ কারণেও খুব অর্থবহ বলে আমার কাছে মনে হতে পারে না। এক সময় বঙ্গ বলতে বুঝিয়েছে কেবল পূর্ব বাংলাকে। আর পশ্চিম বাংলার প্রধান অংশকে বলা হয়ছে রাঢ়। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। প্রসিদ্ধ কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তার 'শর্মিষ্ঠা' নাটকের প্রস্তাবনায় লিখেছেনÑ অলীক কুনাট্য রঙ্গে/ মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে/ নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।' অর্থাৎ মাইকেল মধুসূদন দত্তের সময়ও বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মধ্যে দু'টি ভাগ ছিল। সব বাংলাভাষী মানুষকে দেখা হতো না এক করে। ঢাকাবাসীর দেয়া এক অভ্যর্থনা সভায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছিলেন- 'আমার সম্বন্ধে আপনাদের আর যেকোনো ভ্রমই হউক, আমি সাহেব হইয়াছি, এ ভ্রমটি হওয়া ভারী অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ঘরে ও শয়ন করিবার ঘরে এক একখানি আর্শি রাখিয়া দিয়াছি এবং আমার মনে সাহেব হইবার ইচ্ছা যেমনই বলবৎ হয়, অমনি আর্শিতে মুখ দেখি, আরো, আমি শুদ্ধ বাঙালি নহি, আমি বাঙাল, বাটি যশোরে।' পশ্চিম বাংলায় ১৯৪৭-এর পর পূর্ববঙ্গ থেকে যে সব হিন্দু গিয়েছেন, তারা এখনো সে দেশে যথেষ্ট আদৃত নন। 'ঘটি' ও বাঙালের মধ্যে একটা তফাৎ থেকেই গিয়েছে। পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা কেন যে, পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী হিন্দুদের ঘটি নামে অভিহিত করে উপহাস করতে চান, আমার তা জানা নেই। সুকুমার রায় জন্মসূত্রে ছিলেন পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জের লোক। কিন্তু তিনি তার একটি বিখ্যাত ছড়ায় বলেছেনÑ
বাঙাল মনুষ্য নহে
উড়ে এক জন্তু
লাফ দিয়ে গাছে উঠে
লেজ নেই কিন্তু।
বাঙালদের তখনো পশ্চিমবঙ্গে যেন ঠিক মানুষ বলে মনে করা হত না। বিশেষ করে কলকাতা শহরে তারা ছিলেন প্রহসনের বিষয়। এসব কথা আমার মনে পড়ছিল একটি বিশেষ কারণে। রাজশাহীতে ক'দিন আগে (১৪ মার্চ ২০১৪) হয়ে গেল 'এপার বাংলা ওপার বাংলা'? কবিদের নিয়ে কবিকুঞ্জে বিশেষ কবিতা পাঠের আসর। আসর শেষে ঘোষণা করা হলো, পৃথিবীর সব বাঙালি এক ও অভিন্ন থাকতে চায়। কিন্তু তিস্তার পানি যদি এই বাংলার লোককে তাদের প্রাপ্য অনুসারে না দেয়া হয়, তবে কেবল 'এপার বাংলা ওপার বাংলা'র কবিরা একত্র বসে কবিতা পাঠ করে কি সব বাংলাভাষী মানুষের মনে একটা ঐকান্তিক ও ঐক্য চেতনা সৃজন করতে পারবেন? কেবল এপার বাংলা ওপার বাংলার কথা বলে কি সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মনে একের প্রতি অপরের মমত্ববোধ সৃষ্টি করা যাবে? আমার মনে হয়, আমরা যেন হয়ে উঠতে চাচ্ছি খুবই অবাস্তববাদী। যারা এপার বাংলা ওপার বাংলার কথা বলছেন, তাদের মধ্যে কাজ করছে একটা বিশেষ ধরনের রাজনীতি। আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গের মতো হতে চাই, তবে আমরাও কি শেষ পর্যন্ত হয়ে পড়ব না ভারতেরই একটি অঙ্গরাজ্য অথবা সহজ কথায়, প্রদেশ? যেমন হয়ে পড়েছে কাশ্মির। আমার মনে তাই এপার বাংলা ওপার বাংলা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশকে মনে হয় দুরভিসন্ধিমূলক। কেবলই তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিষয় নয়। আমাদের দেশের বহু কথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীকে অংশ নিতে দেখছি এপার বাংলা ওপার বাংলার আন্দোলনে। ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু জানি, তাতে এদের সম্পর্কে উঁচু ধারণা আমার মনে পোষণ করতে পারি না। তাই বলছি এসব কথা। আমি মনে করি, বাংলা ভাষায় যারাই লিখুন, তার মধ্যে যদি সাহিত্য রস থাকে, তবে তা কদর পাবে সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরই কাছে। সাহিত্যের জগৎ রসের জগৎ। একে রাজনীতি-কণ্টকিত করে তোলা সাহিত্যের জন্য হয়ে উঠতে পারে ক্ষতিরই কারণ। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রÑ এরা কেউ দল করে সাহিত্য করেননি। এদের নির্ভর করে অনেক সাহিত্যিক নিজ নিজ পথে সাহিত্য সাধনায় হতে পেরেছিলেন ব্রতী। যেমন মধুসূদনকে আদর্শ করে কবি কায়কোবাদ কাব্য রচনা করতে চেয়েছিলেন। মুসলমান লেখকদের প্রভাবিত করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কিন্তু সেটা জোর করে নয়। সাহিত্যকে চলতে দেয়া উচিত, এর নিজের পায়ে। না হলে সাহিত্য আর সাহিত্য থাকে না। পরিণত হতে চায় রাজনৈতিক দলের প্রচারপত্রে।
প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
(নয়া দিগন্ত, ২৪/০৩/২০১৪)
__._,_.___