আবার সুযোগ দিন ॥ অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজ শেষ করতে চাই ॥ প্রধানমন্ত্রী
০ উখিয়ায় বিশাল জনসভা
০ সাত বৌদ্ধবিহারসহ ৪০ প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন
০ সাত বৌদ্ধবিহারসহ ৪০ প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন
মহসিন চৌধুরী/দীপন বিশ্বাস, উখিয়া থেকে ॥ কক্সবাজারের উখিয়ায় আওয়ামী লীগের বিশাল জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিগত নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে আপনারা উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছেন। এই সরকার তার মেয়াদে যত উন্নয়নমূলক কাজ করেছে অতীতের কোন সরকার তা করতে পারেনি। উন্নয়নের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে তিনি আবারও নৌকা প্রতীকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে আমরা ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ব। বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ একটি দেশ।
প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার বিকেলে উখিয়া হাইস্কুল ময়দানে আয়োজিত এ সমাবেশে বলেন, 'রিক্ত আমি সিক্ত আমি দেয়ার কিছুই নাই, আছে শুধু ভালবাসা দিয়ে গেলাম তাই।' দক্ষিণ এশিয়ার উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই। হেফাজত, জামায়াত-শিবির, বিএনপি ইসলামের হেফাজতকারী নয়। জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ নির্মূল হয়েছে। এবার অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত করতে আবারও নৌকায় ভোট দিন।
এ অঞ্চলে স্মরণকালের বৃহত্তম এ জনসমাবেশে নারীদের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, হেফাজতের এক হুজুর তেঁতুল তত্ত্ব দিলেন। মেয়েরা কাজ করতে পারবে না, পর্দার বাইরে যেতে পারবে না, চাকরি করতে পারবে না, ঘরে বসে থাকতে হবে। উনার তেঁতুল তত্ত্বের তেঁতুল বিরোধীদলীয় নেত্রী কিনা আমি জানি না? তেঁতুল দেখলে নাকি জিহ্বায় পানি আসে। তাঁকে দেখেও জিহ্বায় পানি আসতে পারে। উনি তো আবার সাজোগুজো করে থাকেন; ফিনফিনে কাপড় পরেন। তাই তেঁতুলের লোভ হতে পারে। কিন্তু আমার দেশের মেয়েরা সে রকম নয়। তারা ঘরে বসে থাকতে পারে না। শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে না কেন-জানতে চান প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রশ্ন করেন, কোরান পুড়িয়ে, মসজিদে আগুন দিয়ে কি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যায়? বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে মুসল্লিদের সুবিধার জন্য উন্নয়নকাজ করা হয়েছে। আর জামায়াত-শিবির, হেফাজত হুজুর, বিএনপি ক্যাডাররা মসজিদে আগুন দিয়েছে। পুড়িয়ে দিয়েছে জায়নামাজ। মসজিদে শুক্রবার ইমাম সাহেবকে নামাজ পড়তে বাঁধা দেয়া হলো। মোনাজাত করার সুযোগও দিল না। এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা ইসলাম প্রতিষ্ঠা নয়, ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসতে চায়। বিশৃঙ্খলা করে ধর্মে আঘাত দেয়া, এর চেয়ে লজ্জার কিছু থাকতে পারে না। তারা আবার ইসলামকে হেফাজতের কথা বলে। শত শত কোরআন পুড়িয়ে জায়নামাজ পুড়িয়ে ইসলামের হেফাজত করা যায় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আলোচনা বা প্রস্তাবে না এসে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েও বিরোধীদলীয় নেত্রী হতাশ হয়েছেন। হেফাজতের হুজুরদের দিয়ে ৫ মে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। জামায়াতে ইসলাম হেফাজতের নামে চালিয়েছে জঙ্গীদের দিয়ে তা-ব। মসজিদে হামলা ও কোরান পুড়িয়ে, হেফাজতীদের মতিঝিলে বসিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েও কাজ হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ দেশে পরিণত করতে তাঁর সরকার ভিশন-২০২১ নিয়ে কাজ করছে। এ জন্য শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব¡ দেয়া হচ্ছে। জানুয়ারির ১ তারিখে শিক্ষার্থীদের হাতে ৯৯ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যন্ত অভিভাবকদের বই কিনতে হয় না। ১ লাখ ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীকে দেয়া হচ্ছে বৃত্তি। চালু করা হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষা। শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে বিনামূল্যে বই বিতরণের কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়। গঠন করা হয়েছে বিশেষ ফান্ড। এ ফান্ড থেকে ইতোমধ্যে মাধ্যমিক পর্যন্ত বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। শীঘ্রই দেয়া হবে উচ্চতর শিক্ষা বৃত্তি। প্রসঙ্গক্রমে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রীর নাম উল্লেখ না করে বলেন, বিএনপি শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে রাখতে চায়। আর তাঁর সরকার শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। ৮৯ ভাগ ছেলেমেয়ে পাস করেছে। ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধা না দিয়ে করা হয়েছে বাধ্যতামূলক। ইসলামকে হেফাজত করার জন্য বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠন করে গেছেন। দুর্নীতি এবং পাকিস্তানপ্রীতিকে ইঙ্গিত করে তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রীর নাম উল্লেখ না করে বলেন, এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন, পাস করেছেন শুধু উর্দু আর অঙ্কে।
সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, পবিত্র কোরআন শরিফে যার যার ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে পালনের নির্দেশনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে গত বছরের ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধবিহারে আক্রমণ করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতিরোধ করে। সব ধর্মের সমঅধিকার নিয়ে সরকার কাজ করছে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত ১৯টি বিহার এবং বাড়িঘর দ্রুত মেরামত করেছেন। এ জন্য তিনি সেনাবাহিনী এবং বিজিবি সদস্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ থেকে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস উৎখাত করা হয়েছে। জঙ্গীবাদকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয়া হয়নি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। আমদানি করলে ব্যবসা হয় কিন্তু মহাজোট সরকার চায় উৎপাদন বাড়াতে। রমজানে কোন পণ্যের সঙ্কট হয়নি। বিভিন্ন পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। দেশের মানুষের জীবনযাত্রা এখন অনেক উন্নত। আরও উন্নতির জন্য সরকার কাজ করছে। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে সরকার গঠনে আপনারা সহায়তা করেছেন। তাই উন্নয়নের ছোঁয়াও পেয়েছেন। এক সঙ্গে ২১টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর কোন সরকার করতে পারেনি। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ হয়েছে। টেক্সটাইল এবং সামুদ্রিক গবেষণার ট্রেনিং সেন্টার চালু হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মৎস্য রফতানিকারক ও আওয়ামী লীগ নেতা সালাউদ্দিন আহমেদকে কক্সবাজারে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, আপনারা আমার নৌকা মার্কায় আবার ভোট দিন। জয়ী হলে ক্ষমতায় এসে জনগণের আরও সেবা দিতে পারব। আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার ওয়াদা করেন। আপনাদের যেসব নির্মাণকাজ শেষ হয়নি, তা শেষ করতে পারব। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল, একটি করে কলেজ সরকারীকরণ এবং কমিউনিটি হেলথ কেয়ার চালু করতে পারব। সরকারের হাতে সময় কম। আপনাদের দাবি উখিয়ায় স্থাপিত বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজটি যেন জাতীয়করণ করা হয়। সম্ভব হলে এ সরকারের আমলেই করে দেব। না হলে নির্বাচিত হলে পরবর্তী আমলে করে দেব এ ওয়াদা দিচ্ছি। এ সময় তিনি বেড়িবাঁধ ভাঙ্গনরোধে ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানান। বিগত সাড়ে ৪ বছরের উন্নয়ন ফিরিস্তি তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঘরে ঘরে এখন মোবাইল ফোন সস্তায় তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি কলরেট ও ফোনসেট বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তাঁর দল এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, দেশে তৈরি হচ্ছে ল্যাপটপ। যেখানে বিদ্যুত নেই সেখানে সোলার সিস্টেম চালু করা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যেতে হচ্ছে না, কক্সবাজারেই পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মিয়ানমার সীমান্তে সমুদ্রসীমায় অধিকার প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু সীমান্তের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন আমরা অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে কিছুই করেনি। আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। সমুদ্রের অফুরন্ত সম্পদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। আগামী ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে মামলাও শেষ হবে। ইনশাআল্লাহ আমরা জয়ী হব। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনে আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে জনসভায় উপস্থিত হয়ে টানা ২৬ মিনিট বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্য রাখার সময়ও কয়েক পশলা বৃষ্টি নামে। তার পরও লাখো মানুষ বিশেষ করে হাজার হাজার নারী প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেন। জনসভা ঘিরে টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকরিয়া ও কক্সবাজার সদরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। নৌকা প্রতীক নিয়ে মিছিল করে জনসভায় যোগদান করেন লাখো জনতা। নির্মাণ করা হয় সম্ভাব্য প্রার্থী ও নেতাদের নামে তোরণ।
উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপক আদিল উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, সংসদ সদস্যদের মধ্যে সাফিয়া খাতুন, হাসিনা মান্নান, নাজমুল হাসান পাপন, আবদুর রহমান বদি, এথিন রাখাইন, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ্যাডভোকেট একেএম আহমদ হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, সালাউদ্দিন আহমদ সিআইপি, অধ্যাপক হামিদুল হক চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান শফিক মিয়া, নুরুল বশর চৌধুরী, মওলানা সিরাজুল ইসলাম সিদ্দিকি, ইউনুছ বাঙালী। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর এমপি প্রমুখ।
স্থানীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদি জনসভায় দাবি জানিয়ে বলেন, আমার নমিনেশন দরকার নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার সময় উপস্থিত জনতা আমার নামে সেøাগান দিলে আমি আছি। উখিয়ায় স্থাপিত বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজটি যেন জাতীয়করণ করা হয় ও টেকনাফের বেড়িবাঁধ যেন নির্মাণ করে দুর্দশা দূর করা হয়- এ দাবি আমি করছি।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী উখিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৪০টি প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন করেন। উখিয়ার ৭টি বৌদ্ধবিহারসহ ১৬টি সরকারী সেবা সংস্থার নতুন ভবন ও উন্নয়নকাজেরও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ ছাড়া অন্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, কক্সবাজারের খুরুশকুল-চৌফলদন্ডী সংযোগ সেতু, পেঁচারদ্বীপের সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, কক্সবাজারের পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র, টেকনাফের ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, টেকনাফ থানার সার্ভিস ডেলিভারি সেন্টার, চকরিয়ার সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, কক্সবাজার টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, চকরিয়ার চিরিংগা খাদ্য গুদাম ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের প্রশিক্ষণ একাডেমী, সরকারী আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ, জেলা সার্ভার স্টেশন ও রামু ফায়ার সার্ভিস স্টেশনসহ জেলার ১৫ স্থানের ১২টি মাদ্রাসা ও ৪টি স্কুল
প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার বিকেলে উখিয়া হাইস্কুল ময়দানে আয়োজিত এ সমাবেশে বলেন, 'রিক্ত আমি সিক্ত আমি দেয়ার কিছুই নাই, আছে শুধু ভালবাসা দিয়ে গেলাম তাই।' দক্ষিণ এশিয়ার উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই। হেফাজত, জামায়াত-শিবির, বিএনপি ইসলামের হেফাজতকারী নয়। জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ নির্মূল হয়েছে। এবার অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত করতে আবারও নৌকায় ভোট দিন।
এ অঞ্চলে স্মরণকালের বৃহত্তম এ জনসমাবেশে নারীদের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, হেফাজতের এক হুজুর তেঁতুল তত্ত্ব দিলেন। মেয়েরা কাজ করতে পারবে না, পর্দার বাইরে যেতে পারবে না, চাকরি করতে পারবে না, ঘরে বসে থাকতে হবে। উনার তেঁতুল তত্ত্বের তেঁতুল বিরোধীদলীয় নেত্রী কিনা আমি জানি না? তেঁতুল দেখলে নাকি জিহ্বায় পানি আসে। তাঁকে দেখেও জিহ্বায় পানি আসতে পারে। উনি তো আবার সাজোগুজো করে থাকেন; ফিনফিনে কাপড় পরেন। তাই তেঁতুলের লোভ হতে পারে। কিন্তু আমার দেশের মেয়েরা সে রকম নয়। তারা ঘরে বসে থাকতে পারে না। শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে না কেন-জানতে চান প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রশ্ন করেন, কোরান পুড়িয়ে, মসজিদে আগুন দিয়ে কি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যায়? বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে মুসল্লিদের সুবিধার জন্য উন্নয়নকাজ করা হয়েছে। আর জামায়াত-শিবির, হেফাজত হুজুর, বিএনপি ক্যাডাররা মসজিদে আগুন দিয়েছে। পুড়িয়ে দিয়েছে জায়নামাজ। মসজিদে শুক্রবার ইমাম সাহেবকে নামাজ পড়তে বাঁধা দেয়া হলো। মোনাজাত করার সুযোগও দিল না। এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা ইসলাম প্রতিষ্ঠা নয়, ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসতে চায়। বিশৃঙ্খলা করে ধর্মে আঘাত দেয়া, এর চেয়ে লজ্জার কিছু থাকতে পারে না। তারা আবার ইসলামকে হেফাজতের কথা বলে। শত শত কোরআন পুড়িয়ে জায়নামাজ পুড়িয়ে ইসলামের হেফাজত করা যায় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আলোচনা বা প্রস্তাবে না এসে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েও বিরোধীদলীয় নেত্রী হতাশ হয়েছেন। হেফাজতের হুজুরদের দিয়ে ৫ মে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। জামায়াতে ইসলাম হেফাজতের নামে চালিয়েছে জঙ্গীদের দিয়ে তা-ব। মসজিদে হামলা ও কোরান পুড়িয়ে, হেফাজতীদের মতিঝিলে বসিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েও কাজ হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ দেশে পরিণত করতে তাঁর সরকার ভিশন-২০২১ নিয়ে কাজ করছে। এ জন্য শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব¡ দেয়া হচ্ছে। জানুয়ারির ১ তারিখে শিক্ষার্থীদের হাতে ৯৯ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যন্ত অভিভাবকদের বই কিনতে হয় না। ১ লাখ ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীকে দেয়া হচ্ছে বৃত্তি। চালু করা হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষা। শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে বিনামূল্যে বই বিতরণের কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়। গঠন করা হয়েছে বিশেষ ফান্ড। এ ফান্ড থেকে ইতোমধ্যে মাধ্যমিক পর্যন্ত বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। শীঘ্রই দেয়া হবে উচ্চতর শিক্ষা বৃত্তি। প্রসঙ্গক্রমে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রীর নাম উল্লেখ না করে বলেন, বিএনপি শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে রাখতে চায়। আর তাঁর সরকার শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। ৮৯ ভাগ ছেলেমেয়ে পাস করেছে। ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধা না দিয়ে করা হয়েছে বাধ্যতামূলক। ইসলামকে হেফাজত করার জন্য বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠন করে গেছেন। দুর্নীতি এবং পাকিস্তানপ্রীতিকে ইঙ্গিত করে তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রীর নাম উল্লেখ না করে বলেন, এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন, পাস করেছেন শুধু উর্দু আর অঙ্কে।
সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, পবিত্র কোরআন শরিফে যার যার ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে পালনের নির্দেশনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে গত বছরের ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধবিহারে আক্রমণ করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতিরোধ করে। সব ধর্মের সমঅধিকার নিয়ে সরকার কাজ করছে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত ১৯টি বিহার এবং বাড়িঘর দ্রুত মেরামত করেছেন। এ জন্য তিনি সেনাবাহিনী এবং বিজিবি সদস্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ থেকে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস উৎখাত করা হয়েছে। জঙ্গীবাদকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয়া হয়নি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। আমদানি করলে ব্যবসা হয় কিন্তু মহাজোট সরকার চায় উৎপাদন বাড়াতে। রমজানে কোন পণ্যের সঙ্কট হয়নি। বিভিন্ন পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। দেশের মানুষের জীবনযাত্রা এখন অনেক উন্নত। আরও উন্নতির জন্য সরকার কাজ করছে। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে সরকার গঠনে আপনারা সহায়তা করেছেন। তাই উন্নয়নের ছোঁয়াও পেয়েছেন। এক সঙ্গে ২১টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর কোন সরকার করতে পারেনি। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ হয়েছে। টেক্সটাইল এবং সামুদ্রিক গবেষণার ট্রেনিং সেন্টার চালু হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মৎস্য রফতানিকারক ও আওয়ামী লীগ নেতা সালাউদ্দিন আহমেদকে কক্সবাজারে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, আপনারা আমার নৌকা মার্কায় আবার ভোট দিন। জয়ী হলে ক্ষমতায় এসে জনগণের আরও সেবা দিতে পারব। আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার ওয়াদা করেন। আপনাদের যেসব নির্মাণকাজ শেষ হয়নি, তা শেষ করতে পারব। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল, একটি করে কলেজ সরকারীকরণ এবং কমিউনিটি হেলথ কেয়ার চালু করতে পারব। সরকারের হাতে সময় কম। আপনাদের দাবি উখিয়ায় স্থাপিত বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজটি যেন জাতীয়করণ করা হয়। সম্ভব হলে এ সরকারের আমলেই করে দেব। না হলে নির্বাচিত হলে পরবর্তী আমলে করে দেব এ ওয়াদা দিচ্ছি। এ সময় তিনি বেড়িবাঁধ ভাঙ্গনরোধে ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানান। বিগত সাড়ে ৪ বছরের উন্নয়ন ফিরিস্তি তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঘরে ঘরে এখন মোবাইল ফোন সস্তায় তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি কলরেট ও ফোনসেট বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তাঁর দল এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, দেশে তৈরি হচ্ছে ল্যাপটপ। যেখানে বিদ্যুত নেই সেখানে সোলার সিস্টেম চালু করা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যেতে হচ্ছে না, কক্সবাজারেই পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মিয়ানমার সীমান্তে সমুদ্রসীমায় অধিকার প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু সীমান্তের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন আমরা অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে কিছুই করেনি। আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। সমুদ্রের অফুরন্ত সম্পদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। আগামী ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে মামলাও শেষ হবে। ইনশাআল্লাহ আমরা জয়ী হব। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনে আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে জনসভায় উপস্থিত হয়ে টানা ২৬ মিনিট বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্য রাখার সময়ও কয়েক পশলা বৃষ্টি নামে। তার পরও লাখো মানুষ বিশেষ করে হাজার হাজার নারী প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেন। জনসভা ঘিরে টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকরিয়া ও কক্সবাজার সদরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। নৌকা প্রতীক নিয়ে মিছিল করে জনসভায় যোগদান করেন লাখো জনতা। নির্মাণ করা হয় সম্ভাব্য প্রার্থী ও নেতাদের নামে তোরণ।
উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপক আদিল উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, সংসদ সদস্যদের মধ্যে সাফিয়া খাতুন, হাসিনা মান্নান, নাজমুল হাসান পাপন, আবদুর রহমান বদি, এথিন রাখাইন, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ্যাডভোকেট একেএম আহমদ হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, সালাউদ্দিন আহমদ সিআইপি, অধ্যাপক হামিদুল হক চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান শফিক মিয়া, নুরুল বশর চৌধুরী, মওলানা সিরাজুল ইসলাম সিদ্দিকি, ইউনুছ বাঙালী। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর এমপি প্রমুখ।
স্থানীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদি জনসভায় দাবি জানিয়ে বলেন, আমার নমিনেশন দরকার নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার সময় উপস্থিত জনতা আমার নামে সেøাগান দিলে আমি আছি। উখিয়ায় স্থাপিত বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজটি যেন জাতীয়করণ করা হয় ও টেকনাফের বেড়িবাঁধ যেন নির্মাণ করে দুর্দশা দূর করা হয়- এ দাবি আমি করছি।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী উখিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৪০টি প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন করেন। উখিয়ার ৭টি বৌদ্ধবিহারসহ ১৬টি সরকারী সেবা সংস্থার নতুন ভবন ও উন্নয়নকাজেরও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ ছাড়া অন্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, কক্সবাজারের খুরুশকুল-চৌফলদন্ডী সংযোগ সেতু, পেঁচারদ্বীপের সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, কক্সবাজারের পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র, টেকনাফের ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, টেকনাফ থানার সার্ভিস ডেলিভারি সেন্টার, চকরিয়ার সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, কক্সবাজার টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, চকরিয়ার চিরিংগা খাদ্য গুদাম ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের প্রশিক্ষণ একাডেমী, সরকারী আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ, জেলা সার্ভার স্টেশন ও রামু ফায়ার সার্ভিস স্টেশনসহ জেলার ১৫ স্থানের ১২টি মাদ্রাসা ও ৪টি স্কুল
__._,_.___