বাংলাদেশে কূটনীতিক হত্যার পেছনে......
আবু জাফর মাহমুদঃ রাজধানী ঢাকায় সৌদি আরবীয় দূতাবাসের ২য় সচিব খালাফ আল-আলী আল সাফাহ আল ফালাহকে (৪৫) গুলি করে হত্যার ৪৮ঘন্টার পরও সময় বয়ে চলেছে অপরাপর কূটনীতিকদের নিরাপত্তা কেড়ে নেয়ার প্রকাশ্য সংকেত বাজিয়ে। কানাডা,জার্মান,ফ্রান্স,ইটালী,সুইজারল্যান্ড ও আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বসেছেন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ণে। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের জন্য কোটি টাকার নিরাপত্তা ও কূটনীতিবিদদের নিরাপত্তাহীনতার কারণ ইতিমধ্যেই জেনেছেন। তবে,এই খুন কোন সাধারণ ঘটনা নয় বলে জোর বিশ্বাস পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের।
সৌদি সরকারকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী বলে চিহ্নিতকারী ও যুদ্ধাপরাধের ঘনিষ্ঠ অংশীদার দাবীকারী হাসিনা সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের উপর চাপ প্রয়োগে বদ্ধপরিকর প্রথম থেকেই। আওয়ামীলীগ এবং ১৪দল হতে বলা হয় সৌদি আরব নাকি ৭১এর যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার,বিচার ও শাস্তি দানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং এই ইসলামী রাষ্ট্রটি নাকি হাসিনা সরকারের ভারতকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্র নীতির বিপক্ষে অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে জামায়াত-বিএনপিকে পোষছে। কেবল তাই নয়,হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ায় নেতৃত্বও করছে। এজন্য সৌদি আরবীয় সরকারকে আন্তর্জাতিক প্রধান শত্রু চিহ্নিত করেছে কট্টর মুসলিম বিরোধী হার্ডলাইনার এই সরকার।
হাসিনার সরকারপন্থীরা নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সদর দপ্তরের সামনে সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিলো ২০১১ সনে। এতে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের প্রধান ডঃ আব্দুল মোমেনকে বেশ তৎপর দেখা গেছে। অবশ্য তাকে সৌদি সরকারের প্রতি ক্ষুদ্ধ থাকার পেছনে একটি আগেকার কাহিনীর ইঙ্গিত দিয়েছেন একটি সূত্র ।এতে নিশ্চিত করা হয়েছে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রীর এই ভাইকে সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পাঠালে সৌদি সরকার তাকে গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলো। এমনিতেই গরীবের রাগ থাকে নাকের আগায়।তাই,তাদের রাগ সূর্যের তাপের সাথে পাল্লা লাগায়।ওসময়ই হাসিনা সরকারের দূরত্ব-পলিসি চালু করে দেয়া হয়।
বর্তমাণে সরকার ভাব করছেন তাদের নাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে এক মহাযুদ্ধ। তাদের বহুদিনের অভিযোগ,সব যুদ্ধাপরাধী নাকি এক হয়ে সরকার পতনে নেমেছে। সরকারও শাড়ির আঁচল বেঁধে যুদ্ধ চালু করেছে তাদের বিরোধীদের নির্মূল করার জন্য। সরকারপন্থী কট্টরপন্থীরা যেহেতু যুদ্ধাপরাধীদের দমনের লড়াইয়ে নেমেছে,এবং সৌদি সরকার যেহেতু কথিত যুদ্ধাপরাধী জামাত-বিএনপির প্রধান আন্তর্জাতিক মুরুব্বী, তাই প্রকারান্তে সৌদি কূটনীতিক হত্যা করে পরীক্ষামূলক প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে বলে ধারনা এখন বহু দিকের। অবশ্য সরকার পত্রপত্রিকায় স্বীকার করেননি অথবা ইঙ্গিত দেননি তারা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন বলে। যদিও সরকারের মনোভাব এবং হুঙ্কার পুরোটাই যুদ্ধংদেহী।
সৌদি আরবে প্রায়ই ৪০ লক্ষ বাংলাদেশী বসবাস করেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে আসা বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ তারাই যোগান দেন। এই কর্মসংস্থান বাংলাদেশের জন্য বিরাট সৌভাগ্যের হলেও সরকার এক রহস্য জনক কারণে ক্ষমতায় আসার পর হতেই সৌদি সরকারের প্রতি সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখিয়েছে এবং উল্লেখ করার মতো গাফিলতি বার বার করেছে। ভাবটা যেন এমন,সৌদি দূতাবাস গুটিয়ে বিদায় হলেই যেনো সরকার তলে তলে খুশী হন এবং সেজন্য খুশীতে লক্ষী পূজা দেন।
সৌদি রাজপরিবারের সাথে বাংলাদেশের আন্তরিক সম্পর্ক গড়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। জিয়ার সকল স্মৃতি মুছে দেয়াটা হাসিনার সরকারও ভারত সরকারের পলিসি হওয়ায় সৌদি থেকে মুখ ফেরানো হাসিনার অন্যতম পদক্ষেপও বটে।
এই সরকারগুলোর রাজনৈতিক বিশ্বাস, বাংলাদেশ তো মুসলিম রাষ্ট্র নয়,ইন্ডিয়ার শাসনতন্ত্র অনুসরণকারী ইন্ডিয়ান-সেক্যুলার স্টেট। ইন্ডিয়ার আদলে চলবার জন্যই ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক পাকিস্থান হতে ভাগ হয়েছে এই স্টেট। তাই, বরং একটা পরিস্থিতিতে নিজেরা গোস্যা করে হউক,আর যে করেই হউক,ওরা হাত গুটালে ইন্ডিয়ানপন্থী রাজনৈতিক কৌশলই বিজয় পায়।শেষতক এটাই তাদের লক্ষ্য।এদিকে অনেক বিশ্লেষক অবশ্য দাবী করছেন, এই সরকারের রাজনীতি ইন্ডিয়ান মিলিটারী ছকের নির্দ্দেশনা মোতাবেকই চলছে,যা রাজনৈতিক বক্তৃতা শোনে প্রথমে বুঝা কিছুটা কঠিন।
তাই, কূটনীতিক হত্যার কোন সূত্র বরং সরকার নিজেই গোপন করবে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো তথ্যের সূত্র আনতে ব্যর্থ হবে। সরকারের এই চাণক্য কৌশলের ফলে কূটনীতিকরা অবশেষে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হবে এবং রাষ্ট্রটি পর্যায়ক্রমে সিকিমের মতো ভারতের হাঁটুতে নিজের মাথা নিজেই লোহার চেইন দিয়ে আটকাবে। জাতীয় সংসদকে সেভাবেই আগেভাগে ঝামেলা মুক্ত করে গড়া হয়েছে যাতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হাতে পাওয়া যায় ভারতীয় সিদ্ধান্তের পক্ষে। গণতান্ত্রিক আত্নসমর্পন সম্পন্ন করা সহজ হয়। বদনাম যেন না হয়,ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক সেক্যুলার শক্তি জোর করে পরের রাষ্ট্র দখল করেছে বলে।
ঢাকায় সফররত আমেরিকার উপ-সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ জেমস এ শিয়ার কূটনীতিপারায় এ খুনের পর বলেছেন, “সন্ত্রাসবাদ নিয়ে বাংলাদেশে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ ও বাহিরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি হতে মুক্ত নয়। আমরা সন্ত্রাসবিরোধী কার্্যক্রমের সাফল্য দেখতে চাই। যেখানে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ মিশনের ওপর বক্তৃতা ও কলেজটি পরিদর্শন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
এ প্রেক্ষিতে পরিষ্কার বলা যায়, বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনের শক্তির সামান্য যুক্তিও নেই এমন ধরনের অপরাধ সংগঠিত করার। অপরাধীরাও বাহিরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এতো শক্ত ঝুঁকি নিতে পারে বলে ধারনা করা কঠিন। বরং বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার অংশ গ্রহনের যুক্তি এখানে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্যতা পায়।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী দুর্বল হয়েছে এবং সীমান্ত অরক্ষিত হয়েছে বর্তমান সরকারের প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র নীতির বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে। বলা যায়,এটি সরকারের রাজনৈতিক সফলতা যা তারা করে এসেছে। আর তাতে অগ্রসর হয়েছে রাষ্ট্রের আত্নহননের সুস্পষ্ট পথ পরিক্রমা। তাই ধরে নেয়া হচ্ছে, একদিকে সৌদি কূটনীতিককে হত্যা করে সরকারকে মুসলিম বিরোধী শক্তির কাছে আরো নিকটতম করা হলো এবং আরেকদিকে নিকট ভবিষ্যতে যুদ্ধের পরিস্থিতির কাজে লাগাবার জন্য তৈরি হয়েছে মূল্যবান উপাদান।
আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধকালে দেখেছি, নপংশুক রাজনীতিকরা জানালেন ভারতীয় সামরিক বাহিনী মিত্রবাহিনীর অবদান রাখতে এসেছে মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে। কিন্তু ২ সপ্তাহের মাথায় দেখা গেলো ভারতীয় বাহিনীর নির্দ্দেশ মানতে বাধ্য করা হয়েছে মুক্তিবাহিনী হাইকমান্ড কে। বন্ধুর পরিচয়ে এসে বীর স্বাধীনতা যোদ্ধাদের বানালো ভৃত্য। যেই ২/৩ জন সেক্টর কমান্ডার এই প্রতারণায় মাথা নোয়ালেননা, তাদেরকে নানা ভাবে বিপদগ্রস্থ করা হয়েছিলো। তারপর অব্যাহত চাপের মাথায় ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কে পাকিস্থানের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয় দেখানো হোলো। ইতিহাসে মুসলিম যোদ্ধাদের হিন্দুদের কাছে পরাজয় দেখানোর দলিল হোল।দুনিয়া অবাক হয়ে সামরিক প্রতারণা দেখলো।হাত বদল হলো কর্তৃত্বের।
এখনো একই খেলা চলছে। হাসিনা সম্ভবতঃ পরবর্তী হাত বদলটা আরো কঠিন পরিস্থিতির জন্য করবেন যদি তেমন সুযোগ চলে আসে। ৭১এর পরিস্থিতি এখন আর নেই। তাই,একতরফা খেলায় বাংলাদেশকে রক্তাক্ত করার পথ নিয়েছে শত্রুরা। বাংলাদেশের বীর জনগণ বিশ্বের খেলার অংশীদার হবার মুরোদ নিয়ে অগ্রসর হবার প্রতিজ্ঞায় থাকলে শেষ হাসি হাসবেই তারা। ওটা হবে বিজয়ী বীরের হাসি।
(নিউইয়র্ক ৭ মার্চ,২০১২ । লেখক আবু জাফর মাহমুদ আমেরিকা হতে প্রকাশিত এশিয়ান টাইমস পত্রিকার সম্পাদক)।
__._,_.___