ভালো কলেজগুলো আসলে ভালো নয়
নভেম্বর ডিসেম্বর আসলেই অনেক অভিভাবকের মাথা গরম হয়ে যায় কিভাবে তার শিশু সন্তানকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করবে। এজন্য অনেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ডোনেশান (ঘুষ) দেয়, দুধের শিশুকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে কোচিং করায়। যে-শিশুর এখনও খেলাধুলার বয়সই হয়নি, তাকে নিয়ে হাজার হাজার শিশুর সাথে প্রতিযোগিতার যুদ্ধে নামিয়ে দেওয়া কতটা অমানবিক, আমরা কেউ তা ভাবি না। সত্যিকার অর্থে এটি একটি মারাত্মক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। অভিভাবকরা ভালো স্কুল বলতে বুঝেন, যে স্কুলের গড়পড়তা রেজাল্ট ভালো অর্থাৎ এ-প্লাস পাওয়াদের সংখ্যা বেশী। অথচ ভালো স্কুল-কলেজের প্রকৃত রহস্য নিয়ে আমরা কেউ চিন্তা করে দেখি না। ভালো স্কুল-কলেজগুলি বেছে বেছে ভালো ভালো ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করায় বলেই তাদের রেজাল্ট ভালো হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ মনে করে তারা ভালো পড়ায় বলেই হয়তো তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা ভালো রেজাল্ট করে। এটা একটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
ভালো স্কুল-কলেজগুলি যদি বেছে বেছে খারাপ ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি করে ভালো রেজাল্ট দেখাতে পারত, তবেই তাদেরকে সত্যিকারের ভালো স্কুল-কলেজ বলা যুক্তিসঙ্গত হতো। তথাকথিত ভালো স্কুল-কলেজের আরেকটি দোষ হলো এরা রোজ এক বস্তা করে হোমওয়ার্ক দিয়ে দেয়, যা সামাল দিতে অভিভাবকদের বাড়িতে টিউটর রাখতে, কয়েক জায়গায় কোচিং করাসহ আরো নানারকম অগণিত হয়রানীর শিকার হতে হয়। বিশেষত একেবারে ছোট ক্লাশে বা কিন্টার গার্টেনের শিশুদের পড়ার মাত্রাতিরিক্ত চাপে জ্ঞানার্জনের প্রতি বাচ্চাদের আগ্রহ সৃষ্টি না হয়ে বরং তাদের মনে বিতৃষ্ণা-ঘৃণার জন্ম হয়। বিষয়টি আমাদের আগামী প্রজন্মকে সুনাগরিক করে গড়ে তোলার পথে একটি অলঙ্ঘনীয় বাধা হিসেবে কাজ করে। আমার পরিচিত এক ব্যক্তি যার দুই সন্তান একটি ভালো স্কুলে চান্স পাওয়ায় খুশিতে আটখানা। তার মতে, ভালো স্কুলে যেহেতু মন্ত্রী, এম.পি., শিল্পপতি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিব, জেনারেল, ব্যারিষ্টার প্রভৃতি হাই-ফাই ফ্যামিলির বাচ্চারা পড়াশোনা করে, তাই তাদের সাথে বুন্ধত্ব হওয়ার মাধ্যমে আমার বাচ্চাও এক লাফে জাতে উঠে যাবে। ইহার চাইতে নীচু মানসিকতা আর কি হতে পারে ? বাস্তবে দেখা যায়, যে বাচ্চা গাড়িতে করে রোজ স্কুলে আসে সে কিন্তু গাড়িতে করে আসা বাচ্চাদের সাথেই বন্ধুত্ব করে; হেঁটে আসা বা রিক্সায় করে স্কুলে আসা বাচ্চাদের সাথে সে মেলামেশাই করবে না। তাছাড়া পবিত্র কোরআন-হাদীসে মুসলমানদেরকে সবসময় ক্ষমতাশালী এবং বিত্তশালীদের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। কেননা পৃথিবীতে যত অপকর্ম হয়ে থাকে, তার নিরানব্বই ভাগই করে থাকে এই দুই শ্রেণীর লোকেরা। সিনেমাতে যতই গরীব-ধনীর মধ্যে প্রেম-ভালবাসা ঘটে যাক না কেন, বাস্তবে তা একেবারেই অকল্পনীয়। পারস্যের কবি শেখ সাদী বলেছিলেন যে, বাঘের সাথে বন্ধুত্বের কারণে শেয়ালের যেমন বিনা শ্রমে খাবার জুটে যায়, তেমনি আবার খেয়ালী বাঘের থাপ্পড়ে শেয়ালকে অকালে প্রাণও হারাতে হয়।
অাফসোসের ব্যাপার হলো অধিকাংশ অভিভাবকেরই একমাত্র চিন্তা থাকে কিভাবে তার সন্তানকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-জজ-ব্যারিষ্টার বানাবে। অন্যদিকে আমার সন্তান সত্যিকারের মানুষের মতো মানুষ হবে কিভাবে, এই চিন্তা খুব কম অভিভাবকই করে থাকেন। এটা একটা অতীব দুঃখজনক হুজুগে পরিণত হয়েছে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমার সন্তান যদি আল্লাহ্কে চিনতে পারে এবং আল্লাহ্র নিদের্শিত সৎ-সুন্দর-পবিত্র জীবনযাপনে আগ্রহী হয়; তবে হোক সে রিক্সাচালক কিংবা চানাচুর বিক্রেতা, আল্লাহ্র কাছে তার মযার্র্দা কোটি কোটি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-জজ-ব্যারিষ্টারের চাইতে অনেক বেশী। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বাদশার অত্যাচারে শাহাদাত বরণ করেছেন কিন্তু তারপরও প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহন করতে রাজী হন নাই। কেননা মানুষ মাত্রই ভুল-ত্রুটি, লোভ-লালসা, অলসতা, দ্বায়িত্বহীনতা, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি দোষ হতে মুক্ত নন। সেক্ষেত্রে কোন বিচারপ্রাথী যদি ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হয়, তবে সেই বিচারককে অন্তত কাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। একই কারণে একজন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষেও একই পরিণতি বরণ করা বিচিত্র কিছু নয়। আমার মতে, পড়াশুনা নিজের কাছে। পড়াশুনা করতে হবে নিজেকেই, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ভূমিকা এখানে খুবই নগণ্য। আবারও বলি ভালো রেজাল্টের ক্ষেত্রে স্কুলের ভূমিকা আসলেই কম। আপনার সন্তান যদি মেধাবী হয়, তাকে বেশী বেশী পড়তে বলেন, বেশী বেশী বই কিনে দেন, সামর্থ থাকলে বেশী বেশী টিউটর রেখে দেন, বেশী বেশী কোচিং করান, সে ভালো রেজাল্ট করবেই। তা সে যত সাধারণ আর অখ্যাত স্কুলেই পড়ুক না কেন। আমার কথাই বলি, মুগদাপাড়া কাজী জাফর হাই স্কুলের মতো অখ্যাত ও সাধারণ স্কুল থেকে পাশ করে আমি নটরডেম কলেজে চান্স পেয়েছিলাম। আমার এক ক্লাসমেট পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজেও চান্স পেয়েছিল ; (যদিও একটি বিশেষ কারণে আমার ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট খারাপ হওয়াতে ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাইনি)। আর একথা কে না জানে যে, নটরডেম কলেজ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে যে-সব ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, তারা বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা ছাত্র-ছাত্রী। বাস্তবে একটু খোঁজ নিলেই দেখতে পাবেন, নটরডেম কলেজ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এবং বুয়েটের মতো মেধাবীদের আখড়ায় নামকরা স্কুলগুলির অনেক ছাত্রও চান্স পায় না আবার নিজের মেধার গুণে অখ্যাত স্কুলগুলোর অনেক ছাত্রও চান্স পেয়ে যায়।
মনীষীরা বলেছেন যে, মেধা/প্রতিভা হলো ছাই চাপা আগুন। শত চেষ্টা করেও তাকে চেপে রাখা যায় না; আপন যোগ্যতায়ই সে সমাজে তার যোগ্য আসন ছিনিয়ে নেবে। তাই আমার মতে, তথাকথিত ভাল স্কুলে ভর্তি না করে আপনার বাসা থেকে সবচেয়ে কাছে যে স্কুলটি আছে তাতেই আপনার সন্তানকে ভর্তি করান। ভালো স্কুলের নামে দূরের কোন স্কুলে রোজ আসা-যাওয়াতে অযথা সময়ের অপচয়, এনার্জি লস, পয়সা নষ্ট, স্বাস্থ্যহানি, সর্বোপরি গাড়িচাপা পড়ে অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনাও আছে। অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি মনে করেন, ভালো স্কুল বা নামকরা স্কুলে ভর্তি করানোর চাইতে বরং ভালোভাবে তৈরী করা বিল্ডিংওয়ালা স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করানো বুদ্ধিমানের কাজ। কেননা গত কয়েক বছরে পাকিস্তান এবং চীনে যে-সব ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে দেখা গেছে পুরনো স্কুলগুলি এবং (খরচ বাচাঁতে) হালকা যাচ্ছেতাই ভাবে তৈরী করা স্কুলগুলি ধ্বসে গিয়ে হাজার হাজার নিষ্পাপ ছাত্র-ছাত্রীর অতীব দুঃখজনক অকাল মৃত্যু হয়েছে। কাজেই বিজ্ঞানীরা যেহেতু বলতেছেন যে, আমাদের দেশে খুব শীঘ্রই বড় ধরণের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাজেই আমাদের উচিত, যে স্কুলের রেজাল্ট ভালো তাতে সন্তানকে ভর্তি না করিয়ে বরং যে স্কুলের বিল্ডিং বেশ পোক্ত, তাতে শিশুদের ভর্তি করানো। সবচেয়ে ভালো হয়, যে-সব স্কুল টিনশেড বিল্ডিংয়ে চলে, তাতে শিশুদের ভর্তি করা। কেননা টিনশেড বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়লেও তাতে শিশুদের করুণ মৃত্যুর সম্ভাবনা খুবই কম।
ডাঃ বশীর মাহমুদ ইলিয়াস
গ্রন্থকার, ডিজাইন স্পেশালিষ্ট, ইসলাম গবেষক, হোমিও কনসালটেন্ট
চেম্বার ঃ জাগরণী হোমিও হল
৪৭/৪ টয়েনবী সার্কুলার রোড (নীচতলা)
(ইত্তেফাক মোড়ের পশ্চিমে এবং স্টুডিও 27 এর সাথে)
টিকাটুলী, ঢাকা।
ফোন ঃ +৮৮০-০১৯১৬০৩৮৫২৭
E-mail : Bashirmahmudellias@hotmail.com
Website : http://bashirmahmudellias.blogspot.com
Website : https://bashirmahmudellias.wordpress.com
__._,_.___