যুদ্ধাপরাধীদের বিচার: সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন রয়েছে
06 November 2014, Thursday
যুদ্ধ থাকলে যুদ্ধাপরাধ হয়, হয় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধও। এসব হীন অপরাধের উপযুক্ত বিচার একটি সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং মানুষের মনের গভীর ক্ষত নিরাময়ে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার তাই বলে বিতর্কমুক্ত থাকেনি। কখনো ঘৃণা বা প্রতিশোধস্পৃহা থেকে বিচার অনুষ্ঠান, আবার কখনো একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগ বিভিন্ন দেশে রয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বীকৃত বৈশ্বিক উদ্যোগের সূচনা ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে। সে যুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তি অনুসারে ১৯২১ সালে লিপজিগে জার্মান সুপ্রিম কোর্টে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। ভার্সাই চুক্তি ও লিপজিগ ট্রায়াল জার্মানদের মধ্যে গভীর বঞ্চনাবোধ সৃষ্টি করে, যার সুযোগ নিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করে অ্যাডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেন। এই যুদ্ধের পরে নুরেমবার্গ ও টোকিওতে অনুষ্ঠিত বিচারগুলোতে জার্মানি ও তার মিত্ররাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধনায়কদের চরম দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়ালকে যুদ্ধাপরাধের আদালতের বৈশ্বিক উদ্যোগের মডেল ধরা হলেও এসব বিচারের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রচুর সমালোচনা করা হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধ আর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সংগঠিত হয়েছে মূলত জাতীয়ভাবে এবং ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনগুলোর আলোকে। এই কনভেনশনগুলো ও পরবর্তীকালের প্রথাগত আইন শাসকগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ নৃশংসতা ও গৃহযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করে বিচারের পথ প্রশস্ত করে।
সাম্প্রতিক কালে হাইব্রিড, মিশ্র বা আন্তর্জাতিকীকৃত (ইন্টারন্যাশনালাইজড) ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার করার একটি প্রবণতা লক্ষণীয়। এসব ট্রাইব্যুনাল সাধারণত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সংমিশ্রণে বিচারকাজ পরিচালনা করে এবং বিচারক-আইনজীবী-তদন্তকারীদের মধ্যে অন্য রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে। লেবানন, কসোভো, পূর্ব তিমুর, সিয়েরা লিয়ন, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কম্বোডিয়া ও সেনেগালে এ ধরনের আদালত রয়েছে। এসব আদালত তুলনামূলকভাবে একটি দেশের নিজস্ব আদালতের তুলনায় বেশি নিরপেক্ষ হিসেবে মূল্যায়িত হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এসব আদালত ধীরগতি, অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে সমালোচিত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ ও প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচিত হয়েছে, এমনকি রোমের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও। এই আদালতে শুধু আফ্রিকান দেশগুলোর যুদ্ধাপরাধ বিচার করা হচ্ছে বলে সম্প্রতি এর সমালোচনা করেছে অর্গানাইজেশন অব আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্যগুলো।
ওপরে উল্লিখিত ট্রাইব্যুনালগুলোর তুলনায় নিজস্ব তদন্তকারী, আইনজীবী ও বিচারকদের নিয়ে গঠিত বলে বাংলাদেশের 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল' সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের মতো ইথিওপিয়াও ২০০৮ সালে সম্পূর্ণ নিজস্ব ট্রাইব্যুনালে ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের আমলের নৃশংস যুদ্ধাপরাধগুলোর বিচার করেছিল। ইথিওপিয়ার ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে এখন মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উঠছে এই ট্রাইব্যুনাল গঠনকারী সরকারের বিরুদ্ধেও। বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম এবং এর পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা রয়েছে। তবে এই বিচারের উদ্যোগ বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছিল, এখনো বিচার অব্যাহত রাখার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন রয়েছে।
২.
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তার এদেশি সহযোগী শক্তি হিসেবে রাজাকার-আলবদর প্রমুখ বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার বিচার বাংলাদেশের হৃদয়ে প্রোথিত একটি দাবি। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের অঙ্গীকার তাই অধিকাংশ মানুষকে আশান্বিত করেছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর এই বিচার অনুষ্ঠানের জন্য জাতীয়ভাবে মানসিক প্রস্তুতিও ছিল। তবে বিভিন্ন কারণে এই বিচার অনুষ্ঠান সহজ ছিল না। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এক বিশেষ ধরনের আন্তজার্তিক অপরাধ, যে অপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা সংগত কারণেই ড. কামাল হোসেনের মতো কিছু আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ বাদে অন্য কারও ছিল না।
দ্বিতীয়ত, এই বিচার প্রায় ৪০ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে অপরাধগুলোর আলামত, সাক্ষ্য ও সাক্ষী সংগ্রহ অত্যন্ত সমস্যাসংকুল ছিল। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিবেচনায় নিলে এই বিচারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রচারণা সৃষ্টির সুযোগ ছিল। মূল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অতীতে আওয়ামী লীগের নানা ধরনের কৌশলগত মিত্রতা ছিল। ২০০১ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী-বিরোধী বিএনপি জোটে আরও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়। আর এ কারণেই জামায়াতের নেতাদের বিচার করা হচ্ছে, এমন প্রচারণা সৃষ্টির সুযোগ সমাজে তৈরি ছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার এসব ঝুঁকি বিবেচনায় না নিয়ে সুচিন্তিত প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। বিচারের প্রাথমিক স্থান নির্বাচনে ত্রুটি, দুর্বল তদন্তকারী ও কৌঁসুলি নিয়ে বিচারকাজের উদ্যোগ, নথি ও সাক্ষ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ দুর্বলতা ছিল এর কয়েকটি মাত্র প্রমাণ। তবে পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার পক্ষগুলোর নিরন্তর চাপে হোক বা আদর্শিক কারণে হোক বা ক্ষমতায় অব্যাহত থাকার কৌশলের কারণেই হোক, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারে অনেক বেশি আন্তরিক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ২০১৩ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বিষয়ই আওয়ামী লীগের জন্য প্রধান রক্ষাকবচ হয়ে ওঠে।
৩.
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারের রাজনীতি থাকতে পারে। তবে এই রাজনীতি যদি বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন তোলা দুরূহ বা অসম্ভব করে তোলে তাহলে তা উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে। এ দেশে গত কয়েক বছরে তা-ই হয়েছে। বিচারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণে আদালত অবমাননা আইনের প্রয়োগ হয়েছে, সমালোচকদের হেনস্তা করা হয়েছে এবং ঢালাওভাবে অপপ্রচারণা চালানো হয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের মিত্রদের দ্বারা বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, বিচার-প্রক্রিয়াকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে এবং রায় ঘোষণার পর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এই বিচারের পক্ষে-বিপক্ষে এমন উগ্রবাদী দুটো বিবদমান পক্ষ সৃষ্টি হয়েছে যে বিচারের যেকোনো মূল্যায়নই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে এখন পর্যন্ত একজনের (আবদুল কাদের মোল্লা) ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে, একজনের (দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী) বিরুদ্ধে আপিল আদালত চূড়ান্তভাবে আজীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ অন্য কয়েকজনের (যেমন মতিউর রহমান নিজামী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী) ফাঁসির রায় আপিল আদালতে দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ ও তার প্রতি সরকারের প্রকাশ্যে সমর্থন হিসেবে আপিলসংক্রান্ত আইন বিচারকালে সংশোধন করার বিরল পদক্ষেপের মাধ্যমে।
অন্যদিকে, সাইদীর মামলায় একজন বিচারকের ফাঁস হয়ে যাওয়া স্কাইপ সংলাপের তথ্য, সাইদীর পক্ষের একজন সাক্ষীর উধাও হওয়া এবং সাইদীর বিপক্ষের ১৫ জন সাক্ষীর বক্তব্য তাঁদের বিনা উপস্থিতিতে ও বিনা স্বাক্ষরে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করা নিয়ে নানা প্রশ্ন বিচারকালে তোলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল কেন ১৯৭১ সালে কয়েকজন সাক্ষী অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল এবং তদন্ত ও বিচারকালে কয়েকজন সাক্ষীর স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েছিলেন—এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়নি—আপিলকালে সাইদীর আইনজীবীরা এমন প্রশ্নও তুলেছিলেন। আপিল আদালতে যে বিচারক সাইদীকে খালাস দিয়েছেন, তাঁর বিস্তারিত রায়ে এসব অসংগতি আরও প্রামাণ্যভাবে ফুটে উঠতে পারে। এসব অসংগতির জবাব মূল রায়ে না থাকলে সাইদীর বিচার আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
৪.
২০১৩ সালের এপ্রিলে এসি নেলসনের একটি জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জানায় যে তারা মনে করে বিচারপ্রক্রিয়ায় গলদ রয়েছে, এদের মধ্যে তার পরও ৮৬ শতাংশ বিচার চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে (তথ্যসূত্র: দি ইকোনমিস্ট, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)।
সরকার যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে তার ন্যায্যতা নিয়ে সমাজে কোনো প্রশ্ন নেই, থাকার কোনো কারণও নেই। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার না করলে তা হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং ১৯৭১ সালে নিহত পরিবারসমূহ এবং ন্যায়বিচার বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের প্রতি মারাত্মক অবমাননা। কিন্তু এই বিচারপ্রক্রিয়া এবং একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন অব্যাহত থাকলে এই বিচারের মাহাত্ম্য ম্লান হবে, রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী অসন্তোষ থাকবে এবং নানা যড়যন্ত্রের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে তাই আরও স্বচ্ছ, দক্ষ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। সেসব পদক্ষেপ নেওয়ার সময় ও সুযোগ খুব একটা বেশি আর নেই এখন। বরং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ট্রাইব্যুনাল ও আপিল আদালতের মন্থরগতি এই বিচারে সরকারের আগ্রহ অটুট রয়েছে কি না, কিংবা ক্ষমতায় নিরাপদে থাকতে উল্টো জামায়াতের সঙ্গে সরকার সাময়িকভাবে হলেও কোনো সমঝোতা করছে কি না—এমন সন্দেহ সমাজে তৈরি হয়েছে।
ক্ষমতায় রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুকে আওয়ামী লীগ অতীতে ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে একই কারণে বিএনপি এই বিচারের দাবি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে বিযুক্ত না করতে পারলে এর গ্রহণযোগ্যতা ভবিষ্যতে অটুট নাও থাকতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বীকৃত বৈশ্বিক উদ্যোগের সূচনা ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে। সে যুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তি অনুসারে ১৯২১ সালে লিপজিগে জার্মান সুপ্রিম কোর্টে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। ভার্সাই চুক্তি ও লিপজিগ ট্রায়াল জার্মানদের মধ্যে গভীর বঞ্চনাবোধ সৃষ্টি করে, যার সুযোগ নিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করে অ্যাডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেন। এই যুদ্ধের পরে নুরেমবার্গ ও টোকিওতে অনুষ্ঠিত বিচারগুলোতে জার্মানি ও তার মিত্ররাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধনায়কদের চরম দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়ালকে যুদ্ধাপরাধের আদালতের বৈশ্বিক উদ্যোগের মডেল ধরা হলেও এসব বিচারের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রচুর সমালোচনা করা হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধ আর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সংগঠিত হয়েছে মূলত জাতীয়ভাবে এবং ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনগুলোর আলোকে। এই কনভেনশনগুলো ও পরবর্তীকালের প্রথাগত আইন শাসকগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ নৃশংসতা ও গৃহযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করে বিচারের পথ প্রশস্ত করে।
সাম্প্রতিক কালে হাইব্রিড, মিশ্র বা আন্তর্জাতিকীকৃত (ইন্টারন্যাশনালাইজড) ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার করার একটি প্রবণতা লক্ষণীয়। এসব ট্রাইব্যুনাল সাধারণত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সংমিশ্রণে বিচারকাজ পরিচালনা করে এবং বিচারক-আইনজীবী-তদন্তকারীদের মধ্যে অন্য রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে। লেবানন, কসোভো, পূর্ব তিমুর, সিয়েরা লিয়ন, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কম্বোডিয়া ও সেনেগালে এ ধরনের আদালত রয়েছে। এসব আদালত তুলনামূলকভাবে একটি দেশের নিজস্ব আদালতের তুলনায় বেশি নিরপেক্ষ হিসেবে মূল্যায়িত হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এসব আদালত ধীরগতি, অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে সমালোচিত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ ও প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচিত হয়েছে, এমনকি রোমের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও। এই আদালতে শুধু আফ্রিকান দেশগুলোর যুদ্ধাপরাধ বিচার করা হচ্ছে বলে সম্প্রতি এর সমালোচনা করেছে অর্গানাইজেশন অব আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্যগুলো।
ওপরে উল্লিখিত ট্রাইব্যুনালগুলোর তুলনায় নিজস্ব তদন্তকারী, আইনজীবী ও বিচারকদের নিয়ে গঠিত বলে বাংলাদেশের 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল' সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের মতো ইথিওপিয়াও ২০০৮ সালে সম্পূর্ণ নিজস্ব ট্রাইব্যুনালে ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের আমলের নৃশংস যুদ্ধাপরাধগুলোর বিচার করেছিল। ইথিওপিয়ার ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে এখন মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উঠছে এই ট্রাইব্যুনাল গঠনকারী সরকারের বিরুদ্ধেও। বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম এবং এর পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা রয়েছে। তবে এই বিচারের উদ্যোগ বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছিল, এখনো বিচার অব্যাহত রাখার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন রয়েছে।
২.
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তার এদেশি সহযোগী শক্তি হিসেবে রাজাকার-আলবদর প্রমুখ বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার বিচার বাংলাদেশের হৃদয়ে প্রোথিত একটি দাবি। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের অঙ্গীকার তাই অধিকাংশ মানুষকে আশান্বিত করেছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর এই বিচার অনুষ্ঠানের জন্য জাতীয়ভাবে মানসিক প্রস্তুতিও ছিল। তবে বিভিন্ন কারণে এই বিচার অনুষ্ঠান সহজ ছিল না। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এক বিশেষ ধরনের আন্তজার্তিক অপরাধ, যে অপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা সংগত কারণেই ড. কামাল হোসেনের মতো কিছু আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ বাদে অন্য কারও ছিল না।
দ্বিতীয়ত, এই বিচার প্রায় ৪০ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে অপরাধগুলোর আলামত, সাক্ষ্য ও সাক্ষী সংগ্রহ অত্যন্ত সমস্যাসংকুল ছিল। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিবেচনায় নিলে এই বিচারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রচারণা সৃষ্টির সুযোগ ছিল। মূল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অতীতে আওয়ামী লীগের নানা ধরনের কৌশলগত মিত্রতা ছিল। ২০০১ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী-বিরোধী বিএনপি জোটে আরও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়। আর এ কারণেই জামায়াতের নেতাদের বিচার করা হচ্ছে, এমন প্রচারণা সৃষ্টির সুযোগ সমাজে তৈরি ছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার এসব ঝুঁকি বিবেচনায় না নিয়ে সুচিন্তিত প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। বিচারের প্রাথমিক স্থান নির্বাচনে ত্রুটি, দুর্বল তদন্তকারী ও কৌঁসুলি নিয়ে বিচারকাজের উদ্যোগ, নথি ও সাক্ষ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ দুর্বলতা ছিল এর কয়েকটি মাত্র প্রমাণ। তবে পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার পক্ষগুলোর নিরন্তর চাপে হোক বা আদর্শিক কারণে হোক বা ক্ষমতায় অব্যাহত থাকার কৌশলের কারণেই হোক, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারে অনেক বেশি আন্তরিক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ২০১৩ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বিষয়ই আওয়ামী লীগের জন্য প্রধান রক্ষাকবচ হয়ে ওঠে।
৩.
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারের রাজনীতি থাকতে পারে। তবে এই রাজনীতি যদি বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন তোলা দুরূহ বা অসম্ভব করে তোলে তাহলে তা উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে। এ দেশে গত কয়েক বছরে তা-ই হয়েছে। বিচারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণে আদালত অবমাননা আইনের প্রয়োগ হয়েছে, সমালোচকদের হেনস্তা করা হয়েছে এবং ঢালাওভাবে অপপ্রচারণা চালানো হয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের মিত্রদের দ্বারা বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, বিচার-প্রক্রিয়াকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে এবং রায় ঘোষণার পর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এই বিচারের পক্ষে-বিপক্ষে এমন উগ্রবাদী দুটো বিবদমান পক্ষ সৃষ্টি হয়েছে যে বিচারের যেকোনো মূল্যায়নই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে এখন পর্যন্ত একজনের (আবদুল কাদের মোল্লা) ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে, একজনের (দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী) বিরুদ্ধে আপিল আদালত চূড়ান্তভাবে আজীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ অন্য কয়েকজনের (যেমন মতিউর রহমান নিজামী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী) ফাঁসির রায় আপিল আদালতে দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ ও তার প্রতি সরকারের প্রকাশ্যে সমর্থন হিসেবে আপিলসংক্রান্ত আইন বিচারকালে সংশোধন করার বিরল পদক্ষেপের মাধ্যমে।
অন্যদিকে, সাইদীর মামলায় একজন বিচারকের ফাঁস হয়ে যাওয়া স্কাইপ সংলাপের তথ্য, সাইদীর পক্ষের একজন সাক্ষীর উধাও হওয়া এবং সাইদীর বিপক্ষের ১৫ জন সাক্ষীর বক্তব্য তাঁদের বিনা উপস্থিতিতে ও বিনা স্বাক্ষরে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করা নিয়ে নানা প্রশ্ন বিচারকালে তোলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল কেন ১৯৭১ সালে কয়েকজন সাক্ষী অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল এবং তদন্ত ও বিচারকালে কয়েকজন সাক্ষীর স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েছিলেন—এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়নি—আপিলকালে সাইদীর আইনজীবীরা এমন প্রশ্নও তুলেছিলেন। আপিল আদালতে যে বিচারক সাইদীকে খালাস দিয়েছেন, তাঁর বিস্তারিত রায়ে এসব অসংগতি আরও প্রামাণ্যভাবে ফুটে উঠতে পারে। এসব অসংগতির জবাব মূল রায়ে না থাকলে সাইদীর বিচার আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
৪.
২০১৩ সালের এপ্রিলে এসি নেলসনের একটি জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জানায় যে তারা মনে করে বিচারপ্রক্রিয়ায় গলদ রয়েছে, এদের মধ্যে তার পরও ৮৬ শতাংশ বিচার চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে (তথ্যসূত্র: দি ইকোনমিস্ট, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)।
সরকার যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে তার ন্যায্যতা নিয়ে সমাজে কোনো প্রশ্ন নেই, থাকার কোনো কারণও নেই। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার না করলে তা হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং ১৯৭১ সালে নিহত পরিবারসমূহ এবং ন্যায়বিচার বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের প্রতি মারাত্মক অবমাননা। কিন্তু এই বিচারপ্রক্রিয়া এবং একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন অব্যাহত থাকলে এই বিচারের মাহাত্ম্য ম্লান হবে, রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী অসন্তোষ থাকবে এবং নানা যড়যন্ত্রের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে তাই আরও স্বচ্ছ, দক্ষ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। সেসব পদক্ষেপ নেওয়ার সময় ও সুযোগ খুব একটা বেশি আর নেই এখন। বরং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ট্রাইব্যুনাল ও আপিল আদালতের মন্থরগতি এই বিচারে সরকারের আগ্রহ অটুট রয়েছে কি না, কিংবা ক্ষমতায় নিরাপদে থাকতে উল্টো জামায়াতের সঙ্গে সরকার সাময়িকভাবে হলেও কোনো সমঝোতা করছে কি না—এমন সন্দেহ সমাজে তৈরি হয়েছে।
ক্ষমতায় রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুকে আওয়ামী লীগ অতীতে ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে একই কারণে বিএনপি এই বিচারের দাবি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে বিযুক্ত না করতে পারলে এর গ্রহণযোগ্যতা ভবিষ্যতে অটুট নাও থাকতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
__._,_.___