'বাঁচাও বাঁচাও' বলে চিৎকার শুনেছি
''বনানীতে পার্কের বেঞ্চে ঘুমাচ্ছিলাম। তখনও গভীর ঘুম ধরেনি। হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ পাই। এতে পাতলা ঘুম ভেঙে জেগে উঠি। পার্কের বেঞ্চে বসেই দেখতে পাই, একটি লোককে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছে ৪ ব্যক্তি। গাড়িতে উঠতে না চাওয়ায় ওই ব্যক্তিকে কিলঘুষি মারা হচ্ছিল। দীর্ঘ সময় ধস্তাধস্তির পর জোর করে তাকে গাড়িতে তোলা হয়। এ সময় ওই ব্যক্তি 'বাঁচাও বাঁচাও' বলে চিৎকার করছিল। পরদিন সকালে জানতে পারি, বনানীর পার্কের পাশের সড়ক থেকে যে ব্যক্তিকে গাড়িতে তোলা হচ্ছিল, তিনি বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। গাড়িতে উঠিয়ে বনানী এক নম্বরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।' ১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার রাত সোয়া ১২টার দিকে বনানীর ২ নম্বর সড়কের পাশের সড়ক থেকে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও তার ব্যক্তিগত গাড়ি চালক মোঃ আনসারকে তুলে নেওয়া হয়। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ডাববিক্রেতা সোহেল রানা। বাসায় ফিরতে দেরি হলে প্রায়ই বনানীর পার্কে ঘুমান সোহেল। ওই পার্কের পাশেই তার বাবা ডাব বিক্রি করেন। সোহেল ডাববিক্রেতা বাবাকে সাহায্য করেন। ইলিয়াসকে তুলে নেওয়ার পুরো ঘটনটি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন সোহেল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সোহেলকে তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। গতকাল বনানী থানায় সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের পর সমকাল প্রতিবেদক সোহেলের সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কথা বলেন। সোহেলের কথায়
উঠে
আসে সেই রাতের চিত্র। সোহেলের সঙ্গে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সমকালের কাছে রয়েছে। এ নিয়ে ইলিয়াস 'নিখোঁজে'র ঘটনায় অন্তত তিন প্রত্যক্ষদর্শীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তাদের সবার বক্তব্য যাচাই করা হচ্ছে।
সোহেল রানা সমকালকে জানান, হঠাৎ দেখলাম পার্ক সংলগ্ন সড়কে একটি সাদা রঙের গাড়িকে আটকে দেওয়া হয়েছে। ওই গাড়িটির সামনে-পেছনে আরও দুটি গাড়ি। গাড়িতে উঠতে না চাওয়ায় কয়েকজন লোক একজনকে লক্ষ্য করে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করছিল আর বলছিল, 'গাড়িতে ওঠ। তোকে গাড়িতে উঠতেই হবে।'
যারা গাড়িতে তুলছিল তাদের পরনে কী ছিল_ এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল রানা জানান, যারা টানাহেঁচড়া করে গাড়িতে তুলছিল তাদের পরনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো পোশাক ছিল না। তাদের পরনে উজ্জ্বল রঙের কাপড় ছিল। পরনের কাপড় ঝিকমিক করছিল।
সব সময় কী পার্কে রাত কাটান? এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল রানা সমকালকে জানান, আমার সঙ্গে ওই রাতে একজন পার্কে ঘুমিয়ে ছিল। ওই ব্যক্তিকে আমি চিনি না। সে আমাকে এসে বলে গ্রাম থেকে এসেছি, থাকার কোনো জায়গা নেই। ঘটনাস্থলে কোনো ব্যক্তিকে কারও শার্টের কলার চেপে ধরতে আমি দেখেনি। ওই সময় অন্য কাউকে ঘটনাস্থলে জড়ো হতেও দেখিনি। গভীর ঘুমে থাকায় আমার পাশের লোকটি ঘটনটি টের পায়নি।
যারা ধরে নিয়ে গেছে, তারা দেখতে কেমন_ এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল বলেন, 'তারা লম্বা ছিলেন। কেউ মোটাসোটা আবার কেউ হ্যাংলা-পাতলা।' আপনি পার্কে ঘুমান কেন_ এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল জানান, রাত ১২টার দিকে বাসার গেট বন্ধ হয়ে যায়। যেদিন কাজ করতে বেশি রাত হয়ে যায়, সেই দিন পার্কে রাত কাটাই। রাজধানীর একটি বস্তিতে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন বলে জানান সোহেল।
নূরানী টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী লুৎফরের বক্তব্য : এ ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বনানীর ২ নম্বর সড়ক সংলগ্ন নির্মাণাধীন ভবন নূরানী টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী লুৎফর রহমান। ইলিয়াস 'নিখোঁজে'র পর লুৎফরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। লুৎফর জানিয়েছেন, ওই রাতে একটি গাড়ির সঙ্গে আরেকটি গাড়ির ধাক্কা লাগার শব্দ তিনি শুনেছেন। এরপর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের আওয়াজ পান। তবে ঘটনাটি নির্মাণাধীন ভবনের টিনের বেড়ার ওপাশে হওয়ায় পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। লুৎফরের কথা জানতে চাইলে নূরানী টাওয়ারের আরেক নিরাপত্তাকর্মী মাসুদ রানা সমকালকে বলেন, চার দিন ধরে লুৎফরের খোঁজ নেই। এ ঘটনার পর সে অনেক ভয় পেয়ে যায়। সম্ভবত গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। তবে আমাদের কাউকে কিছু বলেনি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা লুৎফরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
বনানীর দুই নম্বর সড়কের যে এলাকা থেকে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হন, ওই সড়কের একপাশে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। অন্যপাশে নির্মাণাধীন ভবন নূর টাওয়ার। নূর টাওয়ারের সামনেই একটি পার্ক। ওই স্থান থেকে ইলিয়াস আলীর বাসা ৩শ' গজ দূরেই। 'নিখোঁজ' হওয়ার স্থান ছাড়া বনানীর দুই নম্বর সড়কের দু'পাশেই রয়েছে বাড়ি। ইলিয়াসকে 'তুলে' নিতে বনানীর দুই নম্বর সড়কের সবচেয়ে নির্জন এলাকাটি বেছে নেওয়া হয়।
একটি সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলীকে 'তুলে' নেওয়ার সময় পুলিশের একজন এসআই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। ছিনতাইকারী ভেবে প্রথম ওই কর্মকর্তা একজনকে পেছন দিক থেকে কলার চেপে ধরেন। কৌশলগত কারণে পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে ঘটনাটি তিনি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তাকে অবগত করেন। তবে ইলিয়াসকে 'তুলে' নেওয়ার সময় পুলিশের কোনো সদস্যের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেননি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার এম সোহায়েল সমকালকে বলেন, ইলিয়াসকে উদ্ধারে র্যাব সর্বোচ্চ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি চৌধুরী লুৎফুল কবীর সমকালকে বলেন, তদন্ত করার একটি পর্যায়ে আমরা সোহেলের খোঁজ পাই। এরপর তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
বনানী থানার ওসি (তদন্ত) মাইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ইলিয়াসের সন্ধানে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় যা উঠে এসেছে : প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় একটি বিষয় উঠে এসেছে। তা হলো, ধস্তাধস্তি করেই গাড়িতে ইলিয়াসকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। ঘটনার পরপরই একজন প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশকে জানিয়েছিলেন, একটি প্রাইভেট কার ইলিয়াসের গাড়িকে পেছন দিক থেকে ধাক্কা দিয়েছিল। সোহেল রানা সমকালকে জানান, ঘটনাস্থলে গাড়ি ছিল তিনটি। প্রত্যক্ষদর্শীদের সবার বক্তব্যে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট তা হলো_ ঘটনাস্থলে ইলিয়াসের সঙ্গে 'অপহরণকারীদের' উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছিল।
__._,_.___