Banner Advertise

Tuesday, February 7, 2012

[chottala.com] ভারতের দাসত ;্ব করার জন্ 79; কেউ মুক্তি&# 2479;ুদ্ধ করেনি( Veteran Journalist Sirajur Rahman's column)



ভারতের দাসত্ব করার জন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি

সি রা জু র র হ মা ন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আমি উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিলাম সে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই, উনিশশ’ সত্তরের সাইক্লোন প্রলয়ের সময় থেকে। বিবিসি টেলিভিশন এ সম্পর্কে ৪৫ মিনিট স্থায়ী একটা ‘টোয়েন্টিফোর আওয়ার’ অনুষ্ঠান করে। তত্কালীন একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক কেনেথ অলসপের উপস্থাপনায় সে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ছিলাম আমি আর ডন পত্রিকার তত্কালীন লন্ডন সংবাদদাতা নাসিম আহমেদ। নাসিম প্রস্তাব দেন, সাইক্লোনের ত্রাণকার্য সঠিক পরিচালনার জন্য পরের মাসের জন্য নির্ধারিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন স্থগিত করা হোক।
আমি ভীষণ চটে গিয়েছিলাম। শ্রোতা-দর্শকদের বললাম, উপযুক্ত ত্রাণের কাজ চালানো দূরের কথা, পাকিস্তান সরকার তো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধামাচাপাই দিতে চাইছে। আমি আরও বললাম, ১৯৬০ সালে এই এলাকায় আরেকটা ঘূর্ণিঝড়ের পর বহু ব্রিটিশ নাগরিক অর্থ সাহায্য দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার তখন বলেছিল, সে অর্থে উপকূলীয় অঞ্চলে কনক্রিটের শেল্টার তৈরি হবে। শেল্টারগুলো তৈরি হলে এত লোক নিশ্চয়ই মারা যেত না। শ্রোতা-দর্শকদের আমি আরও বললাম, আপনারা পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে সে অর্থ এখন ফেরত চান।
নাসিম আহমেদ তখন ইউরোপে পাকিস্তান সরকারের বেসরকারি প্রবক্তার কাজ করতেন। একটা গুজব ছিল যে তিনি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই’র লোক ছিলেন। তিনি তারস্বরে ঘোষণা করেন, শেল্টার তৈরির প্রতিশ্রুতি পাকিস্তান সরকার কখনও দেয়নি। আমি মোলায়েম করেই বললাম, মাত্র ১৮ দিন আগে আমি লন্ডন বিমানবন্দরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাত্কার নিয়েছি, সে সাক্ষাত্কারে তিনি স্বীকার করেছেন, শেল্টার তৈরির প্রতিশ্রুতি ১০ বছর আগে দেয়া হলেও সেসব শেল্টার তৈরি হয়নি, তবে তিনি শিগগিরই শেল্টারগুলো তৈরি করবেন। আমি আরও বললাম, ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাত্কারের টেপ বিবিসির বুশ হাউসে আমার আলমারিতে আছে।
পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে দেখি, ফ্লিট স্ট্রিটের সিনিয়র সংবাদদাতাদের অনেকেই এসেছেন। তারা ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাত্কারের টেপ শুনতে চান। সে টেপ তাদের বাজিয়ে শুনিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, ১৯৬০ সালে তত্কালীন করাচির পাকিস্তান সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট শেল্টার তৈরির প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত যে প্রেস রিলিজ প্রকাশ করেছিল সেটাও তাদের দেখালাম এবং আমার সেক্রেটারি তার জেরক্স কপি করে প্রত্যেককে দিয়েছিলেন। পরদিনের ব্রিটিশ পত্রিকাগুলো কেউ পূর্ণ পৃষ্ঠা আর কেউ অর্ধপৃষ্ঠা প্রতিবেদন ছেপেছিল পূর্ব পাকিস্তানের সাইক্লোন আর এ প্রদেশের প্রতি পাকিস্তান সরকারের বঞ্চনা ও অবিচার সম্পর্কে। ব্রিটিশ (এবং লন্ডনভিত্তিক অন্যান্য দেশীয়) সংবাদদাতাদের সঙ্গে তখন থেকেই আমার একটা বিশ্বস্ততার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেটা আমাদের জন্য খুবই উপকারী প্রমাণিত হয়েছিল। যুদ্ধ সংক্রান্ত খবরাদির বিশ্লেষণের জন্য তারা প্রায়ই আমার অফিসে আসতেন অথবা টেলিফোন করতেন। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় আমি ফ্লিট স্ট্রিটের এক পানশালায় সংবাদদাতাদের ব্রিফিং দেয়ার জন্য উপস্থিত থাকতাম। বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীও কয়েকবার সেসব ব্রিফিংয়ে হাজির ছিলেন।
তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানি উচ্চশিক্ষার্থীদের অনেকেই বিবিসি বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন কাজ করতেন। প্রায়ই বিবিসির রেস্তোরাঁ কিংবা ক্লাবে বসে আমরা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতাম। পঁচিশ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আগ্রাসনের খবর লন্ডনে এসে পৌঁছানোর সময় থেকেই আমরা স্থির করলাম, বিভিন্ন সময় ইংরেজিতে ‘ফ্যাক্ট শিট’ প্রচার করে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কার্যকারণ ও পটভূমি বিশ্লেষণ করব। লেখার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর এবং অন্যরা বিলি ও প্রচারের ভার নিলেন। শেষের দিকে আমাদের প্রচার সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার। পরিবেশনের দায়িত্ব যারা নিয়েছিলেন তারা পরে মন্ত্রী, অধ্যাপক, ব্যারিস্টার ও হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছেন। তারা আরও একটা দায়িত্ব দিলেন আমাকে। আমাদের আন্দোলনের জন্য এমন একজন ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন, বিশ্ব সমাজ সহজেই যাকে বিশ্বাস করতে পারবে।
সেদিনই রাতের বেলা খবর পেলাম, ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের বৈঠক থেকে লন্ডনে এসেছেন এবং দক্ষিণ লন্ডনের ব্যালহ্যামে তার ছেলে ব্যারিস্টারির ছাত্র আবুল হাসান চৌধুরীর বাসায় থাকছেন। সে রাতে এবং পরের ১০/১১ রাতে আমি টেলিফোন করে তাকে আমাদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অনুরোধ এবং পীড়াপীড়ি করতে থাকি। বিচারপতি চৌধুরী বিভিন্ন আপত্তি জানাচ্ছিলেন, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা ছিল না যে কমনওয়েলথের সদস্য এবং ব্রিটিশের বন্ধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লন্ডনে আন্দোলন করলে ব্রিটিশ সরকার অসন্তুষ্ট হবে কিনা এটাই ছিল তার দুশ্চিন্তা। ১০ এপ্রিল তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউমের সঙ্গে দেখা করেন এবং বেরিয়ে এসেই আমাকে টেলিফোনে বললেন, আমাদের আন্দোলনে যোগ দিতে তিনি রাজি আছেন, তবে এ শর্তে যে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারের দায়িত্ব আমি আগের মতোই পালন করে যাব। (এসব বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ আছে আমার ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘প্রীতি নিন সকলে’, ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘ইতিহাস কথা কয় ও নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ’ এবং ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘এক জীবন এক ইতিহাস’ বইতে।)
স্বাধীনতা অনিবার্য কেন?
বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া কেন অনিবার্য হয়ে উঠেছে, স্বাধীন হলে বাংলাদেশ টেকসই ও স্বনির্ভর হতে পারবে এবং স্বৈরতন্ত্রী নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ হবে—এসব কথা আমি তখন অজস্রবার বুঝিয়ে বলেছি সাংবাদিক ও অন্যদের। সেসব কথা আমি তখনও আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেছি এবং এখনও করি। কিন্তু একটা ব্যাপারে পরবর্তী কালে আমার মনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে এবং সেটা এখনও আমার মনকে খোঁচা দেয়।
পাকিস্তান সরকার তখন প্রায়ই বিশ্বসমাজকে দেখাতে চাইত যে শেখ মুজিবুর রহমান দেশদ্রোহী ছিলেন, তিনি গোপনে আগরতলায় গিয়ে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন। স্বভাবতই সাংবাদিকদের অনেকে আমাকে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন। আমি সমান বিশ্বাস ও আন্তরিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের প্রচারণা খণ্ডন করার চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্বাসের কারণও ছিল। ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে এক সাক্ষাত্কারে আমি মুজিব ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি কি সত্যি সত্যি আগরতলায় গিয়ে ষড়যন্ত্র করেছিলেন? তিনি আমার প্রশ্ন হেসে উড়িয়ে দেন।
সে বছরেরই নভেম্বর মাসে তিনি লন্ডনে এসেছিলেন। বিবিসির জন্য বাংলায় আমাকে এবং ইংরেজিতে এভান চার্লটনকে দীর্ঘ সাক্ষাত্কারেও আমরা তাকে সে প্রশ্ন করেছিলাম। মুজিব ভাই বলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল সাজানো, সে ষড়যন্ত্রের কথা পাকিস্তানিদের অপপ্রচার। তিনি আরও বলেন, আমরা দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি হতে চাই কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের বঞ্চনা আর বৈষম্যের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সে সফরে বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ ও অন্যান্য দেশীয় সাংবাদিকের সঙ্গে আমি মুজিব ভাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম, তারা তার সাক্ষাত্কারও নিয়েছিলেন। তাদের কারও কারও প্রশ্নের উত্তরেও তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্রের কথা অস্বীকার করেছিলেন।
পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে মুজিব ভাই প্রথমে আসেন লন্ডনে। ক্ল্যারিজেস হোটেলে তার সঙ্গে আমার বহু কথা হয়। (আমার লেখা উপরোক্ত বইগুলো দ্রষ্টব্য)। দিল্লি হয়ে রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট বিমানে তিনি ঢাকা পৌঁছান ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। তার পরই খবর বেরুতে থাকে যে বিভিন্ন ভারতীয় সাংবাদিককে তিনি বলেছেন, পাকিস্তান ভাঙতেই তিনি আগরতলা গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, গোড়া থেকেই নাকি তিনি পাকিস্তান ভাঙার পরিকল্পনা করছিলেন।
কয়েকজন সাংবাদিক আবারও আমাকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। আমার বিশেষ কিছু বলার ছিল না। বলেছিলাম যে আবেগ আর ইউফোরিয়ার ঢলে মানুষ অনেক কিছু বলে ফেলে। ১৯৬৯ সালে এভান চার্লটনকে দেয়া ইংরেজি সাক্ষাত্কারের অনুলিপিও আমি তাদের দেখিয়েছিলাম।
আগরতলা ষড়যন্ত্র? দিল্লি ষড়যন্ত্র?
কিন্তু আমার মনের খটকা এখনও দূর হয়নি। সত্যি কি মুজিব আগরতলায় গিয়ে কিছু ষড়যন্ত্র করেছিলেন? সে ষড়যন্ত্রের বিষয়বস্তু কী ছিল এবং কী প্রাপ্তির আশায় তিনি পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছিলেন, আর বিনিময়ে ভারতকেই বা তিনি কী মূল্য দিতে রাজি হয়েছিলেন? আরও বহু প্রশ্নের উদয় হয় এর জের ধরে। ভারত অবশ্যই পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছে। বস্তুত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে তারা অন্তত এক কোটি মুসলমানের প্রাণনাশ করেছে। তাদের পশ্চিম ও পূর্ব, উভয় সীমান্তে বৈরী পাকিস্তান অবস্থিত ছিল বলে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যয় ছিল আকাশচুম্বী। পাকিস্তান ভাঙলে সে ব্যয় রাতারাতি অন্তত অর্ধেক হয়ে যাবে, সেটাই ভারতের জন্য বিরাট লাভ। তার ওপরও মুজিবের কাছ থেকে ভারতীয়রা আরও কিছু দাবি করেছিল কি? সবচেয়ে বড় কথা, সে ষড়যন্ত্রের কথা, সে ষড়যন্ত্রে মুজিবের কাছে ভারতের দাবি-দাওয়ার কথা জানা থাকলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে, প্রাণ দিতে (সে সংখ্যা তিন লাখই হোক অথবা ত্রিশ লাখই হোক) রাজি হতো কি?
আওয়ামী লীগ এখন জোর গলায় প্রচার করে যে, মুজিব সত্যি সত্যি গোপনে আগরতলায় গিয়েছিলেন এবং পাকিস্তান ভাঙার জন্য ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের মনে এ প্রশ্নটা এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, মুজিবের কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের জানুয়ারিতে সরকারিভাবে ভারতে গিয়ে যেসব ষড়যন্ত্র করে এসেছেন তার বিবরণ তারা কবে জানতে পারবে? সেটা অবশ্যই ষড়যন্ত্র ছিল, কেননা ব্যাপক গণদাবি সত্ত্বেও দিল্লিতে তার স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর বিবরণ আজ অবধি প্রকাশ করা হয়নি। সব সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশেই নিয়ম আছে বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিগুলো সংসদের অধিবেশনে অথবা সংসদের লাইব্রেরিতে পেশ করতে হবে। বাংলাদেশে উল্টো সংবিধান সংশোধন করে বিধান করা হয়েছে যাতে ২০১০ সালে দিল্লিতে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর বিবরণ ভবিষ্যতেও সংসদ সদস্যদের জানতে দেয়া না হয়। যা গোপনীয়তার অন্ধকারে ঘটে এবং যা প্রকাশ রোধে একদলীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করা হয়, সেটা যে ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু হতে পারে না, বাংলাদেশের মানুষ ঠিকই বোঝে।
আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি (কোনো কোনো সূত্র অনুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রীও) ঢাকা আসছেন। ভারতীয় মিডিয়ার খবর অনুযায়ী দু’দেশের সম্পর্কে গতিশীলতা বৃদ্ধির চেষ্টাই মি. মুখার্জির সফরের উদ্দেশ্য। সেটা একই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য সুখবর এবং দুঃসংবাদ হতে পারে। আমাদের কবি লিখেছিলেন : ‘কতোরূপ স্নেহ করি দেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’ বাংলাদেশী মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ উল্টো। দেশের মানুষের সমাদর তাদের কাছে কম। অন্যদিকে বিদেশি আসার খবর শুনলেই তারা নাচানাচি শুরু করে দেয়, সে বিদেশি যেই হোন না কেন। অবশ্যি প্রণব মুখার্জি ভারতের শক্তিধর প্রবীণ রাজনীতিক এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাকে খুবই শ্রদ্ধা করেন বলে শুনেছি। তার আসন্ন সফর নিয়ে জল্পনা-কল্পনা স্বাভাবিক।
ট্রানজিটের জন্য ভারত অধীর কেন
বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ট্রানজিট ব্যবস্থা এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে ভারতের বাণিজ্য শুরু ত্বরান্বিত করা প্রণব মুখার্জির সফরের প্রধান লক্ষ্য। সেজন্য নাকি রূপরেখা চুক্তির (ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট) খসড়া প্রস্তুত হয়েই আছে। আগেই বলেছি, ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা ২০১০ সালে যেসব চুক্তি করে এসেছেন তার বিবরণ, এমনকি সংখ্যাও বাংলাদেশের মানুষকে জানতে দেয়া হয়নি। কিন্তু তারপর থেকে আমরা দেখেছি, এশিয়া মহাসড়ককে টেকনাফ আর মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ চীনে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সে মহাসড়ককে দু’শাখায় বিভক্ত করে বুড়িমারী আর বেনাপোল হয়ে আসামে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এর বৈশিষ্ট্য ভেবে দেখা দরকার। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের সঙ্গে ভারতের মূল অংশের সংযোগ নিতান্তই ঠুনকো। সে সাতটি রাজ্যে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীনতার যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযোদ্ধা গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি উড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাতে সৈন্য চলাচল ও অস্ত্র সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। তাছাড়া অরুণাচল অঞ্চলে একটা বিস্তীর্ণ এলাকার মালিকানা নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের পুরনো একটা বিরোধ আছে। ১৯৬২ সালের নভেম্বরে সেখানে দু’দেশের মধ্যে ভারি একটা যুদ্ধ হয়েছিল।
বিগত কয়েক বছরে উভয় পক্ষই হিমালয়ের ওপরে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। ভারতীয় রণকৌশল বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, চলতি বছরে সেখানে অন্তত মাঝারি আকারের একটা যুদ্ধ প্রায় অনিবার্য। সে যুদ্ধ যদি হয়ই তাহলে রণাঙ্গন এলাকায় ভারতের সৈন্য, রসদ ও ভারী অস্ত্র পাঠানোর নির্ভরযোগ্য পথ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। সড়ক পথে কিংবা রেলপথে ট্রানজিটে মাঝে মাঝে ভারতের অস্ত্র সরবরাহ যাবেই—তা সে বিচ্ছিন্নতাবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের কিংবা চীনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যই হোক। এমনকি তিতাস ও তার শাখা নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে আশুগঞ্জ হয়ে আগরতলার সঙ্গে স্থলপথটাও ভারত স্থায়ী করতে চায় জরুরি অবস্থায় অস্ত্র ও সরবরাহ পাঠানোর স্থলপথ হিসেবে। তেমনি চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে ভারত অবস্থান চায় প্রয়োজনবোধে এই দুই বন্দর এলাকায় চীনের বিরুদ্ধে নৌঘাঁটি নির্মাণের লক্ষ্যে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, উত্তর-পূর্ব ভারতের মুক্তিযোদ্ধারা এবং বেইজিং সরকার বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ট্রানজিট গড়ে তোলা নিয়ে ত্রস্ততার দিকে গভীর নজর রাখছে।
যে কোনো কারণেই হোক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ওপর ভারত সরকারের একটা ‘হিপনোটিক’ শক্তি আছে। কোনো ব্যাপারেই ভারতকে তিনি ‘না’ বলতে পারেন না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতের দালাল তার উপদেষ্টারা অবশ্যই ট্রানজিটের ব্যাপারটা ত্বরান্বিত করতে চাইবেন। বিশেষ আরও একটা ত্রস্ততাও ভারতের আছে। প্রয়োজনবোধে দিল্লি শেখ হাসিনার পাশে থাকবে—ভারতের এ ঘোষণা তার কূটনৈতিক প্রজ্ঞার সুনাম বৃদ্ধি করেনি। তাছাড়া দিল্লিও এখন বুঝে গেছে, শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণআন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠেছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনেই হোক অথবা গণবিপ্লবেই হোক, এ সরকারকে গদি ছাড়তেই হবে। তার আগেই ভারত বাংলাদেশের বুক চিরে চিরে ভারতের ট্রানজিটের ব্যবস্থাগুলো পাকা করে নিতে চায়।
নেয়ার আগে কিছু দিতেও শিখুন
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ নিহিত অন্যান্য বিষয়ে। তাদের প্রধান ও প্রথম প্রয়োজন অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য অংশ। ভারত সেচ ও বিদ্যুত্ উত্পাদন ছাড়াও সংযোগ খাল দিয়ে এ অঞ্চলের নদীর পানি মধ্য ভারতে নিয়ে যেতে চায়। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব পরীক্ষামূলকভাবে ১৪ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সে ১৪ দিনকে ভারত অনন্তকালে পরিবর্ধিত করেছে। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ফারাক্কার পানি বণ্টনের চুক্তি করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার সঙ্গে। সে চুক্তিও ভারত মেনে চলেনি, এক বছরও বাংলাদেশ স্বীকৃত পরিমাণ পানি পায়নি। গত বছর ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হয়েছিল যে ঢাকা সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির চুক্তি করবেন। সে চুক্তিও হয়নি, বাহ্যত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে। মমতা শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে পানি দেবেন না, পানি ছাড়বেন বর্ষা মৌসুমে, যাতে বন্যাপীড়িত বাংলাদেশকে একেবারে তলিয়ে দেয়া যায়।
শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালের মে মাসে দিল্লিতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যে চুক্তি করে আসেন তাতে দু’দেশের মধ্যে ছিটমহলগুলো সংক্রান্ত অমীমাংসিত এলাকাগুলো হস্তান্তরের কথা ছিল। সে চুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এখানেও কোনো কোনো রাজ্যের আপত্তির কথা বলা হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি নাকি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের কোনো ভূমি তিনি বাংলাদেশকে ছেড়ে দেবেন না—‘বিনা রণে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদিনী’। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে অঙ্গরাজ্যগুলোর মতামত যাচাই করবে, সেটা খুবই প্রশংসার কথা। কিন্তু কোনো প্রাদেশিক সরকারের আপত্তির অজুহাতে আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকর করতে অস্বীকার করে ভারত প্রমাণ করছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যাপারে সে নির্ভরযোগ্য অংশীদার নয়।
প্রণব মুখার্জি ঢাকা আসছেন, তাকে স্বাগত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণা এলে তাকেও। কিন্তু বাংলাদেশের গলায় পা দিয়ে সবকিছু আদায় করে নেয়ার আগে তারা যদি নদীর পানি, ভূমি বিনিময়, সীমান্তে বাংলাদেশীদের প্রাণ নিয়ে বিএসএফের চড়ুই পাখি শিকার বন্ধ এবং দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যে ভারসাম্য স্থাপনের বিষয়গুলো মীমাংসার উদ্যোগ নেন—তবেই দু’দেশের সম্পর্কের উন্নতি হতে পারে। এ যাবত সম্পর্ক হচ্ছে শোষক আর শোষিতের মতো। এ অবস্থা দূর মেয়াদে ভারতের জন্য মোটেই ভালো হবে না।
লন্ডন, ০৫.০২.১২
ত্রুটি স্বীকার : গত সপ্তাহের কলামে টাইপ করার সময় অসতর্কতাবশত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার তারিখ ১৯৮১ সালের ৩০ মে’র পরিবর্তে ১৯৮০ সালের ৩০ মে হয়ে গেছে। কানাডা থেকে একজন সহৃদয় পাঠক এদিকে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
serajurrahman@btinternet.com


__._,_.___


[* Moderator's Note - CHOTTALA is a non-profit, non-religious, non-political and non-discriminatory organization.

* Disclaimer: Any posting to the CHOTTALA are the opinion of the author. Authors of the messages to the CHOTTALA are responsible for the accuracy of their information and the conformance of their material with applicable copyright and other laws. Many people will read your post, and it will be archived for a very long time. The act of posting to the CHOTTALA indicates the subscriber's agreement to accept the adjudications of the moderator]




Your email settings: Individual Email|Traditional
Change settings via the Web (Yahoo! ID required)
Change settings via email: Switch delivery to Daily Digest | Switch to Fully Featured
Visit Your Group | Yahoo! Groups Terms of Use | Unsubscribe

__,_._,___