সাপ ও লাঠি
মাহবুব তালুকদার
চাচা প্রশ্ন করলেন, রাজনীতিতে এই সেনা সমর্থিত সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান কি জানো?
সে তো অনেক অবদানই আছে। আপনি কোনটা মিন করছেন? আমি জানতে চাইলাম।
চাচা সহাস্যে বললেন, রাজনীতিতে এরা এমন একটা ঝাঁকানি দিয়েছেন, যাতে ভেতর থেকে রাজনীতির নীতিহীন ব্যক্তিরা ওপরে ভেসে উঠেছে।
এ কি কথা বলছেন আপনি! আমি বিস্ময় প্রকাশ করলাম।
ঠিক বলছি। চাচা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি অনানুগত্য প্রকারান্তরে বেইমানি করার যে চিত্রটি ওয়ান ইলেভেনের পর প্রকাশ পেয়েছে, তাতে দেশের মানুষ রীতিমত থ' বনে গেছে।
আপনি কাদের কথা বলছেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি বললাম।
এতে না বোঝার কিছু নেই। শেখ হাসিনা যাদের 'র্যাটস' (আরএটিএস) বলতেন, সেই রাজ্জাক আমু, তোফায়েল ও সুরঞ্জিতের মুখোশহীন চেহারাটা ধরা পড়তো না ওয়ান ইলেভেন না হলে। অন্যদিকে সাইফুর রহমান, মান্নান ভূঁইয়া ও মেজর হাফিজ গংদের খালেদা জিয়ার প্রতি বেইমানির ব্যাপারে কোন রাখঢাক ছিল না। চাচা থামলেন।
চাচার কথা মিথ্যা নয়। দুর্নীতির দায়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেত্রীকে গ্রেপ্তার করে জেলে নেয়ার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওই প্রবীণ নেতারা যে রকম চেহারা পাল্টে ফেললেন, তা পার্টির সাধারণ কর্মীদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত ও বেদনাদায়ক। পরিবারতন্ত্রের ধুয়া তুলে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে কৌশল তারা অবলম্বন করেছিলেন, তা অবশ্য ধোপে টেকেনি। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে জিল্লুর রহমানের নিয়োগে উষ্মা প্রকাশ করে ঐ সময়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, কারো সঙ্গে আলাপ না করে হাসিনার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্বৈরাচারী মনোভাবের পরিচায়ক। অন্যদিকে খোন্দকার দেলোয়ারকে প্রথম থেকেই মেনে নিতে চাননি বিএনপি'র সংস্কারপন্থিরা। এছাড়া খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে মাইনাস করার ব্যাপারে মান্নান ভূঁইয়ার ষড়যন্ত্রের কথা তৎকালে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন আকারে ইঙ্গিতে বলেই দিয়েছেন। সত্যি বলতে কি, সেই সংকট মুহূর্তে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ। জিল্লুর রহমানের বদলে আমীর হোসেন আমুকে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ করলে কিংবা খোন্দকার দেলোয়ারের বদলে সাইফুর রহমানকে বিএনপির দায়িত্ব দিলে দেশের সবচেয়ে বড় এই দুটি রাজনৈতিক দল এতদিনে সরকার পকেটস্থ করে ফেলতে পারত। তবে ওই পকেটে তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের ঢোকানো সম্ভব হতো না।
আমি যখন চুপচাপ বসে এসব কথা ভাবছি, তখন চাচা চায়ের কাপ সরিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ভাবছো?
রাজনৈতিক নেতাদের কথা ভাবছি।
তাদের আবার কি কথা?
কত দ্রুত এরা চেহারা পাল্টে ফেলতে পারেন। আমি বললাম, আমীর হোসেন আমু পর্যন্ত এখন বলছেন, আগে শেখ হাসিনার মুক্তি, তারপর সংস্কার। আবার অন্যদিকে মেজর হাফিজ বারবার 'খালেদা জিয়া আমাদের নেত্রী' বলতে বলতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে ফেলেছেন। অথচ খালেদা জিয়ার নির্দেশ তিনি মানছেন না। আমি ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললাম।
চাচা বললেন, রাজনীতিতে আমরা যা কিছু দেখছি, তার অনেকটাই রয়ে গেছে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে। তাই আমরা রাজনীতির হিসাব মেলাতে পারি না। সাইফুর রহমান সেদিন আধখোলা লুঙ্গি পরে চরম অসুস্থ অবস্থায় সংস্কারপন্থিদের শো-ডাউনে কেন গিয়েছিলেন, তা কি আমরা জানি?
কিছুটা জানি। পত্রিকায় সে কথা ছাপা হয়েছে। আজকাল মিডিয়ার কল্যাণে কোন কিছুই আর গোপন রাখা যাচ্ছে না। ষড়যন্ত্রকারীদের সব ষড়যন্ত্রই এক সময়ে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। আমি আরও বললাম, চাচা! এসব কথা থাক। নির্বাচন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করুন। নির্বাচন হবে কি হবে না?
তোমার প্রশ্নটা অসম্পূর্ণ। তোমার প্রশ্ন করা উচিত ছিল, ২০০৮ সালের মধ্যে নির্বাচন হবে কিনা।
তা ঠিক। আমি এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করলাম। বললাম, আসলে জানতে চাই নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা আছে কিনা।
অবশ্যই আছে। চাচা হাসি হাসি মুখ করে বললেন, নির্বাচন করার সদিচ্ছা না থাকলে দেশব্যাপী সৎ ও যোগ্য প্রার্থী খোঁজা হচ্ছে কেন? ইতোমধ্যে ৬০০ প্রার্থীর তালিকা হয়েছে বলে পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে। তাছাড়া নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা আছে বলেই জরুরি অবস্থার মধ্যেও ফেরদৌস কোরেশীকে দিয়ে কিংস পার্টি তৈরি করা হয়েছে।
কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড কি নির্বাচনের প্রস্তুতি?
অবশ্যই। চাচা বললেন, আমি যদ্দুর বুঝি, এ সরকারের একটি নির্বাচনী এজেন্ডা রয়েছে। তা হচ্ছে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের জাতীয় সংসদে বসানো।
সেটা কিভাবে সম্ভব? আমি জানতে চাইলাম, দেশের মানুষ সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের চিনবে কি করে?
এটা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। চাচা সারামুখে হাসির ঢেউ তুলে বললেন, সরকার এতগুলো কমিশন করছে, দেশের স্বার্থে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য কি একটি জাতীয় কমিশন গঠন করতে পারে না? ওই কমিশনের ছাড়পত্র না পেলে কেউ সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে নাÑ প্রেসিডেন্টকে দিয়ে এমন একটা অধ্যাদেশ জারি করালেই তো হয়।
চাচা! এতেও কিন্তু একটা রিস্ক থেকে যায়। ওইসব সৎ ও যোগ্য সংসদ সদস্যরা যদি সরকারের সব কর্মকাণ্ডকে বৈধতা না দেয়?
কি সব অলক্ষুণে কথা বলছো তুমি! চাচার হাসিমুখ কিছুটা মলিন হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সহসা তিনি উজ্জীবিত হয়ে বললেন, এরও উপায় আছে। মূল সংলাপের পূর্বে প্রাক সংলাপের মতো নির্বাচনেরও একটা ড্রেস-রিহার্সেল হতে পারে।
সেটা কি রকম?
ব্যাপারটা একই রকম। চাচা বললেন, মূল নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের মধ্যে একটা প্রাক-নির্বাচন করে নেয়া যেতে পারে। তাতে যারা নির্বাচিত হবেন, তারা সরকারের সব কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিলেই কেবল মূল নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া যেতে পারে। এতে সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
তত্ববধায়কদের তাবেদারদের জুতা দিয়ে পিটাও, জেলে যাও, তিনবেলা নিশ্চিন্তে খাও
Be a better friend, newshound, and know-it-all with Yahoo! Mobile.
Try it now.