Banner Advertise

Thursday, April 16, 2015

[chottala.com] ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন



১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন

ফন্ট সাইজ:

         ১৯৪৫ সালেই ৯ই মে জার্মানী ও ইটালীর আত্মসমর্পণের পর আফ্রো-ইউরোপীয় রণভূমিতে যুদ্ধ বন্ধ হয়। ইহার অব্যবহিত পরই গণতান্ত্রিক দেশ যক্তরাজ্যে (United Kingdom) ১৯৪৫ সালের ২৬শে জুলাই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিজয়ী শ্রমিক দল মিঃ ক্লিমেন্ট এটলীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। অক্ষশক্তির অন্যতম অংশীদার জাপান ২রা সেপ্টেম্বর (১৯৪৫) আত্মসমর্পণ করিলে এশীয় রণভূমিতে যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। মহাযুদ্ধোত্তরকালে পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন অনুধাবন করিয়া ভারতীয় জনমত যাচাই করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেন এবং ভারতে নিযুক্ত তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল কর্তৃক ২৫শে জুন (১৯৪৫) আহূত সিমলা কনফারেন্স ব্যর্থ হইলে ২৯শে আগস্ট (১৯৪৫) তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

         নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতীয় উপমহাদেশে স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম আবাসভূমি 'পাকিস্তানের' দাবীতে দশ কোটি ভারতীয় মুসলিম অধিবাসীর নিকট শান্তিপূর্ণ রায়দানের সুযোগ গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানান।
         বঙ্গদেশে নির্বাচন পরিচালনার উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টারী বোর্ড গঠন করার জন্য ৩০শে সেপ্টেম্বর (১৯৪৫) কলিকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জনাব আবুল হাশিমের যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত প্রগতিশীল অংশ খাজা নাজিমুদ্দিন ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ পরিচালিত রক্ষণশীল অংশকে পরাজিত করে। নির্বাচিতব্য পাঁচটি আসনেই জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জনাব আবুল হাশিম, জনাব আহমদ হোসেন, মাওলানা রাগিব আহসান ও জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী (লাল মিঞা) নির্বাচিত হন। নয় সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টারী বোর্ডের অপর চারজন সদস্য প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (বঙ্গীয় মুসলিম লীগ সভাপতি হিসাবে পদাধিকার বলে), বঙ্গীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যবৃন্দ কর্তৃক নির্বাচিত জনাব নূরুল আমিন ও বঙ্গীয় লেজিসলেটিভ এসেম্বলীর মুসলিম লীগ সদস্যবৃন্দ কর্তৃক নির্বাচিত জনাব ফজলুর রহমান পূর্বাহ্নেই স্থিরীকৃত ছিলেন। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৩টিতে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে। ২রা এপ্রিল (১৯৪৬) জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী দলের সর্বসম্মতনেতা নির্বাচিত হন এবং ২২শে এপ্রিল (১৯৪৬) বঙ্গীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
         জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে পার্লামেন্টারী বোর্ড জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে সর্বক্ষণ কর্মী পরিচালিত নির্বাচনী বোর্ড স্থাপন করে। ছাত্রলীগের কার্যব্যাপদেশে কলিকাতা অবস্থানকালে তদানীন্তন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা জনাব নূরুদ্দিন আহমদ ভারতীয় দশ কোটি মুসলমানের আবাসভূমি পাকিস্তান দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে মুসলিম ছাত্রদের অংশগ্রহণের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করিয়া চার সদস্যবিশিষ্ট ত্রিপুরা জেলা নির্বাচনী বোর্ডের অন্যতম সর্বক্ষন কর্মী হওয়ার আহ্বান জানাইলে আমি তাহাতে সানন্দচিত্তে সম্মত হই এবং ১৯৪৬ সালে আই.এস.সি পরীক্ষাদানে বিরত থাকি।
         কলিকাতা হইতে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া আমার শ্রদ্ধেয় অগ্রজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এস.সি শেষবর্ষের ছাত্র জনাব আবদুল করিম (পরবর্তীকালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও ডীন) সাহেবকে আমার রাজনৈতিক অভিমত জ্ঞাপন করিয়া তাঁহার অনুমতি প্রার্থনা করি। আমার কাকুতি-মিনতি উপেক্ষা করিতে না পারিয়া স্নেহান্ধ ভাই অগত্যা আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন এবং আব্বাজান ও বড় ভাইকে বুঝাইয়া বলিবার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের অনুষ্ঠিতব্য আই.এ.সি পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফলাফলের আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁহাদের সমর্থন লাভে সক্ষম হই। আমি মধ্যবিত্ত সরকারী চাকুরে পরিবারের সন্তান। হাজারো সমস্যাসঙ্কুল পরিবার আমাকে কেন্দ্র করিয়া ভবিষ্যত স্বচ্ছলতার স্বপ্ন রচনা করিয়াছিল। আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও কার্যাবলীর ফলস্বরূপ আমাদের গরীব পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের নিকট হইতে অন্যায় এবং অবিচার সহ্য করিতে হইয়াছে। 
         ত্রিপুরা জেলা নির্বাচনী বোর্ডে আমি ব্যতীত বাকী অপর তিনজন সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহম্মদ, জনাব এ,কে,এম, রফিকুল হোসেন ও জনাব সিরাজুল ইসলাম। খন্দাকার মোশতাক আহম্মদ জেলা নির্বাচনী বোর্ডের কর্মাধ্যক্ষ (Workers-in-Charge) ছিলেন। 
         ১৯৪৬ সালের ২০শে মার্চ নির্বাচনী প্রচারণা চালাইতে বরুড়া উপস্থিত হইলে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট ও কৃষক প্রজা দলীয় কর্মীদের অতর্কিত হামলায় সর্ব জনাব নূর মিঞা, আবদুর রব, শাহ আলম, আবদুল হামিদ, রেয়াজত আলী ও আমি গুরুতরভাবে আহত হই। 
         সর্বভারতীয় নির্বাচনী ফলাফল ছিল নিঃসন্দেহে পাকিস্তান দাবীর পক্ষে ভারতীয় দশ কোটি মুসলমানের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের সাক্ষ্য। এই ফলাফল ছিল নিম্নরূপঃ কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের ৩০টি মুসলিম আসনের ৩০টি আসন ও প্রাদেশিক আইন পরিষদ নির্বাচনে আসামে ৩৪টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৩১ টি, বঙ্গদেশে ১১৯টির মধ্যে ১১৩টি, বিহারের ৪০টির মধ্যে ৩৪টি, উড়িষ্যার ৪টির মধ্যে ৪টি, যুক্তপ্রদেশে ৬৬টির মধ্যে ৫৫টি, পাঞ্জাবে ৮৬টির মধ্যে ৭৯টি, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ৩৮টির মধ্যে ১৭টি, সিন্ধুতে ৩৫ টির মধ্যে ২৮টি, বোম্বেতে ৩০টির মধ্যে ৩০টি, মধ্য প্রদেশে ১৪টর মধ্যে ১৪টি, মাদ্রাজে ২৯টির মধ্যে ২৯টি অর্থাৎ সর্বমোট ৫২৫টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪৬৪ টি আসন লাভ। 
 
দিল্লী কনভেনশন
      সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর মুসলিম লীগের একচ্ছত্র নেতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ৭, ৮ ও ৯ এপ্রিল (১৯৪৬) দিল্লীতে এ্যাংলো এরাবিক কলেজে মুসলিম লীগ লেজিসলেটারস্ কনভেনশন আহ্বান করেন। উক্ত কনভেনশনে দর্শক হিসাবে আমার যোগ দিবার ঐকান্তিক ইচ্ছা সত্ত্বেও নানা কারণে আমি দিল্লী যাইতে পারি নাই।
      দিল্লী এ্যাংলো এরাবিক কলেজে অনুষ্ঠিত লেজিসলেটারস কনভেনশনের ৯ই এপ্রিল অধিবেশনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পেশকৃত নিম্নোক্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়ঃ 
 
অর্থাৎ প্রস্তাব গ্রহণ করা হইল যে,
(১) ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বে বঙ্গদেশ ও আসাম এবং উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান অঞ্চলগুলি যাহা 'পাকিস্তান অঞ্চল' নামে অভিহিত এবং যেখানে মুসলমানরা প্রধান সংখ্যাগুরু তাহাদের সমবায়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা হউক এবং অবিলম্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কার্যকর করার নিমিত্ত দ্ব্যর্থহীন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হউক। 
(২) স্ব স্ব সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের জনগণ কর্তৃক দুইটি পৃথক সংবিধান রচনাকারী সংস্থা গঠন করা হউক।
(৩) ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কর্তৃক লাহোরে গৃহীত প্রস্তাবানুসারে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হউক।
(৪) মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবীর স্বীকৃতি ও অবিলম্বে ইহার বাস্তবায়ন্ কেন্দ্রে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনে মুসলিম লীগের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে অপরিহার্য শর্ত। 
       জনাব আবুল হাশিম উপরোক্ত দিল্লী প্রস্তাবকে লাহোর প্রস্তাবের সরাসরি বরখেলাপ বলিয়া তীব্র ভাষায় বিরোধিতা করেন এবং তিনি সঠিকভাবে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সম্মেলন যে প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে এবং ১৯৪১ সালের মাদ্রাজ অধিবেশনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ যাহাকে মূলনীতি (Creed) হিসাবে গ্রহণ করিয়াছে ঐ প্রস্তাবকে বাতিল বা ইহার সংশোধনকরণ লেজিসলেটারস কনভেনশনের এক্তিয়ার বহির্ভূত। লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে দুইটি সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টির দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার ছিল। গভীর পরিতাপের বিষয়, ১৯৪৬ সালের ৯ই এপ্রিল দিল্লী মহানগরীস্থ এ্যাংলো এরাবিক কলেজে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ লেজিসলেটারস কনভেনশনে বঙ্গদেশেরই ভাবী প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবক্রমে লাহোর প্রস্তাবানুযায়ী একাধিক রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে একটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নেতা সোহরাওয়ার্দীর জাতীয় রায়কে বাতিল করার প্রয়াস আমাদের তরুণ মনকে অত্যন্ত আহত করে। যে কায়েদে আজমের সভাপতিত্বে ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল, সেই কায়েদে আজমেরই সভাপতিত্বে ১৯৪৬ সালে দিল্লী প্রস্তাব গৃহীত হয়। নেতৃবৃন্দ বেমালম হজম করিয়া ফেলিয়াছিলেন যে, সর্বভারতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনে মুসলমানগণ লাহোর প্রস্তাবের পক্ষেই দ্ব্যর্থহীন রায় দিয়াছিল। কি প্রখর নীতিজ্ঞান নেতৃকূলের!
 
ক্যাবিনেট মিশন
      ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অব্যবহিত পরই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ ক্লিমেন্ট এটলী ১৫ই মার্চ (১৯৪৬) বৃটিশ হাউস অব কমন্স-এ ঘোষনা করিলেন যে, বৃটিশ সরকার ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দানে সহায়তা করার মানসে ভারত সচিব লর্ড প্যাথিক লরেন্স, বাণিজ্য বোর্ড সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, নৌ-বিভাগের প্রথম লর্ড  (First Lord of admiralty) এ, ভি, অ্যালেকজান্ডার সমবায়ে গঠিত ক্যাবিনেট মিশন ভারতে পাঠাইবার সিদ্ধান্ত নিয়াছে। তদানুযায়ী 'ক্যাবিনেট মিশন' ২০শে মার্চ, (১৯৪৬) করাচী অবতরণ করে। নিম্নোক্ত কারণগুলি বোধ হয় ইংরেজ সরকারকে উপরে বর্ণিত সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেঃ 
      প্রথমতঃ ভারতব্যাপী সদ্য অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে হিন্দ মুসলিম নির্বিশেষে ভারতবাসী স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন (Govt. of India Act, 1935) মোতাবেক ভারতবর্ষের এগারটি প্রদেশে ভারতীয় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক সরকার পরিচালনার সুযোগ ভারতবাসীকে আত্মসচেতন ও স্বাধিকার সচেতন করিয়া তুলিয়াছে। তৃতীয়তঃ প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্বশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মহাচীন, সোভিয়েট রাশিয়া ভারতবাসীর হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আন্তজার্তিক চাপ সৃষ্টি করিতেছিল। চতুর্থতঃ (ক) দীর্ঘকাল যাবৎ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে দীক্ষিত সর্বভারতীয় বিপ্লবী সংগঠনগুলির প্রচেষ্টা, (খ) দ্বিতীয় বিশ্বযুুদ্ধকালে সর্বভারতীয় বিপ্লবী অগ্নিপুরুষ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সর্বাধিনায়কত্বে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশ কর্তৃক জাপান ও  জার্মানীর সহায়তায় আই, এন, এ (Indian National Army) গঠন ও স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা, (গ) মহাযুদ্ধোত্তর ভারতের বোম্বাই বন্দরে ভারতীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ ইত্যাদির মধ্যে দূরদৃষ্টি ও অন্তদৃষ্টি সম্পন্ন ইংরেজী রাজশক্তির একটি অংশ ভারতবাসীর মধ্যে সশস্ত্র পথে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার অদম্য ও দুর্দমনীয় স্পৃহা লক্ষ্য করে। স্মর্তব্য, ভারতকে আজাদী দান প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে ১৯৪২ সালের ১১ই মার্চ বৃটিশ সরকারের অন্যতম মন্ত্রী কূটনীতিক স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, ১৯৪৫ সালের জুন মাসে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল আহূত সিমলা কনফারেন্স ও বৃটিশ পার্লামেন্টারী মিশন ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিরাজমান মতভেদ নিরসনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেন। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মতভেদ ও মতামত যাচাই করিয়া ভারতকে স্বাধীনতা দান কল্পেই ক্যাবনেট মিশনের ভারতে আগমন ঘটে।
      বৃটিশ ক্যাবিনেট মিশন প্রায় দুই মাস ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সহিত আলাপ-আলোচনা এবং দেন-দরবারের পর ১৯৪৬ সালের ১৬ই মে ভারতীয় শাসনতান্ত্রিক জটিলতা অপনোদন মানসে নিম্নোক্ত সুপারিশগুলি সাধারণ্যে প্রকাশ করেঃ 
 
অর্থাৎ
(১) বৃটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যসমূহ সমবায়ে ভারতীয় ইউনিয়ন সংগঠিত হওয়া উচিত, যাহার বিষয়াবলী থাকিবে পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যোগাযোগ। উপরোক্ত বিষয়াবলীর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের আবশ্যকীয় ক্ষমতা থাকা উচিত।
(২) ইউনিয়ন অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি ব্যতীয় সকল বিষয় এবং বাদ বাকী সর্বক্ষমতা প্রদেশগুলির উপর ন্যস্ত হওয়া উচিত। 
(৩) কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি ব্যতীত সকল বিষয় ও ক্ষমতা দেশীয় রাজ্য সমূহের আয়ত্তাধীন থাকিবে। 
(৪) প্রশাসন ও আইন পরিষদসহ গ্র"প গঠন প্রদেশগুলির এক্তিয়ারাধীন। কোন কোন প্রাদেশিক বিষয় সাধারণভাবে গ্রহণ করা হইবে তাহা প্রত্যেক গ্র"পই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে।
(৫) কেন্দ্রী ও গ্র"পগুলির সংবিধানে বিধান থাকা উচিত যে, প্রারম্ভিক দশ বৎসর এবং তৎপরবর্তী প্রত্যেক দশ বৎসর অন্তর অন্তর যে কোন প্রদেশ স্বীয় আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সংবিধানের ধারাগুলি পুনঃ বিবেচনার দাবী করিতে পারিবে। 
ভারতবর্ষকে তিনভাগে বিভক্ত করা হউক।
সেকশন-এঃ মাদ্রাজ, বোম্বে, সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও উড়িষ্যা- ১৬৭টি সাধারণ আসন ও ২০টি মুসলিম আসন।
সেকশন-বিঃ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুপ্রদেশ ৯ট সাধারণ আসন ও ২২টি মুসলিম আসন ও ৪টি শিখ আসন।
সেকশন-সিঃ বঙ্গদেশ ও আসাম-৩৪টি সাধারণ আসন ও ৩৬টি মুুুসলিম আসন। 
 
নেহরুর ভুলঃ হিন্দু মুসলিম ঐক্য প্রচেষ্টা বানচাল
      ২৪শে মে (১৯৪৬) নিখিল ভারত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি "স্বাধীন, অখণ্ড ও গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের" সংবিধান প্রণয়নকল্পে প্রস্তাবিত গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। 
      ৬ই জন (১৯৪৬) নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের গোপন বৈঠক ও ২৫শে জুন (১৯৪৬) নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ছয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশাবলী যথা বঙ্গদেশ, আসাম, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান সমবায়ে একটি গ্রুপ গঠনের দাবী তুলিয়া ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ করিয়া গণপরিষদে যোগ দিতে সম্মত হয়। কিন্তু ১০ই জুলাই (১৯৪৬) বোম্বে শহরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে নিখিল ভরত কংগ্রেসের সদ্য নির্বাচিত সভাপতি পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরুর অবিবেচনা প্রসূত ঘোষণা- "কংগ্রেস গণপরিষদ কেবলমাত্র অংশগ্রহণ করিতে সম্মত হইয়াছে এবং যাহা সর্বোৎকৃষ্ট মনে করে সেই মোতাবেক ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানকে পরিবর্তন বা সংশোধন করার ব্যাপারে নিজেকে স্বাধীন মনে করে- We are entirely and absolutely free to determine অর্থাৎ আমরা নির্ধারণ করার বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে ও নিঃশর্তভাবে স্বাধীন মুসলিম লীগ মহলকে শঙ্কিত করে এবং অখণ্ড সর্বভারতীয় কাঠামো বজায় রাখার অধিকাংশ মহলের সর্বপ্রকার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে বানচাল করে। অবশ্য নেহরুর মন্তব্যের প্রতিধ্বনি ১৯৪৭ সালের ২৫শে এপ্রিল ভারতীয় গণপরিষদের অধিবেশনে শোনা যায়। অতঃপর অখণ্ড ভারতের সংবিধান রচনার মানসে ভারতীয় গণপরিষদে যোগদান মর্মে কংগ্রেস-লীগ ঐক্যমত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়া গেল। বিদেশী ইংরেজী শাসকচক্র অবিভাজ্য ও অখন্ড স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র কায়েমের প্রচেষ্টায় যখন আপ্রাণ চেষ্টায় নিয়োজিত, নিখিল ভারত কংগ্রেসের অখণ্ড ভারত দাবীদার অপরিপক্ক নেতৃবৃন্দ স্বীয় কার্যক্রম দ্বারা ভারতকে দ্বি-খণ্ডিত করার হুতাসন যজ্ঞের সর্বপ্রকার আয়োজন করিয়া ফেলিলেন। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে তখনকার দিনে ভারতবাসীর মনে যে উচ্চাশা ও প্রত্যয় জন্মিয়াছিল, তাহা অচিরেই ধুলিসাৎ হইয়া গেল। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া এক অশুভ ও অভিশপ্ত খাতে প্রবাহিত হইতে লাগিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিষবাষ্পে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এত বিষাক্ত হইল যে, হিন্দু মুসলমানে র পাশাপাশি বাড়িতে সহঅবস্থান চিন্তার অতীত হইয়া পড়িল। পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশে স্বীয় বাস্তুভিটা ত্যাগ করিয়া রিক্ত, পর্যদুস্ত ও সহায়সম্বলহীন হতভাগ্য লক্ষ লক্ষ লোক ভিনদেশযাত্রী হইল ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শিকারে পরিণত হইল। স্বার্থপর ক্ষমতালোভী ভারতীয় নেতৃত্ব ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ঘৃণিত গোষ্ঠী হিসাবেই চিহ্নিত হইবে-ইহাই আমার তখনকার তরুণ বয়সের প্রতিক্রিয়া। 
 
মুসলিম লীগের সীদ্ধান্ত
      সাংবাদিক সম্মেলনে পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরুর মন্তব্যের পটভুমিকায় উদ্ভুত সমগ্র রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার নিমিত্ত কায়েদে আজম কর্তৃক আহূত ২৭, ২৮ ও ২৯শে জুুলাই (১৯৪৬) বোম্বে শহরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের তিনদিন স্থায়ী বিশেষ অধিবেশন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ সম্পর্কিত পূর্ব সিদ্ধান্ত বাতিল করিয়া নিম্নোক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করেঃ
অর্থাৎ "যেহেতু কংগ্রেসের অনমনীয়তা ও বৃটিশ সরকারের বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিল কেবিনেট ডেলিগেশন ও ভাইসরয় কর্তৃক ১৬ই মে (১৯৪৬) প্রদত্ত বিবৃতিতে সন্নিবেশিত প্রস্তাবাবলী প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নিয়াছ, যেহেতু সমঝোতা ও নিয়মতান্ত্রিক পথে ভারতীয় সমস্যার শান্তপূর্ণ সমাধানে মুসলিম ভারত সর্বপ্রচেষ্টা নিঃশেষ করিয়াছে; যেহেতু বৃটিশের পরোক্ষ সমর্থনে বলীয়ান হইয়া কংগ্রেস বর্ণ-হিন্দু রাজ প্রতিষ্ঠা করিতে বদ্ধ পরিকর; যেহেতু সাম্পতিক ঘটনাপঞ্জী প্রমাণ করিয়াছে যে, ভারতীয় ব্যাপারে ন্যায় বিচার ও নিরপেক্ষতা নয় বরং ক্ষমতার রাজনীতিই নির্ধারণী বিষয়বস্তু; যেহেতু ইহা সবিশেষ স্পষ্ট হইয়াছে যে, স্বাধীন ও পূর্ণ সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক প্রতিষ্ঠা ব্যতীত ভারতীয় মুসলমান শান্ত থাকিবে না এবং মুসলিম লীগের অনুমোদন ও সম্মতি ব্যতীত কোন সংবিধান রচনাকারী সংস্থা অথবা দীর্ঘ মেয়াদী কিংবা স্বল্প মেয়াদী সংবিধান অথবা কেন্দ্রে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের যে কোন প্রচেষ্টাকে বাধা দেবে; নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়েছে যে, পাকিস্তান অর্জনের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আশ্রয় গ্রহণ করার, তাহাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করার, তাহাদের সম্মান রক্ষা করার এবং বর্তমান বৃটিশ দাসত্ব ও ভবিষ্যৎ হিন্দু আধিপত্য ঝাড়িয়া ফেলিবার সময় মুসলিম জাতির জন্য আসিয়াছে। 
      "এই কাউন্সিল জাতিকে তাহাদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পিছনে দাঁড়াইবার ও যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুতি নিবার আহ্বান জানাইতেছে।"
      "উপরে ঘোষিত নীতিকে কার্যকর করিতে ও প্রয়োজনবোধে আশু সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য মুসলমানদিগকে সংগঠিত করিতে অবিলম্বে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচী প্রণয়নের জন্য ওয়াকির্ং কমিটিতে কাউন্সিল নির্দেশ দিতেছে।"
      "ইংরেজের মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও তাহাদের গভীর ক্ষোভের প্রতীক হিসাবে সরকার প্রদত্ত সর্বপ্রকার খেতাব বর্জনের জন্য মুসলমানদের প্রতি এই কাউন্সল আহ্বান জানাইতেছে"।
 
১৬ই আগস্ট, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস, সাম্পদায়িক দাঙ্গার তাণ্ডবলীলা
      উপরোক্ত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ১৬ই আগস্টকে "প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস" ঘোষণা করা হয় এবং খাজা নাজিমুদ্দিন, নওয়াব ইসমাইল ও চৌধুরী খালেকুজ্জামান সমবায়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি অব এ্যাকশন বা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। একদিকে ইংরেজী সরকার বিরোধী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাকে ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত, অন্যদিকে খেতাব বর্জনের নির্দেশে বিচলিত খেতাবধারী স্যার খাজা নাজিমুুদ্দিন কলিকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এক সভায় প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া মন্তব্য করেন যে, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ইংরেজের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুন্দের বিরুদ্ধে। মুসলিম লীগের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা খাজা নাজিমুদ্দিনের অপব্যাখ্যা সাম্প্রদায়ক হিন্দুদিগকে কলিকাতার বিভিন্ন এলাকার সংগোপনে দাঙ্গা প্রস্তুতি নিতে ইন্ধন যোগাইয়া ছিল, সাধারণ শান্তিপ্রিয় হিন্দুকে বিভ্রান্ত করিয়াছিল। অথচ ২রা আগস্ট (১৯৪৬) মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বোম্বে নগরীতে অনুষ্ঠিত সভা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস কর্মসূচী নিম্ন প্রস্তাবাকারে ঘোষণা করেঃ 
      অর্থাৎ "ভারতীয় মুসলমানদিগকে ১৬ই আগস্ট (১৯৪৬) সকল কাজ-কর্ম বন্ধ রাখিতে ও পূর্ণ হরতাল পালন করিতে আহ্বান জানাইতেছে।"
      ২২শে জুলাই  (১৯৪৬) কেন্দ্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব জানাইয়া ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস সভাপতি যথাক্রমে কায়েদে আজম ও পণ্ডিত নেহরুকে পত্রে সহযোগিতার আহ্বান জানান। কায়েদে আজমের পত্রে লর্ড ওয়াভেলকে ১৬ই জুন (১৯৪৬) ক্যাবিনেট মিশন ও ভাইসরয় প্রদত্ত যুক্ত ঘোষণা স্মরণ করাইয়া দেওয়া সত্ত্বেও লর্ড ওয়াভেল ১২ই আগস্ট (১৯৪৬) পণ্ডিত নেহরুকে অন্তবর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেন। কেন্দ্রে একদলীয় কংগ্রেস সরকার গঠনের প্রস্তুতি দাঙ্গাবাজ সাম্প্রদায়িক হিন্দুদিগকে অত্যন্ত উৎসাহিত করিল।
      তদানিন্তন বঙ্গীয় প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কায়েজে আজম যদি সেদিন "প্রত্যক্ষ সংগ্রাম" সম্বন্ধে অপব্যাখ্যার অপরাধে স্যার নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতেন তাহা হইলে ১৬ই আগস্ট কলিকাতার রক্ষক্ষয়ী দাঙ্গায় অনাহূত নিরীহ কলিকাতাবাসীকে প্রাণ দতে হইত না। ধনে-জনে-মানে মুসলিম সম্প্রদায়ই সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র ভারব্যাপী এমনকি বিদেশেও মুসলিম ও মুসলিম লীগ সরকার অর্থাৎ সোহওাওয়ার্দ সরকারকেও এই কলঙ্কময় অধ্যায়ের জন্য দায়ী হইতে হইয়াছে। ইহার প্রতিক্রিয়ায় বিহারে নির্দোষ নিরীহ মুসলমানদিগকে উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের হাতে কচুকাটা হইতে হইয়াছে, অবলা নারীকে সতীত্ব হারাইতে হইয়াছে, ধন-সম্পদ লুন্ঠিত ও অগ্নিদাহ হইয়াছে। ইতিপূর্বে কলিকাতার সংগঠিত নারকীয় দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালী জেলার কতিপয় এলাকার উগ্র সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের হাতে নিরপরাধ শান্তপ্রিয় সাধারণ হিন্দুকে ধনে-জনে-মানে মাশুল দিতে হইয়াছে।
      অথচ পাশাপাশি দৃষ্টান্ত ঢাকা শহরে ১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালনকালে কোন প্রকার সাম্প্রদায়ক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নাই, যদিও ঢাকাই ছিল হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আখড়া। ইহাই হইল ঢাকার অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা শামসুল হক ও শামসুদ্দিন আহমেদের স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন নেতৃত্বের কৃতিত্ব। জনাব হক ও জনাব আহমদ যথাক্রমে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবিরের কর্মাধ্যক্ষ ও ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিলেন।
      নোয়াখালীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মহাত্মা গান্ধীর স্বয়ং দাঙ্গা দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে নোয়াখালীর পথে কলিকাতা পৌছার পূর্বদিন বিহারে মুসলিম নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। অপেক্ষাকৃত শান্ত নোয়াখালীর পথে যাত্রা স্থগিত রাখিয়া সদ্য দাঙ্গা কবলিত বিহারই ছিল গান্ধিজীর উপযুক্ত কর্মস্থল। তবে, ঝানু রাজনীতিবিদ গান্ধীজী তাহা করিতে যাইবেন কেন? নোংরা রাজনীতির তাগিদে ঋষিতুল্য গান্ধীজীকেও কত নীচস্তরে নামিতে হইয়াছিল। গান্ধীজীর তখনকার দৃষ্টিতে 'সবার উপরে মানুষ সত্য' ছিল না, ছিল সবার উপরে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার। এতদসত্ত্বেও বঙ্গীয় প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্বয়ং গান্ধীজীর নোয়াখালী যাত্রা ও অবস্থানের সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা স্বীয় ব্যক্তিগত জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ করার মানসে গান্ধীজীর নোয়াখালী অবস্থানের সুযোগ গ্রহণ করিয়া অনর্থক স্থানীয় মুসলিম নেতৃত্বকে নানাভাবে পুলিশী হয়রানির শিকারে পরিণত করিয়াছিল। তাই প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ২রা ডিসেম্বর (১৯৪৬) মহাত্মা গান্ধীকে নিম্নোক্ত ব্যক্তিগত পত্র লিখিয়াছিলেনঃ 
 
অর্থাৎ "বাংলার হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আপনার ইচ্ছাকে আমি অতীব মূল্যবান জ্ঞান করি। তবে, মুসলমানরা মনে করে যে, আপনি যদি পারস্পরিক সুুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার নীতি বাস্তবিকই চালাইয়া যাইতে চান, তাহা হইলে বিহারই প্রকৃত ক্ষেত্র হওয়া উচিত। আপনার অবস্থান আপনার অনুগামীদের অনেককেই বানোয়াট প্রমাণাদি উদ্ভাবন করিতে এবং স্থানীয় মুসলমান ও স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে আপনার সমীপে তাহা পেশ করিতে উৎসাহিত করিয়াছে, যাহা অদূর ভবিষ্যতে পারস্পারিক আস্থা স্থাপনে সম্ভবত সহায়ক হইবে না।"
      ২৪শে আগস্ট (১৯৪৬) কেন্দ্রে এক দলীয় কংগ্রেস সরকার প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দান করিয়া গভর্ণর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় বিধ্বস্ত কলিকাতা নগরী সরেজমিনে পরিদর্শন কল্পে ২৫শে আগস্ট কলিকাতা আগমন করিলেন। কলিকাতায় সোহরাওয়ার্দী-ওয়াভেল আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ৬ই সেপ্টেম্বর (১৯৪৬) কায়েদে আজমের সহিত তাঁহার বোম্বের মালাবার হিল বাসভবনে সাক্ষাত করেন। কায়েদে আজমের সহিত আলোচনার পর ৮ই সেপ্টেম্বর দিল্লীতে পুনরায় সোহরাওয়ার্দী-ওয়াভেল বৈঠক হয়। সোহরাওয়ার্দী-ওয়াভেল বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে ৯ই সেপ্টেম্বর কায়েদে আজম দীর্ঘক্ষণ বৈঠকের পর ১০ই সেপ্টেম্বর (১৯৪৬) ভারতীয় সমস্যা নিরসনকল্পে সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানান। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেলের আমন্ত্রণে ১৬ই এবং ১৮ই সেপ্টেম্বর কায়েদে আজম-ওয়াভেল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভূপালের নওয়াবের উদ্যোগে গান্ধী-জিন্নাহ-ভূপাল নওয়াব একদফা আলোচনা হয়। আলোচনার পর গান্ধী ও জিন্নাহ যুক্ত বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক শান্ত ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানান। স্মর্তব্য যে, ভারতীয় সমস্যা সমাধানকল্পে ১৯৪৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর কায়েদে আজমের বোম্বের মালাবার হিল বাসভবনে গান্ধী-জিন্নাহ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বটে; তবে ভারতের মেঘাচ্ছন্ন ভাগ্যাকাশে সূর্যোদয়ের কোন পূর্বাভাষ পাওয়া যায় নাই। বরং অনাগত ভবিষ্যত ভারতবাসীর জন্য বহয়া আনে দুর্বিষহ দুঃখ ও যাতনা। 
      ৪ঠা ও ৭ই অক্টোবর (১৯৪৬) দিল্লীস্থ ভূপাল হাউজে জিন্নাহ-নেহরু বৈঠক হয়। ১২ই ও ১৩ই অক্টোবর কায়েদে আজম-ওয়াভেল বৈঠকে ফলপ্রসু আলোচনা হয় এবং ১৩ই অক্টোবর নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারে যোগদানের প্রস্তাব গ্রহণ করে। তদানুযায়ী ২০শে নভেম্বর (১৯৪৬) জনাব লিয়াকত আলী খান (অর্থ), জনাব আই,আই, চূন্দ্রীগড় (বাণিজ্য), সরদার আবদুর রব নিশতার (যোগাযোগ), রাজা গজনফর আলী খান (স্বাস্থ্য) ও বাবু যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল (আইন) অর্ন্তবর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দেন। বাবু যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল পরিচালিত সিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের সর্বময় মুসলিম লীগ সংগঠনের প্রতি ভ্রাতৃসুলভ সহানুভূতি ছিল। তাই মুসলিম লীগ শ্রী মণ্ডলকে কেন্দ্রীয় সরকারের সদস্য হিসাবে মনোনীত করে। উক্ত সফল পরিণতির একক কৃতিত্ব তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন জনাব সোহরাওয়ার্দীর।
      আমাদের মত ক্ষুদ্র কর্মীদের তরুণ মন তখনকার নেতাদের আচরণে আশা-নিরাশায় দুলিতেছিল। দলমত নির্বিশেষে আমরা অতি আন্তরিকভাবেই ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের শুভ পরিণতি চাহিতেছিলাম। কিন্তু তাহাতো হইবার নহে। নেতাদের আত্মস্বার্থ তাহা হইতে দিবে কেন? তথাপি শেষরক্ষার কামনায় আল্লাহ আল্লাহ করিতে লাগিলাম। অনভিপ্রেতের সূত্রপাত হইল। ৯ই ডিসেম্বর (১৯৪৬) অনুষ্ঠিত ভারতীয় গণপরিষদের অধিবেশনে যোগদান করা হইতে মুসলিম লীগ বিরত রহিল। বৃটিশ গভর্নমেন্ট ২০শে ফেব্র"য়ারী (১৯৪৭) ঘোষণা করিলেন যে, ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে বৃটিশ সরকার বদ্ধপরিকর। ২২শে মার্চ (১৯৪৭) লর্ড মাউন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেলের স্থলাভিষিক্ত হইয়াই ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সহিত ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। তাঁহারই প্রচেষ্টায় পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু ঘোষনা করিলেন যে, অনিচ্ছুক অংশ বাদ দিয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় কংগ্রেসের কোন আপত্তি নাই। ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস লীগ নেতৃবৃন্দের সহিত সবিশেষ বিস্তারিত আলোচনার পর ৩রা জুন (১৯৪৭) ভারত বিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করিলেন। ইহাই বিখ্যাত "৩রা জুন পরিকল্পনা" নামে অভিহিত।
 


__._,_.___

Posted by: Shahadat Hussaini <shahadathussaini@hotmail.com>


[* Moderator�s Note - CHOTTALA is a non-profit, non-religious, non-political and non-discriminatory organization.

* Disclaimer: Any posting to the CHOTTALA are the opinion of the author. Authors of the messages to the CHOTTALA are responsible for the accuracy of their information and the conformance of their material with applicable copyright and other laws. Many people will read your post, and it will be archived for a very long time. The act of posting to the CHOTTALA indicates the subscriber's agreement to accept the adjudications of the moderator]





__,_._,___

[chottala.com] ইতিহাসের রবীন্দ্রনাথ এবং ঠাকুরবাড়ি



ইতিহাসের রবীন্দ্রনাথ এবং ঠাকুরবাড়ি

 

ইতিহাসের রবীন্দ্রনাথ এবং ঠাকুরবাড়ি


ভূমিকা
শ্রদ্ধা ও ভক্তি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত প্রায় সমার্থক দুটি শব্দ। ব্যক্তি বা বস্তুর বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ পর্যবেক্ষণের পর আকৃষ্ট হয়ে মানুষ প্রমত কোন ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করে বা কোন বস্তুকে গুণের আধার মনে করে। অনেক ক্ষেত্রে শ্রদ্ধা থেকে ভক্তি জন্ম নেয়। এ অবস্থায় শ্রদ্ধার পরবর্তী স্তর হচ্ছে ভক্তি। অন্যদিকে কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে দেখা মাত্র অথবা উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুর বিভিনড়ব বর্ণনা শুনে কোন প্রকার বিচার বিবেচনা ব্যতীত যখন মানুষ উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুকে গুণের আধার মনে করে এবং অন্ধভাবে শ্রদ্ধাবনত হয় তখন আমরা একে এক প্রকারের ভক্তি বলে থাকি। সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি প্রম প্রকারের ভক্তির চোখ রয়েছেআর দ্বিতীয় প্রকার ভক্তিচক্ষুহীনবিবেকহীন বা অন্ধ।
আমাদের ভারতবর্ষে অনেক পীর/পুরোহিত রয়েছেন যারা নিজেদের সততায় ও যোগ্যতায় ভক্তের দল সৃষ্টি করেন আবার অনেক পীর/পুরোহিত রয়েছেন যারা সৎ ও যোগ্য নয় কিন্তু কূটকৌশলে অতি দক্ষ। এসব কূটকৌশলী পীর/ পুরোহিতগণ ধুরন্ধর মুরীদ/ পাণ্ডার মাধ্যমে ভক্তের দল সৃষ্টি করে বৈষয়িক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। আবার এমন অনেক পীর/পুরোহিত ও বুদ্ধিজীবী আছেন যারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালীকে পেশা হিসেবে পছন্দ করেছেন। শেষোক্ত শ্রেণীরপ্রতিষ্ঠায় নিজেদের প্রচেষ্টার চেয়ে আধিপত্যবাদী শক্তির প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় বৈষয়িকসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন। শেষোক্ত ব্যক্তিদেরকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি স্বীয় স্বার্থে ব্যবহারের লক্ষ্যে 'জিরোথেকে 'হিরো'তে পরিণত করে স্বীয় স্বার্থ হাছিল করে। সাম্রাজ্যবাদের বিরাগভাজন হলে অথবা সাম্রাজ্যবাদের পতনে উক্ত 'হিরো'দের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পর্যায়μমে 'জিরো'তে পরিণত হয়।
বিভিনড়বমুখী তথ্যপ্রবাহের ফলে বর্তমানে পৌরাণিক চরিত্র গুরুত্বহীন। আধুনিক যুগের মানুষ ধর্মীয় কারণ ব্যতীত পৌরাণিক হিরোকে সম্মান করে না। আধুনিক যুগের মানুষ যুক্তিবাদী বিধায় ঐতিহাসিক কষ্টিপাথরে যাচাই করে হিরোর হিরোত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতবর্ষে নিজেদের শাসন শোষণকে স্থায়ী এবং যুক্তিপূর্ণ করতে এদেশের অনেক নীতিহীনসুবিধাবাদী ব্যক্তিকে জিরো থেকে হিরো বানিয়েছে এবং তাদের রচিত ইতিহাস উক্ত দালালদের মুখোশ হিসেবে অদ্যাবধি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। অপরদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এদেশের স্বাধীনতাকামী ও আপোসহীন ব্যক্তিত্বদের ইতিহাসে ভেজাল মিশ্রণ করে হিরো থেকে জিরোতে পরিণত করেছে অথবা তাদের রচিত কলঙ্কিত ইতিহাসের পাতা থেকে উক্ত বীর পুরুষদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। ব্রিটিশ রচিত ইতিহাস আমাদের প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে ও স্বাধীনতার বীর সেনাপতিদেরকে ভিলেনে পরিণত করেছে পক্ষান্তরে দেশদ্রোহী ও খলনায়কদেরকে নায়কে পরিণত করেছে। অদ্যাবধি ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ রচিত ইতিহাস পঠিত ও চর্চিত হচ্ছে বিধায় উপমহাদেশের অধিবাসীগণ সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র জাল ছিনড়ব করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হচ্ছে না। শুধু তাই নয়১৯৪৭ সালের পরও ব্রিটিশ শাসকদের অনুসৃত ডিভাইড এন্ড রোল পলিসির তেজস্ক্রিয়তায় লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী প্রতিনিয়ত হত্যানির্যাতনের শিকার হচ্ছেনিজ দেশে পরবাসীর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।
প্রত্যেক বিখ্যাত ব্যক্তির পক্ষে-বিপক্ষে ২টি দল থাকা স্বাভাবিক। আমরা উভয় দলের এবং মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তৃতীয় পক্ষ বা নিরপেক্ষ হয়ে আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের ঐতিহাসিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করব।
রবীন্দ্র ভক্তদের যুক্তি
প্রচারিত ও প্রচলিত ইতিহাসে আছে তিনি ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিকলিকাতার ঠাকুর পরিবারে জন্মপিতা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন মহর্ষিদাদা ছিলেন প্রিন্সবিশ্ববিখ্যাত নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন 'গীতাঞ্জলিলিখেপেয়েছিলেন নাইট উপাধি। বাল্যকাল থেকে কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত। সাহিত্যনাটকউপন্যাসগল্পপ্রবন্ধচিত্রাঙ্কননৃত্যকলায় ছিলেন সফল ও সার্থক। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়বিশ্বভারতী ও শ্রীনিকেতন তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। বাঙালী জাতির ও ভারতীয়দের উনড়বয়নে আমৃত্যু সাধনা করেছেন। সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন জমিদারকবি ও প্রতিভাবান শিল্পী। বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেনইত্যাদি ইত্যাদি।
এতো গেল ভক্তদের কথা। সমকালেপরবর্তীতে এবং বর্তমানের তথ্য প্রবাহের যুগে সবাইকে যে প্রচলিত ও প্রচারিত ইতিহাসকে বিশ্বাস করতে হবে তাতো নয়। প্রচারিত ইতিহাস ও ভক্তদের দাবিসমূহকে ইতিহাসের আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করার নিমিত্তে অত্র প্রবন্ধের অবতারণা করা হয়েছে। প্রবন্ধের লেখক একজন মুসলমান নামধারী ব্যক্তি হওয়ায় প্রবন্ধকারের মূল্যায়নকে যাতে ফুৎকারে কেউ উড়িয়ে না দেয় এবং প্রবন্ধকারের সততাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে গালি না দেয় তজ্জন্য খাঁটি ব্রাহ্মণের/ক্ষত্রিয়ের হস্তলিখিত তথ্যাদি এবং গঙ্গাজলে পবিত্র হওয়া বাঙালী জাতীয়তাবাদী দু-একজন মুসলমানের উদ্ধৃতির মাধ্যমে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেছেন"সত্য প্রিয় হউকঅপ্রিয় হউকসাধারণের গ্রহণযোগ্য হোক কি না হোক তাকে খজুঁতে হবেবুঝতে হবেপ্রচার করতে হবে।"
রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও বংশ পরিচয়
 �� কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষ পঞ্চানন কুশারী খুলনা জেলা ত্যাগ করিয়া কালিঘাটের নিকট গোবিন্দপুরে আসিয়া বসতি স্থাপন করেন। রবিবাবু যে খুলনা জেলার পিঠাভোগের কুশারী বংশ সম্ভূত উহারই সমর্থনে কয়েক বৎসর পূর্বে কলিকাতার যুগান্তর পত্রিকায় এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল। (পৃষ্ঠা ১২৪-১২৫সুন্দরবনের ইতিহাসএ.এফ.এমআবদুল জলিল৩য় খণ্ড)
�� প্রখ্যাত গীতিকারকবি ও অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী তাঁর রচিত 'বাংলার মূলবইয়ে দাবি করেছেন যে,রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষ প্রাচীন আরবের পৌত্তলিক 'কুশাইরীবংশ সম্ভূত ছিলেন। উক্ত কুশাইরীগণ কাবা মন্দিরের তাকুতদেবতার পূজো করত। উক্ত তাকুত দেবতার পূজারী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের বংশের লোকেরা পরবর্তীতে(তাকুত>টাকুট>টাকুর>) ঠাকুর পদবী গ্রহণ করে (পৃ. ১৫২-১৫৩)।
�� কলকাতা জোড়াসাঁকো ঠাকুর বংশের প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথের দাদা নীলমণি ঠাকুর। তিনি প্রমে ইংরেজদের অধীনেচাকুরী করে সাহেবদের সুনজরে পড়েন এবং উন্নতির দরজা খুলতে থাকে μমে μমে। এঁরা কিন্তু বরাবরই ঠাকুর পদবীধারী ননপূর্বে এঁরা ছিলেন কুশারী। পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী যখন শ্রমিকের কাজ করতেন তখন তাকে নিমড়বশ্রেণীর লোকেরা ঠাকুর মশাই বলতেন। ঐ ঠাকুর মশাই থেকে ঠাকুর পদবীর সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ছিলেন নীলমণির জ্যেষ্ঠ পুত্র রামলোচন এর দত্তক পুত্র (এ-এক অন্য ইতিহাসগোলাম আহমাদ মোর্তজাপৃ. ১৪২)।
দ্বারকানাথ
দ্বারকানাথের পিতা ইংরেজদের সাধারণ কর্মচারী ছিলেন। তবুও ইতিহাসে তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ। আর একজন ইংরেজ দালাল রামমোহন ছিল দ্বারকানাথের দীক্ষাগুরু। উভয় গুরু-শিষ্য মিলে এদেশে ইংরেজদের শাসন-শোষণে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে অঢেল অর্থের মালিক হয়েছিলেন তথাকথিত রাজা রামমোহন ও প্রিন্স দ্বারকানাথ। সংক্ষেপে দ্বারকানাথের বিত্তশালী হওয়ার তথ্য ও উৎসসমূহ নিমড়বরূপ :
১. নীতি ও বুদ্ধি বিচারের দিক দিয়ে রামমোহন ছিলেন তাঁর গুরু। গরীবের রক্ত শোষণ করা অর্থে প্রিন্সের এই প্রাচুর্যের পূর্বে তিনি ছিলেন মাত্র দেড়শটাকা বেতনের সাহেব ট্রেভর প্লাউডেনের চাকর মাত্র (তথ্যÑ ড. কুমুদ ভট্টাচার্যরাজা রামমোহন : বঙ্গদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিপৃ. ৮২)।
২. এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আগমনের সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির সৌভাগ্যের সূত্রপাত। শুরু থেকেই তা যুক্ত হয়েছিল ভারতে ব্রিটিশ শক্তির আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা লাভের সঙ্গে (কৃষ্ণ কৃপালিনীদ্বারকানাথ ঠাকুরবিস্মৃত পথিকৃৎপৃ. ১৭)।
৩. রঞ্জন বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন"রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা দ্বারকানাথের তেতাল্লিশটা বেশ্যালয় ছিল কলিকাতাতেই।এছাড়া ছিল মদের ব্যবসাআফিমের ব্যবসাঘোড়ার রেস খেলাবিপদগ্রস্ত লোকের বন্ধু সেজে মামলার তদ্বির করা এবং ২৪ পরগনার সল্ট এজেন্ট ও সেরেস্তাদার (আনন্দবাজার পত্রিকা২৮ কার্তিক১৪০৬)।
৪. ১৮২৪ সালে লুণ্ঠনকারী ব্রিটিশদের যেখানে ২৭১টি নীল কারখানা ছিল সেখানে প্রিন্স ও তার দোসরদের নীল কারখানা ছিল ১৪০টি (প্রমোদ সেনগুপ্তনীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজপৃ. ৬)।
এভাবেই ট্রেভর প্লাউডেনের চাকর দ্বারকানাথ প্রিন্স দ্বারকানাথ হলেন এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অবদান রাখলেন।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
ইনি রবীন্দ্রনাথের পিতা। বাংলার শ্রেষ্ঠ জমিদার। জন্মসূত্রে পিতার চরিত্রব্যবসাবাণিজ ্যইংরেজ দালালী ও জমিদারী প্রাপ্ত হয়ে মহান ঋষি বা মহর্ষি হলেন। তাহার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রজাকূল বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তিনি নির্মম হাতে উক্ত প্রজা বিদ্রোহ দমন করে সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা তথাকথিত বাঙালী হিন্দু রেনেসাঁর মধ্যমণি ছিলেন। তাঁর জমিদারীর দু-একটি নমুনা উলে-খ করা হলো :
১. ঠাকুর পরিবারের এই মহর্ষি-জমিদারদের প্রতি কটাক্ষ করে হরিনাথ লিখেছেন, "ধর্ম মন্দিরে ধর্মালোচনা আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্য শরীরে পাদুকা প্রহার একথা আর গোপন করিতে পারি না।" (অশোক চট্টোপাধ্যায়প্রাক-বৃটিশ-ভারতীয় সমাজপৃ. ১২৭)।
২. "ইত্যাদি নানা প্রকার অত্যাচার দেখিয়া বোধ হইল পুষ্করিণী প্রভৃতি জলাশয়স্থ মৎস্যের যেমন মা-বাপ নাইপশুপক্ষী ও মানুষযে জন্তু যে প্রকারে পারে মৎস্য ধরিয়া ভক্ষণ করেতদ্রƒপ প্রজার স্বত্ব হরণ করিতে সাধারণ মনুষ্য দূরে থাকুক,যাহারা যোগী-ঋষি ও মহাবৈষ্ণব বলিয়া সংবাদপত্র ও সভা-সমিতিতে প্রসিদ্ধতাহারাও ক্ষুৎক্ষামোদর।" (কাঙাল হরিনাথের'অপ্রকাশিত ডায়েরী', চতুষ্কোণআষাঢ়১৩৭১)।
৩. প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে ঠাকুরবাড়ির অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হয়। ঠাকুরবাড়ি থেকে ব্রিটিশ সরকারকে জানানো হলো যেএকদল শিখ বা পাঞ্জাবী প্রহরী পাঠাবার ব্যবস্থা করা হোক। মঞ্জুর হলো সঙ্গে সঙ্গে। সশস্ত্র শিখ প্রহরী দিয়ে ঠাকুরবাড়ি রক্ষা করা হলো আর কঠিন হাতে নির্মম পদ্ধতিতে বর্ধিত কর আদায় করাও সম্ভবহলো। ঠাকুরবাড়ির জন্য শ্রী অশোক চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, "অথচ এরাও কৃষকদের উপর থার্ড ডিগ্রী (প্রচণ্ড প্রহার)প্রয়োগ করতে পিছপা হননিকর ভার চাপানোর প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান অধিকার করেছেনপরন্তু ভয় দেখিয়ে কর আদায়ের জন্য এবং বিদ্রোহীদের মোকাবেলার জন্য একদল শিখ প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন (প্রাকবৃটিশ ভারতীয় সমাজপৃ: ১৩২)।
৪. মহর্ষিদের অসংখ্য করের মধ্যে কয়েকটি নমুনা নিমড়বরূপ :
ক. গরুর গাড়ি করে মাল পাঠালে ধুলা উড়তোতাই গাড়ির মালিককে যে কর দিতে হতোতার নাম 'ধুলট'
খ. প্রজা নিজের জায়গায় গাছ লাগালে যে কর দিতে হতো তার নাম 'চৌথ'
গ. প্রজা আখ গাছ থেকে গুড় তৈরি করলে দিতে হতো 'ইক্ষুগাছকর।
ঘ. প্রজার গরু-মোষ মারা গেলে দিতে হতো 'ভাগাড় কর'
ঙ. নৌকায় মাল উঠানো-নামানোর জন্য দিতে হতো যে কর তার নাম ছিল 'কয়ালী'
চ. ঘাটে নৌকা ভিড়লে যে কর দিতে হতো তার নাম ছিল 'খোটাগাড়ি কর'
ছ. জমিদারের সঙ্গে দেখা করলে দিতে হতো যে কর তার নাম 'নজরানা' জ. জমিদার হাজতে গেলে দিতে হতো 'গারদসেলামীকর।
(তথ্যগণঅসন্তোষ ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজস্বপন বসুপৃ. ১৬৬)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
রতনে রতন চিনে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও রতন চিনতে ভুল করেননি। দাদা দ্বারকানাথ ও পিতা দেবেন্দ্রনাথের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচিত করা হয় রবীন্দ্রনাথকে। এ বিষয়ে স্বপন বসু লিখেছেন : "মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে জমিদার হিসেবে তিনি নির্বাচন করলেন চৌদ্দ নম্বর সন্তান রবীন্দ্রনাথকে। এও এক বিস্ময়! অত্যাচার,শোষণশাসনচাবুকচাতুরীপ্রতারণা ও কলাকৌশলে রবীন্দ্রনাথই কি যোগ্যতম ছিলেন তাঁর পিতার বিবেচনায়অনেকের মতেপিতৃদেব ভুল করেননি। প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতা বহু বিষয়েই অনস্বীকার্য (ঐস্বপন বসু)।
রবীন্দ্র মানস গঠন
বৈষয়িকসামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে জমিদার রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথঠাকুর্দা দ্বারকানাথ ও বাঙালী বাবু সমাজের পথিকৃৎ তথাকথিত রাজা রামমোহনের যোগ্য উত্তরসূরি। অপরদিকে কাব্য ও সাহিত্য ভাবনায় তিনি ছিলেন চরম মুসলিম বিদ্বেষী ইংরেজ দালাল ঋষি বঙ্কিম ও তাঁর গুরু ঈশ্বর গুপ্তের যোগ্য প্রতিনিধি। তাই রবীন্দ্র আলোচনার পূর্বে ঈশ্বর গুপ্ত ও বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। ব্রিটিশ রচিত প্রচলিত ও প্রচারিত ইতিহাস উক্ত ব্যক্তিদের অন্ধকার দিকসমূহ ছাইচাপা দিয়েছে। ব্রিটিশের অন্ধ অনুকরণে অভ্যস্ত পাকিস্তানবাংলাদেশ ও ভারত সরকার একইভাবে দেশের পাঠ্যপুস্তকে উক্ত ব্যক্তিদের অন্ধকার দিকসমূহ উন্মোচনের চেষ্টা করেনি। ফলে সত্যানুসন্ধানী লেখকের সঠিক তথ্যাবলী অনেকের কাছে নতুন মনে হবে বৈকি।
ঈশ্বর গুপ্ত
আমরা জানি ঈশ্বর গুপ্ত যুগ সন্ধিক্ষণের কবি। অর্থাৎ প্রাচীন ও আধুনিক কাব্য প্রতিভা ঈশ্বর গুপ্তকে আশ্রয় করেছে। তাঁর জন্ম ১৮১২ খ্রীস্টাব্দে। ১৫ বছর বয়সে বিয়ে করেন তবে পতড়বী দুর্গামণি দেবীর সঙ্গে তিনি আজীবন সংসার করেননি। আশুতোষ দেবের ভাষায়Ñ "ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কোন সাধারণ কবি ছিলেন নাবরং অসাধারণই ছিলেন। কারণ সে যুগের অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক পত্রপত্রিকার বাজারে তিনি বিখ্যাত পত্রিকা সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদনা করতেন। এছাড়াও'সংবাদ রতড়বাবলী', 'পাষণ্ড পীড়নপ্রভৃতি তাঁর সম্পাদিত সাময়িক পত্রিকা ছিল। বোধেন্দু বিকাশ প্রভৃতি প্রবন্ধও তাঁর দ্বারা রচিত হয়। সবচেয়ে মনে রাখার মতো উল্লেখযোগ্য কথা হলোস্বাধীনতা আন্দোলনের যিনি প্রতিষ্ঠাতা বলে কথিত সেই বঙ্কিমচন্দ্রের ইনি ছিলেন গুরু (নতুন বাঙ্গালা অভিধানের চরিতাবলী অধ্যায়পৃষ্ঠা ১১১৫আশুতোষ দেব সংকলিত)।
�� "তিনিই হচ্ছেন আধুনিক কালের 'কবিগোষ্ঠীর প্র ম প্রবর্তক'। রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়দ্বারকানাথ অধিকারীদীনবন্ধু মিত্র ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রধান চার শিষ্য'। (সুকুমার সেনবাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস২য় খণ্ড)। এহেন মহান গুরু ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্য প্রতিভার নমুনা পেশ করা হলো :
১. একেবারে মারা যায় যত চাঁপদেড়ে (দাড়িওয়ালা)
হাঁসফাঁস করে যত প্যাঁজ (পিঁয়াজ) খোর নেড়ে।।
বিশেষত: পাকা দাড়ি পেট মোটা ভূড়ে
রোদ্র গিয়া পেটে ঢোকে নেড়া মাথা ফড়।।
কাজি কোল্লা মিয়া মোল্লা দাঁড়িপাল্লা ধরি
কাছাখোল্লা তোবাতাল্লা বলে আল্লা মরি।
বি:দ্র: ইংরেজদের সাথে যুদ্ধরত মুসলমানদের মৃত্যুতে খুশী হয়ে তিনি উক্ত কবিতা রচনা করেছেন।
২. ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ-ব বা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি লিখলেন :
চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয়।
ব্রিটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়।।
ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়।
মুক্তমুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।।
(দিল্লীর যুদ্ধ : গ্রন্থাবলীপৃ. ১৯১)
৩. মুসলমানদের হাতে ব্রিটিশের পরাজয়ে লিখলেন :
"দুর্জয় যবন নষ্টকরিলেক মানভ্রষ্ট
সব গেল বৃটিশের ফেম
শুকাইল রাঙ্গা মুখ ইংরাজের এত দুখ,
ফাটে বুক হায় হায় হায়।।"
৪. দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহ যখন বেগমসহ গ্রেফতার হলেন এবং তাঁর সন্তানদের কাটা মাথা তাঁকে উপহার দেওয়া হলো তখন ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন :
"বাদশা-বেগম দোঁহে ভোগে কারাগার।।
অকারণে μিয়াদোষে করে অত্যাচার।
মরিল দু'জন তাঁর প্রাণের কুমার।।
একেবারে ঝাড়ে বংশে হল ছারখার।"
৫. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে এবং রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতি ভক্তিতে লিখলেন:
ক. "জয় হোক বৃটিশেরব্রিটিশের জয়।
রাজ অনুগত যারাতাদের কি ভয়।"
খ. এই ভারত কিসে রক্ষা হবে
ভেব না মা সে ভাবনা।
সেই তাঁতীয়া তোপীর মাথা কেটে
আমরা ধরে দেব 'নানা'"
(দিল্লীর যুদ্ধ গ্রন্থাবলীপৃষ্ঠা ৩২০১৩৬)
["প্রিয় পাঠকএই হলো বাঙালী বাবু সমাজের গুরুস্থানীয় চিন্তাবিদ কবির চিন্তা ও কবিত্বের নমুনা। তাঁরই যোগ্য শাগরেদ ঋষি বঙ্কিম।"]
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অখণ্ড ভারতবর্ষে যখন ইংরেজের রাজত্ব তখন তাদের প্রয়োজন হয়েছিল একদল লেখককবিসাহিত্যিকনাট্যকার,ঐতিহাসিক ও বিশ্বস্ত কর্মচারীর। ইংরেজ জাতি তা সংগ্রহ করেছিল হিন্দু সম্প্রদায় হতে। ঐ হিন্দু লেখকগোষ্ঠীর গুরু হিসেবে ধরা যেতে পারে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে। কারণ তার জন্যই বলা হয়, 'আমাদের দেশের সকলের কবি'Ñ অর্থাৎ শিক্ষিত,অর্ধ-শিক্ষিত এবং নিরক্ষরদের কাছেও তিনি সমান প্রিয়। তাঁর সম্পর্কে শিষ্য বঙ্কিমের উক্তি নিমড়বরূপ :
১. "মধুসূদনহেমচন্দ্রনবীনচন্দ্ররবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালীর কবিÑ ঈশ্বর গুপ্ত বাঙ্গালার কবি। এখন আর খাঁটি বাঙ্গালী কবি জন্মে নাÑ জন্মিবার যো নাইজন্মিয়া কাজ নাই।মধুসূদনহেমচন্দ্রনবীনচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করে শেষ সিদ্ধান্তে বঙ্কিম ঈশ্বর গুপ্তের জন্য লিখিয়াছেনতাঁহার যাহা আছেতাহা আর কাহারও নাই। আপন অধিকারের ভিতর তিনি রাজা (সমালোচনা সংগ্রহকলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়৪র্থ সংস্করণ১৯৫৫পৃ. ২১৫-২১৭)।
২. "বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবেঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্য গুরু ছিলেনবঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন।" (পৃ. ২৫৩)
বঙ্কিম মানস
১. "হিন্দু জাতি ভিনড়ব পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে। তাহাদের মঙ্গল মাত্রেই আমাদের মঙ্গল হওয়া সম্ভব নহে। অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাহাতে না হয় আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতি পীড়ন করিতে হয় করিব। অপিচযেমন তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল ঘটিতে পারে তেমনি আমাদের মঙ্গলে তাহাদের অমঙ্গল ঘটিতে পারে। হয় হউকআমরা সেই জন্য আত্মজাতির মঙ্গল সাধনেবিরত হইব না। পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল সাধিত হয়তাহাও করিব।" (বঙ্কিম রচনাবলী২য় খণ্ডপৃ.২৩৯)।
২. "ঢাকাতে দুই চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হইবেÑ কাককুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটিই সমভাবে কলহপ্রিয়অতিদুর্দমঅজেয়। μিয়াবাড়িতে কাক আর কুকুরআদালতে মুসলমান।" (বঙ্গদর্শনঅগ্রহায়ণ-১২২৭পৃ. ৪০১)।
৩. আনন্দমঠে বঙ্কিম লিখেছেন, "মুসলমানের পর ইংরেজ রাজা হইলহিন্দু প্রজা তাহাতে কথা কহিল না। বরং হিন্দুরাই ডাকিয়া রাজ্যে বসাইল। হিন্দু সিপাহী ইংরাজের হইয়া লড়িল। হিন্দুরা রাজ্য জয় করিয়া ইংরাজকে দিল। কেননা হিন্দুর ইংরাজের উপর ভিনড়ব জাতীয় বলিয়া কোন দ্বেষ নাই। আজিও ইংরাজের অধীন ভারতবর্ষে (হিন্দু) অত্যন্ত প্রভুভক্ত।"
৪. ভারতীয় ঐক্যের পন্থা সম্পর্কে ঋষি বঙ্কিম বলেন, "ভারতবর্ষীয় নানা জাতি একমতএকপরামর্শীএকোদ্যোগী না হইলেভারতবর্ষের উনড়বতি নাই। এই মতৈক্যএকপরামর্শীত্বএকোদ্যম কেবল ইংরেজীর দ্বারা সাধনীয়। কেননা এখন সংস্কৃত লুপ্ত হইয়াছে। বাঙ্গালীমহারাষ্ট্রীতৈলঙ্গীপাঞ্জাবী ইহাদের সাধারণ মিলনভূমি ইংরাজি ভাষা। এই রজ্জুতে ভারতীয় ঐক্যের গ্রন্থি বাঁধিতে হইবে।" (বঙ্কিম রচনাবলী১ম খণ্ডপৃষ্ঠা ১৬-১৭) (পাঠকবৃন্দবঙ্কিম আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়তথাপি আমাদের কবিগুরুর পূর্বসূরি হিসাবে কিঞ্চিৎ উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে।)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জন্ম ১৮৬১ সালে এবং মৃত্যু ১৯৪১ সালে। তাঁর প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি তাঁর ভূমিকাও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি সমকালীন বাঙালী বাবু সমাজের নয়নমণি এবং ঠাকুরবাড়ির যথাযোগ্য উত্তর পুরুষ ছিলেন বিধায় বাঙালী হিন্দু চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তাঁর যুগে বাঙালী হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগ যে চেতনায় সাহিত্য সৃষ্টি করতেন তিনি তার ব্যতিμম ছিলেন না। কেউ যদি ভিনড়বমত পোষণ করেন তাহলে বলবোঅনেক ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিকসামাজিক-রাজনৈতিক চাপে পড়ে তিনি হয়তো স্রোতের বিপরীতে কিছু কথা বলেছেন তবে যখনই অবস্থা অনুকূলে এসেছে তখনই তিনি সমকালকে আঁকড়ে ধরেছেন। অবশ্য তিনি যদি সমকালীন ইংরেজ চাহিদার বিরুদ্ধে মাতামাতি করতেন তাহলে যেভাবে তিনি আজ সমাদৃত হচ্ছেন হয়তো তা নাও হতে পারতেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যারা সত্য কথা লিখেছেন তারা ইতিহাসের গোলক ধাঁধায়হারিয়ে গেছেন। এরূপ তিনজন বাঙালী ভদ্রলোক হচ্ছেন যথাμমে হরিশচন্দ্রশিশির কুমার ও দীনবন্ধু মিত্র। দীনবন্ধু ঋষি বঙ্কিমের সহপাঠী এবং সরকারি কর্মচারী ছিলেন। যদিও তাঁকে রায়বাহাদুর খেতাব প্রদান করা হয়েছিল তবু তিনি চিরদিন নীলকরদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করে বলেছিলেনÑ দীনবন্ধু যদি ইংরেজ বিরোধিতা না করতো তবে তাঁর পোস্টমাস্টার জেনারেল এবং পরে ডাইরেক্টর জেনারেল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। (দ্র: নীল বিদ্রোহ ওবাঙালী সমাজপ্রমোদ সেনগুপ্ত)।
মুসলিম বিদ্বেষী বঙ্কিমচন্দ্রকে অত্যন্ত সমীহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। কারণ তাঁর জানা ছিল যেবঙ্কিম ব্রিটিশরাজের এক নম্বর বাছাই করা ব্যক্তি। তিনি বঙ্কিম রচিত চরম সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট আনন্দমঠে রচিত 'বন্দে মাতরমগানে সুর দেন এবং নিজে গেয়ে বঙ্কিমকে শোনান। (রবীন্দ্র জীবনী১ম খণ্ডপৃ. ৩৩৬)।
গুরু বঙ্কিমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লিখলেন :
"ম্লেছ সেনাপতি এক মহম্মদ ঘোরী
তস্করের মত আসে আμমিতে দেশ।"
(প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়রবীন্দ্র জীবনীপৃ. ৩৭)
উক্ত সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সাহিত্য চর্চা ছিল আরও ভয়াবহ। বাঙালী জাতীয়তার শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনবরত কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের রচিত প্রবন্ধসাহিত্যনাটকপ্রহসনের বিষয়বস্তু ছিল হিন্দুর গৌরব গাথা এবং মুসলমানদের প্রতি আμমণ। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন ঠাকুরবাড়ির প্রভাবশালী সদস্য। ঠাকুরবাড়িতে যেসব নাটক হতো সেগুলোর লেখক ছিলেন তাঁরাই এবং অভিনয়ও করতেন অনেক ক্ষেত্রে ঐ বাড়ির পুরুষ ও মহিলারা। যে ভাষা ও বিষয় সেখানে ঝংকৃত হতো তার একটি নমুনা :
"ওঠ! জাগ! বীরগণ। দুর্দান্ত যবনগণ,
গৃহে দেখ করেছে প্রবেশ
 হও সবে একপ্রাণমাতৃভূমি কর ত্রাণ,
শত্র"দলে করহ নিঃশেষ।।
বিলম্ব না সহে আরউলঙ্গিয়ে তরবার
জ্বলন্ত অনলসম চল সবে রণে।
বিজয় নিশান দেখ উড়িছে গগনে।।
যবনের রক্তে ধরা হোক প্লাবমান
যবনের রক্তে নদী হোক বহমান
যবন শোণিত বৃষ্টি করুক বিমান
ভারতের ক্ষেত্র তাহে হোক বলবান।
এত স্পর্ধা যবনেরস্বাধীনতা ভারতের
অনায়াসে করিবে হরণ?
তারা কি করেছে মনেসমস্ত ভারতভূমে
পুরুষ নাহিক একজন।"
যায় যাক প্রাণ যাকস্বাধীনতা বেঁচে থাক
বেঁচে থাক চিরকাল দেশের গৌরব
 বিলম্ব নাহিক আরখোল সবে তরবার
ঐ শোন ঐ শোন যবনের রব।
এইবার বীরগণ কর সবে দৃঢ়পণ
মরণ শয়ন কিংবা যবন নিধন,
যবন নিধন কিংবা মরণ শয়ন
শরীর পতন কিম্বা বিজয় সাধন।"
(সরকার সাহাবুদ্দীন আহমেদইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত১৯৯৮পৃ. ২৮৩)
[মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী প্রগতিশীল যবনগণের উপলব্ধিতে কি এখনও পরিষ্কার হয়নি বাঙালী বাবু সমাজ এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আসলে কোন বিশ্বের কবিমুসলিম বিশ্বের না হিন্দু বিশ্বেরহিন্দু বিশ্বতো বর্তমান ভারতকেই বুঝায় আর ভারতে প্রত্যেহ যবনদেরকে কচুকাটা করা হচ্ছেতাদের রক্তে ভারতভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের যবনগণ যদি ভারতভূমির উর্বরতার জন্য স্বীয় রক্ত দান করতে চান তবে '৪৭-এর সীমানা মুছে দিলেই চলবেআর কিছু করতে হবে না।]
উপরোক্ত কবিতায়/গানে একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যেবাঙালী হিন্দুদের স্বাধীনতার চেতনা আর মুসলমানদের স্বাধীনতার চেতনা এক নয়। মুসলমানরা যাকে অধীনতা মনে করে বাঙালীরা তাকে স্বাধীনতা মনে করে পক্ষান্তরে মুসলমানদের বিজয় বাঙালীদের পরাধীনতার নামান্তর।
রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি চিন্তা
রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি কারা ছিল তা তাঁর বক্তব্য ও লেখনী থেকে অনুভব করা সহজ হবে। তাই নিমেড়ব কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো।
১. হিন্দু মেলা যে সৃষ্টি হয়েছিল সেটা ঠাকুর বাড়িরই অবদান। রবীন্দ্রনাথ দাবী করেছিলেন যেতাঁদের বাড়ির সহায়তায়ই হিন্দু মেলার জন্ম হতে পেরেছিল।রবীন্দ্রনাথ আরও বলেনভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলব্ধির চেষ্টা হিন্দু মেলাতেই সর্বপ্রম লক্ষণীয়। এই মেলায় দেশের স্তবগানগীতদেশানুরাগের কবিতা পঠিতদেশী শিল্পব্যায়াম প্রভৃতি প্রদর্শিত ও দেশী গুণীলোক পুরস্কৃত হইত।... এই মেলার প্রম উদ্দেশ্যবৎসরের শেষে হিন্দু জাতিকে একত্রিত করা।... যত লোকের জনতা হয় ততই ইহা হিন্দু মেলা ও ইহা হিন্দুদিগের জনতা এই মনে হইয়া হৃদয় আনন্দিত স্বদেশানুরাগ বর্ধিত হইতে থাকে। আমাদের এই মিলন সাধারণ ধর্ম-কর্মের জন্য নহেকেবল আমোদ প্রমোদের জন্য নহে। ইহা স্বদেশের জন্যÑভারতভূমির জন্য। (যথাμমে-জীবন-স্মৃতিরবীন্দ্র রচনাবলীÑ ১০পৃ. ৬৬/ যোগেশচন্দ্র বাগল : হিন্দু মেলার ইতিবৃত্ত (কলকাতা মৈত্রী-১৯৬৮)পৃষ্ঠা ৭)।
২. হিন্দু মেলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল 'জাতীয় সভা১৮৬৯ খ্রীস্টাব্দে। মুসলমাননিমড়ববর্ণের হিন্দু ও খ্রীস্টানদের এই সভায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। (জাতীয় সভা মধ্যস্থ২৩ অগ্রহায়ণ ১২৭৯পৃ. ৫৪২)।
৩. হিন্দু-মুসলিম বিভেদের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল ঐ হিন্দুমেলা ও 'জাতীয় সভাথেকেই।... মেলার কর্মকর্তাদের মধ্যেঅনেকেই ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সদস্য।... সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ এ মেলার কর্মকর্তা নির্বাচিত না হলেও তাঁরা সμিয়ভাবে মেলার কাজে অংশগ্রহণ করতেন দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা রচনার মাধ্যমে। (তথ্য : যোগেশচন্দ্র বাগল,পৃ. ৬ এবং ৪৮)।
৪. হিন্দু মেলার নেতা ও রবি ঠাকুরের বড় ভাই তাঁর জীবন স্মৃতিতে লিখলেনÑ হিন্দু মেলার পর হইতে কেবলই আমার মনে হইত কী উপায়ে দেশের প্রতি লোকের অনুরাগ ও স্বদেশ প্রীতি উদ্বোধিত হইতে পারে। শেষে স্থির করিলাম নাটকে ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা ও ভারতের গৌরব কাহিনী কীর্তন করিলে হয়তো কতকটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলেও হইতে পারে।এইভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া কটকে থাকিতেই আমি পুরুবিμম নাটকখানি রচনা করিয়া ফেলিলাম। (তথ্য: জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতিবসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়পৃ. ১৪১)।
৫. জ্যোতি বাবুর অপর তিনটি নাটক হচ্ছে যথাμমে সরোজিনীঅশ্র"মতি ও স্বপড়বময়ী। নাটকগুলোর আলোচ্য বিষয় ছিল নিমড়বরূপ :
ক. সরোজিনী : সম্রাট আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে মেবারের রাজপুত রাজা লক্ষণ সিংহের লড়াই।
খ. অশ্র"মতি : সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে রাজা প্রতাপ সিংহের লড়াই।
গ. স্বপড়বময়ী : সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে শুভ সিংহ এর বিদ্রোহ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর এসব লেখকের দৃঢ় ধারণা ছিল যেএরই ফলে গণমানুষের হৃদয়ে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হবে এবং জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। জ্যোতিবাবুর সরোজিনী নাটকের (১৮৭৫) সংলাপের নমুনা হচ্ছেÑ
'সরোজিনী॥ মা চতুর্ভুজা! যাদের জন্য পিতার আজ এরূপ বিষম ভাবনা হয়েছেসেই দুষ্ট মুসলমানদের শীঘ্র নিপাত কর।
লক্ষণ ॥ বৎসে! মুসলমানদের নিপাত সহজে হবার নয়। তার পূর্বে অশ্র"পাত করতে হবে। স্বপড়বময়ীর (১৮৮২) অন্যতম চরিত্র 'সুরজমলএর সংলাপ হচ্ছে : "যেখানে মুসলমান থাকে সেখানকার বাতাসও যেন আমার বিষতুল্য বোধ হয়।নাটকের প্রধান চরিত্র শুভসিংহ এর সংলাপÑ
 ... দেব মন্দির সকল,
 চূর্ণ চূর্ণ করিতেছে ম্লেছ পদাঘাতে,
বেদ-মন্ত্র করিতেছে লোপ,
গো-হত্যা নির্ভয়ে করে রাজপথ মাঝে।
(তথ্য : কোলকাতাকেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবীএম.আর. আকতার মুকুলপৃ. ৪৯)
 [পাঠকবৃন্দজ্যোতিদাদার এরূপ মহান নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন বিশ্বকবি (হিন্দু বিশ্বÑমুসলিম বিশ্ব নয়) রবিঠাকুর।]
এরূপ একটি কবিতার নমুনাÑ
জ্বল জ্বল চিতা! দ্বিগুণ দ্বিগুণ
পরাণ সঁপিবে বিধবা বালা।
জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন
জুড়াবে এখনই প্রাণের জ্বালা।।
শোন্রে যবন! শোন্রে তোরা!
 যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে,
সাক্ষী রলেন দেবতা তার
এর প্রতিফল ভুগিতে হবে।।
(তথ্য: জ্যোতিদার নাট্যসংগ্রহ (কোলকাতাবিশ ¦ভারতী)পৃ. ২২৫)
[সুতরাং বাংলাদেশী রবীন্দ্রভক্ত যবনগণআনন্দে নৃত্য কর]
৬. 'ব্রাহ্মধর্মীয়দের সভায় হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের পোশাক পরিচ্ছদের পার্থক্য কিভাবে রক্ষিত হবে তা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেনÑ
"ধুতিটা কর্মক্ষেত্রের উপযোগী নহে অথচ পাজামাটা বিজাতীয়।"(রবীন্দ্র রচনাবলী-১০জীবন স্মৃতিপৃ. ৬৭)
[উপরোক্ত আলোচনার পর রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি কারা আর বিজাতি কারা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।]
* ১৯০২ সালে শান্তিনিকেতন ব্রহ্ম বিদ্যালয়ে ব্রাহ্ম শিক্ষক কুঞ্জলাল ঘোষ কবির কাছে জানতে চান ছাত্ররা প্রণাম করলে তা নেওয়া হবে না নিষেধ করা হবেউত্তরে রবিবাবু লিখেন, "যাহা হিন্দু সমাজ বিরোধী তাহাকে এ বিদ্যালয়ে স্থান দেওয়া চলিবে নাসংহিতায় যেরূপ উপদেশ আছেছাত্ররা তদনুসারে ব্রাহ্মণ অধ্যাপকদিগকে পাদস্পর্শপূর্বক প্রণাম ও অন্যান্য অধ্যাপকদিগকে নমস্কার করিবে। এই নিয়ম প্রচলিত করাই শ্রেয়।" (রবীন্দ্র জীবনী২য় খণ্ডপৃ. ৪৭)।
* "যে কবি রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানিয়ে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেনসেই রবীন্দ্রনাথই অপরের বেলায় ধুয়ো তোলেন এতে হিন্দু ধর্মের প্রভূত ক্ষতি হবে।লেখক আরও লিখেছেন, "ভারতের বৃহত্তর অনুনড়বত হরিজনেরা আম্বেদকরের নেতৃত্বে যখন মাথা তুলতে চেয়েছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাদের সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে গান্ধীর কথা শুনতে আবেদন জানান। কারণ গান্ধী উপবাস শুরু করেছিলেন এই জন্য যেঅস্পৃশ্যদের পৃ ক নির্বাচন মেনে নিলে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। আম্বেদকরের সামনে যে বিরাট সুযোগ এসেছিল রবীন্দ্রনাথ এবং তার সঙ্গে হিন্দুদের এলিট শ্রেণী মিলে এমন চাপ সৃষ্টি করলেন যেতার ফল দাঁড়ালো এইÑ যদি অনশনে গান্ধী মারা যান তার ফল হবে মারাত্মক। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর জন্য করুণ সুরে বাণী লিখলেন, "আজ তপস্বী উপবাস আরম্ভ করেছেনদিনের পর দিন তিনি অনড়ব নেবেন না। কিন্তু তাঁর বাণীকে গ্রহণ করাই তার অনড়বতাই দিয়ে তাঁকে বাঁচাতে হবে।" (জগদীশ চন্দ্র মণ্ডলরবীন্দ্রনাথগান্ধী ওআম্বেদকরপৃ. ৪৮৪৯)।
(উপরোক্ত উদ্ধৃতির মাধ্যমে পাঠকের বুঝতে কষ্ট হয় না যেরবীন্দ্রনাথের স্বজাতি তালিকায় রয়েছে শুধু বর্ণ হিন্দু,নিমড়বশ্রেণীর হিন্দুরাও নয়।)
রবীন্দ্র-জাতীয়তার উৎস মূল : "হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল যদিও সজ্ঞানে তাঁদেরঅনেকেই কখনো এর উপস্থিতি স্বীকার করবেন না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছেন ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাঁরপৃথিবী বিখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবতাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কিছুতেই সুসংগত করা যায় না। তবু বাস্তব সত্য এই যেতাঁর কবিতাসমূহ শুধুমাত্র শিখরাজপুত ও মারাঠাকুলের বীরবৃন্দের গৌরব ও মাহাত্ম্যেই অনুপ্রাণিত হয়েছে। কোনমুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনো এক ছত্রও লিখেননিÑ যদিও তাঁদের অসংখ্যই ভারতেই আবির্ভূত হয়েছেন। এথেকেই প্রমাণিত হয়ঊনিশ শতকী বাংলায় জাতীয়তা জ্ঞানের উৎসমূল কোথায় ছিল।"
(ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারবাংলাদেশের ইতিহাস৩য় খণ্ডপৃ. ২০০৩)।
সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজগণই বর্ণ হিন্দুদেরকে হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান শিখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক গুরু প্রকাশ্যেই তাহা স্বীকার করিয়াছেন। "যে সকল অমূল্য রতন আমরা ইংরেজদের চিত্তভাণ্ডার হইতে লাভ করিতেছিতাহার মধ্যে দুইটির আমরা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করিলামÑ স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা ও জাতি প্রতিষ্ঠা। ইহা কাহাকে বলে তাহা হিন্দু জানিত না।" (বঙ্কিম রচনাবলীপৃ. ২৪০-৪১)।
বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন"মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয়সাহিত্য বিসর্জন দিতে পারি না। মুসলমানদের উচিত নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেরাই সৃষ্টি করা।" ('ভারতীপত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন আবুল আসাদ তাঁর 'একশবছরের রাজনীতিবইতে)।
রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধ : সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি এদেশের ক্ষমতা দখলের পর তাদের সহায়তাকারী হিন্দুদেরকে বলল,পূর্বে তোমাদের সব ছিল। যথাÑ তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি ছিলেতোমাদের ইতিহাস ছিলবিজ্ঞান ছিলআভিজাত্য ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। মুসলমানরা এদেশ দখল করে তোমাদের ইতিহাসবিজ্ঞানজাত্যাভিমানসহ সবকিছু বরবাদ করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা পুনরায় তোমাদেরকে সবকিছু দেব। এভাবে ইংরেজ চাটুকারগণই μমে μমে বর্ণ হিন্দুতে ও বাঙ্গালীতেপরিণত হলো এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখে ভীত হয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হলো। ইংরেজদের পরামর্শ মোতাবেক অনেক খোঁ জাখুিঁ জ করেও যখন এদেশের বর্ণ হিন্দুরা নিজেদের কোন গৌরবময় ইতিহাস খুেঁ জ পেল না তখন তারা হতাশ হয়ে নিজেদেরকে অপাংক্তেয় মনে করল এবং রাজপুতমারাঠা ও শিখ জাতির বীরত্বগাথা দিয়ে কবিতাকাব্যগল্পউপন্যাসনাটক ও ইতিহাস রচনা শুরু করল। এরূপ করতে গিয়ে এ সকল হতাশ বর্ণহিন্দুরা বাঙালী জাতীয়তাবোধকে হারিয়ে ফেলল এবং সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ অভিমুখে ধাবিত হয়ে নিজেদের ভৌগোলিক ও ভাষাগত জাতিসত্তাকে সর্বভারতীয় জাতিসত্তার বেদীমূলে বিসর্জন দিয়ে আত্মহত্যা করল। মূলত: সমগ্র ভারত জয় করার পূর্বে বাংলাভাষীদেরকে ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত করার জন্য হিন্দুদেরকে ইংরেজরাই প্রমে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল। সমগ্র ভারত কুক্ষিগত করা শেষ হলে ব্রিটিশ রাজশক্তি উক্ত বাঙালীদেরকে পর্যায়μমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করে। ব্রিটিশের এ সকল কূটবুদ্ধি বুঝতে না পেরে তৎকালীন বাঙালী জাতীয়তার কর্ণধারগণ নিজ জাতি সম্পর্কে হতাশ প্রতিμিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পাঠকবৃন্দ অনুধাবনে সক্ষম হবেন আশা করি।
১. বাঙালীর বল নাইবিμম নাইবিদ্যাও নাইবুদ্ধিও নাইসুতরাং বাঙালীর একমাত্র ভরসা তৈল। বাংলায় যে কেহ কিছু করিয়াছেন সকলেই তৈলের জোরে। (হরপ্রসাদ রচনা সংগ্রহ১ম খণ্ডপৃ. ৪৯২)
২. "বাঙলার ইতিহাস নাইযাহা আছেতাহা ইতিহাস নয়তাহা কতক উপন্যাসকতক বাঙলার বিদেশীবিধর্মী,পরপীড়কদিগের জীবন চরিত মাত্র। বাঙলার ইতিহাস চাইনহিলে বাঙলার ভরসা নাই। কে লিখিবে?" [একটু খেয়াল করলে পাঠকবৃন্দ বুঝতে পারবেন বঙ্কিমবাবু ইতিহাস বলতে কাদের ইতিহাস বুঝিয়েছেন। আবার বিদেশী ও বিধর্মী বলতে কাদেরবুঝাচ্ছেনজীবন চরিত বলতে কাদের ইতিহাসকে বুঝাচ্ছেন?]
৩. রবীন্দ্রনাথও পূর্বোক্তদের ন্যায় বাঙালী জাতি সম্পর্কে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। তিনিসহ তৎকালীন বাঙালী জাতীয়তারকর্ণধারগণ বাংলাদেশে কোন বীর পুরুষমহান পুরুষ খুঁজে না পেয়ে দস্যু শিবাজীকে হিন্দু পুনরুত্থানের নায়ক বানিয়েছেন এবং বাংলাভাষী হিন্দু জাতি সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে সর্বভারতীয় জাতীয়তায় নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়েছেন। কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে।
১.
সাত কোটি বাঙালীরে- হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালী করে- মানুষ করনি।
(রবীন্দ্রনাথ)
২.
রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'দুরন্ত আশাকবিতায় বাঙালী হওয়া অপেক্ষা আরব বেদুইন হওয়াকে সম্মানজনক বলেছেন। মর্মে যবে মত্ত আশা সর্প সম ফোঁসে
অদৃষ্টের বন্দনেতে দাপিয়া বৃ া রোষে,
তখনও ভাল মানুষ সেজে
বাঁধানো হুকা যতনে মেজে,
মলিন তাস সজোরে ভেজে
খেলিতে হবে কষে।
অনড়বপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব
জনাদশেক জটলা করিতক্তপোষে বসে।
দেখা হলেই মিষ্ট অতি
মুখের ভাব শিষ্ট অতি
অলস দেহ ক্লিষ্ট গতি
গৃহের প্রতি টান,
তৈলঢালা সিড়বগ্ধ তনু নিদ্রা রসে ভরা,
মাথায় ছোট বহরে বড় বাঙালী সন্তান।
বাঙালী মোরা ভদ্র অতি পোষমানা এ প্রাণ,
বোতাম আঁটা জামার নীচে শান্তিতে শয়ান।
ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন
চরণ তলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন,
ছুটেছে ঘোড়াউড়েছে বালি
জীবন স্রোত আকাশে ঢালি
হৃদয় তলে বহ্নি জ্বালি'
চলেছি নিশিদিন,
বরশা হাতে ভরসা প্রাণে সদাই নিরুদ্দেশ।
মরুর ঝড় যেমন বহে সকল বাধাহীন।
পাদুকা তলে পড়িয়া লুটি।
ঘৃণায় মাথা অনড়ব খুঁটি
যেতেছ ফিরি ঘর
ঘরেতে বসে গর্ব কর পূর্ব পুরুষের
আর্য তেজ দর্পভরে পৃথিবী থর থর
হেলায় মাথা দাঁতের আগে মিষ্ট হাসি টানি'
বলিতে আমি পারিবনাতো ভদ্রতার বাণী।
উচ্ছ্বসিত রক্ত আসি বক্ষতল ফেলিছে গ্রাসি,
প্রকাশহীন চিন্তা রাশি করিছে হানাহানি,
কোথাও যদি ছুটিতে পাই বাঁচিয়া যাই তবে
ভব্যতার গণ্ডি মাঝে শান্তি নাহি মানি।
৩. দুরন্ত আশার শেষ দুইটি লাইনে তিনি যা বলেছেন তাতে বুঝা যাচ্ছে বাঙালীত্বে তিনি খুশী নন। বাঙালীত্ব থেকে বেরিয়ে তিনি কোথায় যেতে চান তাও তিনি অব্যক্ত রাখেননি। মারাঠা দস্যু শিবাজীর জন্য তিনি লিখলেনÑ
সেদিন শুনিনি কথাআজি মোরা তোমার
আদেশ শির পাতি লব,
কণ্ঠে কণ্ঠে বক্ষে বক্ষে ভারতে মিলিবে
সর্বশেষ ধ্যানমন্ত্র তব,
এক ধর্ম রাজ্য হবে এ ভারতে এ মহাবচন
করিব সম্বল।
৪. শিবাজী এবং রবীন্দ্রনাথের রুচিবোধ :
বাঙালী জাতীয়তাবাদের কর্ণধারগণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির দরুন বাংলা মুলুকে কোন বীর পুরুষের খোঁজ না পেয়ে মারাঠা দস্যু সর্দার শিবাজীকে জাতীয় বীর হিসেবে বরণ করে নেয়। তাই শিবাজী সম্পর্কে সাধারণ ধারণা লাভ করলে রবীন্দ্র জাতীয়তাবোধ ও রবীন্দ্র রুচির বিশেষত্ব সম্যক উপলব্ধি করা সহজ হবে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যে এক নতুন জাতির উত্থান হয়। এর নাম মারাঠা জাতি। শিবাজীরা ছিলেনভোঁসলে পরিবারের সদস্য। এই পরিবার ছিল কৃষিজীবী। শিবাজীর পিতা শাহজী ভোঁসলে প্রমে নিজাম শাহী সুলতানের পরে আদিল শাহী সুলতানের অধীনে চাকুরি করে প্রতিপত্তি ও জমিদারী লাভ করেন। হঠাৎ উনড়বতির আতিশয্যে অনেক সুন্দরীর সহজ প্রাপ্তিতে তিনি তাঁর প্র মা স্ত্রী জীজাবাঈকে উপেক্ষা করেন। জীজাবাঈ স্বামী সংসার ত্যাগ করে অশিক্ষিত এক ব্রাহ্মণ কোন্দদেবের আশ্রিতা হন। কোন্দদেব নিরক্ষর শিবাজীকে মুসলিম বিদ্বেষী হিসাবে গড়ে তোলেন।
শিবাজী বয়ঃপ্রাপ্তির পর কোন্দদেবের শিক্ষা কাজে পরিণত করতে 'মাওয়ালীনামে দুর্ধর্ষ অসভ্য পার্বত্য জাতির সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। মিত্রতার প্রধান শর্ত হলো মারাঠা ও মাওয়ালীরা একতাবদ্ধ হয়ে লুটতরাজ করবে এবং প্রত্যেকে লুণ্ঠিত দ্রব্যের যথাযথ হিস্যা পাবে। শিবাজীর নেতৃত্বে গঠিত ডাকাত দল সারা ভারতে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে লুটতরাজকরতো। রাতের আঁধারে অতর্কিত আμমণ করতো নিরীহ গ্রাম ও নগরবাসীর উপর। সোনাদানা-অর্থ লুট করতো,নারীশিশুদেরকে μীতদাস করে দাসবাজারে বিμয় করতো। তাদের নিষ্ঠুর অত্যাচারে এদেশের মানুষ এতো আতঙ্কগ্রস্ত ছিল যেছোট শিশুদের কানড়বা থামানোর জন্য বাংলার মায়েরা মারাঠা বর্গীদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতো! এরূপ একটি বহুল প্রচলিত ছড়া হলো :
খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল।
বর্গী এল দেশে।।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে বার বার পরাজিত হয়ে শিবাজী গোপনে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ১৬৭৪ সালের ১২ জুন কোম্পানীর দূত হেনরী ওকসিন্ডেন গোপনে শিবাজীর পার্বত্য দুর্গে এসে মোগল শক্তি ধ্বংসেচুক্তিবদ্ধ হন। ইংরেজদের সহায়তায় শক্তি বৃদ্ধি করে শিবাজীর লুটতরাজ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ঐতিহাসিক শ্রী অজয় কর তাঁর 'ঐতিহাসিক প্রশেড়বাত্তরবইতে মারাঠা বর্গীদের ভূমিকাকে নিমেড়বাক্তভাবে চিত্রিত করেছেন।
ক. "ইংরেজ বণিকেরা বর্গী হাঙ্গামার সুযোগে নবাবের কোন অনুমতি গ্রহণ না করিয়া কলিকাতার দুর্গ নতুন করিয়াগড়িতে আরম্ভ করিল।"
খ. "এইরূপে রঘুজী (মারাঠা) পুনঃ পুনঃ বঙ্গদেশ লুণ্ঠন করিতে লাগিল। আলীবর্দ্দী কিছুতেই তাকে পরাস্ত করিতে না পারিয়া গুপ্ত ঘাতকের দ্বারা নিহত করাইল।"
গ. "মারাঠা অশ্বারোহী সৈন্যরা এদেশে বর্গী নামে পরিচিত। আলীবর্দ্দী খাঁর সিংহাসনারোহণের পূর্ব হইতে তাহারা সময়ে অসময়ে মোগল সাম্রাজ্য μমণ করিয়া লুটপাট করিত। আলীবর্দ্দী খাঁর আমলে এদেশে যে আμমণ ও লুণ্ঠন চলিতে থাকে তাহাই 'বর্গীর হাঙ্গামানামে পরিচিত।"
ঘ. "বর্গীরা তখনকার শ্রেষ্ঠ ধনী জগৎ শেঠের বাড়ী লুণ্ঠন করিয়া প্রায় আড়াই কোটি টাকা লইয়া প্রস্থান করে।"
দস্যু সর্দার শিবাজীর মৃত্যু হয় ৩ এপ্রিল ১৬৮০ সালে। এই সংবাদ শুনে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মন্তব্য ছিল : "আমার দয়াক্ষমাউদারতাসহনশীলতা এবং দাক্ষিণাত্যে আমার অনুপস্থিতির সুযোগেই শিবাজী ক্ষণিকের 'ইঁদুর রাজাহয়ে মরল।" (উল্লেখ্যসম্রাট আওরঙ্গজেব দীর্ঘ ২৪ বছর দাক্ষিণাত্যে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর প্রতিনিধিরাই দাক্ষিণাত্য শাসন করতেন)
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথসহ সকল বর্ণহিন্দু বাঙালী বুদ্ধিজীবীগণ মারাঠারাজপুত ও শিখদের সে সকল ব্যক্তিদের বন্দনা করেছেনযাদের সাথে মুসলমানদের সংঘর্ষ হয়েছিলকিন্তু যেসব মারাঠাশিখ ও রাজপুত ইংরেজদেরবিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ গং তাদের বীরত্বের পক্ষে কিছুই লিখেননি। এর থেকে কি একথাই প্রমাণ হয় না যেতৎকালীন বাঙালী বাবুরা সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক মসীযুদ্ধ পরিচালনাকরেছিলেন?
৫. ডাকাত সর্দার শিবাজীর জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখলেন :
বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যুবলিকরে পরিহাস অট্টহাস্য রবে,
তব পুণ্যচেষ্টা যত তস্করের নিষ্ফল প্রয়াস এই জানে সবে।
...... ...... ...... ......
অশরীরি হে তাপসশুধু তব তপমূর্তি লয়ে আসিয়াছ আজ,
তবু তব পুরাতন সেই শক্তি আনিয়াছ ব'য়েসে তব কাজ।
মারাঠীর সাথে আজি হে বাঙালী এক কণ্ঠে বল জয়তু শিবাজী,
মারাঠীর সাথে আজি হে বাঙালীএকসঙ্গে চল মহোৎসবে সাজি।
(কবির উপরোক্ত আহ্বানে সাড়া দিতে হলে মারাঠার সাথে বাঙালীরা এক সাথে দস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হতে হবেবেপরোয়াহত্যাকাণ্ড করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে হবে। সবকিছু করতে রাজী হলেও যবনগণ কবির স্বদেশবাসীর অন্তর্ভুক্ত নয়।) নিমেড়বর উদ্ধৃতি লক্ষ্য করুন:
৬. ঠাকুরবাড়িতে আর একটি সভা সৃষ্টি হয়েছিল বিষবৃক্ষের মতসেটি হল সঞ্জীবনী সভা। কবির মতে সেটা স্বাদেশিকের সভা। সভ্যদের দীক্ষা দেওয়া হত ঋক বেদের মন্ত্র পড়িয়েÑ ঋক বেদের পঁিু থমরার মাথার খুিল  ইত্যাদি নিয়ে এখানে যে সভা হতো তা বাস্তবিক সত্য। (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতিবসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়পৃ. ১৬৭)।
উপরোক্ত অবস্থায় বিশ্ব কবির স্বজাতি কারাবিজাতি কারা বলার অপেক্ষা রাখে না। সর্বোপরি বিশ্বকবির স্বজাতিদেরকে তৎকালে বলা হতো বাঙালী আর বিজাতিদেরকে বলা হতো মুসলমান।
রবীন্দ্রনাথের ধর্ম চিন্তা
রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ছিলেন ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতাযা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। উক্ত দ্বারকানাথেরদীক্ষাগুরু ছিলেন তথাকথিত রাজা রামমোহন। রামমোহন খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী ইংরেজদের খুশী করার জন্য খ্রীস্টান ধর্মেরঅনুকরণে এক নতুন ধর্ম তৈরি করেন। উক্ত নতুন ধর্মে ঈশ্বর একসাকার পূজা নিষিদ্ধহিন্দু দেব-দেবী পূজা-অর্চনা ও পৈতে ধারণ নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বারকানাথও তাঁর গুরু রামমোহনের শিষ্যত্বের মাধ্যমে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণের ঘোষণা দেন। তবে এ ঘোষণা ছিল বাহ্যিক। দ্বারকানাথ নিজের ছেলে ও নাতিদের নামের সাথে হিন্দুদের বড় দেবতা ইন্দ্রের নাম সংযুক্ত করেন এবং তাঁর বংশের সব মেয়ের নামের সাথে যুক্ত হয় দেবী উপাধি। শুধু তাই নয়ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী ঘোষণা দিলেও পরিবারের মেয়েদেরকে বিয়ে দেন ব্রাহ্ম পাত্রদের পরিবর্তে হিন্দু পাত্রদের নিকট।
রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথও প্রকাশ্যে ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী ছিলেন কিন্তু বাস্তবে ছিলেন ঘোরতর ব্রাহ্মণ্যবাদী। কয়েকটিউদ্ধৃতির মাধ্যমে বিষয়টি প্রমাণিত হবে।
১. "দেবেন্দ্রনাথকেও দেখা যাচ্ছেদুর্গো পূজার সময় পূজোর সব ব্যবস্থা করে দিয়ে পূজোর কটা দিন সরে পড়তেন অন্য কোথাও।" (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতিবসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়. ৩৬)।
২. দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হিন্দু পদ্ধতিতেই করেন। তাঁর যুক্তি ছিল, "মাতাপিতাস্ত্রী,পুত্রকে দুঃখ দিয়ে স্বজাতি হইতে পৃ ক হওয়া কর্তব্য নহে।" (দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলীপৃ. ৫০)।
৩. ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীদের পৈতে ত্যাগ করা জরুরী ছিল। দেবেন্দ্রনাথ নিজে পৈতে ত্যাগ করলেও পুত্র রবীন্দ্রনাথের যথারীতি উপনয়ন অনুষ্ঠান করে পৈতে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। (রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিতপৃ. ১৯৯)।
৪. ব্রাহ্মদের মধ্যে জাতিভেদ প্র া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এতদ্সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠান থেকে রাজনারায়ণ বসুকে শূদ্র বলে অপমান করে বহিষ্কার করা হয়েছিল। (ঐপৃ. ১৯৯)।
৫. রবীন্দ্রনাথ যখন পিতা হলেন তখন পুত্র রথীন্দ্রনাথের উপনয়নের ব্যবস্থা করা হয়। উপনয়নের সময় রথীন্দ্রনাথকেহিন্দু নিয়মে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে ঘুরতে হয়েছিল এবং তিনদিন যাবত শুদ্র বা ছোটলোকের মুখদর্শন থেকে বিরত রাখার জন্য ঘরে আবদ্ধ রাখা হয়েছিল। (ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিতসরকার শাহাবুদ্দীন আহমদপৃ. ১৩০)
৬. বাংলা ১৩১১ সালে দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যু হলে নোবেল পাওয়া কবিব্রাহ্ম ধর্মের গুরু রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম থেকে ব্রাহ্মণ হয়েগেলেন এবং হিন্দু ধর্মের নিয়মে স্বীয় সযতড়ব লালিত কেশদাড়িগোঁফ মুণ্ডন করলেন। (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি,পৃ. ১৬৭)।
৭. ব্রাহ্ম ধর্মের কবি রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষে লিখলেন"ভারতবর্ষে যথার্থ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সমাজের অভাব হইয়াছেÑ দুর্গতিতে μান্ত হইয়া আমরা সকলে মিলিয়াই শুদ্র হইয়াছি।আরও লিখলেনআমি ব্রাহ্মণ আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার সংকল্প হৃদয়ে লইয়া যথাসাধ্য চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছি। (এপ্রিলÑ১৯০২, 'প্রবাসী', পৃ. ৬৫৭)
৮. রবীন্দ্রনাথ সাধারণ কোন ব্রাহ্ম ছিলেন না। তিনি ছিলেন আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক। মুখে ব্রাহ্ম হলেও তিনিছিলেন কর্মে ব্রাহ্মণ। তাই তিনি লিখতে পারলেনÑ
"বেদব্রাহ্মণরাজা ছাড়া আর
কিছু নাই ভবে পূজা করিবার।" (পূজারিনী দেখুন)
উপরোক্ত অবস্থায় কেউ যদি রবীন্দ্রনাথকে ভণ্ড-প্রতারক বলে অথবা কট্টর বর্ণবাদী বলে তবে তাঁর মুখ বন্ধ করার যুক্তি কী?
রবীন্দ্র রাজনীতির স্বরূপ
রবীন্দ্র যুগে এদেশ পরাধীন ছিল। তখন এদেশে অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামে এদেশ আলোড়িত হয়েছিল। যথাÑ স্বাধীনতারআন্দোলনস্বরাজ আন্দোলনস্বদেশী আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। উক্ত আন্দোলনসমূহে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা কি ছিল তার নিরিখেই আমরা বিচার করব রবীন্দ্র রাজনীতির স্বরূপ কি ছিললক্ষ্য- উদ্দেশ্য কি ছিল?
স্বাধীনতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ
১. রবীন্দ্রনাথ স্বাধীনতা বা ফ্রীডমকে ভাল চোখে দেখেননি। পশ্চিমী রাষ্ট্রদর্শনে যাকে ফ্রীডম বলা হয়রবীন্দ্রনাথ তাকেচঞ্চলভীরুস্পর্ধিত ও নিষ্ঠুর আখ্যা দিয়েছেন। (রবীন্দ্র রচনাবলীভারতবর্ষ ও স্বদেশখণ্ড ১২পৃ. ১০২৫)।
২. সমাজ বিরোধীরা অন্যায়খুনজখম করে যেমন অপরাধী হয়রাজনৈতিক নেতাদের স্বাধীনতার নামে হত্যালুটপাটকেও রবীন্দ্রনাথ ঐরকম সমান অপরাধ মনে করতেন। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : দণ্ডনীতিপ্রবাসীআশ্বিন ১৩৪৪)।
৩. ইংরেজ শাসনের পক্ষে তিনি লিখেনÑ "রাগ করিয়া যদি বলি, 'না আমরা চাই নাতবুও আমাদিগকে চাহিতেই হইবে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এক হইয়া মহাজাতি বাঁধিয়া উঠিতে না পারি ততক্ষণ পর্যন্ত ইংরেজ রাজত্বের যে প্রয়োজন তাহা কখনোই সম্পূর্ণ হইবে না" (ড. অরবিন্দ পোদ্দাররবীন্দ্রনাথ : রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বপৃ. ১৩৩)।
৪. কবি আরও লিখেনইংরেজদের আহবান আমরা যে পর্যন্ত গ্রহণ না করিবতাহাদের সঙ্গে মিলন যে পর্যন্ত না সার্থক হইবেসে পর্যন্ত তাহাদিগকে বলপূর্বক বিদায় করিবএমন শক্তি আমাদের নাই। যে ভারতবর্ষ অতীতে অঙ্কুরিত হইয়া ভবিষ্যতের অভিমুখে উদ্ভিনড়ব হইয়া উঠিতেছেইংরেজ সেই ভারতের জন্য প্রেরিত হইয়া আসিয়াছে। সেই ভারতবর্ষ সমস্তমানুষের ভারতবর্ষ আমরা সেই ভারতবর্ষ হইতে অসময়ে ইংরেজকে দূর করিবআমাদের এমন কী অধিকার আছেবৃহৎ ভারত বর্ষের আমরা কে? (ড. পোদ্দারপৃ.১৩৫)।
ইংরেজদের বশংবদ গোলাম রবীন্দ্রনাথের উক্তরূপ আরও বহু স্বাধীনতাবিরোধী মন্তব্য ও উক্তি রহিয়াছে। পাঠক মহলইবিবেচনা করে দেখবেন এই স্বাধীনতাবিরোধী সাম্রাজ্যবাদের গোলাম রবিবাবু স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের আদর্শ হতে পারে কিনাভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের নিকট আত্মসমর্পিত বাঙালীদের জন্যই রবীন্দ্রনাথ আদর্শস্থানীয় হতে পারেতার সাহিত্য প্রেরণার উৎস হতে পারে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ
প্রশাসনিক সুবিধার্থে ব্রিটিশ সরকার যখন বৃহত্তর বঙ্গকে দুই ভাগ করে পূর্ব বাংলা ও আসামকে একটি প্রদেশের মর্যাদা দিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে তখন বাঙালী বাবু সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা পর্যন্ত বাঙালী হিন্দু সমাজ কখনো ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদও করেনি। অথচ উক্ত ১৪৮ বছর বাংলার ও ভারতের মুসলমানগণ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসংখ্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেঅগণিত মানুষ আহতনিহতপঙ্গুদীপান্তর ও কারান্তরালে গিয়েছিলেন। মুসলমানদের এ সকল আন্দোলনে বাঙালী হিন্দুরা বরাবরই প্রকাশ্যে ব্রিটিশের পক্ষে ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। বঙ্গভঙ্গে বাঙালী হিন্দুদের স্বার্থে আঘাত লেগেছিল এবং মুসলমানদের উনড়বতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল বিধায় তথাকথিত মানবতাবাদী কবি ব্রিটিশের গোলামীর পরিবর্তে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
১৯০৫ সালের ২৪ ও ২৭ সেপ্টেম্বরে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী দু'টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলিকাতাতে। রবিবাবু উভয় সভার সভাপতি ছিলেন।
কলিকাতার হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গ বিভাগ দিবস ১৬ অক্টোবরকে 'শোক দিবসহিসেবে পালন করে। কংগ্রেস শোক দিবসউপলক্ষে নিুোক্ত কর্মসূচি পালন করে।
১. রাখী বন্ধন উৎসবÑ রবিঠাকুর এর প্রবক্তা। হিন্দুদের 'মঙ্গল সুতাবন্ধনের আদলে ঐদিন বাহুতে রঙিন ফিতা বাঁধার ব্যবস্থা করা হয়।
২. উপবাস ব্রত পালন- খুব সকালে উপবাস অবস্থায় খালি পায়ে হেঁটে আত্মশুদ্ধির জন্য গঙ্গাসড়বানে যেতে হবে। এই শোক দিবসের গঙ্গাসড়বান অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রার্থনা সঙ্গীত গাইলেন। সমবেত বাঙালী বাবুরা উক্ত গানটিউচ্চস্বরে গাইলেন।
বাংলার মাটিবাংলার জল
বাংলার বায়ুবাংলার ফল
পুণ্য হউকপুণ্য হউক,পুণ্য হউক
হে ভগবান।
বাংলার ঘরবাংলার হাট
বাংলার বনবাংলার মাঠ
পূর্ণ হউকপূর্ণ হউকপূর্ণ হউক
হে ভগবান
বাঙালীর পণবাঙালীর আশা
বাঙালীর কাজবাঙালীর ভাষা
সত্য হউকসত্য হউকসত্য হউক
হে ভগবান।
বাঙালীর প্রাণবাঙালীর মন
বাঙালীর ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক এক হউক এক হউক
হে ভগবান।
ভগবানের নিকট প্রার্থনা শেষে রাখীবন্ধন অনুষ্ঠান করা হয়।
একই দিন বিকেলে রবি ঠাকুর পার্শী বাগান মাঠে অখণ্ড বাংলার 'বঙ্গ ভবনস্থাপনের উদ্দেশ্যে ফেডারেশন হলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্য ছিল-
"যেহেতু বাঙালী জাতির সর্বাঙ্গীন প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করিয়া পার্লামেন্ট বঙ্গের অঙ্গ ছেদন করিয়াছেনসেহেতু আমরা প্রতিজ্ঞাকরিতেছি যেবঙ্গের অঙ্গছেদের কুফল নাশ করিতেবাঙালী জাতির স্বার্থ সংরক্ষণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙালী আমাদেরশক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব তাহার সকলই প্রয়োগ করিব।" (আহসানুল্লাহঅখণ্ড বাংলার স্বপড়বপৃ. ৮২০-৮৩)।
রবিঠাকুরের অন্য রূপ
বাংলায় এবং ভারতে ব্রিটিশবিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে রবি ঠাকুর সকল আন্দোলনে ইংরেজদের পক্ষে ছিলেন। ১৭৫৭ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ইঙ্গ-হিন্দু শাসন-শোষণে ভিক্ষুকে পরিণত হওয়া মুসলমানদের পক্ষে তার কলম থেকে একটি শব্দও বের হয়নি। কিন্তু আন্দোলন সংগ্রাম করেও যখন বঙ্গভঙ্গকে ঠেকানো গেল না তখন তিনি মুসলমানদের সহানুভূতি লাভে কিছু কিছু ভালো ভালো কথা লিখার চেষ্টা করেছেন।
গরজ বড় বালাই। রবিবাবুর জমিদারীর এলাকা ছিল খণ্ডিত পূর্ব বাংলায়। এমতাবস্থায় পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করা বন্ধ করে কবি তাঁর লেখনীকে অসাম্প্রদায়িক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শত হলেও তিনি ছিলেনব্রাহ্মণদের চেয়েও গোঁড়া। তাই শব্দ চয়নে অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করলেও ভাবের দিক থেকে কবির লেখনী আগের মতই থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ এরূপ দু'টি জনপ্রিয় কবিতার বিষয় পাঠকদের অবগতির জন্য পেশ করছি। একটি পূর্বেই উদ্ধৃত হয়েছে : যথাÑ
বাংলার মাটি বাংলার জল ... .... ....
বাঙালীর কাজ বাঙালীর ভাষা
সত্য হউকসত্য হউকসত্য হউক
হে ভগবান।
অসাম্প্রদায়িক হওয়ার চেষ্টা করেও তিনি 'জল'কে পানি বলতে পারেননিহিন্দু কালচারের 'তিন সত্যি'কে আঁকড়ে ধরেছেন এবং ভগবান শব্দের পরিবর্তে স্রষ্টা বা অন্যকিছু বলতে পারেননি।
অপর গানটি বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজীবন ফ্রীডম বা স্বাধীনতা বিরোধী লেখকের কবিতা ও গান স্বাধীনতার চেতনা কতটুকু শাণিত করে তা আমি জানি না। তবে উক্ত গানটিও যে কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী বঙ্কিমচন্দ্রের 'বন্দে মাতরমগানের আদলে রচিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের 'বন্দে মাতরমকবিতাটিতে মায়ের বন্দনা করা হয়েছে। এই মা বলতে বঙ্কিম কি বুঝাতে চেয়েছেন পাঠকবৃন্দ লক্ষ্য করুন : পশ্চিম বঙ্গের প্রখ্যাত গবেষক ড. অরবিন্দু পোদ্দারের মতে,
"... বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তাবাদকে একটা ধর্মীয় আধ্যাত্মিক আলোকে মণ্ডিত করেন। ভারতবর্ষ নামক যে একটি ভৌগোলিকসত্তাতাকে তিনি মাতৃরূপে উপলব্ধি করতে চেয়েছেনএই মাতৃ ভাবনা স্বর্গীয় দেবী ভাবনার সমতুল্য। 'বন্দে মাতরম'সঙ্গীতে তিনি দেশ জননীকে দুর্গালক্ষ্মী ও স্বরস্বতীর সঙ্গে একাত্ম বলে বর্ণনা করেছেন।... অন্য কথায়হিন্দু রাজত্ব স্থাপন এবং তারই অনুপ্রেরণায় ভবিষ্যত ভারতকে নির্মাণ করার আদর্শ তিনি (শ্রী অরবিন্দু) প্রচার করেছিলেন।... হিন্দু ঐতিহ্য আশ্রিত সমস্ত লেখকের দৃষ্টিতেই... সৃজনধর্মী ও বুদ্ধিমার্গীয় উভয়ত:... শ্রীকৃষ্ণই হলেন একমাত্র পুরুষ যিনি বর্তমানের পরাধীন ও শত লাঞ্ছনায় ছিনড়বভিনড়ব ভারতবর্ষকে এক শক্তিশালী প্রগতিশীল দুর্জয় সত্তায় রূপান্তরিত করতে পারেন।... তাঁদের সুদূর বিশ্বাস কেবলমাত্র হিন্দু দার্শনিক চিন্তাজীবদর্শন এবং এর সংশেষবাদী ধর্ম দ্বারাই অতীতে এই বিরাট ভূখণ্ড ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ঐক্য অর্জিত ও সুরক্ষিত হয়েছিল এবং ভবিষ্যতেও পুনরায় সেই আদর্শের শক্তিতেই নবভারতের আবির্ভাব ঘটবে।" (রবীন্দ্রনাথ/ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব : ১৯৮২ 'উচ্চারণকলিকাতা)
হিন্দু ঐতিহ্য 'মাবলতে কাকে বুঝায়মায়ের কষ্টে সন্তানদের কি করা উচিত তা ১৯০৮ সালের ৩০ মে কলিকাতার যুগান্তর পত্রিকায় লেখা হয়েছিল:
"মা জননী পিপাসার্ত হয়ে নিজ সন্তানদেরকে জিজ্ঞেস করছেএকমাত্র কোন বস্তু তাঁর পিপাসা নিবারণ করতে পারে?মানুষের রক্ত এবং ছিনড়বমস্তক ব্যতীত অন্য কিছুই তাকে শান্ত করতে পারে না। অতএব জননীর সন্তানদের উচিত মায়ের পূজা করা এবং তার ইপ্সিত বস্তু দিয়ে সন্তুষ্টি বিধান করা। এসব হাসিল করতে যদি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়তবুও পশ্চাদপদ হওয়া উচিত হবে না। যেদিন গ্রামে গ্রামে এমনিভাবে মায়ের পূজা করা হবেসেদিনই ভারতবাসী স্বর্গীয় শক্তি ও আশীর্বাদে অভিষিক্ত হবে" (ইবনে রায়হান বংগভংগের ইতিহাসপৃ. ৬-৭)।
'বন্দে মাতরম'-এর খণ্ডিত 'মা'কে অখণ্ড করার জন্য প্রাণঅর্থবিদ্যামনসংসারকে পণ করে যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু হয়তার সাথেও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল। (বাংলার বিপ্লববাদশ্রী নলিনী কিশোর গুহপৃ. ৭৭৭৮)।
প্রিয় পাঠকবৃন্দউপরোক্ত উদ্ধৃতিতে হিন্দু ঐতিহ্যের 'মাকিন্তু ভক্তের রক্ত ও ছিনড়ব মস্তকে খুশী নন। তিনি ভক্তদেরকে মানুষ (মুসলমান নয় কি?) হত্যা করে উক্ত মানুষের রক্ত ও মস্তকের বিনিময়ে স্বর্গীয় শক্তি ও আশীর্বাদের ওয়াদা করেছেন। এমতাবস্থায় বঙ্কিমের মারবি ঠাকুরের মা এবং হিন্দু দেবী কি এক ও অভিনড়ব নয়মনে রাখা প্রয়োজন,উক্ত সময়ে উপমহাদেশেবিশেষত: বাংলায় হিন্দুরা মা কালীর নিকট শপথ নিয়ে মুসলমান হত্যায় মেতে উঠেছিল। বাংলায় অসংখ্য গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছিল।
উক্ত সময়ে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক রচিত হয়েছিল মাতৃবন্দনার গান :
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি
... .... ....
'মাতোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন
ও 'মাআমি নয়ন জলে ভাসি।
লক্ষণীয়১৯০৫-০৬ সালে হিন্দু বাংলা ছিল সোনার বাংলা কিন্তু মুসলিম বাংলা বা পূর্ব বাংলা ছিল ভিক্ষুকের বাংলা,অবহেলিতলাঞ্ছিত নিপীড়িতম্লেচ্ছযবন ও অস্পৃশ্যদের বাংলা। এমতাবস্থায় কবি কোন বাংলাকে উদ্দেশ্য করে গানটি রচনা করেছিলেন তা সহজেই অনুমেয়।
অপরদিকে যুগান্তরে প্রকাশিত 'মাছিল পিপাসায় কাতর আর রবীন্দ্রনাথের 'মা'- এর বদনখানি মলিন। মায়ের মলিন বদনদেখে কবির চোখ অশ্র"সজল। বঙ্গভঙ্গ না হলে নিশ্চয়ই কবির চোখ অশ্র"সজল হতো নাকবি এত সুন্দর গান রচনা করতেন না। এ জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য ব্রিটিশ রাজশক্তিরতাই পাঠকবৃন্দ সমস্বরে গেয়ে উঠুনÑ
'জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা..."
'স্বরাজআন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ '
স্বরাজআন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উগ্র হিন্দুবাদী নেতা বালগঙ্গাধর তিলক। তিনি উচ্চবর্ণের হিন্দুদেরকে মুসলমান ওনিমড়ববর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। কুখ্যাত দস্যু সর্দার শিবাজীকে ভারতের জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠাকল্পে তিনি গণপতি উৎসব ও শিবাজী উৎসব প্রচলন করেন। তার প্ররোচনায় ভারতের দিকে দিকে প্রধানত বাংলায় প্রচণ্ড হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। তিলক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মাধ্যমে হিন্দুদেরকে সংগঠিত করে ভারতবর্ষে রামরাজত্ব স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ শুরু থেকেই স্বরাজ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। শ্রী অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন, "তাতে দেখতে পাচ্ছি তিলক তার দূত হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে ইউরোপে পাঠাতে চেয়েছিলেন এবং সে বাবদ রবীন্দ্রনাথকে ৫০ হাজার টাকা দিতেচেয়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে কবি এ প্রস্তাবে রাজী হননি। মি. চৌধুরী আরও লিখেছেন, "আগেই বলেছি তিলকের লক্ষ্য ছিল হিন্দু স্বরাজ। প্রশড়ব উঠতে পারে রবীন্দ্রনাথ কি করে এরূপ লক্ষ্যধারী রজনৈতিক নেতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তিলকের সহিংস আন্দোলনে দেশে অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৭ সালে তিলককে গ্রেফতার করে। রবীন্দ্রনাথ নিজে উদ্যোগী হয়ে 'তিলকমুক্তির জন্য চাঁদা সংগ্রহ করে পুনেতে পাঠান। (দ্র: ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ : শ্রী অমিতাভ চৌধুরী১৪০০ সালপৃ. ৬)
রবীন্দ্রনাথের কর্মকাণ্ডে ব্রিটিশ সরকার নাখোশ হলে তিনি স্বরাজ আন্দোলনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন এবং লিখেনÑ "স্বরাজতো আকাশ কুসুম নয়একটা কার্য পরম্পরার মধ্য দিয়াতো তাহাকে লাভ করিতে হইবে। নতুন বা পুরাতন যে দলই হোন তাঁহাদের সেই কাজের তালিকা কোথায়তাহাদের প্লান কিতাহাদের আয়োজন কিকর্মশূন্য উত্তেজনায় এবংঅক্ষম আস্ফালনে একদিন একান্ত ক্লান্তি ও অবসাদ আসিবেইÑ ইহা মনুষ্য স্বভাবের ধর্মÑ কেবল মদ যোগাইয়া আমাদিগকেসেই বিপদে যেন লইয়া যাওয়া না হয়।" (রবীন্দ্রনাথ/ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বপৃ. ১৪৬, 'উচ্চারণকলিকাতা)।
রবীন্দ্রনাথের মুসলিম বিদ্বেষ
জোড়া-সাঁকোর ঠাকুর পরিবার মূলত : By the British, of the British & for the British empire. সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট উক্ত পরিবার বংশানুμমিকভাবে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের অনুকূলেই সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। উক্ত পরিবারের উগ্রহিন্দুত্ব এবং সময়ে সময়ে মুসলমানদের অনুকূলে ছিঁটেফোটা বক্তব্য প্রদানও মূলত: ব্রিটিশের স্বার্থেই নিবেদিত ছিল। রবীন্দ্রনাথের চরিত্রও এর ব্যতিμম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ কোন কোন সময় স্বীয় গোষ্ঠীস্বার্থে অথবা প্রভুর স্বার্থে পরস্পর বিরোধী যেসকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন তা যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। আলোচনার এই অংশে তাঁর মুসলিম বিদ্বেষের ঐতিহাসিক তথ্যাদি উপস্থাপিত হলো।
১. "কবি রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের পূর্ণ মুসলমান হয়ে থাকাটা বোধ হয় পছন্দ করতেন না। সেই জন্য তিনি বলতেন, 'মুসলমানেরা ধর্মে ইসলাম অনুরাগী হলেও জাতিতে তারা হিন্দু। কাজেই তারা হিন্দু মুসলমান'" (আবুল কালাম সামসুদ্দীন,অতীত দিনের স্মৃতিপৃ. ১৫০)।
২. মরহুম মোতাহের হোসেন চৌধুরী শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনআপনার লেখায় ইসলাম ওবিশ্বনবী সম্পর্কে কোন লেখা নেই কেনউত্তরে কবি বলেছিলেন, "কুরআন পড়তে শুরু করেছিলুমকিন্তু বেশিদূর এগুতেপারিনিআর তোমাদের রসুলের জীবন চরিতও ভাল লাগেনি"। (দ্র: বিতণ্ডা : সৈয়দ মুজিব উল্লাহপৃ. ২২৯)।
৩. মুসলমান শ্রমিকদের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে বিরক্ত কবি লিখলেন : "কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রখণ্ড হাতে উপদ্রপের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যেলক্ষ্যটা বিশেষরূপে ইংরেজের প্রতি। তাহাদের যথেষ্ট শাস্তিও হইয়াছিল।... কেহ বলিল মুসলমান বস্তিগুলো একেবারে উড়াইয়া পুড়াইয়া দেওয়া যাক। (রবীন্দ্র রচনাবলী১০ম খণ্ডপৃ. ৪২৮-৪২৯)। (অথচ কবিবাবু হিন্দু সন্ত্রাসীদের বাড়িঘরউড়াইয়া পোড়াইয়া দেওয়ার কথা কখনও বলেননি)।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবিরবিরোধিতা : আমাদের দেশের একশ্রেণীর জ্ঞানপাপীঅন্ধ রবীন্দ্র ভক্ত অথবাব্রাহ্মণ্যবাদের দালাল গোষ্ঠী উচ্চকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের কথাওফলাও করে প্রচার করেন অথচ এসকল প্রচারণার সাথে ঐতিহাসিক সত্যের কোন সম্পর্ক নাই। অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বলেনকবি ১৯০৬ সাল থেকে মুসলমানদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হয়ে তাঁর লেখনী পরিচালিত করেছেন কিন্তু ইতিহাস তা সাক্ষ্য দেয় না। সংক্ষেপে রবীন্দ্র জীবনী পর্যালোচনা করলে ব্যাপারটি বুঝা যাবে।
"কবি কিশোর বয়স থেকে মুসলমান বিরোধী কবিতা/ গান রচনা করেছেন। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর কলিকাতার সাম্প্রদায়িক নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে একের পর এক মুসলিম বিরোধী কবিতা-গান রচনা করেছেন। কবি উগ্রসাম্প্রদায়িক মুসলিম বিরোধী বালগঙ্গাধর তিলকঅরবিন্দ পাল ও লালা লাজপত রায়ের সাথে μিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের সূচনা থেকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। কোনভাবেই যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করাসম্ভব হয়নি তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে না গিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে মুসলমানদের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করেছেন। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত কবি মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন এই জন্য যেনতুন পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশেই ছিলকবির জমিদারী। প্রজারা প্রায় সকলেই ছিল মুসলমান। এমতাবস্থায় নিজ জমিদারীকে নির্বিঘড়ব করার জন্য এবং ইংরেজ প্রভুদেরকে খুশী করার জন্য তিনি কিছুদিন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু যখন ১৯১২ সালে ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করার ঘোষণা দেয় তখনই কবি পুনরায় স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেন।
১. ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে এক বিরাট সমাবেশ করা হয়। তখন কবির বয়স ছিল ৫১ বছর। ঠিক তার দু'দিন পূর্বে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছিল। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যেঢাকায় ইউনিভার্সিটি হতে দেওয়া যাবে না। ঐ গুরুত্বপূর্ণ সভায় বাঘা বাঘা হিন্দু নেতারা উপস্থিত ছিলেন। নতুন রাজ্য পুনর্গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন কিনাবা শিক্ষা বিষয়ে করণীয় কিআলোচনার জন্য এক জনপ্রতিনিধিত্বপূর্ণ সভা হয় কলকাতার টাউন হলে। উক্ত উভয় সভার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। (কলকাতা ইতিহাসের দিনলিপিড. নীরদ বরণ হাজরা২য় খণ্ড৪র্থ পর্ব)।
২. "তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ চাননি যেতার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত মুসলমান কৃষক ও শ্রমিক সন্তান এবং অনুনড়বতরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের আলো পেয়ে ধন্য হোক।... বলতে আরো লজ্জা হয় যেকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে সেই সময়কার ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে (যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না হয় তার জন্য) ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। নীচতা এত নীচে নেমেছিল যেতাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদ্রƒপ করেবলতেন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়।" (তথ্যজীবনের স্মৃতিদ্বীপে : ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারআবুল আসাদের ১০০ বছরেররাজনীতি থেকে উদ্ধৃতপৃ. ৭২) (উলে-খ্যউক্ত আশু বাবু ছিলেন রবি ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়)
৩. ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দুরা প্রতিবাদ সভা ডাকে। প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কারণ তিনি ছিলেন জমিদার। তিনি মুসলমান প্রজাদের মনে করতেন গৃহপালিত পশু। (নীরদ চন্দ্র চৌধুরীদি অটোবায়োগ্রাফী অব আননোন ইন্ডিয়া)।
৪. তখনকার ষড়যন্ত্রের কারখানা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৬-এর ১১ সেপ্টেম্বর আরবিফার্সী মিশ্রিত চলতি বাংলা ভাষার শব্দ ও বানান পরিবর্তন যজ্ঞে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত স্বীকৃতি দেন। রবিবাবুর স্বাক্ষরের তলায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও সই করেন। ( গোলাম আহমাদ মোর্তজাএ এক অন্য ইতিহাসপৃ. ১৬৬)।
৫. বিভাগ-পূর্ব ভারতের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি উঠলে রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিবাদ করে বলেন : "ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম শাসন কায়েম হবে। সে জন্য হিন্দুদের মারাত্মক ভুল হবে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেয়া।"... "মহাত্মা গান্ধীকে মুসলমানেরা পুতুলে পরিণত করেছে। তুরস্ক ও খেলাফতের সাথে হিন্দু শাস্ত্রের কোন সংশ্রব নেই।(সাপ্তাহিক সুলতান১৯২৩ সালের জ্যেষ্ঠ সংখ্যা)।
যা বলছিলামরবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালের আগে মুসলমানদের পক্ষে একটি লাইনও লিখেননিএকটি কথাও বলেননি। ১৯০৬ সাল থেকে মাঝে মাঝে কিছু বলার চেষ্টা করেছেন তবে যখনই দেখেছেন কোন কারণে মুসলমানরা লাভবান হচ্ছে তখনই তিনি ভদ্রতারমানবতার মুখোশ ছুঁে ড় ফেলে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাঁর স্বরূপ কি ছিল তা সহজেই অনুমেয়। প্রমত তিনি ছিলেন একজন মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক হিন্দু কবিদ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবী। বিদেশেও রবীন্দ্রনাথকে এরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
১৯১৬ সালের ৬ অক্টোবর সানফ্রান্সিসকো একজামিনার পত্রিকায় লিখা হয়েছিলÑ বাংলায় "গতকাল নোবেল প্রাইজ বিজয়ী হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হত্যার চμান্তের সংবাদ পুলিশের নিকট পৌঁছামাত্র প্যালেস হোটেলে তার এপার্টমেন্টে এবং কলম্বিয়া থিয়েটারে যেখানে বিকালে তার ভাষণ দেবার কথা ছিল সেখানে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।" [পত্রিকাটি রবীন্দ্রনাথকে 'হিন্দু কবিবলেছে। সত্যি তিনি হিন্দু কবি ছিলেন। মুসলমানের জন্য এক বর্ণও লিখেননি। মুসলমানের প্রতি ছিল তার তীব্র ঘৃণা। (অধ্যাপক আহমদ শরীফের স্বীকারোক্তি।)]
(তথ্য : সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদআত্মঘাতী রাজনীতির তিনকালপৃ. ৪৭১)
�� রবীন্দ্র চরিত্রের বৈপরীত্য-
রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন একই সরলরেখায় চলেননি। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কট্টর সাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম বিদ্বেষী। চরমপন্থী তিলকদস্যু সর্দার শিবাজীউগ্রবাদী লালা লাজপত রায় থেকে আরম্ভ করে সকল সন্ত্রাসীদের পক্ষে এবংমুসলমানদের বিরুদ্ধে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। প্রত্যেক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনেমুসলিম স্বার্থবিরোধী সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের সূচনাতে এবং বিস্তার লাভ পর্যন্ত সময় তিনি উক্ত আন্দোলনে যথাসাধ্য অবদান রাখতেন। কিন্তু উক্ত আন্দোলন যখন ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়তো তখন কবিকে দেখা যেত বিপরীত ভূমিকায় অথবা নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়চরম মুসলিম বিরোধী তিলকের নেতৃত্বে সংগঠিত শিবাজী উৎসবেগরুরক্ষা আন্দোলনে কবি সূচনাতে ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার পর্যন্ত কবি নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতায় তিনি পুরোভাগে ছিলেন। বিশের দশকের খেলাফত আন্দোলন ও তিরিশের দশকের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনেও কবি খোলাখুলি হিন্দু স্বার্থের পক্ষে ও মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন। উক্ত আন্দোলনসমূহ যখন সরকারের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের পর্যায়ে পৌঁছাত তখন কবির অন্যরূপ দেখা যেত। ব্যাপারটি অনেকটা এরকম : "তিনি ভয়াবহদাবানল সৃষ্টি করতেন এবং পরে দূরে বসে ভস্মীভূত ছাইভস্মের পক্ষে কলম ধরতেন।এটার আর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এই, "তিনি মনের তাগিদে সাম্প্রদায়িক আগুন প্রজ্বলিত করতেন কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের ইচ্ছায় নিজেকে সংযত করতেন।এর আরও একটি ব্যাখ্যা হতে পারে আর তা হলো, "তিনি পারিপার্শ্বিক প্রভাবে সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যেতেন কিন্তু পরবর্তীতে এর ভয়াবহ রূপ দেখে ভয়ে বা বিবেকের তাড়নায় পিছিয়ে আসতেন।"
উপরোক্ত সিদ্ধান্তসমূহ ইতিহাসের আলোকে আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কেউ আমার সাথে একমত না হলে আমার কোন দুঃখ নেই। বাংলাদেশের অসংখ্য রবীন্দ্রভক্তের শুভ দৃষ্টি লাভে আমি অনেক চেষ্টা করে দেখেছি রবীন্দ্রনাথের জীবনকে কয়েকটি ভাগ করে অন্তত একটি ভাগকেও অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী বলা যায় কিনাকিন্তু আমি হতাশ হয়েছি। আমারহতাশার কারণ নিমড়বরূপ :
১. ১৯০৫ সালে কবির বয়স ছিল ৪৫। অর্থাৎ তিনি তখন কোন আবেগতাড়িত তরুণ-যুবা ছিলেন নাতবু তিনি শুধুমাত্র নিজ গোষ্ঠীস্বার্থে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন।
২. ১৯০৬ সাল থেকে কবি কিছুটা ভিনড়বরূপে আবির্ভূত হলেন। ১৯০৬ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত দেখা গেল তিনি তাঁর প্রবন্ধে হিন্দুমুসলিম বিরোধ সম্পর্কে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করছেনউভয় সম্প্রদায়ের সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য প্রবন্ধ লিখছেনবক্তৃতা দিচ্ছেন। এ সময়টা ছিল বঙ্গভঙ্গের যুগ।
৩. কিন্তু ১৯১২ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলো এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হলো তখন কবি আবার ১৯০৪-০৫ এর ভূমিকায় ফিরে এলেন। হিন্দু-মুসলিম সমতার কথাসম্পর্ক বৃদ্ধির কথা ভুলে গেলেন। তিনি আবার কট্টর বর্ণ হিন্দুতে পরিণত হলেন।
৪. ১৯১৪ সাল থেকে কবি পুনরায় মুসলমানদের পক্ষে সহানুভূতিপূর্ণ দু'চারটা প্রবন্ধবাণী লিখতে শুরু করলেন। আমরা ধরে নিলাম তাঁর বোধোদয় হয়েছে।
কিন্তু খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনকালে গান্ধীর নেতৃত্বে যখন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেঝাঁপিয়ে পড়ে তখন কবি আবার সাম্প্রদায়িক বর্ণ হিন্দু হয়ে গেলেন এবং বললেন"ভারতে স্বায়ত্তশাসন এলে মুসলমান শাসন কায়েম হয়ে যাবে"। তিনি হিন্দুদেরকে যৌথ আন্দোলন থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেন।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেরও বিরোধিতা করেছেন কবিকারণ মুসলিম 'ফোবিয়া'। ১৯৩৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে ষড়যন্ত্রের কারখানা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবির নেতৃত্বে আরবিফাসীর্  মিশ্রিত চলতি বাংলা ভাষার শব্দ ও বানানপরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে কোন কোন সময় নিজেকে মুসলিম হিতৈষী হিসেবে প্রমাণ করেছেনকিন্তু কাব্যেনাটকে,উপন্যাসে তিনি ছিলেন বর্ণবাদী হিন্দু। সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্য মূল্যায়ন করলে বলা কঠিনতিনি আসলে কি ছিলেনতিনি কি ব্রাহ্মনাকি হিন্দুনা বাউলনা সুবিধাবাদী। তবে প্রত্যেকেই নির্দ্বিধায় বলতে পারবেনকবি ব্রিটিশের এজেন্ট হিসেবে কোনরূপ বৈপরীত্য দেখাননি। তবে হ্যাঁ এখানেও কথা থাকতে পারে। জীবনের সর্বশেষ বছরে তিনি দু-একটি সত্য কথা স্বীকার করেছেনআর তা হলো :
১. "আর মিথ্যা লেখার প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দুমুসলমােনর মাঝখানে প্রকট বিরোধ আছেআমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তা নয়Ñ আমরা বিরুদ্ধ।... (রবীন্দ্র রচনাবলী১০ম খণ্ডপৃ.৬২৮)। ঠাকুরের কথায় কেউ যদি প্রশড়ব করে এতদিন মিথ্যা লেখার প্রয়োজন ছিল এখন হঠাৎ প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল কেনএর জবাব কী?
২. "আজ আমি বলিতেছিভারতবর্ষের দীনতমমলিনতম কৃষককে আমি ভাই বলিয়া আলিঙ্গন করিবআর ঐ যে রাঙ্গা সাহেব টম্টম্ হাঁকাইয়া আমার সর্বাঙ্গে কাদা ছিটাইয়া চলিয়া যাইতেছে উহার সহিত আমার কানাকড়ির সম্পর্ক নাই।" (রবীন্দ্র রচনাবলী১২শ খণ্ডপৃ. ৫৬)।
৩. "আমার পৃথিবীর মেয়াদ সংকীর্ণ হয়ে এসেছেঅতএব আমাকে সত্য হবার চেষ্টা করতে হবেপ্রিয় হবার নয়।" (রাশিয়ার চিঠিপৃ. ৫৯)।
অতএব বুঝা গেল কবি এতদিন ব্রিটিশ সরকার ও বর্ণবাদী হিন্দুদের প্রিয় হওয়ার জন্য সত্য থেকে দূরে ছিলেন। মৃত্যুর হাতছানি দেখতে পেয়ে একেবারে শেষ দিকে তিনি সত্য হওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন। এতদ্সত্ত্বেও তিনি দীনতম,মলিনতম কৃষকদের উনড়বতির জন্য কিছু করেছেন এমন নজির নেই। যথা-
১. "সমগ্র ঠাকুর পরিবার কখনো প্রজার কোন উপকার করেনি। স্কুল করাদীঘি কাটানো এসব কখনো করে নাই। মুসলমান প্রজাদের 'টিটকরার জন্য নমঃশূদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বের হয়েছিল।" (অনড়বদা শংকর রায়দৈনিক বাংলাবাজারতাং ১৪/৪/৯৭ এবং ০১/০৫/৯৭)।
২. "চারিদিকে নিষ্ঠুরতার এবং দুর্নামের প্রতিকূল বাতাসকে অনুকূল করতে রবীন্দ্রনাথের প্রাইভেট সেμেটারী অমিয় চμবর্তী একবার বিশাল জমিদারীর একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রজা সাধারণের জন্য দান করার প্রস্তাব করেছিলেন। ঠাকুর মশাই ইজি চেয়ারে আধশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসে বলেছিলেন"বল কি হে অমিয়আমার রথীন (কবির একমাত্র পুত্র) তাহলে খাবে কী?" (অনড়বদা শংকর রায়ঐ)।
রবি ঠাকুরের আর একটি বৈপরীত্যের বিষয় উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গের ইতি টানছি।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছেমুসলিম বিদ্বেষী বঙ্কিমচন্দ্র মাটির দেশকে রক্ত মাংসের মা বানিয়ে তাতে দেবত্ব আরোপ করে রক্ত ও মস্তকভোজী দেবী বানিয়ে হিন্দুদেরকে সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এবং মাতৃবন্দনার গান 'বন্দে মাতরমরচনা করে সারাদেশে ভয়াবহ হিন্দুমুসলিম সংঘাত বাঁধিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর দীক্ষাগুরু বঙ্কিমের 'বন্দে মাতরমএর আদলে মাতৃবন্দনার গান 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসিলিখে ফেললেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনিই আবার এর বিরুদ্ধাচরণ করে লিখলেন-
১. "মাটির দেশকে মা বানিয়ে নেওয়া হলোআবার দেবীর মত মনে করে দেশ-মায়ের কাছে সাহায্য চাওয়া হলো। কবির মতেওটা একটা নেশা ছাড়া কিছু নয়। তিনি লেখেনকেননাআমি এই বলিদেশকে সাদাভাবে দেশ বলেই জেনে,মানুষকে মানুষ বলেই শ্রদ্ধা করেযারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায় না,Ñ চিৎকার করে মা বলেদেবী ব'লেমন্ত্র পড়ে যাদের কেবলই সম্মোহনের দরকার হয়Ñ তাদের সেই ভালবাসা দেশের প্রতি তেমন নয়যেমন নেশার প্রতি। (ভারতে জাতীয়তাআন্তর্জাতিকতা ও রবীন্দ্রনাথসংগ্রহেÑ অধ্যাপক দীপেন চট্টোপাধ্যায়পৃ. ১২৭)।
২. কবি দেশকে মামাবলে ডাকাকে প্রমে সমর্থন করেছিলেন এবং সেইভাবে গান-কবিতাও লিখেছিলেন। কিন্তু নিজের ভুল নিজেই শুধরে নিয়ে স্পষ্টভাবে দেশের লোককে জানিয়েছেন (ক) "শুধু মামাবলে দেশকে যারা ডাকাডাকি করে তারা চিরশিশু। দেশ বৃদ্ধ শিশুদের মা নয়দেশ অর্ধ নারীশ্বর- মেয়ে পুরুষের মিলনে তার উপলব্ধি।" (চার অধ্যায়,১৯৩৪) (খ) বাংলাদেশের মেট্রিয়ার্কী বাইরে নেইআছে নাড়ীতে। মামাশব্দে হাম্বাধ্বনিতা আর কোন দেশের পুরুষ মহলে শুনেছ কি? (ল্যাবরেটরী১৯৪০ দ্র:) [সংগ্রহ ঐপৃ. ১৯- ২০]
৩. অধ্যাপক দীপেন চট্টোপাধ্যায় কবির জন্য আরও লিখেছেনÑ "রবীন্দ্রনাথ ভাবাদর্শের দিক থেকে এই নগড়ব শক্তির উপাসনার বিরুদ্ধে ছিলেন। ভারতে শক্তি উপাসনা হয়ে আসছে ভয়ংকরী মা কালীর মূর্তিতে। ধার্মিক বিভ্রান্তি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সাধ্যমতো তা প্রত্যাখ্যান করেন। (ঐপৃ. ২০)। (বাঙালীর কবি রবীন্দ্রনাথ নিজের ভুল বুঝতে সক্ষম হলেওবাংলাদেশী এলিটগণ এখনও মামাশব্দের হাম্বাধ্বনির মর্মার্থ বুঝে উঠতে পারেনি)।
রবীন্দ্র প্রতিভা
রবীন্দ্র প্রতিভা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে রবীন্দ্রনাথের সমকালকে অন্তরচোখে উপলব্ধি করতে হবে। আমি অত্রপ্রবন্ধের শুরুতে বলেছিলাম ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছরের মেয়াদে যোগ্যতার মাপকাঠি ব্রিটিশ শাসকদের সন্তুষ্টি অর্জনের পরিমাণের উপর নির্ভর ছিল। শাসককুলের সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম ব্যক্তিগণকে জিরো থেকে হিরোতে পরিণত করা হয়েছিল পক্ষান্তরে বিরুদ্ধবাদীরা যতই যোগ্যতাসম্পনড়ব হোক না কেন তাদেরকে দেশের কোন কর্মকাণ্ডে জড়িত করা হয়নি,তদুপরি তৎকালীন ইতিহাসের কোথাও তাদের নাম পর্যন্ত খুেঁ জ পাওয়া যাবে না।
ব্রিটিশ শাসকগণ বাংলা এবং ভারতকে শাসন করার লক্ষ্যে প্রম ১২০ বছর বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায় থেকে এবং পরবর্তী ৭০ বছর হিন্দুমুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে কিছু লোককে বাছাই করে নিজেদের শাসন-শোষণ পাকাপোক্ত করার জন্য। উক্ত বাছাইকৃত লোকগুলোই ছিল তৎকালীন ইতিহাসের বরপুত্র। তাদের মধ্যে সমাজের সকল পেশার লোকই ছিল। এসব লোকদেরকে ইংরেজী ভাষা লিখতে পড়েত জানলেই চলতো। তাদের হুকুমসমূহ পড়তে পারা এবং কাজ শেষে একটি রিপোর্ট প্রদান করতে পারাই যথেষ্ট ছিল। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী যে নিয়মে তাদের আজ্ঞাবহ চাকর সৃষ্টি করতো তা সাধারণত এইরূপ ছিল।
১. "বঙ্গবাসীকে দিয়ে সারা ভারতবর্ষকে বশে আনতে হলে যাদেরকে নেতা বানানো হবে তাদের কিছুটা শিক্ষিত হতেই হয়। সেইজন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হওয়ার আগে থেকেই বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বা তাদের গৃহভৃত্যের কাজ দিয়ে বা ছোট ছোট স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষিত করার ব্যবস্থা চালু ছিল। ঐ সময়কার তথাকথিত শিক্ষিতযারা স্কুল ফাইনাল বা মেট্রিক পাস ছিল নাঅথচ তাবেদারীগোলামী ও বেঈমানীমূলক কাজ করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মত ও যোগ্যতাদের জন্য ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা করে ফেললএবং ঠিক হলো যেতারা মেট্রিক পরীক্ষায় না বসেও ডিগ্রী পরীক্ষায় বসতে পারবে।" (তথ্য : কলিকাতা ইতিহাসের দিনলিপিড. নীরদ বরণ হাজরা১ম খণ্ডপৃ. ৭৫)
২. "এইসব স্যার উপাধিপ্রাপ্ত পণ্ডিতেরা সকলেই যে খুব পণ্ডিত ছিলেন তা নয়এমন কিছু অপণ্ডিতও এই স্যার'দের দলে ঢুকবার সুযোগ পেয়েছেন যাঁরা আসলেই মূর্খ। কিন্তু ব্রিটিশের বিশ্বাসভাজন হওয়াবিশেষ করে বিপ্লবীদের দমিয়ে দেওয়া,লুকিয়ে থাকা বিপ্লবীদের ধরিয়ে দেওয়াঅকথ্য অত্যাচার চালানোঅনাদায় কর আদায় করতে অকথ্য নির্যাতন চালানোরবিনিময়েই হয়েছিল তাঁদের এই উপাধি।
এসব স্যারদের পাণ্ডিত্যের দু-একটি নমুনা ব্যতীত কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না।
১. মহারাজা স্যার প্রতাপ সিং ইংল্যান্ডে গিয়ে এক সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ মহিলাকে বলতে চেয়েছিলেনপ্রত্যেক মুহূর্তেই এই ইংল্যান্ড আমার ভাল লাগছে। সুন্দর ঘাসের উপর সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ পুরুষ
ও মহিলারা এই যে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াচ্ছেনএটাআমার খুবই ভাল লাগছে। ইংরেজীতে উপরোক্ত কথাটা তিনি বলেছিলেন এইভাবে- Lekin, lady, I every time happy this England, horses gentleman, ladies gentlemen, and grass is gentleman.
২. সপ্তম এডওয়ার্ডের অভিষেক উপলক্ষে দিল্লীর দরবারে লর্ড কার্জন ও তাঁর স্ত্রী হাতিতে চড়ে গিয়েছিলেন। এটা স্যার প্রতাপের ভাল লাগেনি। তিনি বিনয়ের সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন"You eating knife and fork, I eating knife & fork. I not knowing this knife & fork. Great Mogul he knowing how mount this elephant. You not knowing. You sitting howdah in uniform with english lady. Great Mogul he mount properly. He dressed in white Moslin and squat by himself on elephants back. You sitting howdah, we laughing, you not knowing." (বাঙলা ও বাঙালীর ইতিহাস,ধনঞ্জয় দাস মজুমদারপ্রম খণ্ডপৃ. ১২১)
৩. ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়কে ডাকা হতো টি.এন. মুখার্জী বলে। লেখাপড়া বেশি জানতেন না। মাসিক পাঁচ টাকা মাইনের চৌকিদার ছিলেন। কর্মপটুতার জন্য হয়ে গেলেন উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্তা। মাইনে মাসিক ছয়শত টাকা। স্যার উইলিয়াম হান্টার তাকে কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগের উচ্চকর্মী হবার সুযোগ করে দেন। পরে কলকাতা মিউজিয়ামেরসুপারিনটেনডেন্ট পদে তাঁকে অধিষ্ঠিত করা হয়। তিনি তার সহোদর দাদা রঙ্গলাল বাবুর সঙ্গে সহযোগিতা করে বিশ্বকোষ সৃষ্টি করেন। বেশি লেখাপড়া না জেনে ইংরেজী পুস্তক Art Manufacture of India, Visit to Europe বইগুলো লিখে ফেললেন। (কলকাতা ইতিহাসের দিনলিপিনীরদ বরণ হাজরাপশ্চিম বঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ)।
(উপরোক্ত উদাহরণগুলো দেখে অনেক পাঠক নিশ্চয় খুবই আফসোস করছেন কেন সে সময় দুনিয়াতে এলাম না। যদি আসতাম তবে ইংরেজের দালালী করে চৌকিদার থেকে বিশ্বকোষ প্রণেতা হওয়া যেত আবার স্যার-নাইট খেতাবও অর্জন করা যেত। বই না লিখেও গ্রন্থ প্রণেতা হওয়া যেত। উক্ত পাঠকবৃন্দের অবগতির জন্য বলছিএখনও বাংলাদেশে অনেক ঘোড়ার ডক্টরেট রয়েছেটাকা খরচ করলে অথবা সাম্রাজ্যবাদের দালালী করলে হরেকরকম ডিগ্রীখেতাব পাওয়া কোন ব্যাপার নয়। আর বেশি নাম করতে চাইলে তসলিমা নাসরিনকে অনুসরণ করুন।)
৪. আর একটি কথা বলে রাখা ভাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রম তৈরি হয়েছিল ২টি উদ্দেশ্য নিয়ে। একটি হল সিভিলিয়ান অফিসার ও ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করাআর দ্বিতীয়টি হলো একটি প্রভুভক্ত অনুগত স্তাবকদল তৈরি করা। শান্তিনিকেতনের কোন শাখা প্রশাখা না থাকলেও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল ব্রিটিশদের সহকারী কেন্দ্রÑ শান্তিনিকেতনকে বস্তুত কলকাতার উপক্ষেত্র বলা যায়। বিশেষত: রবীন্দ্রকালে [ড. নীরদ বরণ হাজরা,কলকাতা ইতিহাসের দিনলিপিপৃষ্ঠাভূমিকা ৬।
ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ঠ া ক ুর ব া ি ড় ে ক একটি ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলেছিল। সেখানে দেশী বিদেশী অনেক ভাষাভাষী অনুবাদক ও লেখক অবস্থান করত। তারা ব্রিটিশের ফরমায়েশ অনুযায়ী কবিতানাটক গ্রন্থ লিখত,অনুবাদ করত এবং কোন না কোন বাঙালীর নামে ছাপিয়ে দিত। বিখ্যাত কবি ইয়েটস ও মি. নেভিনসন ওরফে দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কবিকে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন।
স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য হয়ে যেমন মিস মার্গারেট নোবল অবিবাহিতা হয়ে আজীবন স্বামীজির পাশে ছিলেন ঠিক তেমনি দীনবন্ধু এন্ড্রুজ ৩৩ বছর বয়সে ভারতবর্ষে আসেন এবং আজীবন ভারতবর্ষে থেকে যান। তাঁর প্রধান আবাসস্থল ছিল শান্তিনিকেতন। উপরোক্ত মন্তব্যের সপক্ষে কয়েকটি প্রামাণ্য তথ্য উল্লেখ করা হলো :
১. কবির শান্তিনিকেতনের শিক্ষক কর্মী সহযোগী ও বান্ধবের দল যারা ছিলেন তাঁরা অনেকে নানা ভাষার যোগ্য অনুবাদকও ছিলেন। কবির প্রতিভা বিকাশের পূর্বে এতদিন যারা সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন তাঁরা বেশির ভাগই মুসলমান। যেমন মাওলানা জালালউদ্দীন রুমীশেখ সাদীহাফিজওমর খৈয়ামহালিমীর্জা গালিবফিরদৌসী প্রমুখ ভারতীয় ও বহির্ভারতীয় কবি ও সাহিত্যিক। তাঁদের বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্য রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখার বহু মিল দেখে কবি তাদের ভাব চুরি করেছেন না লিখে কথাটা উল্টোভাবে লেখা হলো 'সমাজ দর্পণে'। "কবির জন্মের পূর্বেই মধ্যযুগেরসাধকেরা বিনা স্বীকৃতিতেই চুরি করে নিয়েছেন। অদৃশ্য সিঁদ কাটবার কোথাও কোন একটি সহজ পথ নিঃসন্দেহে আছে।" (সূত্র : ডেইলী পত্রিকাদৈনিক বাংলাবাজারতারিখ ১/৫/১৯৯৭)।
২. "ঠাকুরবাড়ির ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে কবিতাকাব্যগানচিত্রাঙ্কনের প্রতিভা অধিকাংশেরই ছিল। এটা অস্বীকার করারউপায় নেই। তাহা ছাড়া অর্থের জোরে বহু প্রতিভাবান ও প্রতিভাবতীদের তাঁরা পুষতে পারতেনইচ্ছামতো আনাতে পারতেন ও পারতেন ইচ্ছামতো কাজে লাগাতে।" (অমিতাভ চৌধুরীইসলাম ও রবীন্দ্রনাথপৃ. ২৩)।
৩. কিছু গবেষকের ধারণারবীন্দ্রনাথকে তৈরি করে নিয়েছেন ব্রিটিশআর নোবেল প্রাইজও পাইয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। আমরা সকলে তাতে একমত হই আর না হইকবির প্রখর প্রতিভা অনস্বীকার্য জেনেও তার পারিবারিক প্রারম্ভিক আলোচনা করলে দেখা যাচ্ছেযদিও তিনি কবিতা লিখতে পারতেন হঠাৎ একদিন তাঁর ভাগেড়ব জ্যোতিপ্রকাশ মামাকে ডেকে বললেন, "তোমাকে কবিতা লিখিতে হইবে। ইহার পর চৌদ্দ অক্ষরে পয়ার কি করিয়া লিখিতে হয় তাহাও শিখাইয়া দিলেন।তখন তাহাকে আর কে ঠেকাইয়া রাখে।" (আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথনীরদ সি চৌধুরী২য় খণ্ডপৃ. ৯৩)
৪. "একটা কথা উড়িয়ে অস্বীকার করা যাবে না যেনোবেল প্রাইজ পাওয়ার পূর্বে কবির বাজারদর ছিল খুব নীচুমানের। মূল্য নির্ধারকেরা অনেকে লিখেছেন, "ঠাকুর নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির পূর্বে প্রায় অশিক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হতেন। আমারম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার বাংলা প্রশড়বপত্রে ঠাকুরের একটি রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সেটাকে বিশুদ্ধ ও সাধু বাংলায় লেখার নির্দেশ ছিল। এবং এটা ছিল ১৯১৪ সালে তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির এক বছর পরে।" (জাস্টিস আবদুল মওদুদ;মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ: সংস্কৃতির রূপান্তর১৮৯২পৃ. ৪০৮)।
৫. "এই প্রেক্ষিতে স্মরণ করা যাইতে পারে যে১৯০৭ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকেবিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সঙ্গীতের উপর একটা ডিগ্রী দেবার প্রস্তাব করেন। কিন্তু অক্সফোর্ডের তদানীন্তন চ্যান্সেলর লর্ড কার্জন এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দেন। কার্জনের বক্তব্য হলোরবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতিসম্পনড়ব গুণী ভারতবর্ষে আছেন।" (অধ্যাপক ডক্টর অরবিন্দ পোদ্দাররবীন্দ্রনাথ : রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বপৃ. ১৪৮)।
৬. "১৯০০ সালে কবির বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে তিনি লিখেছিলেনভাইএকটা কাজের ভার দেব?... আমার গ্রন্থাবলী ও ক্ষণিকা পর্যন্ত কাব্যের কপিরাইট কোন ব্যক্তিকে ৬০০০ টাকায় কেনাতে পারশেষের যে বইগুলি বাজারে আছেসে আমি সিকিমূল্যে তার কাছে বিμি করবÑ গ্রন্থাবলী যা আছেসে এক-তৃতীয়াংশ দামে দিতে পারব। (কারণ এটাতে সত্যের (সত্যেন্দ্রনাথ) অধিকার আছে। আমি স্বাধীন নই। আমার দৃঢ় বিশ্বাসযে লোক কিনবে সে ঠকবে না... আমার প্রস্তাবটা কি তোমার কাছে দুঃসাধ্য বলে ঠেকছেযদি মনে করছোটগল্প এবং বৌ-ঠাকুরানীর হাট ও রাজর্ষী কাব্য গ্রন্থাবলীরচেয়ে খরিদ্দারের কাছে বেশি সুবিধাজনক বলে প্রতিভাত হয় তাহলে তাতেও প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমার বিশ্বাসকাব্য গ্রন্থগুলোই লাভজনক।" (সূত্র : ঐপৃ. ৭৯)।
(সুতরাং দেখা যাচ্ছে গ্রন্থের ব্যাপারে কবি স্বাধীন ননতাতে অন্যের অধিকার আছে)।
৭. একমাত্র কালীপ্রসনড়ব বিদ্যাবিশারদ তার 'মিঠেকড়া'তে পরিষ্কার বলেই দিয়েছিলেন যে, "রবীন্দ্রনাথ মোটেই লিখতে জানতেন নাস্রেফ টাকার জোরে ওর লেখার আদর হয়। কিন্তু বরাবর এতো নির্বোধের মত লিখলে চলে কখনো।" (জ্যোতির্ময় রবি কালোমেঘের দলসুজিত কুমার সেনগুপ্তপৃ. ১১১)।
৮. "পাঁচকড়ি বাবু সত্যিই বিশ্বাস করতেন যেরবীন্দ্রনাথের μমবর্ধমান জনপ্রিয়তা একটা হুজুগ মাত্র।... কারণ রবীন্দ্র সাহিত্য অনুরাগ বিশুদ্ধ ন্যাকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। পাঁচকড়ি বাবু একথাও বহুবার স্পষ্ট বলে দিয়েছেনÑ রবীন্দ্রনাথের প্রায় যাবতীয় সৃষ্টিই নকল। বিদেশ থেকে ঋণ স্বীকার না করে অপহরণ।" (সূত্র : ঐপৃ. ঐ)।
৯. রবীন্দ্র গবেষকদের বক্তব্য এই যেরবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ কবিতাটি মধ্যযুগের পারস্যের কবি মাওলানা জালালুদ্দীন রুমীর কবিতার নকল। যেটি পরে প্রমাণিত হয়েছে। যথা-
"বায্ আঁবায্ আঁ
হর আঁচে হাস্তী বায্ আঁ
 গর কাফির গর গবর ওয়া
বোত পরস্তী বায্ আঁ।
ইদরগাহে মা দরগাহে
না উম্মীত নীস্ত।
শতবার গর তওবাহ শিকস্তী বায্ আঁ।"
রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-
"এসো হে আর্য,এসো অনার্য
হিন্দু মুসলমান,
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ
এসো এসো খ্রিস্টান।
মা'র অভিষেক এসো এসো ত্বরা
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা
সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।"
(দ্র: ডেইলী পত্রিকাদৈনিক বাংলাবাজারতাং ১/৫/১৯৯৭)
১০. "রবিঠাকুরের রচিত 'চিত্রাকাব্যের 'এবার ফিরাও মোরেএবং 'মানসীকাব্যের 'বধূকবিতা দু'টির ভাব ও কাঠামো ইংরেজ কবি মি. শেলী ও মি. ওয়ার্ডস্ ওয়ার্থের কবিতার অনুরূপ বলে অনেক গবেষকের মত। নারায়ণ বিশ্বাস প্রমে ধরে দেন 'গোরা এবং 'ঘরে বাইরেনকল। একথা অবশ্য আগে বলার চেষ্টা করেছিলেন প্রিয়রঞ্জন সেন। তারপর পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত একটি মেয়ে ও 'গোরাএবং 'ঘরে বাইরে'র সাথে দু'টি ইংরেজী উপন্যাসের সাদৃশ্যের কথা বলেছিলেন। এর বেশি বলতে সাহস পাননি। কালী মোহন ধরে দিয়েছিলেন রবীন্দ্র কবিতার নকল।" (সূত্র : ঐ)।
১১. "এই রবীন্দ্রনাথই ড. ডেভিডের মধ্যস্থতায় আন্ডারসনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে 'চার অধ্যায়লেখেন। এটা এখন প্রমাণ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, 'ঘরে বাইরে'ও তাঁকে টাকা দিয়ে লেখানো হয়।" (সূত্র : ঐ)।
১২. "তিনি (দীনবন্ধু এন্ড্রুজ) রবীন্দ্রনাথের ইংরেজী যেখানে উচ্চাঙ্গের বলিয়া মনে করিতেন নাউহাকে সাহিত্যিক করিয়াদিতেন।... রবীন্দ্রনাথের যেসব মত তাঁহার ভাল লাগিত না তাহা বদলাইয়া নিজের বিচার অনুযাযী পরিবর্তন করিয়া দিতেন। অর্থাৎ তিনি রবীন্দ্রনাথকে যতটুকু সম্ভব শ্রেষ্ঠ এনড্রুজ বলিয়া দেখাইতে চাহিতেন।" (আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথনীরদ সি চৌধুরী২য় খণ্ডপৃ. ৯৩)।
১৩. অমিতাভ চৌধুরী তাঁর ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ পুস্তকে লিখেছেন, "গীতাঞ্জলি নামটাই ধার করা। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন কাটিয়েছিলেন শিলাইদহের কুমারখালী অঞ্চলে। কুমারখালীর বিশিষ্ট তান্ত্রিকের সঙ্গে পরিচিত হন। বাংলা ১২৯৫ অর্থাৎ ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যার্নব মশাই একটি বই লিখেন। বইটির নাম 'গীতাঞ্জলি'। কুমারখালীর মথুরানাথ যন্ত্রে মহেশচন্দ্র দাস মুদ্রিত করেন।"
"...'গীতাঞ্জলিনোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর জনরবের কি ধুম- রবীন্দ্রনাথ কোন বাউলের খাতা চুরি করে ছেপে দিয়েছেন। ... শেষে অবশ্যি নামও জানা গেল। স্বয়ং লালন ফকির মহাশয়ের বাউল গানের খাতা চুরি করেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। আজ অবিশ্বাস্য শুনালেও একথা কিন্তু সত্যসেদিন বহু ব্যক্তি শান্তিনিকেতনের বিভিনড়ব কর্তাকে বলেছেন এবং লিখেছেনরবিবাবু বড় কবি স্বীকার করি।... যাকগেতা গীতাঞ্জলির খাতাটা এবার উনি ফিরিয়ে দিন। প্রাইজ তো পেয়েই গেছেনঅনেক টাকাও হাতে এসে গেছেওতো আর কেউ নিতে যাচ্ছে নাতাগান লেখা খাতাটা উনি দিয়ে দিন।" (জ্যোতির্ময় রবি ও কালো মেঘের দলসুজিত কুমার সেনগুপ্তপৃ. ১৬১)।
নীরদ বাবু দেখিয়েছেনরবীন্দ্রনাথের 'গীতাঞ্জলি'র যে কবিতাগুলো অনুবাদ করে বা করিয়ে তিনি পেয়েছিলেন নোবেল প্রাইজ,সেগুলো ইংরেজ কবিদের নকল মাত্র। এটা তার ভিত্তিহীন দাবি নয়। কবির ইংরেজী করা গীতাঞ্জলির ৬১২৬ ও ৮৬ নং কবিতাগুলোর পাশাপাশি ইংরেজ কবি ঝড়ষড়সড়হ এবং ঝঃ. ঋৎধহপরং-এর কবিতা বা গান পরস্পর সাজিয়েদিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যেরবীন্দ্রনাথের তৈরি করা কবিতার সঙ্গে ইংরেজ কবিদের বহুলাংশেই মিল রয়েছে। অনেকের ধারণাভাব ও ভাষায় মিল রয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। তাহলে কি তাঁদেরই (ব্রিটিশদের) ইঙ্গিতে বিলেতের কবিদের 'থীম'তাঁকে পূর্বেই গোপনে পরিবেশন করা হয়েছিল?" (আত্মঘাতী বাঙালীনীরদ সি চৌধুরী২য় খণ্ড)।
'গীতাঞ্জলি'র গুপ্ত রহস্য বলতে গেলে আরও দু- একটি কথা জানানো প্রয়োজন। 'গীতাঞ্জলিযারা দেখেননি তারা অনেকে মনে করেন যেমোটা 'গীতাঞ্জলিবইখানার পুরো ইংরেজী অনুবাদ বিলেতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলআর তাঁর কবি প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁরা দিয়েছিলেন নোবেল প্রাইজ।
"ইহার পর ইংরেজী 'গীতাঞ্জলি'তে রবীন্দ্রনাথের কোন কোন কবিতার অনুবাদ আছে বলা প্রয়োজন। ইহার নাম 'গীতাঞ্জলি'হইলেও বইটিতে বাংলা গীতাঞ্জলির সব গান (বা কবিতা) অনুদিত হয় নাই। বাংলাতে ১৫৭টি গান ছিলউহার মধ্যে শুধু ৫৩টি মাত্র ইংরেজী করা হইয়াছিলইংরেজী 'গীতাঞ্জলি'তে সবশুদ্ধ ১০৩টি কবিতা ছিল (বইটি বড় টাইপে মাত্র ১০১পৃ. হইয়াছিলদাম হইয়াছিল মাত্র চার শিলিং ছয় পেন্সআমাদের টাকায় তিন টাকা ছয় আনা)। বাকি ইংরেজীতে অনুদিত কবিতা আসিয়াছিল প্রধানত 'নৈবেদ্যও 'খেয়াহইতেঅল্প কয়েকটি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত কবিতা হইতে।" (দ্র: ঐ,পৃ. ১৪২)।
বঙ্গভঙ্গ যখন রদ হয় তখন ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস। কত রক্তারক্তিগুলিজেল প্রভৃতির তাণ্ডবনৃত্য। কবি তখন সপক্ষ-বিপক্ষ কোন পক্ষেই না গিয়ে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য খুবই কর্মব্যস্ত ছিলেন। অর্থাৎ ঠিক ঐ সময়েও তিনি বিলেতেবিলেতে একবার নয়Ñ বহুবার তাঁকে যেতে হয়েছে। এমন যে তাঁর প্রতিভার বিচার হয়েছে তার লেখার উপর তারপর তাঁকে তাঁর প্রাসাদে থাকা অবস্থায় পুরস্কৃত করা হয়েছে। বরং ১৯১২তে বঙ্গভঙ্গ হয় আর ১৯১৩-তে তিনি দেশে ফেরেন অক্টোবরে। আর তাঁর পিছনে পিছনে নভেম্বর মাসেই তাঁর নোবেল প্রাইজের সংবাদ পৌঁছালকোন শর্ত হয়েছিলকিনাকোন রাজনৈতিক চμান্ত হয়েছিল কিনা? (কালান্তরবিশ্বভারতী ১৩৫৫ সংস্করণপৃ. ১৬৯)।
'জনগণমনতিনি লিখেছেন আশুতোষ চৌধুরীর পরামর্শেভারত সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে। আশুতোষ চৌধুরী ছিলেন তাঁর ভাইঝি জামাইপ্রমথ চৌধুরীর বড় ভাই। ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জকে তিনি ভারতের ভাগ্য বিধাতা আখ্যা দিয়ে লিখেছিলেন উক্ত গান। এর প্রম লাইনটি হচ্ছে : 'জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা'
উক্ত সময়ে নোবেল প্রাইজ প্রদান কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন সম্রাট ৫ম জর্জ। অনেকের মতে সম্রাট ৫ম জর্জ খুশী হয়ে কবির জন্য নোবেল প্রাইজের ব্যবস্থা করেছিলেন।
রবীন্দ্র প্রতিভা সম্পর্কে আমার নিজের কোন কথা নেই। উপরোক্ত মনীষীদের বক্তব্য-মন্তব্য থেকে পাঠক যা অনুমান করবেনআমার অনুমানও তাই।
রবীন্দ্র চরিত্রের বৈশিষ্ট্য
ইতিপূর্বে আমি যে সকল তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন করেছি তাতে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ রাজশক্তির মনোনীত ব্যক্তি,ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট বিশ্বকবি এবং আজীবন তিনি ব্রিটিশের পক্ষেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এহেন সাম্রাজ্যবাদের গোলাম নিশ্চয়ই কোন স্বাধীন ব্যক্তির ও জাতির আদর্শ হতে পারে না। এরূপ ব্যক্তির সাহিত্য সাধনা স্বাধীনতার চেতনাকে শাণিত না করে ভূলুণ্ঠিত করে। এরূপ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দেশ ও জাতিদ্রোহী তৎপরতার কারণেই ব্রিটিশ শাসন ও শোষণ ভারতবর্ষে দীর্ঘায়িত হয়েছিল। ব্রিটিশের মনস্কামনা পূর্ণ করতে এসব মেরুদণ্ডহীন বুদ্ধিজীবীগণ বাঙালীজাতীয়তাবোধের চেতনাকেগর্বকেস্বকীয়তাকে বর্ণবাদী আর্য সাম্রাজ্যের পদতলে বিসর্জন দিয়েছিল। ইতিহাস পাঠকগণ একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেনব্রিটিশ শাসকদেরকে এদেশে ডেকে আনাক্ষমতায় বসানোভারতব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনসহ সবকিছুতেই বাঙালী বাবুদের রক্ত-ঘাম-শ্রম সর্বোচ্চ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ সকল নির্বোধ বুদ্ধিজীবীগণ কোনবাংলা ভাষাভাষী দেশনায়ক খুেঁ জ পাননি অথবা খোঁজার চেষ্টা না করে ব্রিটিশের প্রেসμিপশন মোতাবেক রাজপুত,মারাঠা ও শিখ জাতির ব্যক্তিদেরকে দেবতার আসনে বসিয়েছিল। ফলে বাঙালী জাতীয়তার খাত বদল হয়ে ভারতীয়জাতীয়তায় রূপান্তরিত হয় এবং ভারতবর্ষের রাজধানী এবং কর্তৃত্ব বাঙালীদের নিকট থেকে স্থানান্তরিত হয়ে দিল্লীতে এবং বর্ণহিন্দু আর্যদের নিকট চলে যায়।
তাহলে ফল দাঁড়াল কি১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের নিকট থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেখা গেলরাজধানী বা কর্তৃত্ব কোনটাই আর বাঙালীদের হাতে নেই। বাঙালীরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার পর পরই বর্ণবাদী আর্যভারতের কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলো। যার অনিবার্য ফলশ্র"তি হলো আমাদের ভগড়ব-জরাজীর্ণ কোলকাতা শহর ও দিল্লীর পশ্চাৎভূমি বা শোষণের ক্ষেত্র পশ্চিম বাংলা। আরেকটি ঐতিহাসিক শিক্ষা সকলের স্মরণে থাকা দরকারতা হলোপশ্চিমা মুসলমানেরা পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে প্রম শ্রেণীর মুসলমান মনে করতো না এবং উত্তর ভারতের আর্য হিন্দুরাওতদ্রƒপ পশ্চিম বাংলার হিন্দুরদেরকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দু মনে করে। পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ পশ্চিমা মুসলমানদের অহংকারকে ১৯৭১ সালে চূর্ণ করতে সক্ষম হলেও পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা আর্য প্রাধান্যকেপ্রভুত্বকে ইতিহাসের শাস্তি হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলা ছিল রাজধানী কোলকাতার শোষণের ক্ষেত্র আর বর্তমানেকলকাতা হচ্ছে দিল্লীর শোষণের ক্ষেত্র।
তবে আশার কথা হচ্ছেইতিমধ্যে পশ্চিম বাংলার কিছুসংখ্যক স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রগোষ্ঠীর অশুভ কার্যকলাপের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে এবং নিজেদের আশু কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। বাঙালীদের স্বাধীনতার শত্র"- মিত্র চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাসপশ্চিম বঙ্গের বাঙালীরা এতদিন যেসকল বাঙালী বুদ্ধিজীবী যথা হরপ্রসাদবঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ গংকে স্বাধীনতার অগ্রনায়ক হিসেবে সম্মান করেছিলেন তাদেরকেই অদূর ভবিষ্যতে বাঙালী স্বাধীনতার শত্র"পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করবে এবং বাঙালী স্বাধীনতার সত্যিকার বীর পুরুষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনশরৎ বসু,সুভাষ বসুশেরে বাংলাআবুল হাশিম ও সোহরাওয়ার্দীকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে মর্যাদা দান করবে। যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন পশ্চিম বাংলাকে আর্য হিন্দুদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ থাকতে হবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছেরবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা কোন স্বাধীন মানুষের আদর্শ হতে পারে না। এখন আমরা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব তাঁর সামাজিক চিন্তাধারা আমাদের চলার পথে অনুকরণযোগ্য কিনাসামাজিকভাবে তিনি ছিলেন প্রজাপীড়ক বর্ণবাদী জমিদার। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অবাধ যৌনাচার বা ব্যভিচারের পক্ষে। কয়েকটিউদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বোধগম্য করা হলো:
১. "কবির সঙ্গে তার (বৌদি) কাদম্বরীর অবৈধ প্রেমকে কেন্দ্র করে নাকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সংঘর্ষ হয়েছিল। সেটাকে কেন্দ্র করে ডক্টর নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত 'পাপের ছাপেলেখায় কবি বিরুদ্ধ মতামত ব্যক্ত করেছেন। ঠাকুরবাড়ির সুভোঠাকুর সম্পাদিত 'ভবিষ্যতপত্রিকায় কবির বিরুদ্ধে লেখা বের হয়- পয়েট টেগোর কে হন তোমার জোড়াসাঁকোতেই থাকো/ বাবার খুড়ো যে হন শুনিয়াছিমোর কেহ হয় নাকো।" (অধ্যাপক দীপন চট্টোপাধ্যায়পূর্বোক্তপৃ. ২৩)।
২. "রবীন্দ্রনাথ নিজেকেও বাউল বলে পরিচয় দিয়েছেন। ড. সুধীর বাবু এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, "তাঁর কোন কোন রচনাকে তিনি 'রবীন্দ্র বাউলের রচনাবলে মেনে নিয়েছেন।" (দ্র: 'দেশ', পৃ. ৩৬ডিসেম্বর ১৯৯১)।
৩. "বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শ্রী ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রী বাউলদের সম্পর্কে লিখেছেন, "দেহের মধ্যেই তাহাদের বিশ্ব। জাতি ও সমাজের বন্ধন উভয়ের কাছেই অর্থহীন।" (বাংলার বাউলশ্রী ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রীপৃ. ২)।
৪. "মিথুনাত্মক যোগসাধনা আধ্যাত্ম্যবাদী বাউল সম্প্রদায়ের সাধনার মূল পদ্ধতি। বাউলের সাধনা দেহকেন্দ্রিক।'দেহমন্দিরে প্রাণের ঠাকুরঅন্বেষণই বাউলের সাধনার সার।" (দ্র: বসন্ত কুমার পালমহাত্মা লালন ফকিরপৃ. অবতরণিকা-১০)।
সুতরাং পাঠকবৃন্দ বুঝতেই পারছেনআমাদের বাউল কবি রবি ঠাকুর সুযোগ পেলেই 'দেহমন্দিরে প্রাণের ঠাকুরখোঁজায় লিপ্ত হতেন। এ বিষয়ে তিনি কোন রাখঢাকের ধার ধারতেন না। দু-একটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে পাঠকবৃন্দ বুঝে নিবেন :
১. "আমাদের ভারতীয় সমাজে কথিত শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেশিরভাগ মানুষই অতিমানুষমহান মানুষপ্রতিভাবান মানুষের প্রতি ভক্তির মাত্রা বাড়াতে বাড়াতে তাঁকে বানিয়ে ফেলেন ঋষি-মহাঋষিযোগীমুণিসাধকÑ সবশেষে ভগবান পর্যন্ত করে ফেলেন তাঁকে। অপরদিকেচরিত্রহীনলম্পটসমাজবিরোধীঅসংযমীব্যভিচারী প্রভৃতি লোককে সমাজের এত পরির্তনহওয়া সত্ত্বেও ভাল চোখে দেখা হয় না। কবির ব্যক্তিগত ব্যবহারিক জীবনে নারীসঙ্গঅবাধ মেলামেশাযৌনতা বিষয়ে বিতর্ক আনবার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবাদী।" (এ এক অন্য ইতিহাসগোলাম আহমাদ মোর্তজা)।
১৯২৮ সালের ১লা ফেব্র"য়ারি তাঁর সেড়বহধন্য দিলীপ কুমার রায়কে কবি এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন। বিষয়- নারীর ব্যভিচার। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন, "সমাজে যদি অশান্তি না ঘটে তাহলে ব্যভিচার-ব্যভিচারই হয় না। ব্যভিচারের ফলে যদি সন্তান সমস্যা দেখা দেয়তাহলে আজকাল সেটাও সমস্যা নয়। কেননা কন্ট্রাসেপটিভ বেরিয়ে গেছে। নিবারণের উপায়গুলোও সহজ। সুতরাং গর্ভধারণ করতে হয় বলে দেহকে সাবধান রাখার দায় আর তেমন নেই।... সমাজ নিজের প্রয়োজনবশত: স্বভাবকে ঠেকিয়ে রাখে। ঠেকিয়ে রাখতে তার অনেক ছলবল- কৗশল অনেক কড়াকড়িঅনেক পাহারার দরকার হয়। কিন্তু প্রয়োজনগুলোই যখন আলগা হতে থাকেতখন স্বভাবকে ঠেকিয়ে রাখা আর সহজ হয় না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভোগের দৃষ্টান্ত দেখ না। আমার যখনই ক্ষিদে পায়তখন আমার গাছে যদি ফল না থাকেতবে তোমারগাছ থেকে ফল পেড়ে খেতে আমার স্বভাবতই ইচ্ছা হয়। কিন্তু যেহেতু ব্যক্তি সম্পত্তির সীমা রক্ষা করা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে অত্যাবশ্যকএজন্যই ফল পেড়ে খাওয়াটা চুরি। এই চুরি সম্পর্কে সমাজ আমাদের মনে যে সংস্কার দৃঢ় বদ্ধমূল করে দিয়েছে সেটা নিজের ব্যবস্থা রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে।... বস্তুত: চুরি না করার নীতি শাশ্বত নীতি নয়। এটা মানুষের মনগড়া নীতি। এ নীতিকে পালন না করলে সমাজে যদি অশাস্তি না ঘটেতবে পরের দ্রব্য নেওয়া চুরিই নয়। এই কারণে তুমি দিলীপ কুমার রায় যদি আমি রবীন্দ্রনাথের লিচু বাগানে আমার অনুপস্থিতিতে লিচু খেয়ে যাওতুমিওসেটাকে চুরি বলে অনুশোচনা কর না। আমিও সেটাকে চুরি বলে খড়গহস্ত হই না। ব্যভিচার সম্বন্ধে এই কথাটাই খাটে। এর মধ্যে যে অপরাধ সেটা সামাজিক। অর্থাৎ সমাজে যদি অশান্তি ঘটেতবে সমাজের মানুষকে সাবধান হতে হয়। যদি না ঘটেতাহলে ব্যভিচার-ব্যভিচারই হয় না। (দ্র: অমিতাভ চৌধুরীইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ)।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ! উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ পড়ে নিশ্চয়ই পুলকিত হয়েছেন এবং অনুভব করতে সক্ষম হয়েছেন কেন আমাদের দেশে রবীন্দ্রভক্ত এত বেশি এবং বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরীন রবীন্দ্র ভক্ত বুদ্ধিজীবীদের নামে '' 'লিখতে বাধ্য হয়েছেন। রবীন্দ্র ভক্তরা কি ঋষি কবিকে ভক্তি করেননাকি রক্ত মাংসে গড়া ষড়রিপুর দাস বাউল কবি রবীন্দ্রনাথকে বেশি ভালবাসেন?
রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতি
('রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতিএই অংশটি আমার ছাত্রজীবনে রচিতযখন আমি বিশ্বাস করতামরবীন্দ্রনাথের নামে প্রকাশিত কাব্যসমূহ তাঁর মৌলিক রচনা)
প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলা কবিতায় প্রকৃতি বিপুল এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের ভাষার সর্বকালের কাব্যে প্রকৃতির উপর কবিদের নির্ভরতা লক্ষণীয়। তাঁরা যে শুধুমাত্র প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন তাই নয় বরং প্রকৃতির সঙ্গে জীবনকে সম্পর্কিত করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন যেপ্রকৃতির কোন উপাদান থেকে মানুষ বিচ্ছিনড়ব নয়।
প্রাচীন চর্যাপদের মানুষের বসবাস ছিল প্রকৃতি নির্ভর এবং তৎকালীন কবিদের রূপকের বিন্যাসের সম্বলও ছিল প্রকৃতি,যদিও রূপকের মাধ্যমে তত্ত্ব প্রচারই চর্যাপদের মূল লক্ষ্য ছিল। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে ও বৈষ্ণব পদাবলীতে নারীর প্রণয় লিপ্সার বিভিনড়ব প্রকাশকে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত করে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের সময় যা সত্য ছিল রবীন্দ্রনাথের কালেও তা সত্য রয়েছে বরং বলা যায়অধিকতর সত্য হয়েছে। আমাদের কবিতায় প্রকৃতিকে অধিকতর ব্যবহারের কারণ সম্ভবতঃ এই যেআমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবন ভূমির সাথে সম্পর্কিত এবং গ্রামের সঙ্গে নিবিড়তম ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা প্রকৃতির বিচিত্র ব্যবহার প্রত্যক্ষ করি। গ্রামের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিবিড়তর হবার ফলেই তিনি প্রকৃতির উদার দাক্ষিণ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। পৈত্রিক জমিদারীর দায়িত্বভার পেয়ে তিনি বর্তমান কুষ্টিয়ার শিলাইদহের সদর কাচারীতে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। এ স্থানটি পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। তিনি পদ্মা নামক নৌকায় আরোহণ করে জমিদারী তদারকির উদ্দেশ্যে এখান থেকে কুষ্টিয়াকুমারখালীশাহজাদপুর ও অন্যান্য স্থানে গমন করতেন। এভাবে নদীপথে বারবার ভ্রমণের ফলে পল্লী বাংলার বিচিত্র প্রকৃতির সাথে তিনি একাত্ম হয়ে পড়েন। প্রকৃতির বিচিত্র শোভা তাঁর দৃষ্টিকে আপ্লুত করেছিলহৃদয়কে উদ্বেল করেছিল। ফলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কবিতার চিত্রকল্প নির্মাণে প্রকৃতিকে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে অবলম্বন করে জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বোধকে প্রকাশ করতে সচেষ্ট ছিলেন। বলাকা কাব্যগ্রন্থের চঞ্চলা কবিতাটি এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই কবিতায় গতির একটি উপলব্ধি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি নদীর চিত্রকল্পের মাধ্যমে সে উপলব্ধিকে ব্যক্ত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ স্বীয় অনুধ্যানউপলব্ধি ও নিভৃত চিন্তাকে প্রকাশ করার জন্য প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। কখনও দৃশ্যপটে এনেছেন প্রকৃতির স্থায়ী সম্পদ নদীপাহাড়প্রান্তরসমুদ্র আর কখনও এনেছেন ভূমি থেকে উদ্গত বৃক্ষ ও তৃণলতা। এছাড়াও পরিবেশ পরিস্থিতি উপস্থাপনে তিনি ঝড়বাতাসরৌদ্রের মতো প্রাকৃতিক μিয়াকাণ্ডকে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পূর্বে অন্য কেউ এত সূক্ষ্মভাবে প্রকৃতির ব্যবহার করেনি এবং এত বিচিত্রভাবে মানুষের অনুভূতি কবিতায় ব্যক্ত হয়নি।
রবীন্দ্রকাব্যে সকল বোধ প্রকাশের অবলম্বন ছিল প্রকৃতি। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে প্রকৃতির সত্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত করে উপস্থাপন করেছেন। চিত্রা কাব্যগ্রন্থের 'চিত্রানামক উন্মোচনী কবিতায় কবি বলেছেন, 'অজস্র আলোকছটা নীল আকাশকে উজ্জ্বল করেছে' সুখ কবিতাটিতে তিনি চিত্তের প্রসনড়বতাকে প্রকৃতির প্রসনড়বতার উপর নির্ভরশীল করেছেন। সিড়বগ্ধ বায়ু প্রবাহধীর কল্লোলে নদী প্রবাহঘনছায়াপূর্ণ বৃক্ষগুল্মআম্রমুকুলের গন্ধ ও বিহঙ্গের কলগুঞ্জনের অবতারণা করে তিনি প্রসনড়বতার পটভূমি নির্মাণ করেন। প্রেমের অভিষেক কবিতায় কবি প্রেমের যে অমরাবতীর বর্ণনা দিয়েছেনসে অমরাবতী নির্মিত হয়েছে প্রকৃতির সাহায্যে।
প্রকৃতি ব্যবহারে রাবিন্দ্রীক স্টাইল
প্রকৃতির উপর মানব স্বভাবের গুণাবলী আরোপ করা যায় আবার প্রকৃতির গুণাবলী মানুষের উপর আরোপ করা যায়। উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কবি যখন বলেন বিষণড়ব নদীতীরতখন মানব চিত্তের বিষণড়বতা নদীতীরের উপর আরোপ করেন। রবীন্দ্রনাথ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানব স্বভাবকে প্রকৃতির উপর আরোপ করেছেন।
প্রকৃতিকে আবার ভিনড়বভাবেও উপস্থাপন করা যায়। এক্ষেত্রে প্রকৃতির বিশেষ পরিচয়লিপি মানুষের উপর আরোপ করে মানুষকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যায়। শেক্সপীয়র শীতের পাতাঝরা গাছের সঙ্গে একজন বয়স্ক ব্যক্তির তুলনা করে প্রকৃতির বিশেষ পরিচয়লিপি মানব জীবনের উপর আরোপ করেছেন।
শেলী যে অর্থে একটি আদর্শ পরিমণ্ডল নির্মাণ করার জন্য প্রকৃতিকে বিশেষ রূপে আবিষ্কার করার কথা ভেবেছিলেন,রবীন্দ্রনাথও তেমনি তার মানস সুন্দরীকেজীবনদেবতাকে অথবা অলৌকিক সৌন্দর্যকে আবিষ্কারের জন্য আরোপিত বিশেষ বিশেষ স্বভাবে অলংকৃত করে প্রকৃতিকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য ছিল একটি অলৌকিকসৌন্দর্যের সত্তাকে প্রকাশ করাপ্রকৃতি সেই প্রকাশের ক্ষেত্রে কবির সহায়ক হয়েছে। এ জন্য রবীন্দ্র কাব্যে প্রকৃতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়নিপ্রাকৃতিক চিত্রগুলি বিশেষ প্র াবদ্ধ সাধারণ চিত্রে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ জাগতিক বস্তু কবি চেতনার প্রতীক হয়ে প্রকাশিত হয়েছেজাগতিক বস্তুর দিকে কবির প্রধান লক্ষ্য কখনও ছিল না।
মানস সুন্দরী কবিতার মর্মবস্তু হচ্ছেমানস সুন্দরী রূপিনী কবির যে প্রেরণা অথবা যে সৌন্দর্য কবিচিত্তে একটি উপলব্ধি নির্মাণ করেছে সে অন্তর্চেতনাকে উপস্থিত করা। এই অন্তর্চেতনাকে কবি উপস্থিত করেছেন প্রকৃতির বর্ণনার মধ্য দিয়ে। এ বর্ণনায় কবি ২টি চিত্র উপস্থিত করেছেন। প্রমতঃ শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেহকে প্রসারিত করে সায়াহ্ন আলোকে যে পদ্মা জেগে আছেসে পদ্মার উপমা। দ্বিতীয়তঃ সন্তর্পণে নদীতীরে সন্ধ্যার পদার্পণের সিড়বগ্ধ রূপকল্প। এ কবিতায় কবিপ্রকৃতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে নির্জনতাকে এবং প্রশান্তিকে সর্বত্র প্রবাহিত করে পৃথিবীর বুকে যে রাত্রি নেমে এসেছে তার বিবরণ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে কবি মানবচিত্তের বিভিনড়ব অবস্থার বিকল্প হিসেবে প্রকৃতির চিত্তকে উন্মোচন এবং তারমাধ্যমে মানবচিত্তের বিভিনড়ব অবস্থাকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।
চৈতালী কাব্যের ভূমিকা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যে মন্তব্য করেছেন তার সারকথা হচ্ছেচতুর্দিকে তিনি যে দৃশ্য দেখেছেন সে দৃশ্যের কোন কোনটি তার নিকট অভাবিত মনে হয়েছে এবং সে অভাবিত অংশের খণ্ড খণ্ড অংশ তিনি চৈতালী কাব্যে উপস্থাপন করেছেন। চৈতালীতে তিনি শুধুমাত্র নির্জনতা ও শ্রান্ত শ্রীর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেনপ্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেননি।
মধ্যাহ্ন কবিতাটিতে কবি দুপুরের একটি সুষুপ্ত অবস্থার পরিচয় অংকন করেছেন। প্রকৃতিকে অবলম্বন করে মধ্যাহ্নের আবহ নির্মাণই কবির মূল লক্ষ্য ছিল। এ অবস্থাটি কবির অন্তর্লোকের। প্রভাত কবিতাটিতেও আমরা একই আবহের নির্মাণ কৌশল লক্ষ্য করি। সেখানে পরিচ্ছনড়ব ঊষার সিড়বগ্ধতা এবং শীতলতাকে কবি প্রভাতকালের আবহ নির্মাণে ব্যবহার করেছেন।
রবীন্দ্র বিশ্বাস : রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজগতের সুষম সংগতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বিশ্বজগত একটি মৌলিক সংগতিতে সংরক্ষিত। বিভিনড়ব কবিতায় তিনি এই সংগতির সাথে একাত্ম হতে চেয়েছেন।
মহুয়া কাব্যগ্রন্থের বোধন কবিতায় আমরা দেখতে পাই যেকবি নির্দয় নবযৌবনের ভাঙ্গনের কথা বললেও তাঁর নিকট সে ভাঙ্গনটা হচ্ছে একটি আনন্দের নতুন পট উন্মোচনের মতো। দায়মোচন কবিতায় কবি লিখেছেন,
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি।
যা পেয়েছি তাই মোর অক্ষয় ধন,
যা পাইনি সেই বড়ো নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন,
চিরবিচ্ছেদ করি জয়।
এ কবিতায় কবি সকল অবস্থার শৃঙ্খলিত সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাসের কথা ঘোষণা দিয়ে একটি শান্তি ও নিশ্চিন্ততাকে কামনা করেছেন।
'পরিচয়কবিতায় কবি দুর্যোগের মধ্যেও নৈরাশ্যজয়ী একটি পটভূমির কল্পনা করেছেন। কবি লিখেছেন,
সে দুর্যোগে এসেছিনু তোমার বৈকালী,
কদম্বের ডালি।
বাদলের বিষণড়ব ছায়াতে,
গীতহারা প্রাতে।
নৈরাশ্যজয়ী সে ফুল রেখেছিল কাজল প্রহরে,
রোদ্রের স্বপন ছবি রোমাঞ্চিত কেশরে কেশরে।
আছিযাত্রীদুর্দিনেদুয়ার প্রভৃতি কবিতায় কবির মূল কথা হলো- "পৃথিবীতে আঘাতের অন্ত নেই কিন্তু বিপুল শান্তি তবুও অক্ষুণড়ব থাকে।"
'রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতিবিষয়ক আলোচনার সমাপ্তিপর্বে কবির 'রূপ-বিরূপকবিতার আলোচ্য বিষয় স্মরণযোগ্য। এ কবিতায় কবি এই অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন যেতিনি সমগ্র জীবনব্যাপী প্রকৃতির বিচিত্র ভাষা পাঠ করার চেষ্টা করেছেন। সে ভাষার স্বরূপে ভিনড়বতা ছিল। কোথাও তা ছিল রহস্যঘেরা অরণ্যের ছায়াময় ভাষাকোথাও তা কুসুম প্রগলভ রূপকের ভাষাকোথাও তা ছিল প্রাচীন পর্বতের ধ্যানমৌনতার ভাষা। কবির বক্তব্যে যে প্রগলভতারহস্য এবং ধ্যানমৌনতার কথা বলা হয়েছে তা মূলত কবিচিত্তের রহস্য প্রবণতাপ্রগলভতা ও ধ্যানমৌনতার অনুভূতি।
এক কথায় বলা যায়রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতি উপাদান মাত্র- প্রকৃতি চর্চাটা এখানে মুখ্য নয়।
আদর্শ হিসেবে রবিন্দ্রনাথঃ
এ পর্যায়ে আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাইরবীন্দ্রনাথ কখনো পশ্চিম বাঙলার বাঙালীদের এবং পূর্ব বাংলার বাংলাদেশীদের আদর্শ হতে পারেন না। তাঁর জীবনালেখ্যে আমরা যা পাই তা হলো :
১. তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি এবং সাম্রাজ্যবাদের চাহিদা মিটাতেই তিনি আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
২. তিনি এবং তাঁর সতীর্থরা কোন বাঙালী বীরকে আদর্শস্থানীয় হিসেবে নিজ সাহিত্যে স্থান দেননি। ফলে জাতীয়তাবোধ বাংলার সীমানায় কেন্দ্রীভূত থাকেনি।
৩. তিনি বাঙালী জাতিসত্তাকে আর্যভারতীয় জাতিসত্তার পদপ্রান্তে বিসর্জন দিয়েছেন।
৪. তিনি সাধারণ বাঙালীদের কল্যাণার্থে কখনও কিছু করেননিলেখেননি।
৫. তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনশ্রীনিকেতন ব্রিটিশ প্রভুদের গোলাম সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত ছিলবাংলার উত্থানের কাজেনিয়োজিত হয়নি।
৬. তিনি বাংলার এবং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে কখনও একটি বাক্য উচ্চারণ করেননি বা একটি লাইনও লিখেননি। তদুপরি ভবিষ্যত স্বাধীন ভারতের আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা হিসেবে পছন্দ করেছিলেন হিন্দী ভাষাবাংলা নয়।
রবীন্দ্রনাথ কখনো বাংলাদেশের জনগণের অনুকরণীয় হতে পারেন না। তার কারণসমূহ নিমড়বরূপ :
১. ব্রিটিশ আমলে হিন্দুরাই বাঙালী ছিল মুসলমানরা নয়। দু'টি উদাহরণ দেখুন:
ক. "তিনশত বৎসরের মধ্যে বাঙালী ধর্ম রক্ষার্থে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়ায় নাই।" (বাঙ্গালার ইতিহাস,রমেশচন্দ্র মজুমদার)।
খ. "ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ।" (শ্রীকান্ত : ১ম পর্ব১ম অধ্যায়২য় পৃষ্ঠা)।
২. রবীন্দ্রনাথ বাঙালী হিন্দুদের কবি ছিলেনমুসলমানদের নয়। যথা- "বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীয় আকাশে কতবার শরতের চন্দ্রোদয় হয়েছেতাতে শারদীয় পূজায় 'আনন্দময়ী মাকতবার এসেছে গিয়েছেকিন্তু একদিনের তরেও সে বিশ্বের আকাশে ঈদ-মোহররমের চাঁদ উঠেনি। সে চাঁদ উঠাবার ভার ছিল নজরুল ইসলামের উপর। এতে দুঃখ করার কিছুই নেই। কারণ এটা স্বাভাবিক। কাজেই কঠোর সত্য।" (বাংলাদেশের কালচারআবুল মনসুর আহমদপৃ. ১০৩)।
৩. রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টতাঁর সাহিত্যও সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের সাহিত্য। সুতরাং তার অনুসরণে এদেশেরস্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদের নিকট আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে।
৪. রবীন্দ্র সাহিত্য হিন্দু সংস্কৃতি নির্ভর এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির বিপরীতে অবস্থিত। সুতরাং এরূপ সাহিত্যেবাংলাদেশের কোন কল্যাণ নেই। যথা- "দেশের প্রাণ প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে মনগড়া অথবা পরদেশী সংস্কৃতি বা সাহিত্যের প্রবর্তনে পৃথিবীর কোন জাতির কখনোই মঙ্গল হয়নি। মূল বৃক্ষের ন্যায় সংস্কারকেও একেবারে মাটির অন্ধকার ফঁেু ড়উঠতে হবে।" (শ্রী সজনী কান্ত দাসদীপালী উৎসবপৃ. ১৩৯)।
৫. শুধু রবীন্দ্র সাহিত্য নয়। সাম্রাজ্যবাদেরএজেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী কোন কবি-লেখকের সাহিত্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাহিত্য হতে পারে না। এ বিষয়ে বিশিষ্ট লেখকসাহিত্যিকসাংবাদিকরাজনীতিবিদ ও আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন বুদ্ধিজীবী আবুল মনসুর আহমদ লিখিত বাংলাদেশের 'কালচারনামক অতি মূল্যবান বই থেকে উদ্ধৃতি পেশ করছি।
"পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুবই উনড়বত সাহিত্য। বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথ এ সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গেছেন।
তবু এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়কারণ এটা বাংলার মুসলমানের সাহিত্য নয়। এ সাহিত্যে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোন দান নেইশুধু তা নয় মুসলমানের প্রতিও এ সাহিত্যের কোন দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ কোন প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছেসে কারণ এই যেএই সাহিত্যের স্রষ্টা মুসলমান নয়এর বিষয়বস্তুও মুসলমান নয়এর স্পিরিটও মুসলমান নয় এবং এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়। প্রমত এ সাহিত্যের স্পিরিটের কথা ধরা যাক। এ সাহিত্য হিন্দু-মনীষীর সৃষ্টি। সুতরাং স্বভাবতই হিন্দু সংস্কৃতিকে বুনিয়াদ করেই তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ঠিকই করেছেন তাঁরা। নইলে ওটা জীবন্ত সাহিত্য হতো না।...
ত্যাগের আদর্শবৈরাগ্যের আদর্শভক্তিবাদের আদর্শপ্রেমের আদর্শ সমস্তই উঁচু দরের আদর্শ। এইসব আদর্শকে বুনিয়াদ করে নারী প্রেমকে কেন্দ্র করে হিন্দু শিল্প-মনীষা যে সাহিত্য রচনা করেছে সে সবই হয়েছে উচ্চাঙ্গের সাহিত্য এবং তা পড়ে অপর সকলের মতই মুসলমান রস পিপাসুরাও পিপাসা নিবারণ করে থাকে।
কিন্তু সত্য কথা এই যেঐ সাহিত্যকে মুসলমানরা তাদের জাতীয় সাহিত্য মনে করতে পারে না। কারণ ত্যাগ-বৈরাগ্য-ভক্তি-প্রেম যতই উঁচু দরের আদর্শ হউকমুসলমানের জীবনাদর্শ তা নয়। হিন্দুর ধর্ম যেমন ত্যাগ-বৈরাগ্য ও মুণি ঋষির ধর্ম মুসলমানের ধর্ম তেমনি হক-ইনসাফ ও জেহাদ-শহীদের ধর্ম। প্রতীকবাদী সুন্দর পূজারী আর্টবাদী হিন্দু সংস্কৃতি যেমনব্যক্তিকেন্দ্রিকমুসলিম সংস্কৃতি তেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। হক-ইনসাফবাদী কল্যাণমুখীমুসলিম সংস্কৃতি তাই সমাজকেন্দ্রিক।...
এ জন্যই বর্তমান বাংলা সাহিত্য মুসলিম সমাজ মনে কোন প্রেরণার স্পন্দন জাগাতে পারেনি। তাই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমে প্রতিবেশী হিন্দু ভাইকে আনন্দে নৃত্য করতে দেখেও মুসলিম সমাজমে নর একটি তারও ঝনাৎ করে উঠেনি। বিশ্ব-কবির'মাথানত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে'র অত বড় আবেদনে একটি মুসলমানের মাথা এক ইঞ্চি হেঁট হলো না
তার বদলে যেদিন এক অচেনা-অজানা বালক হঠাৎ জিকির দিয়ে উঠলো : 'বল বীর উনড়বত মম শিরসেদিন রিক্ত,ক্লান্তঘুমন্ত ও জীবনমৃত মুসলমান ধচমচ করে জেগে উঠে চোখ রগড়াতে রগড়াতে হুংকার দিয়ে উঠলো- 'উনড়বত মমশির'। কারণ এ যে তারই অন্তরের ঘুমন্ত শিশুর চিৎকার। এ যে তারই জীবনের কথা। তাই নজরুল ইসলামের আকস্মিক আবির্ভাব মুসলিম সমাজ মনকে এমন করে আলোড়িত করতে পেরেছে। মুসলমানের বিবেচনায় মানব জীবনেরসুখ-দুঃখ আলো-আঁধারহাসি-কানড়বাতাদের দেবত্ব-পশুত্বতাদের হীনতা-ক্ষুদ্রতাতাদের সংগ্রাম-সাধনা এ সবই সাহিত্যের বুনিয়াদ এবং নজরুল ইসলাম এই জীবনকে কেন্দ্র করেই সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। শুধু এই কারণেই নজরুল ইসলাম পূর্ব পাকিস্তানের প্রম জাতীয় কবি।
সাহিত্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি বলেছেন, "সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা যদি আমরা না হলামসাহিত্যের পটভূমি যদি আমার কর্মভূমি না হলোতবে সে সাহিত্য আমার সাহিত্য হয় কিভাবেআমার ঐতিহ্যআমার ইতিহাসআমার কিংবদন্তী,আমার উপকথা যে সাহিত্যের উৎস নয়সে সাহিত্য আমার উৎস হবে কেমন করে। রাম-লক্ষ্মণভীম-অর্জুনসীতা-সাবিত্রীরাধা-কৃষ্ণমথুরা-অযোধ্যাউজ্জ্বয়িনী-ইন্দ্রপ্রস্থহিন্দুর মনে যে স্মৃতি কল্পনা ও রস সৃষ্টি করেযে 'আইডিয়া অব এসোসিয়েশনজাগায়মুসলিম মনে কি তা করতে পারেতেমনি আবার আলীহামযাসোহরাব-রুস্তমশাহজাহান-আলমগীর,হাযেরা-রাবিয়া-চাঁদ সুলতানাসিরাজ-কাসেমঈশা খাঁ-মুসা খাঁগৌড়-সোনারগাঁমুসলিম মনে যে স্মৃতি-কল্পনা ও রস সৃষ্টি করে বা 'আইডিয়া অব এসোসিয়েশনজাগায় হিন্দুর মনে তা করতে পারে না। এটা শুধু মুসলিমের কথা নয়।তামাম দুনিয়ায় সকল জাতি সম্বন্ধেই এ কথা সত্য। সব জাতির জাতীয় চেতনাই জাগে তার ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে। যতদিন সে ঐতিহ্যকে বুনিয়াদ করে সাহিত্য রচিত না হবে ততদিন সে সাহিত্য থেকে কোন জাতি প্রেরণা পাবে না।"বাংলার মুসলমানও তেমনি রবীন্দ্রনাথকে নকল করে বড় হতে পারবে না। তাকে বড় হতে হবে তার স্বকীয়ত্বের উপর দাঁড়িয়েনিজের কৃষ্টিকে বুনিয়াদ করে।
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সতীর্থদের লিখিত সাহিত্য অনুকরণ ও অনুসরণের অনিবার্য পরিণাম বাঙালীত্বের মৃত্যুএকইভাবে উক্ত সাহিত্যের অনুকরণ ও অনুসরণ বাংলাদেশীত্বের মৃত্যু ঘটাবে। মূলত: বাংলাদেশী জাতিসত্তার মৃত্যু ঘটাতেই আর্যভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী চμ এদেশে রবীন্দ্র ভক্তের চাষাবাদে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে।
উপসংহার
ঐতিহাসিক নিরীক্ষকের প্রয়োজন হয় পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সার্থক ব্যবহারভক্তের চোখ ও কান থাকাই যথেষ্ট আর অন্ধ ভক্তের শুধু কান থাকলেই চলে। অতিভক্তি যে সব সময় সুখকর হয় না তা রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু যন্ত্রণার পরপরই।
"ভক্তঅভক্ত না অতিভক্ত- নির্ধারণ করা মুশকিল। প্রচুর বাঙালী দর্শক এসে প্রতীক্ষা করছেন তাঁর মরদেহ দেখার। জয়ধ্বনি হচ্ছিল জোরে জোরে। ভক্তির প্রাবল্যে ঠাকুরবাড়ির কোলাপসিবল গেট ভেঙ্গে ফেলল জনতা। ভক্তরা কবির মরদেহ সাজানো খাট থেকে তুলে নিয়ে চলে গেলেন জনস্রোতের মাঝখানে। কবি নিষেধ করে গিয়েছিলেন তবুও 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি জয়' 'বন্দেমাতরমধ্বনিত হতে লাগলো বারে বারে। বাঙালী রবি ভক্তদের এতই ভক্তির আধিক্য যেকবির স্মৃতি বাড়িতে রাখার জন্য প্রায় সারা জীবন ধরে তাঁর সযতেড়ব সংরক্ষিত মাথাভর্তি শুভ্র কেশচিত্তাকর্ষক দাড়ি অনেকেছিঁড়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। শেষে দেখা গেলশ্মশানে যাওয়ার পূর্বে কবির চেহারাই বদলে দিয়েছেন অতি ভক্তের দল।
যখন মুখাগিড়ব করা হয়তখন রবীন্দ্রনাথের মুখমণ্ডল বিকৃত। জনতার এতই রবি অনুরাগ যেস্মৃতিচিহ্ন হিসাবে তাঁর মাথার চুল ও মুখের দাড়ি সব উপড়ে নিয়ে যাওয়া হযেছে। এই হলো গিয়ে কবির প্রয়াণের শেষ দৃশ্য। (অমিতাভ চৌধুরীইসলাম ও রবীন্দ্রনাথপৃ. ১৩৬-৩৭)।
ঠাকুরবাড়ি
৪৩টি বেশ্যালয়ের মালিকমাদক ও দাস ব্যবসায়ীলবণের এজেন্ট এবং নীলকর দ্বারকানাথ ওরফে প্রিন্স দ্বারকানাথ ছিলেনঠাকুরবাড়ির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রাজ্যবিহীন রাজা রামমোহনের সাগরেদ দ্বারকানাথ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম দোসর বা গোলাম। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা এবং শাসন-শোষণ দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে প্রণীত বহুল পরিচিত ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির সূতিকাগার হিসেবে ঠাকুরবাড়িকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা লাভের জন্য কয়েকটি উদ্ধৃতি প্রদত্ত হলো।
১. "অনেকের মতেহিন্দু-মুসলিম বিভেদের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল ঐ 'হিন্দুমেলা জাতীয় সভা থেকে। এ মেলার পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নে ঠাকুরবাড়ির আর্থিক ও মানসিক সাহায্য আর সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেলার কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সদস্য। প্রম দিকে মেলার সম্পাদক ছিলেন গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পঞ্চম অধিবেশনের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ষষ্ঠ ও সপ্তম অধিবেশনের সম্পাদকও ছিলেন তিনি। অষ্টম অধিবেশনে তিনি হন সহ-সভাপতি। অষ্টম অধিবেশনের সহ-সম্পাদক ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ এ মেলার কর্মকর্তা নির্বাচিত হননি বটেকিন্তু মেলার কাজে তাঁরা μিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা রচনার মাধ্যমে। তথ্য : যোগেশ চন্দ্র বাগলহিন্দুমেলার ইতিবৃত্তপৃ. ৬ এবং ৪৮)।
২. রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ জীবনালেখ্য যদি খুব খুঁটিয়ে দেখা যায় তাহলে অন্ধভক্ত ও স্বপক্ষীয়দের বাদ দিলে আরো দু'টি পক্ষ থাকেএকটি বিপক্ষ এবং অপরটি নিরপেক্ষ। এই শেষ দু'টি পক্ষের অনেকের একথা বলা অস্বাভাবিক নয় যেব্রিটিশেরহাতে ভারতকে তুলে দেওয়ার চμান্তে যে দলটি সμিয়ভাবে কাজ করেছে তার মধ্যে ছিলেন ঠাকুরবাড়ির অনেক পুরুষ ও মহিলা। প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে অনুগত ভারতীয়দের সঙ্গে ইংরেজদের পরামর্শপরিকল্পনা গ্রহণমদ-মাংস,ইন্দ্রিয়পরায়ণতাব্যভিচার বা ইন্দ্রিয় রসের ছড়াছড়ি করিয়ে দেওয়ার মূল কারখানা যে 'টি ছিল ঠাকুরবাড়ি তার শ্রেষ্ঠতম না হলেও শ্রেষ্ঠতর হওয়ার দাবিদার। এই সাংঘাতিক ধারণার সাথে আমরা সহজে একমত হতে পারব নাকিন্তু এই দাবিকে খুব সহজে উড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধাও নেই আমাদের। কারণ এঁদের পক্ষে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দও আছেন। স্বামী বিবেকানন্দ মনে করতেনবাঙালী জাতির সর্বনাশ করেছে ঠাকুরবাড়ি। বাঙালী জাতির পৌরুষ সৃষ্টিতে সহায়ক না হয়ে ক্ষতিকারক হয়েছে ঐ ঠাকুরবাড়ি। এক কথায় ঠাকুর বাড়ির কালচার সম্পর্কে স্বামীজীর মনোভাব ছিল অত্যন্ত কঠোর। (দ্র: গোলাম আহমাদ মোর্তজাএ এক অন্য ইতিহাসপৃ. ১৯০)।
৩. "কিন্তু স্বামীজী ঠাকুরবাড়ির কালচার সম্পর্কে কঠোর মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেনঠাকুরবাড়ির প্রভাব বাঙালী জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর। তাঁর মত ছিলঠাকুরবাড়ির সাহিত্যদর্শন বাঙালীর সমাজে পৌরুষ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে না। তিনি রুঢ় কণ্ঠে বলেছিলেনএই পরিবার ইন্দ্রিয় রসের বিষ বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাঁর তীব্রমন্তব্যআমার জীবনোদ্দেশ্য রামকৃষ্ণ নয়বেদান্ত নয়আর কিছুই নয়- শুধু জনগণের মধ্যে পৌরুষ আনা।" (দ্র: পবিত্র কুমার ঘোষসাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকা ফেব্র"য়ারি১৯৯৭)।
"দূরদর্শী স্বামী বিবেকানন্দ ঊনবিংশ শতাব্দীতে যা বুঝেছিলেন বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা তার সত্যতা মেনে নিয়েছেন বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আর বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীরা সম্ভবত এখনো বয়োঃপ্রাপ্ত হয়নি।"
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের উপলব্ধি যেদিন সকল চিন্তাশীল বাঙালীর মনে ছড়িয়ে পড়বে সেদিন হলওয়েল মনুমেন্টের মতোরবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-পরবর্তী কেশরাশির মতোঠাকুরবাড়ির সকল স্থাপনা জনতা সমূলে উপড়ে ফেলে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে। সেদিনই বাঙালী ও বাংলাদেশীদের মিলনের সদর দরজা উন্মুক্ত হবে। কেননা ঠাকুরবাড়ি ও তার সমগোত্রীয় অন্যান্য ঋষিবাড়িতে ব্রিটিশ রোপিত সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষসমূহের ফল ও রস অমৃতজ্ঞানে গ্রহণ করার ফলেই উপমহাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের সূচনা ও বিকাশ ঘটেছে।

এস. এম. নজরুল ইসলাম
প্রকাশক  সম্পাদকমাসিক ইতিহাস অন্বেষা
১ম প্রকাশইতিহাস-অন্বেষাআগস্ট ২০০৫
[লেখকের 'জাতির উত্থান-পতনের সূত্র' গ্রন্থ থেকে নেওয়া]



__._,_.___

Posted by: Shahadat Hussaini <shahadathussaini@hotmail.com>


[* Moderator�s Note - CHOTTALA is a non-profit, non-religious, non-political and non-discriminatory organization.

* Disclaimer: Any posting to the CHOTTALA are the opinion of the author. Authors of the messages to the CHOTTALA are responsible for the accuracy of their information and the conformance of their material with applicable copyright and other laws. Many people will read your post, and it will be archived for a very long time. The act of posting to the CHOTTALA indicates the subscriber's agreement to accept the adjudications of the moderator]





__,_._,___