প্রোগ্রেসিভ ফোরামের দ্বি বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে গত ৮ নভেম্বর নিউ ইয়র্কের জেকসন হাইটসএর জুইস সেন্টার আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন,৭১এ মুক্তি যুদ্ধকালীন প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা লেখিকা শারমিন আহমদ। তিনি তার বক্তব্যে বলেন বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন ছিলেন পরস্পরের পরিপূরক। তাদেরকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অবৈধ ভাবে দখলের পর খোন্দকার মোশতাক অর্ডিনেন্স জারি করেন যে,বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবেনা। একই বছর মোশতাককে অপসারনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ঐ অর্ডিনেন্সকে স্থায়ীত্ব ও বৈধতা প্রদান করেন। তার ফলে ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও ৩ রা নভেম্বর জেল খানায় জাতীয় চার নেতাদের হত্যাকান্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বক্তা শারমিন আরো বলেন যে, ৭৫ এর ১৫ আগষ্টের বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড ও ৩রা নভেম্বরের জেল হত্যাকান্ড একই ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই হত্যাকান্ড গুলোর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে বিনষ্ট করার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০৪ সালে বি এন পি সরকারের আমলে জেল হত্যা কান্ডের সাথে জড়িত বলে অভিযুক্ত বি এন পির সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দবেকসুর খালাস প্রাপ্ত হন। তিনি উল্লেখ করেন যে এরশাদের আমলে হত্যাকারীদের দুজন ফারুক ও রশিদকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়া হয়।১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যান্ডের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। আশার কথা যে জেলহত্যা কান্ডের বিচারের বিষেয়ে পূনঃ তদন্ত শুরু হবে বলে জানা গিয়েছে। সেই সময়ে ১৯৮৭ সালে তিনি দেশে ফিরে জেল হত্যাকান্ডের উপর সাক্ষাৎকার ও নথিপত্র যোগাড় করে তিনি '৩রা নভেম্বর জেলহত্যা ও বিবেকের আত্মাহুতি' নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ঐ প্রবন্ধটি খুব সম্ভবত জেল হত্যাকান্ডের উপর প্রকাশিত প্রথম গবেষনা ভিত্তিক লেখনী।তিনি আরো উল্লেখ করেন যে সাক্ষাৎকার গুলো নেয়ার সময় অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতে চাননি। যাদের সাক্ষাৎকার তিনি নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আবদুস সামাদ আজাদ,জেল হত্যা কান্ড তদন্ত কমিশনের সদস্য বিচারপতি কে এম সোবহান,ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক বীর উত্তম, এ এস এম মহসিন বুলবুল প্রমুখ। তিনি বলেন, ভয় ভীতির উর্ধে থেকে আমাদের সত্যকে তুলে ধরতে হবে।তিনি বলেন দুঃখজনক হলেও এটা আজ সত্য যে আমাদের বুদ্ধিজীবিদের একটি বড় অংশ দলীয় হয়ে গেছেন। তাই এধরনের জাতীয় ইস্যু গুলোতে আমরা সত্য প্রকাশিত হতে দেখছিনা।আমাদের ভয় ভীতির উর্ধে উঠে অখন্ডিত ভাবে ইতিহাস ও সত্যকে ধারন করতে হবে। তিনি ইউরোপের রেনেসার উদাহরন দিয়ে বলেন,যে সেখানে সত্য সন্ধানী বুদ্ধিজীবিরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে সত্যের সংগ্রাম অব্যাহত রেখে আলোকিত নতুন যুগের সূচনা করেন। আজ শত শত বছর পর ইতিহাসে সক্রেটিস,ব্রুনো,গ্যালিলিও কে মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
তিনি বলেন,তার লিখিত বই 'তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা' বইটি না পড়েই অনেকেই তার বিরুদ্ধে না না অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। তিনি বইটি যথাসম্ভব নির্মোহ ও যুক্তিনিষ্ঠভাবে একটি ইতিহাস হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বইটির কোন অংশ পছন্দ না হলেই যুক্তি তথ্যের মধ্যে না গিয়ে তাকে নানা রূপ মিথ্যা অপবাদ দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এই ধারাটি থেকে জাতীয় স্বার্থেই বেরিয়ে এসে আমাদের সত্যের সাধনা ও যুক্তি বুদ্ধির মাধ্যমে মুক্ত চিন্তার চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। উনি একটি সুন্দর উপমা দিয়ে বক্তব্য শেষ করেন,যেখানে তিনি বলেন, মুক্তি যুদ্ধের গনতান্ত্রিক চেতনাকে ধারন করে জাতীয় কল্যানে দল মত নির্বিশেষে আমরা যেন রং ধনুর মতো বৈচিত্র্যময় নানা রং এর সমাহারে একটি একতার সেতু গড়ে তুলতে পারি। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে আরো উপস্থিত ছিলেন একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশী আমেরিকান ডাক্তারদের নেতা ডাক্তার জিয়াউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপিকা হুসনে আরা।বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা কাসেম আলী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রোগ্রেসিভ ফোরামের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদুল ইসলাম।সভা পরিচালনা করেন ফোরাম সাধারন সম্পাদক আলীম উদ্দিন।অনুষ্ঠান উদ্বাধন করেন সংগীতজ্ঞ মুত্তালিব বিশ্বাস। উদ্বোধনীতে নিউ ইয়র্কের উদীচী ইঞ্জিনিয়ার জীবন বিশ্বাসের নেতৃত্বে দেশাত্ববোধক সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সমাপ্তিতে আনন্দ ধবনি শিল্পী গোষ্ঠী সংগীত পরিবেশন করেন এবং আবৃত্তি করে শোনান গোপন সাহা। অনুষ্ঠানে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন নাজনীন মামুন। সম্মেলনের প্রথমে শিশু কিশোরদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সেমন্তী ওয়াহেদের সঞ্চালনায় নতুন প্রজন্মের 'বাংলাদেশ ভাবনা'বিষয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
__._,_.___