আসম আব্দুর রব বলেছেন, স্বাধীনতার সব মৌলিক ইস্যু যেমন-জাতীয় পতাকা নির্ধারণ ও অঙ্কন, জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন, সার্বভৌম দেশের সীমানা নির্ধারণ, বঙ্গবন্ধু উপাধি, বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন দেশের সর্বাধিনায়ক, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, ২৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনাসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও পরিকল্পনা করেছে 'ছাত্রলীগ' এবং 'স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস'।
স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের পরিকল্পনায় ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বিকালে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সভায় সিদ্ধান্ত হয় ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠানের। ঐ সভায় ডাকসু ভিপি হিসেবে ছাত্রসমাজের পক্ষে আমি সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করি। আমার পাশে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। একাত্তরের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান পূর্ব ঘোষিত সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার পর গর্জে ওঠে ছাত্র-জনতা। সংসদ স্থগিত ঘোষণা শোনার পর হাজার হাজার ছাত্র-জনতার এক মিছিল বের করি। মিছিল নিয়ে হোটেল পূর্বাণীতে যাই এবং পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে দিই। বঙ্গবন্ধু তখন হোটেল পূর্বাণীতে অবস্থান করছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবদুল কুদ্দুস মাখন বিশাল মিছিল নিয়ে বায়তুল মোকাররম আসার পর, আমরা পল্টন ময়দানে যাই এবং পাকিস্তানপন্থিদের (মাওলানা ফরিদ আহমদের) সভামঞ্চ ভেঙে দিই। ৩ মার্চ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সভায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন নূরে আলম সিদ্দিকী। আমি, তোফায়েল আহমেদ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন বক্তব্য দিই। এ ইশতেহারেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণাসহ স্বাধীন রাষ্ট্রের নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিরোধ দিবসের ডাকে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ে। ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উঠানো হয়। পতাকা উত্তোলনের সময় গান ফায়ারিং করেন জয় বাংলা বাহিনীর উপ-প্রধান কামরুল আলম খসরু। জয় বাংলা বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করি আমি, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। জয় বাংলা বাহিনীর পাঁচ শতাধিক সদস্য সামরিক কায়দায় স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে মিছিল করে সারা ঢাকা শহরে। শহর প্রদক্ষিণ শেষে তারা পল্টনে জমায়েত হয়। সেখানে সামরিক কায়দায় বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানানো হয়। জয় বাংলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নতুন পতাকা তাকে উপহার দেওয়া হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমি সামরিক কায়দায় স্বাধীন বাংলার পতাকা হাতে তুলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানাই। বাংলাদেশের সব বিদেশি দূতাবাসে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকারি অফিস-আদালতে এ পতাকা তোলা হয়। এদিন বেতার-টেলিভিশনে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি প্রচার করা হয়। এদিন হাজার হাজার ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমি স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিই। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে বিএলএফ ট্রেনিং ক্যাম্পে চলে যাই, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকবাহিনী ও তার দোসররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ও শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। রাজারবাগে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাঙালি পুলিশদের। নিরস্ত্র বাঙালি ক্রমেই সশস্ত্র হয়ে ওঠে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
__._,_.___