অভিমত : ফেলানীকে আবার মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে
অ্যাডভোকেট বাবুল দে : ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীকে সীমান্তে গুলি করে হত্যা-পরবর্তী লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকার সচিত্র দৃশ্য দেখে যে কোনো বিবেকবান মানুষের মনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জন্ম নেয়া স্বাভাবিক। দেশে নারী নির্যাতন ও হত্যার অনেক জঘন্য ঘটনা প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় প্রকাশ হলেও প্রতিবেশী বৃহত্তর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষী বাহিনী একজন নিরীহ কিশোরীকে নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করে তার লাশ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখে যে বীরত্ব দেখিয়েছে, তাকে বিশ্ববাসী ধিক্কার জানিয়েছে। ফেলানী শুধু বাংলাদেশী কিশোরী নয়, সে একজন মানুষ ছিল। হাতে অস্ত্র থাকলে অকারণে নিরপরাধ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা যায় না- তা প্রশিক্ষিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের ভালো করে জানা থাকার কথা। আমরা যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নেই যে, ফেলানী হত্যা বিএসএফের একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল ছিল, তাহলে সে ভুলের সংশোধন স্বরূপ যদি পরবর্তীতে সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বন্ধ থাকত, তাহলে বিষয়টিকে অসাবধানতাবশত ভুল বলে মেনে নেয়া যেত। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিকদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা, জখম এবং নানাভাবে নির্যাতনের ঘটনা একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিষয়টি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ও উসকানিমূলক ধরনের হেতু তা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। ভিনদেশের কোনো নাগরিক যদি অবৈধভাবে সীমান্ত লঙ্ঘনে অনুপ্রবেশ করে তাহলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী গ্রেফতার ও শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তাই বলে লঘু অপরাধে গুরুদ-, বিনাবিচারে হত্যা মানবতার চরম লঙ্ঘন নয় কী? অবৈধ অনুপ্রবেশকারী যদি কোনোভাবে আক্রমণ না করে, নাশকতার চেষ্টা না করে বা সীমান্তরক্ষীদের জান-মালের হুমকির কারণ না হয়, তাহলে তাকে গুলি করার আইনগত অধিকার থাকতে পারে না। ফেলানী একজন নিরীহ অসহায় কিশোরী ছিল। সে বিএসএফের জন্য কোনোভাবে হুমকির কারণ ছিল না। ফেলানী হত্যা-পরবর্তী বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলে কর্তৃপক্ষ তদন্তক্রমে দোষী বিএসএফ সদস্যের বিরুদ্ধে বিচার ও শাস্তির আশ্বাস প্রদান এবং বিচার অনুষ্ঠানে ফেলানীর বাবা, মামা, বাংলাদেশের একজন পাবলিক প্রসিকিউটর এবং বিজিবি প্রতিনিধির বিচারে সাক্ষ্য দান ও সহায়তা দানের জন্য ভারতে যাওয়ার সুযোগ দেয়াতে আমরা বাংলাদেশীরা আশা করেছিলাম ফেলানী হত্যার ন্যায় বিচার হবে। কিন্তু ফেলানী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এবং গুলি করে হত্যার কথা স্বীকার করা বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে হত্যার দায় থেকে বেকসুর খালাস দেয়ার খবর পাঠে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক বিস্মিত, হতবাক হওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবে চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে এহেন প্রহসনের বিচারের রায়ে। পত্রিকার খবরে জানা যায়, ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এহেন প্রহসনের রায়ের সমালোচনা করেছে। মৃত্যদ- নয়, আজীবন কারাদ- নয়, ৫-৭ বছরের সশ্রম কারাদ- নহে, একেবারে বেকসুর খালাস দেয়ার প্রহসনের রায়ে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত লাইন 'কাদম্বিনীকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হইল সে মরে নাই'-এর কথা মনে পড়ে যায়। এখানে কি ফেলানীর আবার মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে- সে মরিয়াছে। বিষয়টি ভারত সরকার গুরুত্বের সাথে পুন:বিবেচনা না করায় দু'দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাবের ঝুঁকি রয়েছে। কেননা, ফেলানী শুধু এক দরিদ্র বাবা-মায়ের সন্তান নয়, তার বিষয়ে দেশের ১৫ কোটি মানুষের শোকাহত সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়েছে এবং বিষয়টি এখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তাসহ নানা বিষয়ে ত্যাগ স্বীকারের যেমন গৌরব করে, তেমনি বাংলাদেশের জনগণও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলেও স্বাধীন রাষ্ট্রটির জনগণের সুখ-দুঃখের প্রতি মমত্ব দেখানো এবং নাগরিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্যও রয়েছে। বৃহত্তর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষী কর্তৃক ছোট দেশের নিরীহ নাগরিকদের হত্যা বন্ধুত্বের পরিচায়ক নয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা করেছে বলেই কি সে দেশের নাগরিকদের হত্যার অধিকারী হবে? একইভাবে আন্তর্জাতিক ও আন্তঃদেশীয় অভিন্ন নদ-নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি থেকে বঞ্চিত করার অধিকারী হবে? এমনকি সীমান্তবিরোধ ও ছিটমহল বিনিময় সমস্যাকে যুগ যুগ ধরে ঠেকিয়ে রেখে নানা অপকৌশলে স্বাধীন দেশটিকে শোষণ করবে, এমনকি মাথা তুলতে দেবে না- এরূপ মনোভাব কাম্য হতে পারে না। গ্রামীণ প্রবাদ- 'যে কারণে মুড়াইলাম মাথা, সে কারণে যদি যায় ঝুলি আর কাঁথা' তাহলে বিষয়টি মেনে নেয়া যায় না। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সমস্যার বিষয়ে আন্তরিক না হয়ে কেবল ক্ষমতাদর্পী, তাঁবেদারি মনোভাব দিয়ে ১৫ কোটি মানুষের অধিকার ও বিবেকবোধকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা ও চিন্তা নিছক নির্বুদ্ধিতারই পরিচায়ক। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সমস্যা থাকাটা স্বাভাবিক বটে। তাই বলে সমাধানের ক্ষেত্রে সৎ মনোভাব না নিয়ে চানক্যনীতি, ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিলে তাতে অশ্রদ্ধা-ক্ষোভের বৃদ্ধি ঘটে। বর্তমান আলামতদৃষ্টে বহু বিষয়ে তা হতে দেখে স্বাধীন দেশের মানুষ ক্রমে প্রতিবাদী হচ্ছে। বিষয়টি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সে দেশের জনগণকে হৃদয় দিয়ে বুঝতে হবে। বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগে কেবল অস্ত্র বল আর অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কোনো দেশকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। তাই এসব হীনমন্যতা পরিহারে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে শান্তি অন্বেষণই বুদ্ধিমানের কাজ। ভারত সরকার ও সেই দেশের নাগরিকরা বিষয়টি সময় থাকতে বুঝলেই মঙ্গল।
একইভাবে বাংলাদেশের নাগরিকদেরও অবৈধভাবে সীমান্তে অনুপ্রবেশের ঘটনা থেকে বিরত থাকতে হবে। সীমান্তে যেহেতু বারবার বিএসএফ কর্তৃক গুলিবর্ষণের মাধ্যমে নিরীহ নাগরিকদের হত্যার ঘটনা ঘটায়- তাই সাবধান হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কুকুর হতে সাবধান নীতির পাশাপাশি বিএসএফ থেকেও সাবধান থাকার নীতি অনুসরণ করতে হবে। করিৎকর্মা বিএসএফ বাংলাদেশের ইলিশ যখন অবৈধভাবে ভারতে পাচার হয়, তখন বাধা দেয় না বা গুলি করে না। ফেনসিডিলসহ বহুধরনের মাদকদ্রব্য ও অস্ত্রশস্ত্র ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার হয় তখন বাধা দেয় না বা গুলি করে না, শুধু নিরীহ নাগরিক দেখলেই তাদের হাত নিশপিশ করে ট্রিগার টানার জন্য। একেই বলে মরাগরুর বাঘ। এযাবত সীমান্তে যেসব বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে, তারা কেউ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ছিল বা তারা তখন কোনো ক্ষতিকর দ্রব্য বহন করেছিল যা ভারতের জন্য হুমকির কারণ ছিল, এরূপ কোনো প্রমাণ নেই। বরং তাদের বেশিরভাগই সীমান্তে কাজ করতে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, চোরাই পথে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার গরু পাচারের শ্রমিক। এসব লোকদের ধৃত করে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে শাস্তি দেয়া হলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশ ব্যতীত পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান রাষ্ট্রের সীমান্ত থাকলেও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে, তেমন বিশেষ নজির নেই। যদিও এসব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কয়েকটির সাথে ভারতের একাধিকবার যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে, এমন কি তাদের সাথে সম্পর্ক এখনও তেমন বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। আর স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তাকারী দাবীতে বন্ধুপ্রতীম ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নাগরিকদের অহরহ গুলি করার বিষয়টি শোল ধরে মোচড়াতে না পারলেও টাকি ধরে মোচড়ানোর সামিল বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। এর পশ্চাতে ভারত সরকারের অন্য কোনো গোপন উদ্দেশ্য, সন্দেহ, সংশয়, শঙ্কা রয়েছে- যা তারা প্রকাশ করছে না। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যথাযথ ভূমিকা নিতে না পারা ও ব্যর্থতার বিষয়টিকে অস্বীকার করা যাবে না। বিগত ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলেও সীমান্তে হত্যাকা- ঘটেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ও দায়িত্বশীল মহল বারবার হত্যাবন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তার কোনো লক্ষণ এ যাবত দেখা যাচ্ছে না। আমাদের বিশ্বাস এর সাথে রাজনীতির চাইতেও অর্থনীতির বিষয় জড়িত, যে কারণে বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কঠোর হতে পারছে না। এজন্য আমাদের স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের স্বাবলম্বী হতে না পারার ও অসহায়ত্বের সুযোগ তারা নিতে থাকবে। যেমন এই তো কয়েকদিন আগে ভারত সরকার সাময়িক পেঁয়াজ রফতানি বন্ধে কৌশল হিসেবে পেঁয়াজের রফতানি মূল্য বাড়িয়ে দিলে বাংলাদেশে রাতারাতি পেঁয়াজের কেজি ৪০ থেকে ৮০ টাকা হয়ে যায়। এমন গুজবও রটানো হয় যে, ইলিশ রফতানি বন্ধের প্রতিশোধ নিতে নাকি ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ রেখেছে। এভাবে আমরা যতদিন ভারত থেকে নানা দ্রব্যসামগ্রী আমদানিতে নির্ভরশীল থাকব ততদিন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কঠোর হতে পারবে না। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে জাতিকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা, এক সাধক পুরুষের উপদেশবাণী 'স্বাবলম্বনই শক্তিমানের পরিচয়পত্র'। পরিশেষে ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার দাবিসহ সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা-নির্যাতন বন্ধ হোক, এটাই কামনা করছি।
লেখক : আইনজীবী
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তাসহ নানা বিষয়ে ত্যাগ স্বীকারের যেমন গৌরব করে, তেমনি বাংলাদেশের জনগণও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলেও স্বাধীন রাষ্ট্রটির জনগণের সুখ-দুঃখের প্রতি মমত্ব দেখানো এবং নাগরিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্যও রয়েছে। বৃহত্তর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষী কর্তৃক ছোট দেশের নিরীহ নাগরিকদের হত্যা বন্ধুত্বের পরিচায়ক নয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা করেছে বলেই কি সে দেশের নাগরিকদের হত্যার অধিকারী হবে? একইভাবে আন্তর্জাতিক ও আন্তঃদেশীয় অভিন্ন নদ-নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি থেকে বঞ্চিত করার অধিকারী হবে? এমনকি সীমান্তবিরোধ ও ছিটমহল বিনিময় সমস্যাকে যুগ যুগ ধরে ঠেকিয়ে রেখে নানা অপকৌশলে স্বাধীন দেশটিকে শোষণ করবে, এমনকি মাথা তুলতে দেবে না- এরূপ মনোভাব কাম্য হতে পারে না। গ্রামীণ প্রবাদ- 'যে কারণে মুড়াইলাম মাথা, সে কারণে যদি যায় ঝুলি আর কাঁথা' তাহলে বিষয়টি মেনে নেয়া যায় না। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সমস্যার বিষয়ে আন্তরিক না হয়ে কেবল ক্ষমতাদর্পী, তাঁবেদারি মনোভাব দিয়ে ১৫ কোটি মানুষের অধিকার ও বিবেকবোধকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা ও চিন্তা নিছক নির্বুদ্ধিতারই পরিচায়ক। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সমস্যা থাকাটা স্বাভাবিক বটে। তাই বলে সমাধানের ক্ষেত্রে সৎ মনোভাব না নিয়ে চানক্যনীতি, ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিলে তাতে অশ্রদ্ধা-ক্ষোভের বৃদ্ধি ঘটে। বর্তমান আলামতদৃষ্টে বহু বিষয়ে তা হতে দেখে স্বাধীন দেশের মানুষ ক্রমে প্রতিবাদী হচ্ছে। বিষয়টি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সে দেশের জনগণকে হৃদয় দিয়ে বুঝতে হবে। বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগে কেবল অস্ত্র বল আর অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কোনো দেশকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। তাই এসব হীনমন্যতা পরিহারে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে শান্তি অন্বেষণই বুদ্ধিমানের কাজ। ভারত সরকার ও সেই দেশের নাগরিকরা বিষয়টি সময় থাকতে বুঝলেই মঙ্গল।
একইভাবে বাংলাদেশের নাগরিকদেরও অবৈধভাবে সীমান্তে অনুপ্রবেশের ঘটনা থেকে বিরত থাকতে হবে। সীমান্তে যেহেতু বারবার বিএসএফ কর্তৃক গুলিবর্ষণের মাধ্যমে নিরীহ নাগরিকদের হত্যার ঘটনা ঘটায়- তাই সাবধান হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কুকুর হতে সাবধান নীতির পাশাপাশি বিএসএফ থেকেও সাবধান থাকার নীতি অনুসরণ করতে হবে। করিৎকর্মা বিএসএফ বাংলাদেশের ইলিশ যখন অবৈধভাবে ভারতে পাচার হয়, তখন বাধা দেয় না বা গুলি করে না। ফেনসিডিলসহ বহুধরনের মাদকদ্রব্য ও অস্ত্রশস্ত্র ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার হয় তখন বাধা দেয় না বা গুলি করে না, শুধু নিরীহ নাগরিক দেখলেই তাদের হাত নিশপিশ করে ট্রিগার টানার জন্য। একেই বলে মরাগরুর বাঘ। এযাবত সীমান্তে যেসব বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে, তারা কেউ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ছিল বা তারা তখন কোনো ক্ষতিকর দ্রব্য বহন করেছিল যা ভারতের জন্য হুমকির কারণ ছিল, এরূপ কোনো প্রমাণ নেই। বরং তাদের বেশিরভাগই সীমান্তে কাজ করতে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, চোরাই পথে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার গরু পাচারের শ্রমিক। এসব লোকদের ধৃত করে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে শাস্তি দেয়া হলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশ ব্যতীত পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান রাষ্ট্রের সীমান্ত থাকলেও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে, তেমন বিশেষ নজির নেই। যদিও এসব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কয়েকটির সাথে ভারতের একাধিকবার যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে, এমন কি তাদের সাথে সম্পর্ক এখনও তেমন বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। আর স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তাকারী দাবীতে বন্ধুপ্রতীম ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নাগরিকদের অহরহ গুলি করার বিষয়টি শোল ধরে মোচড়াতে না পারলেও টাকি ধরে মোচড়ানোর সামিল বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। এর পশ্চাতে ভারত সরকারের অন্য কোনো গোপন উদ্দেশ্য, সন্দেহ, সংশয়, শঙ্কা রয়েছে- যা তারা প্রকাশ করছে না। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যথাযথ ভূমিকা নিতে না পারা ও ব্যর্থতার বিষয়টিকে অস্বীকার করা যাবে না। বিগত ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলেও সীমান্তে হত্যাকা- ঘটেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ও দায়িত্বশীল মহল বারবার হত্যাবন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তার কোনো লক্ষণ এ যাবত দেখা যাচ্ছে না। আমাদের বিশ্বাস এর সাথে রাজনীতির চাইতেও অর্থনীতির বিষয় জড়িত, যে কারণে বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কঠোর হতে পারছে না। এজন্য আমাদের স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের স্বাবলম্বী হতে না পারার ও অসহায়ত্বের সুযোগ তারা নিতে থাকবে। যেমন এই তো কয়েকদিন আগে ভারত সরকার সাময়িক পেঁয়াজ রফতানি বন্ধে কৌশল হিসেবে পেঁয়াজের রফতানি মূল্য বাড়িয়ে দিলে বাংলাদেশে রাতারাতি পেঁয়াজের কেজি ৪০ থেকে ৮০ টাকা হয়ে যায়। এমন গুজবও রটানো হয় যে, ইলিশ রফতানি বন্ধের প্রতিশোধ নিতে নাকি ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ রেখেছে। এভাবে আমরা যতদিন ভারত থেকে নানা দ্রব্যসামগ্রী আমদানিতে নির্ভরশীল থাকব ততদিন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কঠোর হতে পারবে না। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে জাতিকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা, এক সাধক পুরুষের উপদেশবাণী 'স্বাবলম্বনই শক্তিমানের পরিচয়পত্র'। পরিশেষে ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার দাবিসহ সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা-নির্যাতন বন্ধ হোক, এটাই কামনা করছি।
লেখক : আইনজীবী
__._,_.___