Dear chottala readers,
The following is the story of a Rickshaw puller Joinal Abedin. Please read it and you will come to know how he is running a small hospital in his village by his Rickshaw income.
Dr. Siraj Uddowllah.
মানুষ মানুষের জন্য শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন রিকশা চালিয়ে হাসপাতাল কামরুজ্জামান, ময়মনসিংহ | তারিখ: ০২-০৭-২০১১ ঢাকায় রিকশা চালান তিনি। রোদে পোড়েন। বৃষ্টিতে ভেজেন। কাঁপেন কনকনে শীতে। তবু থামে না রিকশার চাকা। এ যে তাঁর স্বপ্নেরও চাকা। তিনি মো. জয়নাল আবেদিন। বয়স কত হবে? ৬০ কিংবা ৬১। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। কালো হয়ে গেছে দাঁত। দাড়ি শ্বেতশুভ্র। শরীর দুর্বল। রিকশার প্যাডেল চাপতে এখন পা ধরে আসে। পেশি টনটন করে। মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু স্বপ্ন তাঁকে টেনে নিয়ে যায়। ঢাকায় জয়নাল যখন কষ্টে কাতর, ময়মনসিংহে তখন তাঁর গড়া হাসপাতালে গরিব রোগীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ঢাকার বালি-ধূলি-ভেঁপুর শোরগোল চাপা পড়ে যায় জয়নালের অন্তরে বাজা তাঁর গড়া বিদ্যালয়ের শিশুদের হিল্লোলের নিচে। একজন জয়নাল শুধু রিকশা চালিয়ে নিজ গ্রামে একটি হাসপাতাল করেছেন। গড়েছেন একটি বিদ্যালয়। চালাচ্ছেন মক্তব। ছোট তাঁর সেই হাসপাতালে ছয়টি শয্যা আছে। আছেন একজন পল্লি চিকিৎসক, সার্বক্ষণিক। সপ্তাহে এক দিন সরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক এসে রোগী দেখেন। শুধু রিকশা চালিয়ে একজন অক্ষরজ্ঞানহীন জয়নাল একটি বিদ্যালয় গড়েছেন। হোক সেখানে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা। তাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ১২০। বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে সকালে মক্তব বসে। গ্রামের শিশুরা সকালে সেখানে আরবি পড়ে। সাধ্য নয়, স্বপ্ন একজন রিকশাচালককে দিয়ে কী না গড়িয়ে নেয়! আঘাত থেকে অঙ্গীকার: ময়মনসিংহ সদর উপজেলার পরানগঞ্জ ইউনিয়নের টানহাসাদিয়া গ্রামে জয়নাল আবেদিনের বাড়ি। বাবা মো. আবদুল গনি ছিলেন ভূমিহীন কৃষক। আবদুল গনির চার ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে জয়নাল সবার বড়। অভাব-অনটনের সংসারে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি কারও। প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। দিনক্ষণ ঠিক মনে নেই জয়নালের। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধ্যার দিকে বাবা আবদুল বুক চেপে ধরে কাতরাতে লাগলেন। বাবার কষ্টকাতর মুখ দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লেন সন্তানেরা। জয়নাল ও তাঁর ভাইয়েরা বের হলেন চিকিৎসকের খোঁজে। সে যুগে কাছেপিঠে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র বা ভালো চিকিৎসকও ছিল না। গুটিকয়েক নাম ভাঙানো চিকিৎসক ও ওষুধের দোকান ছিল ভরসা। জয়নাল বললেন, 'একপর্যায়ে রাত আটটার দিকে বাবাকে নিয়ে দুই কিলোমিটার দূরে মীরকান্দাপাড়ায় যাই। সেখানে মেহছেন বেপারীর ওষুধের দোকান ছিল। মেহছেনের বাবা জসিমউদ্দিন ছিলেন এলাকার কুখ্যাত রাজাকার। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে দোকানে পৌঁছালে মেহছেন তাচ্ছিল্য করে বলে, রাজাকারের দোকানে ওষুধ নিতে আইছো ক্যান? তোমরার কাছে ওষুধ বেচুম না।' বিমুখ হয়ে মুমূর্ষু বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন ছেলেরা। রাত ১০টার দিকে বাবা মারা যান। এই মৃত্যু স্তব্ধ করে দেয় জয়নালকে। কষ্টের আগুনে পুড়তে থাকেন তিনি। পেছনে চোখ ফেলেন জয়নাল। তাঁর এক মামা ময়মনসিংহের ব্যাংকে চাকরি করতেন। তাঁর সূত্রে '৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় একদল মুক্তিযোদ্ধা আসেন তাঁদের বাড়িতে। তাঁর বাবা সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েক দিন বাড়িতে রেখে খাইয়েছেন। সে ইতিহাস জয়নালরা ভুলে গেলেও স্থানীয় রাজাকার জসিমউদ্দিন বা তাঁর ছেলে তা ভোলেননি। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জয়নাল। মনের আগুন থেকে অঙ্গীকার। একটি হাসপাতাল গড়ার পণ করেন জয়নাল। সেই হাসপাতালে বিনা মূল্যে গরিব মানুষের চিকিৎসা হবে। ঠিক করেন, ঢাকায় চলে যাবেন। গতর খেটেই হাসপাতাল গড়ার টাকা জোগাবেন। বাবার কুলখানির পর গাঁয়ের কয়েকজন মুরব্বি নিয়ে বসলেন জয়নাল। তাঁদের বলেন, 'এই রইল আমার মা আর ভাইবোনরা। ওগো সমস্যা হইলে আপনেরা দেইখেন। আমি চললাম।' স্ত্রী লাল বানু ও দেড় বছরের মেয়ে মমতাজকে নিয়ে ট্রেনে ঢাকার পথে ছোটেন জয়নাল। সাহসী যাত্রা: ঢাকায় পৌঁছে যেন গোলকধাঁধায় পড়ে যান জয়নাল। নতুন শহর। আপনজনহীন। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। ট্রেন থেকে নেমে স্ত্রী ও শিশুকন্যা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় মাঠে গিয়ে পৌঁছেন তিনি। পরে জেনেছেন, এটি শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠ। ওই মাঠে পানির ট্যাংকের নিচে সপরিবারে আশ্রয় নেন জয়নাল। সেখানে কাটে দেড় দিন। কত সালে জানতে চাইলে বলেন, 'তখন এরশাদের আমল।' পরিবারটির ব্যাপারে কৌতূহলী হন স্থানীয় মোশাররফ (৪৫)। তাঁর বাড়ি বিক্রমপুরে। কয়েকটি রিকশা ভাড়া খাটাতেন তিনি। জয়নালের সব জেনে মায়া হয় তাঁর। খাওয়ার জন্য ৫০ টাকা দেন। মোশাররফ এক দিনেই রিকশা চালানো শিখিয়ে একটি রিকশাও দেন জয়নালকে। সঙ্গে কলোনির একটি বাসার বারান্দায় ১৫০ টাকা ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থাও করে দেন। জয়নাল স্মৃতিচারণা করেন, 'প্রথম খেপে বাদামতলীতে গিয়ে ৩০ টাকা পাই। এভাবে এক দুপুর রিকশা চালিয়ে পাই ৯৫ টাকা। বাকি বেলায় জোটে ৫৫ টাকা। মোশাররফকে রিকশার জমা দেই ২০ টাকা। সপ্তাহ খানেক এভাবে চলে।' অঙ্গীকার পালনের তাড়া আর স্বপ্নের হাতছানি জয়নালকে পরিকল্পনা শেখায়। হাসপাতাল গড়তে হলে তিল তিল করে করতে হবে বড় সঞ্চয়। এক মনে সঞ্চয়: তত দিনে আপনজন হয়ে ওঠা মোশাররফকে অকপটে হাসপাতাল গড়ার স্বপ্নের কথা জানান জয়নাল। মোশাররফের পরামর্শে স্থানীয় এক মুদি দোকানির কাছে কিছু টাকা জমান জয়নাল। ওই টাকা নিয়ে ব্যাংকে হিসাব খুলতে গেলে শুরুতে কর্মকর্তারা পাত্তাই দেননি। অবজ্ঞাভরে বলেছেন, 'রিকশাওয়ালা! কিছু টাকা জমিয়ে কয় দিন পর ঋণ চাইতে আসবে।' কিন্তু দমেননি জয়নাল। বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে হিসাব খুলতে ধরনা দেন। শেষে সোনালী ব্যাংক মতিঝিল শাখার ব্যবস্থাপক সালেহা আক্তার তাঁর আবেগের মূল্য দিলেন। তাঁর সহযোগিতায় ডিপিএস হিসাব খুলে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে জমাতে লাগলেন জয়নাল। একই ব্যাংকের দিলকুশা শাখায়ও একটি হিসাব খুললেন তিনি। সেখানে ডিপিএস করেন ৫০০ টাকার। 'নিয়মিত টাকা জমাতে গিয়ে জান দিয়ে খাটতে হয়েছে। কখনো রাতদিন রিকশা চালিয়েছি। টাকা জমানোর কথা স্ত্রীকে জানাইনি। সংসারে যত কষ্টই হতো, কখনো জমানো টাকায় হাত দেইনি।' বললেন জয়নাল। এর মধ্যে সংসারে ছেলে জাহিদ হাসানের আগমন ঘটেছে। মগবাজারের উদয়ন ক্লিনিকে আয়ার কাজ নিয়েছেন স্ত্রী লাল বানু। চিকিৎসক জাহাঙ্গীর কবির একদিন জয়নালের রিকশায় করে যাচ্ছিলেন। কথায় কথায় জয়নাল চিকিৎসককে তাঁর সংকল্পের কথা জানান। ওই চিকিৎসকই জয়নালের স্ত্রীকে কাজটি পাইয়ে দেন। দীর্ঘদিনের চর্চায় প্রসূতি নারীর আনুষঙ্গিক সহযোগিতার কাজে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন লাল বানু। কায়ক্লেশে প্রায় ২০ বছর রাজধানীতে কেটে যায় জয়নাল পরিবারের। এতগুলো বছর গোপনে জমা হয়েছে জয়নালের রক্তমাংস নিংড়ানো টাকা। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। মেয়ে মমতাজের বিয়ে হয়েছে ময়মনসিংহে। ছেলে জাহিদ হাসান এইচএসচি পাস করে এখন মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে মোবাইল ফোনসেট মেরামতের দোকান দিয়েছেন। তিনিও দুই সন্তানের জনক। স্বপ্নের খুঁটি গাড়া: ২০০১ সালে স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন জয়নাল। সব সঞ্চয় এক করে পান এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা। তা নিয়ে গ্রামে ফেরেন তিনি। বাড়ির কাছে ৪০ হাজার টাকায় ২৪ শতাংশ জমি কেনেন। এক শুক্রবারে গাঁয়ের মানুষ ডেকে হাসপাতাল গড়ার ঘোষণা দেন জয়নাল—'এইহানে বিনা মূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হইব।' লাল বানু বললেন, 'লোকজন খুশি হবে কি, হেসেই উড়িয়ে দিল। হাসপাতাল গড়বে রিকশাচালক জয়নাল আবেদিন!' আরও যোগ করলেন, 'মাইনসের কতা কি কমু, আমার নিজেরই তহন তাঁরে পাগল মনে অইত। এহন হেই কথা ভাবলে কষ্ট লাগে।' আপনজনরা টাকা অপচয় হবে বলে জয়নালকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু জয়নাল স্বপ্ন জয় না করে ছাড়বেন না। নতুন কেনা জমিতে দোতলার ভিত্তি দিয়ে একটি বড় আধাপাকা ঘর তৈরি করেন। এই নির্মাণকাজে সঞ্চয়ের প্রায় পুরো টাকা চলে যায়। মেয়ের নামে হাসপাতালের নাম দিলেন তিনি 'মমতাজ হাসপাতাল'। হাসপাতালে একদিন: সম্প্রতি ময়মনসিংহ শহর থেকে নৌকায় ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে মোটরসাইকেলে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছি সিরতা বাজার। মনিহারি দোকানে কয়েকজন লোক বসা। উদ্দেশ্য জানালে এক যুবক নিয়ে গেলেন জয়নালের বাড়ি। বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। বাড়ির সামনে বাঁশের খুঁটিতে একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা মমতাজ হাসপাতাল। পেছনে প্রায় ২৫ ফুট দীর্ঘ একটি টিনশেড ঘর। এটাই জয়নালের হাসপাতাল ভবন। উঠানে গাভির পরিচর্যা করছিলেন জয়নাল। আগন্তুক দেখে কাছে এসে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহী সৌম্যকান্ত জয়নাল। মৃদু হেসে পরিচয় জানতে চাইলেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সোৎসাহে দেখাতে লাগলেন তাঁর হাসপাতাল। হাসপাতাল বলতে প্রচলিত অর্থে যা বোঝায়, জয়নালের আয়োজন তা নয়। তবে জয়নাল তাঁর ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে যেভাবে তিন দশক ধরে লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন, তার মাহাত্ম্য অনেক বড়। এ মাহাত্ম্য একটি হাসপাতাল গড়ার চেয়েও বিশাল। ঘরটি দুটি কক্ষে বিভক্ত। একটি কক্ষে রোগীদের জন্য ছয়টি শয্যা। অন্য ঘরে একপাশে চিকিৎসক ও রোগীর বসার ব্যবস্থা। অন্য পাশে রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষায় নানা বয়সী ১০-১২ জন নারী-পুরুষ। বেশভুষায় দারিদ্র্য। সময় গড়াচ্ছে, রোগীও বাড়ছে। সকাল নয়টার দিকে মোটরসাইকেলে চেপে হাসপাতালে এলেন পল্লি চিকিৎসক মো. আলী হোসেন। বারান্দায় টেবিল পেতে শুরু করলেন রোগী দেখা। পাশে বসে খাতায় রোগীর নাম-পরিচয় লিখছে জয়নালের নাতনি মমতাজের মেয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্রী আল্পনা। জয়নালের পুত্রবধূ এসএসসি পাস তামান্না ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বিনা মূল্যে ওষুধ দিচ্ছিলেন রোগীদের। ভেতরে একটি শয্যায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত একজনকে স্যালাইন নেওয়ায় সহযোগিতা করছেন লাল বানু, জয়নালের স্ত্রী। জয়নাল ঘুরে ঘুরে রোগীদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। নয়াপাড়ার কৃষিশ্রমিক মজিবর (৩৫) বলেন, 'মাইনসের খেতে কাম কইরা খাই। জ্বরে পইড়া কাইল আইছিলাম। আইজ একটু ভালা। এহানে ডাক্তার দেহাইতে টেহা লাগে না। ওষুধও মাগনা।' পাশের হইল্লাবাড়ি গ্রামের আমেনা খাতুন (৬০) বলেন, 'আগে অসুখ অইলে চাইর-পাঁচ মাইল হাইট্টা পরানগঞ্জ যাইতে হইত। এহন কাছেই চিকিৎসা। এইহানে চিকিৎসা করাইতে টেহা লাগে না। ডাক্তারও ভালা।' উপস্থিত অন্য রোগীরা তাঁর কথায় সায় দিলেন। পল্লি চিকিৎসক আলী হোসেন শুক্রবার বাদে প্রতিদিনই আসেন। সকাল নয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত রোগী দেখেন। প্রতিমাসে তিনি দেড় হাজার টাকা বেতন পান। আলী হোসেন বলেন, 'শুরুতে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে গাঁয়ের লোকজন হাসাহাসি করত। এখন আর তা নেই। প্রতিদিন এখানে ২৫-৩০ জন রোগী আসে। জ্বর, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, কাটাছেঁড়ার রোগী আর গর্ভবতী মারা আসেন এখানে। তাদের আমরা সাধ্যমতো চিকিৎসা ও ওষুধ দেই। হাসপাতালের যাবতীয় খয়খরচা জয়নাল কাকা চালান। কাকি (লাল বানু) ধাত্রীবিদ্যার কৌশল জানেন বলে এখানে অন্তঃসত্ত্বা নারীর স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের ব্যবস্থাও আছে।' প্রতি বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালের বক্ষব্যাধির চিকিৎসক হেফজুল বারী আসেন মমতাজ হাসপাতালে রোগী দেখতে। ওই দিন রোগী হয় সবচেয়ে বেশি। যেভাবে ব্যয় নির্বাহ: জয়নাল জানান, বর্তমানে ঢাকায় প্রতিদিন দুই বেলা রিকশা চালিয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পান। সপ্তাহে তিন-চার দিন রিকশা চালিয়ে যা আয় হয় তার সিংহভাহ দিয়ে ওষুধ কিনেন হাসপাতালের জন্য। বাকি টাকায় বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়ি ফেরেন। দিন দুয়েক বাড়িতে থেকে আবার ছোটেন ঢাকায়। এভাবে চলে এখন জয়নালের দিনকাল। জয়নাল জানান, গ্রামে কিছু জমি বর্গা নিয়ে ধান, মরিচ ও সবজি চাষ করছেন। বাড়িতে একটি দুধেল গাই বর্গায় পালন করছেন। একটি ছোট পুকুরে মাছ চাষও করছেন। এসবের আয় দিয়ে এখন কোনো মতে চলে যায় তাঁর। জয়নাল জানেন, তাঁর শারীরিক শক্তি যত দিন আছে তত দিন চলবে এই হাসপাতাল। কিন্তু তারপর কী হবে? সহায়তার জন্য অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দিতে শুরু করেছেন জয়নাল। বিমুখ হয়েছেন, হয়েছেন প্রতারিতও। ২০০৫ সালে তাঁর হাসপাতালের কথা জানতে পেরে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শাহনাজ পারভীন এক হাজার ডলার পাঠান। যার কাছে সেই টাকা পাঠানো হয়েছিল তিনি তাঁর বড় অংশই মেরে দেন। কিছু টাকা অনেক কষ্টে উদ্ধার করে হাসপাতালের জন্য কিছু আসবাব কেনেন জয়নাল। কাটান একটি ছোট পুকুর। এই প্রতিবেদকের কাছে জয়নালের হাসপাতাল সম্পর্কে জেনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান বললেন, 'আমি সংগঠনের মাধ্যমে সেখানে সপ্তাহে অন্তত একজন চিকিৎসক পাঠানোর ব্যবস্থা করব।' ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) এ বি এম মোজাহারুল ইসলাম বললেন, 'বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এখন আমি আমার সাধ্যমতো সহযোগিতা করব।' ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো. লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, 'ওই হাসপাতালের জন্য ওরস্যালাইনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব, তার ব্যবস্থা আমি নেব।' বিদ্যালয়: হাসপাতালের পাশে একটি ছোট দোচালা ঘর। এখানেই বিদ্যালয় ও মক্তব চালু করেছেন জয়নাল। সকালে মক্তবে শিশুরা এসে আরবি শেখে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত চলে প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান। বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের একজন ফলিয়ামারীর এসএসসি পাস যুবক মো. আইয়ুব আলী জানান, বিদ্যালয়ে এখন ১২০ জন শিক্ষার্থী আছে। এর মধ্যে ৭০ জনের মতো ছাত্রী। তাদের বিনা মূল্যে বই-খাতা দেওয়া হয়। কোনো ফি নেওয়া হয় না। সরকারি বই পান কি না জানতে চাইলে জয়নাল বলেন, 'না। আমি বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে পুরোনো বই চেয়ে আনি। সামান্য কিছু লাগলে কিনে নিই। খাতা-কলম-চক-পেনসিল কিনে দেই।' তৃতীয় শ্রেণী পাস করে শিক্ষার্থীরা কোথায় যায়—জানতে চাইলে শিক্ষক আইয়ুব আলী জানান, সিরতা-নয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এক মাইল দূরের ফলিয়ামারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। যা কিছু প্রাপ্তি: জয়নাল গরিব, কিন্তু তাঁর হাসিটা কোটি টাকা দামের! হাসিতে থাকে তৃপ্তির আলোকছটা। স্বপ্নের হাসপাতাল তাঁকে এই তৃপ্তি দিয়েছে। এই মানুষটি মনের দিক থেকে কেমন? ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৮ জুন 'এসো বাংলাদেশ গড়ি' শীর্ষক রোড শো চলাকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে 'সাদা মনের মানুষ' হিসেবে সনদ ও পদক দেওয়া হয়। জয়নাল বলেন, 'শেষ বয়সে আমি আর কী চাইব? এলাকার মানুষ যে আমার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন, এটাই আমার বড় পাওয়া।' অসম্ভবকে জয় করা জয়নাল পড়ন্ত বয়সেও কারও আশায় বসে থাকতে রাজি নন। জীবিকার পথে এখনো সচল তিনি। রিকশা চালিয়ে যে টাকা পান, তা দিয়েই চালান হাসপাতাল, বিদ্যালয় ও মক্তব। এতেই তাঁর সুখ।
The following is the story of a Rickshaw puller Joinal Abedin. Please read it and you will come to know how he is running a small hospital in his village by his Rickshaw income.
Dr. Siraj Uddowllah.
মানুষ মানুষের জন্য শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন রিকশা চালিয়ে হাসপাতাল কামরুজ্জামান, ময়মনসিংহ | তারিখ: ০২-০৭-২০১১ ঢাকায় রিকশা চালান তিনি। রোদে পোড়েন। বৃষ্টিতে ভেজেন। কাঁপেন কনকনে শীতে। তবু থামে না রিকশার চাকা। এ যে তাঁর স্বপ্নেরও চাকা। তিনি মো. জয়নাল আবেদিন। বয়স কত হবে? ৬০ কিংবা ৬১। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। কালো হয়ে গেছে দাঁত। দাড়ি শ্বেতশুভ্র। শরীর দুর্বল। রিকশার প্যাডেল চাপতে এখন পা ধরে আসে। পেশি টনটন করে। মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু স্বপ্ন তাঁকে টেনে নিয়ে যায়। ঢাকায় জয়নাল যখন কষ্টে কাতর, ময়মনসিংহে তখন তাঁর গড়া হাসপাতালে গরিব রোগীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ঢাকার বালি-ধূলি-ভেঁপুর শোরগোল চাপা পড়ে যায় জয়নালের অন্তরে বাজা তাঁর গড়া বিদ্যালয়ের শিশুদের হিল্লোলের নিচে। একজন জয়নাল শুধু রিকশা চালিয়ে নিজ গ্রামে একটি হাসপাতাল করেছেন। গড়েছেন একটি বিদ্যালয়। চালাচ্ছেন মক্তব। ছোট তাঁর সেই হাসপাতালে ছয়টি শয্যা আছে। আছেন একজন পল্লি চিকিৎসক, সার্বক্ষণিক। সপ্তাহে এক দিন সরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক এসে রোগী দেখেন। শুধু রিকশা চালিয়ে একজন অক্ষরজ্ঞানহীন জয়নাল একটি বিদ্যালয় গড়েছেন। হোক সেখানে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা। তাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ১২০। বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে সকালে মক্তব বসে। গ্রামের শিশুরা সকালে সেখানে আরবি পড়ে। সাধ্য নয়, স্বপ্ন একজন রিকশাচালককে দিয়ে কী না গড়িয়ে নেয়! আঘাত থেকে অঙ্গীকার: ময়মনসিংহ সদর উপজেলার পরানগঞ্জ ইউনিয়নের টানহাসাদিয়া গ্রামে জয়নাল আবেদিনের বাড়ি। বাবা মো. আবদুল গনি ছিলেন ভূমিহীন কৃষক। আবদুল গনির চার ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে জয়নাল সবার বড়। অভাব-অনটনের সংসারে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি কারও। প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। দিনক্ষণ ঠিক মনে নেই জয়নালের। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধ্যার দিকে বাবা আবদুল বুক চেপে ধরে কাতরাতে লাগলেন। বাবার কষ্টকাতর মুখ দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লেন সন্তানেরা। জয়নাল ও তাঁর ভাইয়েরা বের হলেন চিকিৎসকের খোঁজে। সে যুগে কাছেপিঠে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র বা ভালো চিকিৎসকও ছিল না। গুটিকয়েক নাম ভাঙানো চিকিৎসক ও ওষুধের দোকান ছিল ভরসা। জয়নাল বললেন, 'একপর্যায়ে রাত আটটার দিকে বাবাকে নিয়ে দুই কিলোমিটার দূরে মীরকান্দাপাড়ায় যাই। সেখানে মেহছেন বেপারীর ওষুধের দোকান ছিল। মেহছেনের বাবা জসিমউদ্দিন ছিলেন এলাকার কুখ্যাত রাজাকার। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে দোকানে পৌঁছালে মেহছেন তাচ্ছিল্য করে বলে, রাজাকারের দোকানে ওষুধ নিতে আইছো ক্যান? তোমরার কাছে ওষুধ বেচুম না।' বিমুখ হয়ে মুমূর্ষু বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন ছেলেরা। রাত ১০টার দিকে বাবা মারা যান। এই মৃত্যু স্তব্ধ করে দেয় জয়নালকে। কষ্টের আগুনে পুড়তে থাকেন তিনি। পেছনে চোখ ফেলেন জয়নাল। তাঁর এক মামা ময়মনসিংহের ব্যাংকে চাকরি করতেন। তাঁর সূত্রে '৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় একদল মুক্তিযোদ্ধা আসেন তাঁদের বাড়িতে। তাঁর বাবা সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েক দিন বাড়িতে রেখে খাইয়েছেন। সে ইতিহাস জয়নালরা ভুলে গেলেও স্থানীয় রাজাকার জসিমউদ্দিন বা তাঁর ছেলে তা ভোলেননি। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জয়নাল। মনের আগুন থেকে অঙ্গীকার। একটি হাসপাতাল গড়ার পণ করেন জয়নাল। সেই হাসপাতালে বিনা মূল্যে গরিব মানুষের চিকিৎসা হবে। ঠিক করেন, ঢাকায় চলে যাবেন। গতর খেটেই হাসপাতাল গড়ার টাকা জোগাবেন। বাবার কুলখানির পর গাঁয়ের কয়েকজন মুরব্বি নিয়ে বসলেন জয়নাল। তাঁদের বলেন, 'এই রইল আমার মা আর ভাইবোনরা। ওগো সমস্যা হইলে আপনেরা দেইখেন। আমি চললাম।' স্ত্রী লাল বানু ও দেড় বছরের মেয়ে মমতাজকে নিয়ে ট্রেনে ঢাকার পথে ছোটেন জয়নাল। সাহসী যাত্রা: ঢাকায় পৌঁছে যেন গোলকধাঁধায় পড়ে যান জয়নাল। নতুন শহর। আপনজনহীন। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। ট্রেন থেকে নেমে স্ত্রী ও শিশুকন্যা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় মাঠে গিয়ে পৌঁছেন তিনি। পরে জেনেছেন, এটি শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠ। ওই মাঠে পানির ট্যাংকের নিচে সপরিবারে আশ্রয় নেন জয়নাল। সেখানে কাটে দেড় দিন। কত সালে জানতে চাইলে বলেন, 'তখন এরশাদের আমল।' পরিবারটির ব্যাপারে কৌতূহলী হন স্থানীয় মোশাররফ (৪৫)। তাঁর বাড়ি বিক্রমপুরে। কয়েকটি রিকশা ভাড়া খাটাতেন তিনি। জয়নালের সব জেনে মায়া হয় তাঁর। খাওয়ার জন্য ৫০ টাকা দেন। মোশাররফ এক দিনেই রিকশা চালানো শিখিয়ে একটি রিকশাও দেন জয়নালকে। সঙ্গে কলোনির একটি বাসার বারান্দায় ১৫০ টাকা ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থাও করে দেন। জয়নাল স্মৃতিচারণা করেন, 'প্রথম খেপে বাদামতলীতে গিয়ে ৩০ টাকা পাই। এভাবে এক দুপুর রিকশা চালিয়ে পাই ৯৫ টাকা। বাকি বেলায় জোটে ৫৫ টাকা। মোশাররফকে রিকশার জমা দেই ২০ টাকা। সপ্তাহ খানেক এভাবে চলে।' অঙ্গীকার পালনের তাড়া আর স্বপ্নের হাতছানি জয়নালকে পরিকল্পনা শেখায়। হাসপাতাল গড়তে হলে তিল তিল করে করতে হবে বড় সঞ্চয়। এক মনে সঞ্চয়: তত দিনে আপনজন হয়ে ওঠা মোশাররফকে অকপটে হাসপাতাল গড়ার স্বপ্নের কথা জানান জয়নাল। মোশাররফের পরামর্শে স্থানীয় এক মুদি দোকানির কাছে কিছু টাকা জমান জয়নাল। ওই টাকা নিয়ে ব্যাংকে হিসাব খুলতে গেলে শুরুতে কর্মকর্তারা পাত্তাই দেননি। অবজ্ঞাভরে বলেছেন, 'রিকশাওয়ালা! কিছু টাকা জমিয়ে কয় দিন পর ঋণ চাইতে আসবে।' কিন্তু দমেননি জয়নাল। বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে হিসাব খুলতে ধরনা দেন। শেষে সোনালী ব্যাংক মতিঝিল শাখার ব্যবস্থাপক সালেহা আক্তার তাঁর আবেগের মূল্য দিলেন। তাঁর সহযোগিতায় ডিপিএস হিসাব খুলে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে জমাতে লাগলেন জয়নাল। একই ব্যাংকের দিলকুশা শাখায়ও একটি হিসাব খুললেন তিনি। সেখানে ডিপিএস করেন ৫০০ টাকার। 'নিয়মিত টাকা জমাতে গিয়ে জান দিয়ে খাটতে হয়েছে। কখনো রাতদিন রিকশা চালিয়েছি। টাকা জমানোর কথা স্ত্রীকে জানাইনি। সংসারে যত কষ্টই হতো, কখনো জমানো টাকায় হাত দেইনি।' বললেন জয়নাল। এর মধ্যে সংসারে ছেলে জাহিদ হাসানের আগমন ঘটেছে। মগবাজারের উদয়ন ক্লিনিকে আয়ার কাজ নিয়েছেন স্ত্রী লাল বানু। চিকিৎসক জাহাঙ্গীর কবির একদিন জয়নালের রিকশায় করে যাচ্ছিলেন। কথায় কথায় জয়নাল চিকিৎসককে তাঁর সংকল্পের কথা জানান। ওই চিকিৎসকই জয়নালের স্ত্রীকে কাজটি পাইয়ে দেন। দীর্ঘদিনের চর্চায় প্রসূতি নারীর আনুষঙ্গিক সহযোগিতার কাজে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন লাল বানু। কায়ক্লেশে প্রায় ২০ বছর রাজধানীতে কেটে যায় জয়নাল পরিবারের। এতগুলো বছর গোপনে জমা হয়েছে জয়নালের রক্তমাংস নিংড়ানো টাকা। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। মেয়ে মমতাজের বিয়ে হয়েছে ময়মনসিংহে। ছেলে জাহিদ হাসান এইচএসচি পাস করে এখন মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে মোবাইল ফোনসেট মেরামতের দোকান দিয়েছেন। তিনিও দুই সন্তানের জনক। স্বপ্নের খুঁটি গাড়া: ২০০১ সালে স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন জয়নাল। সব সঞ্চয় এক করে পান এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা। তা নিয়ে গ্রামে ফেরেন তিনি। বাড়ির কাছে ৪০ হাজার টাকায় ২৪ শতাংশ জমি কেনেন। এক শুক্রবারে গাঁয়ের মানুষ ডেকে হাসপাতাল গড়ার ঘোষণা দেন জয়নাল—'এইহানে বিনা মূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হইব।' লাল বানু বললেন, 'লোকজন খুশি হবে কি, হেসেই উড়িয়ে দিল। হাসপাতাল গড়বে রিকশাচালক জয়নাল আবেদিন!' আরও যোগ করলেন, 'মাইনসের কতা কি কমু, আমার নিজেরই তহন তাঁরে পাগল মনে অইত। এহন হেই কথা ভাবলে কষ্ট লাগে।' আপনজনরা টাকা অপচয় হবে বলে জয়নালকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু জয়নাল স্বপ্ন জয় না করে ছাড়বেন না। নতুন কেনা জমিতে দোতলার ভিত্তি দিয়ে একটি বড় আধাপাকা ঘর তৈরি করেন। এই নির্মাণকাজে সঞ্চয়ের প্রায় পুরো টাকা চলে যায়। মেয়ের নামে হাসপাতালের নাম দিলেন তিনি 'মমতাজ হাসপাতাল'। হাসপাতালে একদিন: সম্প্রতি ময়মনসিংহ শহর থেকে নৌকায় ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে মোটরসাইকেলে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছি সিরতা বাজার। মনিহারি দোকানে কয়েকজন লোক বসা। উদ্দেশ্য জানালে এক যুবক নিয়ে গেলেন জয়নালের বাড়ি। বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। বাড়ির সামনে বাঁশের খুঁটিতে একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা মমতাজ হাসপাতাল। পেছনে প্রায় ২৫ ফুট দীর্ঘ একটি টিনশেড ঘর। এটাই জয়নালের হাসপাতাল ভবন। উঠানে গাভির পরিচর্যা করছিলেন জয়নাল। আগন্তুক দেখে কাছে এসে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহী সৌম্যকান্ত জয়নাল। মৃদু হেসে পরিচয় জানতে চাইলেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সোৎসাহে দেখাতে লাগলেন তাঁর হাসপাতাল। হাসপাতাল বলতে প্রচলিত অর্থে যা বোঝায়, জয়নালের আয়োজন তা নয়। তবে জয়নাল তাঁর ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে যেভাবে তিন দশক ধরে লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন, তার মাহাত্ম্য অনেক বড়। এ মাহাত্ম্য একটি হাসপাতাল গড়ার চেয়েও বিশাল। ঘরটি দুটি কক্ষে বিভক্ত। একটি কক্ষে রোগীদের জন্য ছয়টি শয্যা। অন্য ঘরে একপাশে চিকিৎসক ও রোগীর বসার ব্যবস্থা। অন্য পাশে রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষায় নানা বয়সী ১০-১২ জন নারী-পুরুষ। বেশভুষায় দারিদ্র্য। সময় গড়াচ্ছে, রোগীও বাড়ছে। সকাল নয়টার দিকে মোটরসাইকেলে চেপে হাসপাতালে এলেন পল্লি চিকিৎসক মো. আলী হোসেন। বারান্দায় টেবিল পেতে শুরু করলেন রোগী দেখা। পাশে বসে খাতায় রোগীর নাম-পরিচয় লিখছে জয়নালের নাতনি মমতাজের মেয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্রী আল্পনা। জয়নালের পুত্রবধূ এসএসসি পাস তামান্না ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বিনা মূল্যে ওষুধ দিচ্ছিলেন রোগীদের। ভেতরে একটি শয্যায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত একজনকে স্যালাইন নেওয়ায় সহযোগিতা করছেন লাল বানু, জয়নালের স্ত্রী। জয়নাল ঘুরে ঘুরে রোগীদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। নয়াপাড়ার কৃষিশ্রমিক মজিবর (৩৫) বলেন, 'মাইনসের খেতে কাম কইরা খাই। জ্বরে পইড়া কাইল আইছিলাম। আইজ একটু ভালা। এহানে ডাক্তার দেহাইতে টেহা লাগে না। ওষুধও মাগনা।' পাশের হইল্লাবাড়ি গ্রামের আমেনা খাতুন (৬০) বলেন, 'আগে অসুখ অইলে চাইর-পাঁচ মাইল হাইট্টা পরানগঞ্জ যাইতে হইত। এহন কাছেই চিকিৎসা। এইহানে চিকিৎসা করাইতে টেহা লাগে না। ডাক্তারও ভালা।' উপস্থিত অন্য রোগীরা তাঁর কথায় সায় দিলেন। পল্লি চিকিৎসক আলী হোসেন শুক্রবার বাদে প্রতিদিনই আসেন। সকাল নয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত রোগী দেখেন। প্রতিমাসে তিনি দেড় হাজার টাকা বেতন পান। আলী হোসেন বলেন, 'শুরুতে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে গাঁয়ের লোকজন হাসাহাসি করত। এখন আর তা নেই। প্রতিদিন এখানে ২৫-৩০ জন রোগী আসে। জ্বর, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, কাটাছেঁড়ার রোগী আর গর্ভবতী মারা আসেন এখানে। তাদের আমরা সাধ্যমতো চিকিৎসা ও ওষুধ দেই। হাসপাতালের যাবতীয় খয়খরচা জয়নাল কাকা চালান। কাকি (লাল বানু) ধাত্রীবিদ্যার কৌশল জানেন বলে এখানে অন্তঃসত্ত্বা নারীর স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের ব্যবস্থাও আছে।' প্রতি বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালের বক্ষব্যাধির চিকিৎসক হেফজুল বারী আসেন মমতাজ হাসপাতালে রোগী দেখতে। ওই দিন রোগী হয় সবচেয়ে বেশি। যেভাবে ব্যয় নির্বাহ: জয়নাল জানান, বর্তমানে ঢাকায় প্রতিদিন দুই বেলা রিকশা চালিয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পান। সপ্তাহে তিন-চার দিন রিকশা চালিয়ে যা আয় হয় তার সিংহভাহ দিয়ে ওষুধ কিনেন হাসপাতালের জন্য। বাকি টাকায় বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়ি ফেরেন। দিন দুয়েক বাড়িতে থেকে আবার ছোটেন ঢাকায়। এভাবে চলে এখন জয়নালের দিনকাল। জয়নাল জানান, গ্রামে কিছু জমি বর্গা নিয়ে ধান, মরিচ ও সবজি চাষ করছেন। বাড়িতে একটি দুধেল গাই বর্গায় পালন করছেন। একটি ছোট পুকুরে মাছ চাষও করছেন। এসবের আয় দিয়ে এখন কোনো মতে চলে যায় তাঁর। জয়নাল জানেন, তাঁর শারীরিক শক্তি যত দিন আছে তত দিন চলবে এই হাসপাতাল। কিন্তু তারপর কী হবে? সহায়তার জন্য অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দিতে শুরু করেছেন জয়নাল। বিমুখ হয়েছেন, হয়েছেন প্রতারিতও। ২০০৫ সালে তাঁর হাসপাতালের কথা জানতে পেরে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শাহনাজ পারভীন এক হাজার ডলার পাঠান। যার কাছে সেই টাকা পাঠানো হয়েছিল তিনি তাঁর বড় অংশই মেরে দেন। কিছু টাকা অনেক কষ্টে উদ্ধার করে হাসপাতালের জন্য কিছু আসবাব কেনেন জয়নাল। কাটান একটি ছোট পুকুর। এই প্রতিবেদকের কাছে জয়নালের হাসপাতাল সম্পর্কে জেনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান বললেন, 'আমি সংগঠনের মাধ্যমে সেখানে সপ্তাহে অন্তত একজন চিকিৎসক পাঠানোর ব্যবস্থা করব।' ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) এ বি এম মোজাহারুল ইসলাম বললেন, 'বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এখন আমি আমার সাধ্যমতো সহযোগিতা করব।' ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো. লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, 'ওই হাসপাতালের জন্য ওরস্যালাইনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব, তার ব্যবস্থা আমি নেব।' বিদ্যালয়: হাসপাতালের পাশে একটি ছোট দোচালা ঘর। এখানেই বিদ্যালয় ও মক্তব চালু করেছেন জয়নাল। সকালে মক্তবে শিশুরা এসে আরবি শেখে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত চলে প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান। বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের একজন ফলিয়ামারীর এসএসসি পাস যুবক মো. আইয়ুব আলী জানান, বিদ্যালয়ে এখন ১২০ জন শিক্ষার্থী আছে। এর মধ্যে ৭০ জনের মতো ছাত্রী। তাদের বিনা মূল্যে বই-খাতা দেওয়া হয়। কোনো ফি নেওয়া হয় না। সরকারি বই পান কি না জানতে চাইলে জয়নাল বলেন, 'না। আমি বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে পুরোনো বই চেয়ে আনি। সামান্য কিছু লাগলে কিনে নিই। খাতা-কলম-চক-পেনসিল কিনে দেই।' তৃতীয় শ্রেণী পাস করে শিক্ষার্থীরা কোথায় যায়—জানতে চাইলে শিক্ষক আইয়ুব আলী জানান, সিরতা-নয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এক মাইল দূরের ফলিয়ামারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। যা কিছু প্রাপ্তি: জয়নাল গরিব, কিন্তু তাঁর হাসিটা কোটি টাকা দামের! হাসিতে থাকে তৃপ্তির আলোকছটা। স্বপ্নের হাসপাতাল তাঁকে এই তৃপ্তি দিয়েছে। এই মানুষটি মনের দিক থেকে কেমন? ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৮ জুন 'এসো বাংলাদেশ গড়ি' শীর্ষক রোড শো চলাকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে 'সাদা মনের মানুষ' হিসেবে সনদ ও পদক দেওয়া হয়। জয়নাল বলেন, 'শেষ বয়সে আমি আর কী চাইব? এলাকার মানুষ যে আমার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন, এটাই আমার বড় পাওয়া।' অসম্ভবকে জয় করা জয়নাল পড়ন্ত বয়সেও কারও আশায় বসে থাকতে রাজি নন। জীবিকার পথে এখনো সচল তিনি। রিকশা চালিয়ে যে টাকা পান, তা দিয়েই চালান হাসপাতাল, বিদ্যালয় ও মক্তব। এতেই তাঁর সুখ।
__._,_.___