ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু
তোফায়েল আহমেদ
এর শুরুটা হয়েছিল '৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন ডাকসু কার্যালয়ে আমার সভাপতিত্বে এবং তিন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম 'সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন এবং জাতির উদ্দেশে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ১১ দফা ঘোষণা করি। ৮ জানুয়ারি সম্মিলিত বিরোধী দল সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আটটি বিরোধী দলের ঐক্যফ্রন্ট কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে আট দফাভিত্তিক এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। ৯ জানুয়ারি দেশের আটটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের ঐক্যের ভিত্তিতে 'গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ' ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি সংক্ষেপে 'ডাক' গঠন করে। ১২ জানুয়ারি ডাক প্রাদেশিক সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। আট দফা দাবির ভিত্তিতে ১৭ জানুয়ারি 'দাবি দিবস' পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ তথা ডাক-এর এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র সমাবেশে পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি শনিবার ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানো হয়। ১৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সফল ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে বটতলায় ছাত্র জমায়েতের পর খণ্ড খণ্ড মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উচ্চারণ_ 'শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।' সন্ধ্যায় জিন্নাহ হলে (বর্তমানে সূর্যসেন হল) বিনা উসকানিতে ইপিআর ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ করে। প্রতিবাদে ১৯ জানুয়ারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল, পুলিশের বাধা ও গুলিবর্ষিত হলে ছাত্রনেতা আসাদুল হক আহত হন। ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মাইলফলক। ১১ দফার দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালন। এর পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ সার্জেন্টের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান নিহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে শোকসভা। শোকসভায় আমার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর শহীদ আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ ও ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে শহীদ আসাদের নামাজে জানাজা। জানাজার পর সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি : ২২ জানুয়ারি শোক মিছিল, কালোব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন, ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল, পরে কালো পতাকাসহ শোক মিছিল, ২৪ জানুয়ারি বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল। কর্মসূচি ঠেকাতে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে প্রতিটি দিনের কর্মসূচিতে সর্বাত্দক অংশগ্রহণ করে। জানাজার পরে বিক্ষোভ মিছিলে লাখো মানুষের ঢল নামে। দেশের বিভিন্ন স্থানের পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে গুলি চালালে সারা দেশে এদিন ছয়জন নিহত ও ১৪ জন আহত হন। ২২ জানুয়ারি ঢাকায় সব বাড়ি ও গাড়িতে কালো পতাকা আর প্রতিটি মানুষের বুকে কালোব্যাজ। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। ২৩ জানুয়ারি ঢাকা শহর মশাল আর মিছিলের নগরী। ইতিহাসের বৃহত্তম মশাল মিছিল। ২৪ জানুয়ারি হরতালে ছাত্র-গণমিছিলে পুলিশের গুলিতে ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর রহমান নিহত হন। ক্ষোভে ফেটে পড়া বিক্ষুব্ধ মানুষ সরকার সমর্থিত দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ এবং পয়গাম পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয় আনোয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীরসহ আরও অনেক নাম। দুপুরে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। আমার বক্তৃতার পর সেখান থেকে মিছিল জমায়েত হয় ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) মাঠে। সান্ধ্য আইন অমান্য করে বানের জলের মতো রাজপথে নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। গণরোষে কেঁপে ওঠে তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খানের মসনদ। দেশব্যাপী গণআন্দোলনের ব্যাপকতা গণমানুষের জাতীয় মুক্তির চেতনায় যে আগুন ধরিয়েছিল তাতে প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় ২৪ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থান। ইতিহাসে যা খ্যাত হয়ে আছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামে।
২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকে। ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানে গণবিক্ষোভ। করাচি ও লাহোরে সেনাবাহিনী তলব এবং সান্ধ্য আইন জারি। ২৯ জানুয়ারি গুজরাটওয়ালায় সেনাবাহিনী তলব। গুলিবর্ষণে ৩ জন নিহত। ১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খানের বেতার ভাষণ। বিরোধী দল এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রত্যাখ্যান। ৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুবের পূর্ব পাকিস্তান সফর। সংবাদ সম্মেলনে দেশরক্ষা আইন ও অর্ডিন্যান্সের প্রয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা। ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের ছাপাখানা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের ওপর থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। ৯ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পল্টন ময়দানে 'শপথ দিবস' পালন। পরিষদের সমন্বয়ক হিসেবে আমার সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে এক বিশাল সমাবেশে ১০ জন ছাত্রনেতা জীবনের বিনিময়ে ১১ দফা দাবি প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প ঘোষণা করেন এবং শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার শপথ গ্রহণ করেন। এ দিন স্লোগান ওঠে 'শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করব', 'শপথ নিলাম শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করব।' ১১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে ধৃত রাজবন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তি লাভ। ১২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তি লাভ। ১৪ ফেব্রুয়ারি 'ডাক'-এর সারা দেশে হরতাল আহ্বান। পল্টন ময়দানের সভায় জনতা কর্তৃক নূরুল আমিন ও ফরীদ আহমদ লাঞ্ছিত। ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা। ১৫ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি। আইয়ুব খানের 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' প্রত্যাহার এবং প্যারোলে মুক্তি দিয়ে শেখ মুজিবসহ বিরোধী নেতৃবৃন্দকে গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ। ছাত্র-জনতা কর্তৃক প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। ১৬ ফেব্রুয়ারি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে ঢাকা। বাংলা একাডেমী সংলগ্ন স্টেট হাউসে অগি্নসংযোগ। পল্টনে লক্ষাধিক লোকের অংশগ্রহণে সার্জেন্ট জহুরুল হকের গায়েবানা জানাজা। ১৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে পূর্ণ দিবস হরতাল পালন। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের রিডার শামসুজ্জোহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের বেয়নেট চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টায় সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে আমার সভাপতিত্বে পল্টনের মহাসমুদ্রে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের অগ্রনায়কদের সংগ্রামী শপথ এবং ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান। সারা দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত। প্রচণ্ড জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান কর্তৃক সব রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি দান।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯-এর এই দিনে শেখ মুজিবের মুক্তিতে দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম_ 'ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার মুজিবসহ সকলের মুক্তি লাভ : কারাগার রাজবন্দী শূন্য পূর্ব বাংলার মাটিতে অবশেষে বাস্তিলের কারাগার ধসিয়া পড়িয়াছে। জনতার জয় হইয়াছে। গণদাবির নিকট নতিস্বীকার করিয়া দোর্দণ্ড প্রতাপ সরকার তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করিয়া পূর্ব বাংলার অগি্ন সন্তান, দেশগৌরব আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানসহ এই মামলায় অভিযুক্ত সকলকেই কুর্মিটোলার সামরিক ছাউনির বন্দীনিবাস হইতে গতকল্য (শনিবার) মধ্যাহ্নে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হইয়াছেন।' সেদিন ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়তে আবেগমথিত ভাষায় লেখা হয়_ 'জয় নিপীড়িত জনগণ জয়, জয় নব উত্থান। আজ উৎসবের দিন নয়, বিজয়ের দিন, আজ আনন্দের দিন নয়, স্মরণের দিন। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হইয়াছে। দুঃশাসনের কারা কক্ষ হইতে দেশের প্রিয় সন্তান শেখ মুজিব অন্যান্য সহবন্দীর সঙ্গে মুক্ত হইয়া আবার তার প্রিয় দেশবাসীর মাঝে ফিরিয়া আসিয়াছেন। শহীদী ঈদের সেনাদের অভিযান সফল হইয়াছে। গণজাগরণের প্রবল প্লাবনের পলি মাটিতে রক্তাক্ষরে লিখিত হইয়াছে নূতন এক ঊষার স্বর্ণ দুয়ার উন্মুক্ত করার অবিস্মরণীয় কাহিনী। তবুও আজ অহল্যা-প্রতিম পূর্ব বাংলা জাগ্রত। তার অশোক আকাশে ফাল্গুনের রক্ত সূর্যে নূতন প্রাণে পতাকা শিহরিত। মেঘের সিংহবাহনে নূতন প্রভাত আসিয়াছে। এই প্রভাতের সাধনায় তিমির রাত্রির তপস্যায় যাহারা আত্দাহুতি দিয়াছেন আজ বিপুল বিজয়ের ক্রান্তিলগ্নে তাহাদেরই আমরা সর্বাগ্রে স্মরণ করি। তাহাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে জানাই আমাদের অবনত চিত্তের অভিনন্দন।'
৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি। শুরুতেই বলেছি এই দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না সেই জনসমাবেশের কথা। আমরা যখন সেখানে পেঁৗছেছি, তখন রেসকোর্স ময়দানে মানুষ আর মানুষ। ১৪ লাখ মানুষ অধ্যুষিত ঢাকা নগরীর মানুষই শুধু নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমারে বোঝাই হয়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে। ঢাকার মানুষ তো আছেই। অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি। এত মানুষ তো একসঙ্গে কোনোদিন দেখিনি। আমার বন্ধুরাও স্তম্ভিত। কিন্তু কত সুশৃঙ্খল তারা। এরাই তো আমাদের শক্তি। অনেকেই পত্র-পত্রিকায় আমাদের নাম শুনেছেন, দেখেননি। তাদের সামনে আজ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দাঁড়াবে। আমার আজও যখন মনে হয় সেদিনের সেই গণসংগ্রামের কথা, কী এক শিহরণে আমার চোখ ফেটে পানি এসে যায়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, শামসুদ্দোহা, সাইফুদ্দীন আহমেদ মানিক, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবউল্লাহ, ফখরুল ইসলাম মুন্সী, ইব্রাহিম খলিল, নাজিম কামরান চৌধুরী কার কথা না আজ আমার মনে পড়ে। মনে পড়ে কারাবন্দী শেখ মনি ভাইয়ের কথা। ষাটের দশকের সূচনা থেকে স্বৈরশাসক আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্যের তিনিই অন্যতম উদ্যোক্তা। আমাদের কাছে তার বিভিন্ন পরামর্শ আসত জেল থেকে। জেলে বন্দী ছিলেন আমাদের রাজ্জাক ভাইও। তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। জেলের বাইরে ছিলেন সিরাজ ভাই, অর্থাৎ সিরাজুল আলম খান। তিনি যথেষ্ট সহায়তা করেছেন আমাকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে। কোথাও কোনো জটিলতা কিংবা বিবৃতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন।
বলছিলাম ২৩ ফেব্রুয়ারির কথা। একজন ছাত্রনেতার জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? বাংলার অবিসংবাদিত নেতা যে মঞ্চে উপবিষ্ট, যার সামনে ১০ লাখেরও অধিক মানুষ, আমি সেই সভার সভাপতি। সেদিন ওই মঞ্চে বক্তব্য রেখেছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) সাইফুদ্দীন আহমেদ মানিক, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) মাহবুবউল্লাহ এবং এনএসএফ-এর মাহবুবুল হক দোলন। আগেই বলেছি আমি ছিলাম সভাপতি, নিয়মানুসারে সব বক্তার শেষেই আমার বক্তৃতা দেওয়ার কথা। কিন্তু নেতা বক্তৃতা দেওয়ার পর আমি বলব এবং আমার ভাষণ কেউ শুনবেন এমন আশা করার ধৃষ্টতা আমি কেন, আমার বন্ধু নেতারাও ভাবেননি। তাই প্রিয় নেতার ভাষণের আগে আমাকে দাঁড়াতে হলো। যাকে গণসংবর্ধনা দিচ্ছি তিনি ভাষণ দেবেন সবার শেষে সেটাই সাব্যস্ত হয়েছিল। আমার জন্য অবশ্য ভাষণ দেওয়াটা তেমন জরুরি ছিল না, এর চেয়ে অনেক বড় একটা দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করা হয়েছিল। সেটা হলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জাতির অনুমোদন নিয়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি উপাধি দেওয়া_ যা তার নামের সঙ্গে অবিনশ্বর হয়ে থাকবে। তখন আর অস্বীকার করার কোনো সুযোগ ছিল না, সবাই যা সত্য হিসেবে চোখের সামনে লক্ষ্য করেছে তা হলো সমগ্র জাতি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। গণসংবর্ধনায় এই অভিধা প্রদান নিয়ে আমরা সব ছাত্রনেতা আলোচনায় বসেছিলাম। আমরা একমত ছিলাম যে, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে যে জাতীয় ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছে, সমগ্র জাতি আমাদের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছে। সুতরাং, যে মানুষটি শুধু পূর্ব বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা স্বাধিকারের জন্য তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কারান্তরালে কাটিয়েছেন অকুতোভয়ে, যার প্রতিটি উচ্চারণ আপসহীন, যার লক্ষ্য সুস্থির অটল, যিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বার বার_ জাতি যাকে বুকে তুলে নিয়েছে, যাকে নেতা হিসেবে বরণ করে নিয়েছে, যার জন্য রক্ত দিয়েছে, তাকে গণউপাধিতে ভূষিত করার অধিকার আমাদের অবশ্যই আছে এবং ঐতিহাসিক কারণে এটা আমাদের কর্তব্যও_ এবং আমাদের সামনে সেই সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমাদেরই এক ছোট ভাই প্রিয় নেতাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলেন যার নাম ছিল 'বঙ্গবন্ধু'। কবিতায় নেতাকে সে বঙ্গবন্ধু সম্বোধন করেছিল প্রতিটি চরণে। আমরা তো এর আগে 'বাংলার নয়নমণি', 'বঙ্গশার্দুল', 'অবিসংবাদিত নেতা', 'বাঙালির মুক্তিদাতা' প্রভৃতি বিশেষণে সম্বোধন করতাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অভিধাটি আমাদের সবার কাছেই খুব ভালো লাগল। আমরা একমত হলাম। অবরুদ্ধ বাঙালি যেন সহস্রাধিক বছর অপেক্ষায় এমন একজন বন্ধুর জন্য। চোখের সামনে বন্ধুর অবয়ব ভেসে ওঠে। বন্ধু অর্থ কি? বিশাল ক্যানভাসে সেদিন বন্ধুর ভাবার্থ আমাদের সামনে সুস্পষ্ট ছিল। যিনি ভালোবাসেন। শুধু ভালোবাসেন না, ভালোবাসার জন্য আপসহীন এবং আমৃত্যু সংগ্রাম করে যান। যার ভালোবাসা নির্লোভ, নিঃস্বার্থ। শেখ মুজিব যখন বন্ধু তখন তিনি হয়ে উঠেন বাংলার প্রকৃতির বন্ধু, বাংলার ভাষা কৃষ্টি-সংস্কৃতির বন্ধু, বাঙালি জাতীয়তাবোধের বন্ধু, মুক্তি সংগ্রামের বন্ধু। সুতরাং, একমাত্র শেখ মুজিবই হতে পারেন বঙ্গবন্ধু। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা কাউকেই আর বলিনি যে তাকে আজ এরূপ সম্বোধনে ভূষিত করব। সভাপতির ভাষণ দিতে দাঁড়ালাম। জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখলাম, যে নেতা তার যৌবন কাটিয়েছেন কারাগার থেকে কারাগারে। মৃত্যুভয় যার কাছে ছিল তুচ্ছ। এমনকি প্রধানমন্ত্রিত্বও ছিল যার কাছে তুচ্ছ। যে নেতা সবসময় বলেছেন আমি ক্ষুদিরামের বাংলার মুজিব, সূর্যসেনের বাংলার মুজিব। যিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের জন্য আমি হাসিমুখে জীবন দিতে পারি_ সেই নেতাকে আমরা একটি উপাধি দিয়ে বরণ করতে চাই। ১০ লাখ জনতা তাদের ২০ লাখ হাত উঁচিয়ে সমস্বরে সম্মতি জানিয়েছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঘোষণা করলাম_ বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান, হাজার বছরের মহাপুরুষ, নিপীড়িত-লাঞ্ছিত-প্রবঞ্চিত বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করলাম। আজ থেকে তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। লাখ লাখ কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো_ জয় বঙ্গবন্ধু।
পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল_ 'রেসকোর্সের গণমহাসমুদ্রে বক্তৃতারত শেখ মুজিবুর রহমান, প্রয়োজন হইলে সংগ্রাম করিয়া আবার কারগারে যাইব, কিন্তু দেশবাসীর সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিব না।' দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ নিবন্ধে লেখা হয়, 'ঢাকার বুকে সর্বকালের বৃহত্তম গণসংবর্ধনা সভায় মুজিবের ঘোষণা। এই দিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে গণমহাসমুদ্রের সভার সভাপতি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলা ও বাঙালির স্বার্থে অবিচল ও অবিরাম সংগ্রামের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া ঢাকার ইতিহাসে সর্বকালের সর্ববৃহৎ জনসমাবেশের উদ্দেশে বলেন যে, আমরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে নানা বিশেষণে বিশেষিত করার প্রয়াস পাই। কিন্তু তার রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করিলে যে সত্যটি সবচাইতে ভাস্বর হইয়া ওঠে তা হইতেছে মানব দরদী_ বিশেষ করিয়া বাংলা ও বাঙালির দরদী, প্রকৃত বন্ধু। তাই আজকের এই ঐতিহাসিক জনসমুদ্রের পক্ষ হইতে আমরা তাহাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করিতে চাই। রেসকোর্সের জনতার মহাসমুদ্র তখন এক বাক্যে বিপুল করতালির মধ্য দিয়া ১০ লক্ষাধিক লোক তাদের ২০ লক্ষাধিক হস্ত উত্তোলন করিয়া এই প্রস্তাব সমর্থন করেন।'
ভাবতে আজ কত ভালো লাগে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম রাজধানী ঢাকার শাহবাগে মিলিত হয়ে '৫২, '৬৯ ও '৭১-এর চেতনায় জাগ্রত হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের দাবিতে গোটা জাতিকে পুনর্জাগরিত করেছে। তরুণ প্রজন্মের জাগ্রত চেতনার সঙ্গে একাত্দতা জানাতে শাহবাগে গিয়েছিলাম। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, স্বকর্ণে শুনেছি তাদের স্লোগান। গর্বে আমার বুক ভরে উঠেছে। ষাটের দশকে আমরা যেসব স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করেছি_ 'জাগো জাগো বাঙালি জাগো', 'পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা', 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি', 'আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ', এবং 'জয় বাংলা'। সেসব রণধ্বনি আজ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নবপ্রজন্মের কণ্ঠে। ছোট্ট সোনামণিরা মা-বাবার কোলে চেপে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, গৃহবধূ, প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা, সবাই আজ যুদ্ধাপরাধীদের দাবি আদায়ে সমবেত হয়েছে শাহবাগের রাজপথে। তাদের কপালে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার ব্যান্ড, গালে লেখা এবং দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে 'জয় বাংলা' স্লোগান। হাতের ব্যানারে লেখা 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।' এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। একদিন যে স্বপ্ন নিয়ে, যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনায় হাতিয়ার তুলে নিয়ে ১৯৭১-এ জাতির জনকের ডাকে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনে সশস্ত্র জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম, '৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান তার সবকিছুই ধ্বংস করে দেওয়ার সর্বাত্দক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু সফলকাম হননি। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের সুফল আজ নবপ্রজন্মের চেতনার শোণিতে ধারিত ও প্রবাহিত হয়েছে। কোনো অপশক্তিই আর তাদের পশ্চাৎমুখী করতে সক্ষম হবে না। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সুদীর্ঘকালের সংগ্রামী অভিজ্ঞতার আলোকে আজ আত্দবিশ্বাসের সঙ্গে বলছি, যে অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে সামনে রেখে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির জনক_ সেই স্বপ্নের পতাকা বহনের শক্তি নবপ্রজন্ম অর্জন করেছে। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
ই-মেইল :tofailahmed69@gmail.com
__._,_.___