http://www.dainikazadi.org/seditor_details.php?news_id=475
আজ ২২ মে, শনিবার। ১৯৭১ সালের ২২ মে তারিখটিও ছিল শনিবার। সেদিন সকালের কোন একটি ক্ষণ আমাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল পরিবারের মেরুদণ্ডকে। বলছিলাম আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই শহীদ প্রকৌশলী নুর হোসেনের কথা।
মানুষ স্বজন হারায়, কিন্তু আমাদের এ হারানোর অনুভূতি আপনজন ছাড়া কিংবা মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা আপনজন হারিয়েছেন তাঁরা ছাড়া অন্যের প্রাণে কতটুকুই বা আবেদন সৃষ্টি করতে পারে?
আমার বড় ভাই শহীদ মোহাম্মদ নুর হোসেন (দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের প্রথম অবৈতনিক সম্পাদক) চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানে পাকিসত্মানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে বাঙালি অফিসার, কর্মচারীদের একত্র করে গোপন বৈঠক, সভা ইত্যাদিতে নেতৃত্ব দান, বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম এম এ আজিজসহ অন্যান্যদের সাথে সম্পর্কের কারণে বন্দরের অবাঙালি অফিসারদের মনে জেগেছিল ভয় এবং প্রতিহিংসার আগুন। যে আগুনের লেলিহান শিখা আমাদের পরিবারের সবাইকে আজো দগ্ধ করে চলেছে। বড় ভাই সপরিবারে থাকতেন বন্দর অফিসার্স কলোনির ৩০ নম্বর বাংলোয়। '৭১-এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তাঁরা ছিলেন এক রকম নজরবন্দি, কারণ এলাকাটি ছিল পাক বাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে এবং সে মুহূর্তে সেখান থেকে সরে আসাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এরই মধ্যে পাক সেনারা একদিন প্রকৌশলী নুর হোসেন মনে করে ধরে নিয়ে গেল প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেনকে। সেখান থেকে বলা হয়েছিল 'চমল দটশণ যধডপণঢ-লয ষরমভথ যণর্রমভ'. এই কথার পর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। এটা জানাজানি হওয়ার পর তিনি ধীরে ধীরে ব্যবস্থা নিলেন শহরের দিকে বাসা বদলের। বন্দরের তৎকালীন চেয়ারম্যান কমোডর মালিক সহানুভূতি (?) সহকারে রাজি হলেন। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাসা বদলের ব্যবস্থা হয়ে গেলে তিনি সাময়িকভাবে সপরিবারে ওঠলেন আমাদের নিজস্ব বাসায় 'হোসেন মঞ্জিল' রেয়াজুদ্দিন রোডে। উদ্দেশ্য ছিল সুযোগ বুঝে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং এজন্য বাসায় এসে আমার হাতে গচ্ছিত রেখেছিলেন বন্দর সম্পর্কিত বেশ কিছু মূল্যবান বইপত্র ও নকশা, যেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দর অপারেশনে অত্যন্ত প্রয়োজন। এসব বই ও নকশা জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, কর্ণফুলী রেয়ন মিলের তৎকালীন প্রকৌশলী জনাব মোহাম্মদ ইব্রাহিমের হাতে তুলে দিয়েছিলাম আসকারদিঘির পাড়স্থ একটি বাসায়, যেখানে তিনি মাঝে মাঝে আসতেন। তাঁরই নির্দেশ ও পরামর্শে আমি সে সময় ওপারে যাওয়া থেকে বিরত থাকি এবং বেতারে যাতায়াত অব্যাহত রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন খবরাখবর প্রদান করতে থাকি। পাকসেনা এবং তাদের দোসরদের শ্যেন দৃষ্টির কারণে বড় ভাই কয়েকদিন বাসা থেকেই অফিসে যাওয়া-আসা করছিলেন, আর সেদিনও যথারীতি রওনা দিয়েছিলেন অফিসের উদ্দেশ্যে। সে দিনটি ছিল শনিবার, ২২ মে, ১৯৭১। সে দিনের কোন একটি ক্ষণ আমার ভাইকে বিচ্ছিন্ন করল আমার কাছ থেকে, বাবা-মা'র কাছ থেকে, তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে ও একমাত্র মেয়ের কাছ থেকে। আমাদের পুরো পরিবারকে পঙ্গু করে দিয়ে গেল সেই ক্ষণটি। পাক সেনারা ভাইয়ের নিরপরাধ ড্রাইভার আবুল কালামকেও ছেড়ে দেয় নি। ভাইয়ের সাথে আমার শেষ দেখা একুশে মে রাত দশটার দিকে, যখন তিনি বাসার পেছন দিকে খালি জায়গাটুকুতে পায়চারি করছিলেন। ঐদিনই বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী জনাব শামসুজ্জামানকে অফিস থেকে পাক সেনা লে.কমান্ডার সিদ্দিকী সুকৌশলে নেভাল ব্যাজ-এ সরিয়ে ফেলেছিল, যিনি আর ফিরে আসেন নি। আমি সে ব্যাপারেই বড় ভাইয়ের কাছে জানতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখেই তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখ তো আজ আকাশে এত মেঘ কেন'? আমি বললাম, হয়ত বৃষ্টি হবে। অথচ তখন ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি পরদিন সকালেই নিষ্ঠুর পাক-সেনারা মেঘ হয়ে আমার ভাইকে আড়াল করে দেবে।
পরদিন ভোরে আমি চলে গেলাম বেতারে ডিউটি করতে। আটটার পর বাসায় টেলিফোন করে জানলাম বড় ভাই নির্ধারিত সময়ে বাবা-মা, ভাবি ও ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে প্রতিদিনের মতো বিদায় নিয়ে জামান সাহেবের বাসা হয়ে অফিসে রওনা দিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব গাড়ি এবং ড্রাইভারসহ। কিন্তু প্রায় সাড়ে ন'টা পর্যনত্ম বার বার ফোন করেও তাঁকে অফিসে পাওয়া গেল না। পি.এ. মাহবুব সাহেব জানালেন হয়তবা তিনি সাইটে গেছেন বলে আসতে দেরি হচ্ছে। আমি আবারও বাসায় ফোন করলাম জামান সাহেবের খবর জানার জন্য। ধরলেন ভাবি, কান্নায় ভেঙে পড়লেন, বললেন, ' তোমার বড় ভাইয়েরও তো খবর পাওয়া যাচ্ছে না'।
বিচলিত হলাম আমি, তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। এদিক-ওদিক খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম ভাইয়ের গাড়িটা বাটালি রোডে তৎকালীন আলী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের সামনে পড়ে আছে দরজা বন্ধ অবস্থায়। গাড়ি কে বা কারা রেখে গেছে কেউ বলতে পারল না সঠিকভাবে। প্রায় দুপুর বারোটার দিকে পাড়ার ইউসুফ ভাই আমাদের বাসায় এসে জানালেন সকাল আটটার দিকে বড় ভাইয়ের গাড়িতে বড় ভাই, ড্রাইভার ও দু'জন পাকসেনাকে দেওয়ানহাট থেকে উত্তরদিকে আসতে দেখেছেন। এ কথা শুনেই আমাদের স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেল যে নিশ্চয়ই বড় ভাইকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে গেছে। শুরু হল ভাইকে ফিরিয়ে আনার বিভিন্ন নিষ্ফল প্রচেষ্টা। কোথায় নিয়ে গেছে জানি না, তবু সবাই যে যেদিকে পারলাম ছুটলাম, কিন্তু কোন খবর পেলাম না। পেলাম শুধু আশ্বাস। এ সময় বেতারের পরিচয় কাজে লাগিয়ে গেলাম সার্কিট হাউজে ভাবীকে নিয়ে। গেলাম মেজ ভাইকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে। এভাবে দিনের পর দিন শুধু খোঁজাই হল সার।
বড় ভাই ফিরে আসার আশায় দিন গুণতে গুণতে ক্যান্সারে আক্রানত্ম হয়ে আমার মা মাবিয়া খাতুন জান্নাতবাসী হলেন '৭৫-এর ডিসেম্বরেই। আমার বাবা আলহাজ্ব মোহাম্মদ জাকের হোসেন আক্রানত্ম হলেন 'স্ট্রোকে'। ধুঁকে ধুঁকে তিনিও বিদায় নিলেন ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আমার মা- বাবাকে দাফন করতে পেরেছি নিজের হাতে। তাঁদের শেষ চিহ্ন 'কবর' দিতে পেরেছি। অথচ বড় ভাইতো আমাদের মাঝ থেকে এভাবে হারিয়ে যাবার কথা ছিল না। কোথাও রেখে গেল না কোন চিহ্ন।
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয়ে থাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। কারণ ঐ দিন মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় আঁচ করতে পেরে পাক হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ ইত্যাদির সহায়তায় বাংলাদেশের অবশিষ্ট শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞে শেষ মরণ কামড় দিয়েছিল এবং নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল এ দেশের সোনার সনত্মানদের। তবে তাদের বুদ্ধিজীবী হত্যার এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চের কালরাত্রি থেকে। সেদিন থেকে সারাদেশে সাধারণ জনগণের সাথে সাথে বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়ায় তারা নিমগ্ন ছিল। আর এই প্রক্রিয়ায় শিকার হয়ে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদেরই একজন শহীদ প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুর হোসেন।
তাঁর জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৩৬ সালের ২৩ এপ্রিল। শিক্ষাজীবন শুরু হয় এনায়েত বাজারের জুবিলী রোডস্থ এবাদুল্লাহ পণ্ডিত প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন অংক এবং অতিরিক্ত। উভয় বিষয়ে লেটার মার্কস অর্জন করেন এবং সেই সাথে বৃত্তি পান। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে দ্বাদশ স্থান অধিকার করে রসায়ন ও অংকে লেটার নিয়ে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন এবং বৃত্তি লাভ করেন। পরে ১৯৫৭ সালে ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিএসসি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। পাস করার সাথে সাথেই কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে (তৎকালীন সদরঘাট পোর্ট কমিশনার অফিসে) সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালের ৬ জুন বিয়ে করেন প্রখ্যাত পুঁথি সাহিত্যিক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের নাতনী খুরশীদ জাহান বেগমকে। তিনি শুধুমাত্র প্রকৌশলী ছিলেন না। ১৯৬৩ সালে বন্দরের পক্ষ থেকে নেদারল্যান্ড সফরে গেলে সেখানে তাঁর কথাবার্তা শুনে একজন বলেছিলেন 'তুমি প্রকৌশলী না হয়ে আইনবিদ হওয়া উচিত ছিল।" এ কথা তাঁর মনে এতই দাগ কেটেছিল যে, দেশে ফিরে এসে কাউকে না জানিয়ে আইন বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। আমরা জানলাম সেদিন, যেদিন দৈনিক আজাদী পত্রিকায় খবর ছাপা হলো-"প্রকৌশলী আইনজ্ঞ হলেন।" হ্যাঁ ১৯৬৬ সালে তিনি এল. এল বি পাস করেন। বেতারে কথিকা পড়তেন, ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার ধারা ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁর কৌতুকপূর্ণ কথাবার্তা শ্রোতাসাধারণকে আকর্ষণ করতো। বেতারের শিশু-কিশোর মেলায় তিনি ধাঁধাঁর আসর পরিচালনা করতেন। তাঁর নিজের তৈরি অনেক ধাঁধাঁর মধ্যে চট্টগ্রামকে নিয়ে একটি ধাঁ ধাঁ এখনো অনেকের মনে আছে। ধাঁধাঁটি ছিল "নাম শুনে মনে হয় যেন গন্ডগ্রাম, আসলে শহর এক নয়ানাভিরাম।" আজ তিনি নেই। রয়ে গেছে তাঁর রক্তের স্বাক্ষর স্বাধীন বাংলাদেশ।
শহীদ প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুর হোসেন-এর ছোট ছেলে সাদিক হোসাইন মোহাম্মদ শাকিল (এম.বি.এ) যাঁর বয়স সেদিন ছিল মাত্র সাড়ে তিন বছর (তিনি এখন দুবাই-এর একটি ব্যাংক-এ কর্মরত, তাঁর স্ত্রী ডা. সাজেদা বেগম মুন্নী ও একমাত্র ছেলে সৌম্যসহ সেখানেই আছে)। বড় ছেলে মোহাম্মদ আবিদ হোসাইন (ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, আইটি কনসালটেন্ট) তাঁর স্ত্রী নাজমা আখতার তুহীন ও একমাত্র ছেলে ফাইয়াজ হোসাইন এবং মেজ ছেলে ডা. মোহাম্মদ জাহিদ হোসাইন, তাঁর স্ত্রী জোহরা হোসাইন রাখী, মেয়ে উজমা, আরিবা ও ছেলে শামস্ আর একমাত্র মেয়ে সালমা তানভীর উদ্দিন উইলী তাঁর স্বামী জামাল উদ্দিন ছেলে মাহির ও মেয়ে মারিসাসহ আমেরিকায় অবস্থান করছেন। মা খুরশীদ জাহান বেগমের অনেক শাসন ও আদর যত্নে লালিত এ সনত্মানেরা পিতাকে হারিয়ে মায়ের আশ্রয়েও থাকতে পারলো না বেশি দিন। ১৯৯৩ সালের ২৭ আগস্ট শহীদ প্রকৌশলী নুর হোসেনের সহধর্মিনী চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ তাঁদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার ভাইসহ সকল শহীদকে স্মরণ করে থাকেন এবং শহীদ পরিবার হিসেবে আমাদের আমন্ত্রণও জানিয়ে থাকেন। এজন্যে তাঁদের কাছে আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁদের নামাঙ্কিত স্থাপনা তৈরিসহ সরকারের অঙ্গীকারকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হোক।
লেখক: শহীদ প্রকৌশলী নুর হোসেন এর ছোট ভাই
সাবেক মুখ্য উপস্থাপক, বাংলাদেশ বেতার।
আজ ২২ মে, শনিবার। ১৯৭১ সালের ২২ মে তারিখটিও ছিল শনিবার। সেদিন সকালের কোন একটি ক্ষণ আমাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল পরিবারের মেরুদণ্ডকে। বলছিলাম আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই শহীদ প্রকৌশলী নুর হোসেনের কথা।
মানুষ স্বজন হারায়, কিন্তু আমাদের এ হারানোর অনুভূতি আপনজন ছাড়া কিংবা মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা আপনজন হারিয়েছেন তাঁরা ছাড়া অন্যের প্রাণে কতটুকুই বা আবেদন সৃষ্টি করতে পারে?
আমার বড় ভাই শহীদ মোহাম্মদ নুর হোসেন (দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের প্রথম অবৈতনিক সম্পাদক) চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানে পাকিসত্মানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে বাঙালি অফিসার, কর্মচারীদের একত্র করে গোপন বৈঠক, সভা ইত্যাদিতে নেতৃত্ব দান, বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম এম এ আজিজসহ অন্যান্যদের সাথে সম্পর্কের কারণে বন্দরের অবাঙালি অফিসারদের মনে জেগেছিল ভয় এবং প্রতিহিংসার আগুন। যে আগুনের লেলিহান শিখা আমাদের পরিবারের সবাইকে আজো দগ্ধ করে চলেছে। বড় ভাই সপরিবারে থাকতেন বন্দর অফিসার্স কলোনির ৩০ নম্বর বাংলোয়। '৭১-এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তাঁরা ছিলেন এক রকম নজরবন্দি, কারণ এলাকাটি ছিল পাক বাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে এবং সে মুহূর্তে সেখান থেকে সরে আসাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এরই মধ্যে পাক সেনারা একদিন প্রকৌশলী নুর হোসেন মনে করে ধরে নিয়ে গেল প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেনকে। সেখান থেকে বলা হয়েছিল 'চমল দটশণ যধডপণঢ-লয ষরমভথ যণর্রমভ'. এই কথার পর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। এটা জানাজানি হওয়ার পর তিনি ধীরে ধীরে ব্যবস্থা নিলেন শহরের দিকে বাসা বদলের। বন্দরের তৎকালীন চেয়ারম্যান কমোডর মালিক সহানুভূতি (?) সহকারে রাজি হলেন। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাসা বদলের ব্যবস্থা হয়ে গেলে তিনি সাময়িকভাবে সপরিবারে ওঠলেন আমাদের নিজস্ব বাসায় 'হোসেন মঞ্জিল' রেয়াজুদ্দিন রোডে। উদ্দেশ্য ছিল সুযোগ বুঝে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং এজন্য বাসায় এসে আমার হাতে গচ্ছিত রেখেছিলেন বন্দর সম্পর্কিত বেশ কিছু মূল্যবান বইপত্র ও নকশা, যেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দর অপারেশনে অত্যন্ত প্রয়োজন। এসব বই ও নকশা জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, কর্ণফুলী রেয়ন মিলের তৎকালীন প্রকৌশলী জনাব মোহাম্মদ ইব্রাহিমের হাতে তুলে দিয়েছিলাম আসকারদিঘির পাড়স্থ একটি বাসায়, যেখানে তিনি মাঝে মাঝে আসতেন। তাঁরই নির্দেশ ও পরামর্শে আমি সে সময় ওপারে যাওয়া থেকে বিরত থাকি এবং বেতারে যাতায়াত অব্যাহত রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন খবরাখবর প্রদান করতে থাকি। পাকসেনা এবং তাদের দোসরদের শ্যেন দৃষ্টির কারণে বড় ভাই কয়েকদিন বাসা থেকেই অফিসে যাওয়া-আসা করছিলেন, আর সেদিনও যথারীতি রওনা দিয়েছিলেন অফিসের উদ্দেশ্যে। সে দিনটি ছিল শনিবার, ২২ মে, ১৯৭১। সে দিনের কোন একটি ক্ষণ আমার ভাইকে বিচ্ছিন্ন করল আমার কাছ থেকে, বাবা-মা'র কাছ থেকে, তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে ও একমাত্র মেয়ের কাছ থেকে। আমাদের পুরো পরিবারকে পঙ্গু করে দিয়ে গেল সেই ক্ষণটি। পাক সেনারা ভাইয়ের নিরপরাধ ড্রাইভার আবুল কালামকেও ছেড়ে দেয় নি। ভাইয়ের সাথে আমার শেষ দেখা একুশে মে রাত দশটার দিকে, যখন তিনি বাসার পেছন দিকে খালি জায়গাটুকুতে পায়চারি করছিলেন। ঐদিনই বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী জনাব শামসুজ্জামানকে অফিস থেকে পাক সেনা লে.কমান্ডার সিদ্দিকী সুকৌশলে নেভাল ব্যাজ-এ সরিয়ে ফেলেছিল, যিনি আর ফিরে আসেন নি। আমি সে ব্যাপারেই বড় ভাইয়ের কাছে জানতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখেই তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখ তো আজ আকাশে এত মেঘ কেন'? আমি বললাম, হয়ত বৃষ্টি হবে। অথচ তখন ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি পরদিন সকালেই নিষ্ঠুর পাক-সেনারা মেঘ হয়ে আমার ভাইকে আড়াল করে দেবে।
পরদিন ভোরে আমি চলে গেলাম বেতারে ডিউটি করতে। আটটার পর বাসায় টেলিফোন করে জানলাম বড় ভাই নির্ধারিত সময়ে বাবা-মা, ভাবি ও ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে প্রতিদিনের মতো বিদায় নিয়ে জামান সাহেবের বাসা হয়ে অফিসে রওনা দিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব গাড়ি এবং ড্রাইভারসহ। কিন্তু প্রায় সাড়ে ন'টা পর্যনত্ম বার বার ফোন করেও তাঁকে অফিসে পাওয়া গেল না। পি.এ. মাহবুব সাহেব জানালেন হয়তবা তিনি সাইটে গেছেন বলে আসতে দেরি হচ্ছে। আমি আবারও বাসায় ফোন করলাম জামান সাহেবের খবর জানার জন্য। ধরলেন ভাবি, কান্নায় ভেঙে পড়লেন, বললেন, ' তোমার বড় ভাইয়েরও তো খবর পাওয়া যাচ্ছে না'।
বিচলিত হলাম আমি, তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। এদিক-ওদিক খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম ভাইয়ের গাড়িটা বাটালি রোডে তৎকালীন আলী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের সামনে পড়ে আছে দরজা বন্ধ অবস্থায়। গাড়ি কে বা কারা রেখে গেছে কেউ বলতে পারল না সঠিকভাবে। প্রায় দুপুর বারোটার দিকে পাড়ার ইউসুফ ভাই আমাদের বাসায় এসে জানালেন সকাল আটটার দিকে বড় ভাইয়ের গাড়িতে বড় ভাই, ড্রাইভার ও দু'জন পাকসেনাকে দেওয়ানহাট থেকে উত্তরদিকে আসতে দেখেছেন। এ কথা শুনেই আমাদের স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেল যে নিশ্চয়ই বড় ভাইকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে গেছে। শুরু হল ভাইকে ফিরিয়ে আনার বিভিন্ন নিষ্ফল প্রচেষ্টা। কোথায় নিয়ে গেছে জানি না, তবু সবাই যে যেদিকে পারলাম ছুটলাম, কিন্তু কোন খবর পেলাম না। পেলাম শুধু আশ্বাস। এ সময় বেতারের পরিচয় কাজে লাগিয়ে গেলাম সার্কিট হাউজে ভাবীকে নিয়ে। গেলাম মেজ ভাইকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে। এভাবে দিনের পর দিন শুধু খোঁজাই হল সার।
বড় ভাই ফিরে আসার আশায় দিন গুণতে গুণতে ক্যান্সারে আক্রানত্ম হয়ে আমার মা মাবিয়া খাতুন জান্নাতবাসী হলেন '৭৫-এর ডিসেম্বরেই। আমার বাবা আলহাজ্ব মোহাম্মদ জাকের হোসেন আক্রানত্ম হলেন 'স্ট্রোকে'। ধুঁকে ধুঁকে তিনিও বিদায় নিলেন ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আমার মা- বাবাকে দাফন করতে পেরেছি নিজের হাতে। তাঁদের শেষ চিহ্ন 'কবর' দিতে পেরেছি। অথচ বড় ভাইতো আমাদের মাঝ থেকে এভাবে হারিয়ে যাবার কথা ছিল না। কোথাও রেখে গেল না কোন চিহ্ন।
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয়ে থাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। কারণ ঐ দিন মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় আঁচ করতে পেরে পাক হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ ইত্যাদির সহায়তায় বাংলাদেশের অবশিষ্ট শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞে শেষ মরণ কামড় দিয়েছিল এবং নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল এ দেশের সোনার সনত্মানদের। তবে তাদের বুদ্ধিজীবী হত্যার এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চের কালরাত্রি থেকে। সেদিন থেকে সারাদেশে সাধারণ জনগণের সাথে সাথে বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়ায় তারা নিমগ্ন ছিল। আর এই প্রক্রিয়ায় শিকার হয়ে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদেরই একজন শহীদ প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুর হোসেন।
তাঁর জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৩৬ সালের ২৩ এপ্রিল। শিক্ষাজীবন শুরু হয় এনায়েত বাজারের জুবিলী রোডস্থ এবাদুল্লাহ পণ্ডিত প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন অংক এবং অতিরিক্ত। উভয় বিষয়ে লেটার মার্কস অর্জন করেন এবং সেই সাথে বৃত্তি পান। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে দ্বাদশ স্থান অধিকার করে রসায়ন ও অংকে লেটার নিয়ে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন এবং বৃত্তি লাভ করেন। পরে ১৯৫৭ সালে ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিএসসি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। পাস করার সাথে সাথেই কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে (তৎকালীন সদরঘাট পোর্ট কমিশনার অফিসে) সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালের ৬ জুন বিয়ে করেন প্রখ্যাত পুঁথি সাহিত্যিক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের নাতনী খুরশীদ জাহান বেগমকে। তিনি শুধুমাত্র প্রকৌশলী ছিলেন না। ১৯৬৩ সালে বন্দরের পক্ষ থেকে নেদারল্যান্ড সফরে গেলে সেখানে তাঁর কথাবার্তা শুনে একজন বলেছিলেন 'তুমি প্রকৌশলী না হয়ে আইনবিদ হওয়া উচিত ছিল।" এ কথা তাঁর মনে এতই দাগ কেটেছিল যে, দেশে ফিরে এসে কাউকে না জানিয়ে আইন বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। আমরা জানলাম সেদিন, যেদিন দৈনিক আজাদী পত্রিকায় খবর ছাপা হলো-"প্রকৌশলী আইনজ্ঞ হলেন।" হ্যাঁ ১৯৬৬ সালে তিনি এল. এল বি পাস করেন। বেতারে কথিকা পড়তেন, ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার ধারা ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁর কৌতুকপূর্ণ কথাবার্তা শ্রোতাসাধারণকে আকর্ষণ করতো। বেতারের শিশু-কিশোর মেলায় তিনি ধাঁধাঁর আসর পরিচালনা করতেন। তাঁর নিজের তৈরি অনেক ধাঁধাঁর মধ্যে চট্টগ্রামকে নিয়ে একটি ধাঁ ধাঁ এখনো অনেকের মনে আছে। ধাঁধাঁটি ছিল "নাম শুনে মনে হয় যেন গন্ডগ্রাম, আসলে শহর এক নয়ানাভিরাম।" আজ তিনি নেই। রয়ে গেছে তাঁর রক্তের স্বাক্ষর স্বাধীন বাংলাদেশ।
শহীদ প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুর হোসেন-এর ছোট ছেলে সাদিক হোসাইন মোহাম্মদ শাকিল (এম.বি.এ) যাঁর বয়স সেদিন ছিল মাত্র সাড়ে তিন বছর (তিনি এখন দুবাই-এর একটি ব্যাংক-এ কর্মরত, তাঁর স্ত্রী ডা. সাজেদা বেগম মুন্নী ও একমাত্র ছেলে সৌম্যসহ সেখানেই আছে)। বড় ছেলে মোহাম্মদ আবিদ হোসাইন (ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, আইটি কনসালটেন্ট) তাঁর স্ত্রী নাজমা আখতার তুহীন ও একমাত্র ছেলে ফাইয়াজ হোসাইন এবং মেজ ছেলে ডা. মোহাম্মদ জাহিদ হোসাইন, তাঁর স্ত্রী জোহরা হোসাইন রাখী, মেয়ে উজমা, আরিবা ও ছেলে শামস্ আর একমাত্র মেয়ে সালমা তানভীর উদ্দিন উইলী তাঁর স্বামী জামাল উদ্দিন ছেলে মাহির ও মেয়ে মারিসাসহ আমেরিকায় অবস্থান করছেন। মা খুরশীদ জাহান বেগমের অনেক শাসন ও আদর যত্নে লালিত এ সনত্মানেরা পিতাকে হারিয়ে মায়ের আশ্রয়েও থাকতে পারলো না বেশি দিন। ১৯৯৩ সালের ২৭ আগস্ট শহীদ প্রকৌশলী নুর হোসেনের সহধর্মিনী চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ তাঁদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার ভাইসহ সকল শহীদকে স্মরণ করে থাকেন এবং শহীদ পরিবার হিসেবে আমাদের আমন্ত্রণও জানিয়ে থাকেন। এজন্যে তাঁদের কাছে আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁদের নামাঙ্কিত স্থাপনা তৈরিসহ সরকারের অঙ্গীকারকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হোক।
লেখক: শহীদ প্রকৌশলী নুর হোসেন এর ছোট ভাই
সাবেক মুখ্য উপস্থাপক, বাংলাদেশ বেতার।