রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং সাহসী খালেদা জিয়া
23 Apr, 2015
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও সম্মান রক্ষা করা। অপর দিকে যদি সরকার রাষ্ট্রীয় শক্তি, অস্ত্রশস্ত্র এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বাহিনীকে ব্যবহার করে নাগরিকের জীবন বিপন্ন করে তোলে, তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলা যায়। সরকারি সন্ত্রাস আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্যে তেমন কোনো হেরফের না থাকলেও মাত্রাগত পার্থক্য আছে। সংসদীয় বিধিব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনা করে। সেখানে সরকার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী নয়। রাষ্ট্রের অঙ্গসংগঠনগুলো এমনভাবে পরিচালিত হয় যে, ক্ষমতার ভারসাম্য যেন নষ্ট না হয়। নির্বাহী বিভাগ যদি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে বিচার বিভাগ তার ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরে। আবার আইনসভা নির্বাহী বিভাগকে সংবিধান মোতাবেক নিয়ন্ত্রণ করবে, এটাই সংসদীয় রীতি। কিন্তু সব কিছুকে উপেক্ষা করে সরকার যখন ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে চায় তখন নাগরিক জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। সরকার এবং রাষ্ট্রের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক পার্থক্য যখন লোপ পায়, তখন ক্ষমতার দর্প প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দলীয় সরকার স্বীকৃত। আরেকটু জোরালোভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক দলই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিস্থাপিত। রাষ্ট্রপতি-শাসিত ব্যবস্থা কিংবা মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত ব্যবস্থা- সর্বত্রই রাজনৈতিক দল ক্ষমতার নিয়ামক শক্তি। তাই পাশ্চাত্য কিংবা প্রাচ্য- সর্বত্রই জনগণের কল্যাণধারণায় রাজনৈতিক দলকে লালনপালন করা হয়। পাশ্চাত্যে রাজনৈতিক দলগুলো উদারনৈতিক নীতি বা লিবারেল ডেমোক্র্যাসিকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। অবক্ষয়মান কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলই ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি। তৃতীয় বিশ্বের মিশ্র ধরনের দেশগুলোতে রাজনৈতিক দল আদর্শভিত্তিক না হওয়ার কারণে সাধারণত ক্ষমতাকেন্দ্রিক দৌরাত্ম্য দুর্নীতিপরায়ণ এবং সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের উৎপীড়নের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সরকার রাজনৈতিক কর্মীবাহিনীকে অন্যায় অনিয়ম ও দুর্নীতি দ্বারা দানবে পরিণত করে। এই দানবগুলো সরকারের রক্ষণ,ভক্ষণ ও তোষণের মাধ্যম হয়ে ওঠে।
এ ক্ষেত্রে নেতা-নেত্রী যদি হন ক্ষমতার বাতিকগ্রস্ত, তাহলে স্বৈরতন্ত্র কায়েম হতে বাধ্য। যেকোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। বলা হয়ে থাকে, একজন রাষ্ট্রনায়ক নিজ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। অপর দিকে ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতিবিদ শুধু নির্বাচন নিয়েই ভাবেন। একজন নীতিবান রাষ্ট্রনায়কের কাছে নীতি-নৈতিকতা, সৌজন্য-সভ্যতা এবং রীতি-রেওয়াজ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অপর দিকে একজন ক্ষমতাপাগল রাজনীতিবিদের কাছে তার ক্ষমতার দাপট, হিংসা-প্রতিহিংসা লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই দীর্ঘ নীতিকথার ভূমিকা এই কারণে যে, এর মধ্য দিয়ে আমরা গত কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক ঘটনাবলি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারব। এ সময়টি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময়ে বিরোধী দল পরিচালিত অবরোধ আন্দোলনের কার্যত পরিসমাপ্তি ঘটে। অপর দিকে আন্দোলন মোকাবেলার কৌশল হিসেবে সরকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘোষণা করে। নির্বাচনটি হয়ে দাঁড়ায় বিএনপির জন্য শাঁখের করাত। সরকারের পরিকল্পিত এই নির্বাচন বিএনপির জন্য বেশি সুফল বয়ে আনবে না বলে অনেকের ধারণা। এক দিকে অবৈধ সরকারের এক রকম স্বীকৃতি, অপর দিকে সরকারের নিকৃষ্ট নিগ্রহের মধ্য দিয়ে নির্বাচন- উভয়ই অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু যেহেতু বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল এবং এর কর্মীরা সততই নির্বাচনমুখী, তাই নির্বাচনকে উপেক্ষা করা বিএনপির জন্য সহজ ছিল না। তা ছাড়া দুঃশাসনে অতিষ্ঠ জনগণ যেকোনো পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে উন্মুখ। সে কারণে বিএনপির জন্য নির্বাচন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের শীর্ষ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ যুক্তি দেখান, নীরব জনগোষ্ঠী যদি সরব হয়ে ওঠে, সত্যি সত্যিই যদি তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয় লাভ করে, তাহলে তা হবে বিএনপির জন্য জাদুর কাঠি। এই কাঠির স্পর্শে বিএনপির নীরব নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠী জেগে উঠতে পারে, তা ভবিষ্যৎ গণবিপ্লবের ভিত্তি তৈরি করবে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০১৩ সালের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির জয় লাভ সারা দেশে জয়তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিল। এতে ভীত হয়ে আওয়ামী লীগ ছল-বল-কৌশল প্রয়োগ করে এ বিজয়কে অকার্যকর করার সর্বাত্মক প্রয়াস পায়। রাজনৈতিক চাতুর্যে বিশ্বাসী অনেকেই মনে করেন, বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মতো কূটকৌশল প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়। অপর দিকে নীতিবান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপির প্রতি নৈতিক সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। এক বছর পরে যখন বিএনপি পুনরায় অন্দোলনের সূচনা করে তখন সরকার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করে দেয়। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয় গণতন্ত্র। নির্মম নিপীড়নের মাধ্যমে সরকার আন্দোলনকে বন্ধ করে দেয়। এরপর আকস্মিকভাবে সিটি করপোরেশনের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীন দল আন্দোলন মোকাবেলার কৌশল খোঁজে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও বিএনপি অবশেষে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।
যথেষ্ট টানাপড়েন অতিক্রম করে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যখন নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন তখন তাদের পিলে চমকে যায়। প্রচারণায় বিপুল জনসমাগম দেখে সম্ভাব্য পরাজয়কে ঠেকানোর অপকৌশল হিসেবে বেগম জিয়াকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। পরপর চারবার তার ওপর হামলা পরিচালিত হয়েছে পুলিশের উপস্থিতিতেই। সরকারদলীয় ক্যাডাররা এ হামলা চালায়। খালেদা জিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে। কিন্তু তার গাড়ি বুলেটপ্রুফ হওয়ায় তিনি বেঁচে যান। এসব হামলায় তাঁর গাড়িসহ অন্তত ২০ গাড়িতে হামলা চালানো হয়। হামলায় বিরোধী জোটের শতাধিক নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী আহত হয়েছেন। রোববার থেকে বুধবার পর্যন্ত চারবার গাড়িবহরে হামলা চালানো হলো। উল্লেখ্য, হামলার আগে তার পুলিশি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সকালে নিরাপত্তা প্রত্যাহার এবং বিকেলে হামলা- এর মধ্যে নিশ্চয়ই যোগসূত্র রয়েছে। 'জয় বাংলা' স্লোগান দিয়ে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট। তা ছাড়া হামলাকারীদের যাদের ছবি বেরিয়েছে, তাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যেই সরকারি দলের প্রার্থীদের প্রচারণায় শামিল রয়েছেন। এ দিকে প্রধানমন্ত্রী এবং তার সভাসদরা এই হামলার নিন্দা করা তো দূরের কথা, বরং তারা উসকানিমূলক উক্তি করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, কারওয়ান বাজারের ঘটনা খালেদা জিয়ার নাটক। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছেন, হামলার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। সুতরাং হামলার পেছনে সরকারি মদদ প্রমাণিত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইইউসহ ১৫টি দেশের কূটনীতিকেরা এ হামলার নিন্দা করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া বলেন, 'কিছু দিন আগে সন্তান হারিয়েছি, আব্বাস আমার সন্তানের মতো। তাকে ভোট দিয়ে এই হামলার প্রতিবাদ জানান।' এই হামলা-মামলার মধ্য দিয়ে বেগম জিয়া যেভাবে অকুতোভয় এগিয়ে যাচ্ছেন, তা অকল্পনীয়। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রচারণাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন। তা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করছে। বেগম জিয়া তার অদম্য সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও দুর্দান্ত সাহস ধারণ করেই এ রকম চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে পারছেন।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের হামলা অকল্পনীয়। দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং কার্যত প্রধান বিরোধী নেত্রী বারবার হামলার শিকার হচ্ছেন প্রকাশ্য দিবালোকে ও রাজধানীতে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সহজেই মন্তব্য করা যায়, এ হামলা পরিকল্পিত। সরকার যেভাবে এটাকে তথাকথিত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া বলার চেষ্টা করছে; এ প্রপাগান্ডা মানুষ বিশ্বাস করছে না। ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায়, শাসক দলের ক্যাডাররা একই কায়দায় হামলা করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে আওয়ামী বাহিনী হামলা করছে। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে নেতা-পাতিনেতারা তাদের উৎসাহিত করছেন। সুতরাং একে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়া অন্য কিছু বলার অবকাশ নেই। বস্তুত একদলীয় আদর্শে বিশ্বাসী এই সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন করে লাভ নেই। এর অবসান হতে পারে কেবল গণতন্ত্র কায়েমের মধ্য দিয়ে। প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিশারদেরা যথার্থই বলেছেন, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যদি শাসক দলের ভরাডুবি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
দেশে-বিদেশে সরকার নৈতিক চাপের সম্মুখীন হবে। তখন একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন অনিবার্য হয়ে উঠবে, যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অবসান ঘটাবে। তখন নাগরিক সাধারণ স্বস্তি ও সান্ত্বনা লাভ করবে।
ড. আবদুল লতিফ মাসুম
লেখক : প্রফেসর সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দলীয় সরকার স্বীকৃত। আরেকটু জোরালোভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক দলই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিস্থাপিত। রাষ্ট্রপতি-শাসিত ব্যবস্থা কিংবা মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত ব্যবস্থা- সর্বত্রই রাজনৈতিক দল ক্ষমতার নিয়ামক শক্তি। তাই পাশ্চাত্য কিংবা প্রাচ্য- সর্বত্রই জনগণের কল্যাণধারণায় রাজনৈতিক দলকে লালনপালন করা হয়। পাশ্চাত্যে রাজনৈতিক দলগুলো উদারনৈতিক নীতি বা লিবারেল ডেমোক্র্যাসিকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। অবক্ষয়মান কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলই ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি। তৃতীয় বিশ্বের মিশ্র ধরনের দেশগুলোতে রাজনৈতিক দল আদর্শভিত্তিক না হওয়ার কারণে সাধারণত ক্ষমতাকেন্দ্রিক দৌরাত্ম্য দুর্নীতিপরায়ণ এবং সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের উৎপীড়নের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সরকার রাজনৈতিক কর্মীবাহিনীকে অন্যায় অনিয়ম ও দুর্নীতি দ্বারা দানবে পরিণত করে। এই দানবগুলো সরকারের রক্ষণ,ভক্ষণ ও তোষণের মাধ্যম হয়ে ওঠে।
এ ক্ষেত্রে নেতা-নেত্রী যদি হন ক্ষমতার বাতিকগ্রস্ত, তাহলে স্বৈরতন্ত্র কায়েম হতে বাধ্য। যেকোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। বলা হয়ে থাকে, একজন রাষ্ট্রনায়ক নিজ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। অপর দিকে ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতিবিদ শুধু নির্বাচন নিয়েই ভাবেন। একজন নীতিবান রাষ্ট্রনায়কের কাছে নীতি-নৈতিকতা, সৌজন্য-সভ্যতা এবং রীতি-রেওয়াজ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অপর দিকে একজন ক্ষমতাপাগল রাজনীতিবিদের কাছে তার ক্ষমতার দাপট, হিংসা-প্রতিহিংসা লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই দীর্ঘ নীতিকথার ভূমিকা এই কারণে যে, এর মধ্য দিয়ে আমরা গত কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক ঘটনাবলি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারব। এ সময়টি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময়ে বিরোধী দল পরিচালিত অবরোধ আন্দোলনের কার্যত পরিসমাপ্তি ঘটে। অপর দিকে আন্দোলন মোকাবেলার কৌশল হিসেবে সরকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘোষণা করে। নির্বাচনটি হয়ে দাঁড়ায় বিএনপির জন্য শাঁখের করাত। সরকারের পরিকল্পিত এই নির্বাচন বিএনপির জন্য বেশি সুফল বয়ে আনবে না বলে অনেকের ধারণা। এক দিকে অবৈধ সরকারের এক রকম স্বীকৃতি, অপর দিকে সরকারের নিকৃষ্ট নিগ্রহের মধ্য দিয়ে নির্বাচন- উভয়ই অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু যেহেতু বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল এবং এর কর্মীরা সততই নির্বাচনমুখী, তাই নির্বাচনকে উপেক্ষা করা বিএনপির জন্য সহজ ছিল না। তা ছাড়া দুঃশাসনে অতিষ্ঠ জনগণ যেকোনো পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে উন্মুখ। সে কারণে বিএনপির জন্য নির্বাচন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের শীর্ষ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ যুক্তি দেখান, নীরব জনগোষ্ঠী যদি সরব হয়ে ওঠে, সত্যি সত্যিই যদি তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয় লাভ করে, তাহলে তা হবে বিএনপির জন্য জাদুর কাঠি। এই কাঠির স্পর্শে বিএনপির নীরব নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠী জেগে উঠতে পারে, তা ভবিষ্যৎ গণবিপ্লবের ভিত্তি তৈরি করবে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০১৩ সালের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির জয় লাভ সারা দেশে জয়তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিল। এতে ভীত হয়ে আওয়ামী লীগ ছল-বল-কৌশল প্রয়োগ করে এ বিজয়কে অকার্যকর করার সর্বাত্মক প্রয়াস পায়। রাজনৈতিক চাতুর্যে বিশ্বাসী অনেকেই মনে করেন, বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মতো কূটকৌশল প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়। অপর দিকে নীতিবান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপির প্রতি নৈতিক সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। এক বছর পরে যখন বিএনপি পুনরায় অন্দোলনের সূচনা করে তখন সরকার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করে দেয়। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয় গণতন্ত্র। নির্মম নিপীড়নের মাধ্যমে সরকার আন্দোলনকে বন্ধ করে দেয়। এরপর আকস্মিকভাবে সিটি করপোরেশনের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীন দল আন্দোলন মোকাবেলার কৌশল খোঁজে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও বিএনপি অবশেষে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।
যথেষ্ট টানাপড়েন অতিক্রম করে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যখন নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন তখন তাদের পিলে চমকে যায়। প্রচারণায় বিপুল জনসমাগম দেখে সম্ভাব্য পরাজয়কে ঠেকানোর অপকৌশল হিসেবে বেগম জিয়াকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। পরপর চারবার তার ওপর হামলা পরিচালিত হয়েছে পুলিশের উপস্থিতিতেই। সরকারদলীয় ক্যাডাররা এ হামলা চালায়। খালেদা জিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে। কিন্তু তার গাড়ি বুলেটপ্রুফ হওয়ায় তিনি বেঁচে যান। এসব হামলায় তাঁর গাড়িসহ অন্তত ২০ গাড়িতে হামলা চালানো হয়। হামলায় বিরোধী জোটের শতাধিক নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী আহত হয়েছেন। রোববার থেকে বুধবার পর্যন্ত চারবার গাড়িবহরে হামলা চালানো হলো। উল্লেখ্য, হামলার আগে তার পুলিশি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সকালে নিরাপত্তা প্রত্যাহার এবং বিকেলে হামলা- এর মধ্যে নিশ্চয়ই যোগসূত্র রয়েছে। 'জয় বাংলা' স্লোগান দিয়ে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট। তা ছাড়া হামলাকারীদের যাদের ছবি বেরিয়েছে, তাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যেই সরকারি দলের প্রার্থীদের প্রচারণায় শামিল রয়েছেন। এ দিকে প্রধানমন্ত্রী এবং তার সভাসদরা এই হামলার নিন্দা করা তো দূরের কথা, বরং তারা উসকানিমূলক উক্তি করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, কারওয়ান বাজারের ঘটনা খালেদা জিয়ার নাটক। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছেন, হামলার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। সুতরাং হামলার পেছনে সরকারি মদদ প্রমাণিত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইইউসহ ১৫টি দেশের কূটনীতিকেরা এ হামলার নিন্দা করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া বলেন, 'কিছু দিন আগে সন্তান হারিয়েছি, আব্বাস আমার সন্তানের মতো। তাকে ভোট দিয়ে এই হামলার প্রতিবাদ জানান।' এই হামলা-মামলার মধ্য দিয়ে বেগম জিয়া যেভাবে অকুতোভয় এগিয়ে যাচ্ছেন, তা অকল্পনীয়। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রচারণাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন। তা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করছে। বেগম জিয়া তার অদম্য সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও দুর্দান্ত সাহস ধারণ করেই এ রকম চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে পারছেন।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের হামলা অকল্পনীয়। দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং কার্যত প্রধান বিরোধী নেত্রী বারবার হামলার শিকার হচ্ছেন প্রকাশ্য দিবালোকে ও রাজধানীতে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সহজেই মন্তব্য করা যায়, এ হামলা পরিকল্পিত। সরকার যেভাবে এটাকে তথাকথিত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া বলার চেষ্টা করছে; এ প্রপাগান্ডা মানুষ বিশ্বাস করছে না। ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায়, শাসক দলের ক্যাডাররা একই কায়দায় হামলা করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে আওয়ামী বাহিনী হামলা করছে। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে নেতা-পাতিনেতারা তাদের উৎসাহিত করছেন। সুতরাং একে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়া অন্য কিছু বলার অবকাশ নেই। বস্তুত একদলীয় আদর্শে বিশ্বাসী এই সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন করে লাভ নেই। এর অবসান হতে পারে কেবল গণতন্ত্র কায়েমের মধ্য দিয়ে। প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিশারদেরা যথার্থই বলেছেন, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যদি শাসক দলের ভরাডুবি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
দেশে-বিদেশে সরকার নৈতিক চাপের সম্মুখীন হবে। তখন একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন অনিবার্য হয়ে উঠবে, যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অবসান ঘটাবে। তখন নাগরিক সাধারণ স্বস্তি ও সান্ত্বনা লাভ করবে।
ড. আবদুল লতিফ মাসুম
লেখক : প্রফেসর সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
__._,_.___