প্রিয় অপ্রিয় ভারত: ছাড় হবে না একচুলও
প্রভাষ আমিন॥
কিভাবে জানি না, তসলিমা নাসরিন পারেন। একইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশেরও জয় চান, ভারতেরও। কিন্তু আমি এখনও তার মতো বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি। আমার কাছে বাংলাদেশই প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা। আর খেলা দেখতে বসে নিরপেক্ষ থাকা খুব কঠিন। কোনও একটা দলকে সমর্থন না করলে খেলা দেখার আনন্দটা পূর্ণ হয় না। তবে খেলা দেখতে দেখতে আমরা কখনও কখনও খেলাকে যুদ্ধ বানিয়ে ফেলি। গত ২৬ মার্চ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল দেখতে বসে যে দ্বিধায় পড়েছি, তা আর আগে কখনও হয়নি।
ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে এমনিতে আমার ভারতের সমর্থন করার কথা। কিন্তু সেদিন শুধু আমি নই, বাংলাদেশের কোটি মানুষ, এই দ্বিধায় ভুগেছে। আমার মতো অনেকেই জীবনে প্রথমবারের মতো এবং সম্ভবত শেষবারের মতো অস্ট্রেলিয়াকে সমর্থন করেছি। পছন্দের ব্যাপারটায় পরে আসছি। আগে অপছন্দের কথা বলে নেই। শুধু ক্রিকেট নয়, সবকিছু মিলিয়ে আমার অপছন্দের শীর্ষে সবসময় পাকিস্তান। ক্রিকেটে অপছন্দে দুই নম্বরে আছে এবারের বিশ্বকাপেই যাদের বিদায় করে দিয়েছে বাংলাদেশ, সেই ইংল্যান্ড। আর তিনে আছে অস্ট্রেলিয়া। সেই অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে গলা ফাটানো অনেক কষ্টকর। তাই ফাইনালে আমি নিউজিল্যান্ডের পক্ষে। কারণ নিউজিল্যান্ড বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলে আমরা মাথা উঁচিয়ে বিশ্বকে বলতে পারবো, ছ্যা, এই নিউজিল্যান্ডকে আমরা দুইবার হোয়াইট ওয়াশ করেছি। গত ৮ ম্যাচের সাতটিই জিতেছি আমরা। বিশ্বকাপেও নিউজিল্যান্ডকে একটু টেনশনে ফেলেছে, সে তো এই বাংলাদেশই।
আগেই বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত ছিল বলে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপ ম্যাচে বাংলাদেশের একটু গা ছাড়া ভাব ছিল। বিশ্রামে ছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। ওই ম্যাচের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান রুবেলকে ঠিকভাবে ব্যবহার করলে বাংলাদেশেরই জয়ের সুযোগ ছিল। জিতলে সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা, হারলে ভারত; এই সমীকরণে বাংলাদেশ চেনা প্রতিপক্ষ ভারতকেই বেছে নেয়।
তাহলে সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে সমর্থন করা কেন?
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই আজকের লেখা। যে দুয়েকজন বাংলা ট্রিবিউনে আমার লেখা পড়েন তারা দেখেছেন 'বাংলাদেশের নৈতিক জয়' এবং 'এবার হোক ভারতবধ কাব্য' শিরোনামে দুটি লেখা লিখেছিলাম। তবে আমি ঘোষণা করছি, অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলায় ভারতের বিপক্ষে থাকলেও, এমনিতে আমি ভারতবিদ্বেষী নই। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পাশে ছিল বলে ভারতের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা চিরদিনের। তখন ভারত অর্থ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে, সমর্থন দিয়ে, এক কোটি শরণার্থীকে নয় মাস আশ্রয় দিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধারাই যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। তবে এটা মানতেও দ্বিধা নেই, একাত্তরে ভারতের অকাতর সহায়তা না পেলে আমাদের অত সহজ হতো না।
হুমায়ূন আহমেদ আর ইমদাদুল হক মিলনের আগে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের বাজার ছিল ভারতীয় বাঙালি লেখকদের দখলে। ছেলেবেলায় আমার আউট বই পড়া শুরুই হয়েছে ভারতীয় বই দিয়ে। ফাল্গুনী, নীহাররঞ্জন, নিমাই, শঙ্কর ছিল তখন আমার পড়ার তালিকায়। পরে সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ দখল করে নেয় পাঠসময়ের অনেকটাই। সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ পড়ে স্বপ্নাতুর হননি; আমাদের প্রজন্মে এমন তরুণ খুঁজে পাওয়া ভার। আমি কখনও ভারত যাইনি। কিন্তু ভারতীয় উপন্যাস পড়ে পড়ে কলকাতার অধিকাংশ রাস্তাঘাটের নাম আমার মুখস্ত। কল্পনায় কলকাতা আমার অনেক চেনা।
ছেলেবেলা থেকে বাংলাদেশের গানের পাশাপাশি ভারতীয় বাংলা গানও অনেক শুনেছি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ভারতের গানই বেশি শুনেছি। তখন বাংলাদেশের গান শুনতাম রেডিওতে আর ভারতীয় বাংলা গান শুনতাম পাশের বাড়ির কাশেম ভাইয়ের চেঞ্জারে। প্রেম একবারই এসেছিল নিরবে… বা ছাইয়া দিল মে আনারে…। আশা, লতা, সন্ধ্যা, হৈমন্তী, মান্না, কিশোর, হেমন্ত, রফি, ভুপেন, সতীনাথ, মানবেন্দ্র থেকে শুরু করে চিত্রা, জগজিত, সুমন, নচিকেতা পর্যন্ত প্রিয় শিল্পীর তালিকাটা বড় লম্বা।
আমাদের টিভি ইন্ডাস্ট্রির কিলার ভারতীয় চ্যানেলের সিরিয়াল না দেখলেও ভারতীয় সিনেমা আমি নিয়মিত দেখি। উত্তম-সুচিত্রায় মজেনি এমন বাঙালি, দুই বাংলায় একজনও কি আছে? শুধু উত্তম-সুচিত্রা কেন, সুনীল দত্ত, নার্গিস, দিলীপ কুমার, রেখা, অমিতাভ, শাহরুখ, সালমান, আমির খান থেকে শুরু করে বিদ্যা বালান কার না প্রেমে পড়েছি আমরা? অনেকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আগ্রাসন বলে চেঁচামেচি করে পাড়া মাতান। কিন্তু বাসায় গিয়ে ঠিকই হিন্দি গান শোনেন বা সিরিয়াল দেখেন। সমরেশ পড়ার সময় আমার মাথায় থাকে না তিনি ভারতের না বাংলাদেশের। অন্ধ ভারতবিরোধিতা করে যদি আমি 'পিকে' না দেখি; লস তো আমারই হবে, আমির খানের নয়। মান্না দের গান না শুনলে তো আমার প্রেমই করা হতো না। আমি তাই যেটুকু ভালো নিয়ে নিতে চাই। তা হিন্দি না ইংরেজি, বাংলা না উর্দু; সেটা বাংলাদেশের না ভারতের; তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
ক্রিকেট দেখা শুরুর পর আমি ভারতের সমর্থক ছিলাম। পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম স্থানটি নিলেও এরপরই ছিল ভারত। গাভাস্কার আমার খুব প্রিয়। সৌরভ বাঙালি হিসেবে আমাকেও গর্বিত করে। শচীনকে আমি এখনও বিশ্ববিদ্যালয় মানি। শুধু ক্রিকেট নয়, শচীনের গোটা জীবন থেকেই শেখার আছে অনেক কিছু। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট শুরুর পর আমার ওয়ান অ্যান্ড অনলি পছন্দ বাংলাদেশ। তবুও বাংলাদেশ না খেললে ভারতের প্রতি একটু পক্ষপাতিত্ব থাকে। কিন্তু এতকিছুর পরও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের পরাজয় চেয়েছি। শুধু আমি নই, বাংলাদেশের কোটি মানুষ সেদিন ভারতের পরাজয় চেয়েছে। আমি মনে করি, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় ভারতীয়দেরই। ভারতের নানাকিছু আমার পছন্দ বটে, তবে দাদাগিরিটা ছাড়া। ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী। কিন্তু তাদের মাথায় রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। একাত্তরে আমাদের সহায়তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ, কিন্তু নত নই। আমরা কথা বলবো চোখে চোখ রেখে, চোখ রাঙিয়ে নয়। মানছি বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের জগমোহন ডালমিয়ার অবদান ছিল। কিন্তু তারপর ভারত আর আমাদের কোনও সহায়তা করেনি। কোনও সফরের আমন্ত্রণ পর্যন্ত দেয়নি। এসব কারণে বিরক্তি থাকলেও ১৯ মার্চের কোয়ার্টার ফাইনালের আগে ভারতীয়রা বাংলাদেশকে কটাক্ষ করে নানা গান, ভিডিও বানিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে। প্রসেনজিতের মত তারকা, যিনি বাংলাদেশেও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন, বাংলাদেশকে বাঘ নয় বেড়াল বলে সেই আগুনে ঘি ঢেলেছেন। বাংলাদেশ থেকেও জবাব গেছে। সাইবার যুদ্ধ চলেছে সমানে সমানে।
কিন্তু ১৯ মার্চের কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশকে যেভাবে হারানো হয়েছে, তাতে অন্তত ক্রিকেটে ভারতকে সমর্থন করা সম্ভব ছিল না। এমনিতে বাংলাদেশ ভারতের কাছে হারতেই পারতো। কিন্তু যেভাবে আম্পায়াররা একের পর বাংলাদেশের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়ে বাংলাদেশকে হারিয়ে দিয়েছে তা অকল্পনীয়। তারই প্রতিফলন ছিল ২৬ মার্চের সেমিফাইনালে। গোটা বাংলাদেশ হঠাৎ করে অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক বনে যায়। সেদিন আমি একজন ভারতীয় সমর্থককে খুঁজে পাইনি, অন্তত প্রকাশ্যে। সেমিফাইনালে ভারতের শোচনীয় পরাজয়ের পর উল্লাস ছিল গোটা বাংলাদেশে, মিছিলও হয়েছে। কিন্তু মজাটা হলো, এই ভারতবিরোধিতা উল্লসিত করেছে হৃদয়ে পাকিস্তানকে ধারণ করা একটি মহলকেও। তারা ধরে নিয়েছেন, এই বুঝি মওকা পাওয়া গেল ভারতকে একটু সাইজ করার।
পরাজয়ের পর যেন পাগল হয়ে গেছে ভারতের লোকজন। রূপম ইসলাম নামে পশ্চিমবঙ্গের এক শিল্পী বাংলাদেশকে 'নতুন পাকিস্তান' হিসেবে অভিহিত করেছেন। নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করে বলছি, এই শিল্পীর নামই শুনিনি আমি। তিনি বাংলাদেশের লোকজনকে অভিহিত করেছেন 'ছোটলোক' হিসেবে। এমনকি বাংলাদেশের বাঙালিদের 'বাঙালি' বলতেই আপত্তি তার। তার আপত্তি শুনে আমার হাসি পেয়েছে। কলকাতার লোকজনই বলেন, বাংলা ভাষা টিকে আছে বাংলাদেশেই। কলকাতার সবকিছু যেভাবে ভারতের অন্য রাজ্যের আগ্রাসনের শিকার, তাতে ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির রূপ দেখতে তাকে বাংলাদেশেই আসতে হবে। নিজেকে বুকের পাটাওয়ালা বাঙালি দাবি করলেও এক ঘণ্টার মধ্যে তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি মুছে দিয়েছেন। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে রূপম ইসলাম, বাংলাদেশের মানুষের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি দাবি করেন, তার স্ট্যাটাসটি বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া নয়। তার দাবি, বাংলাদেশের মাইলস ব্যান্ডের ড্রামার জিয়াউর রহমান তুর্য তার স্ত্রীর একটি স্ট্যাটাস শেয়ার করতে গিয়ে তাকে অপমান করেন। এ জন্যই তিনি তুর্যকে লক্ষ্য করেই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, সরাসরি কাউকে অপমান করতে চাননি বলেই নামটি বলেননি। সাক্ষাৎকারটি পড়ে আমার তাকে বোকা মনে হয়েছে। বোকা না হলে, একজনের নাম আড়াল করতে গিয়ে তিনি ১৬ কোটি মানুষকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলতেন না। তবে আমি তার আবেগের প্রতি সম্মান রেখে, তার স্ট্যাটাসটিকে বোকামি হিসেবে ধরে নিয়ে, তার নিঃশর্ত ক্ষমা গ্রহণ করতে রাজি আছি। কারণ কারও প্রতি আমার কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই। আর এটাও সত্যি, স্ট্যাটাসের কোথাও তিনি 'বাংলাদেশ' শব্দটি লেখেননি। স্ত্রীকে অপমান করলে যে কোনও বাঙালির ইগোতে লাগবে। তবে ব্যক্তিগত ঝগড়া ইনবক্সে করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ব্যক্তিগত ঝগড়া পাবলিক করলে, এমন বিপর্যয় হতে পারে। খালি একটা ছোট কথা, বুকের পাটাওয়ালা বাঙালি রূপম বাবু স্ট্যাটাসটি লিখেছেন রোমান হরফে!
পাকিস্তান এবং ইসরায়েল ছাড়া অন্য কোনও দেশের প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নেই। তবে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশও। পাকিস্তান একটি অকার্যকর রাষ্ট্র। পাকিস্তান আর তুলনারও যোগ্য নয়। শুধু ক্রিকেটেই পাকিস্তান আমাদের চেয়ে একটু ভালো। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, শিগগিরই আমরা ক্রিকেটেও সবাইকে ছাড়িয়ে যাব। অনেক সামাজিক সূচকে আমরা ভারতের চেয়েও এগিয়ে। আমার কথা পরিষ্কার। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। সম্পর্কটা শ্রদ্ধার-ভালোবাসার হলে; আমরা আছি, নইলে নাই। আমাদের বন্ধু বললে, আমরাও তোমাকে বন্ধু বলবো। কিন্তু আমাকে গালি দিলে আমি তোমাকে চুমু দেব না। আমাদের বেড়াল বললে, আমি তোমাকে কুকুর বলবো। আমাকে ছোটলোক বললে, আমি তোমার জন্য করুণা করবো। একচুলও ছাড় হবে না। কিন্তু অন্তরে পাকিস্তান ধারণ করে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে, অন্ধ ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে চান; আমি তাদের দলেও নেই।
লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
__._,_.___