সরকার জিতলেও হারবে, বিরোধীরা হারলেও জিতবে
25 March 2015, Wednesday
সিটি নির্বাচন নগদ ও চলমান ইস্যু। এই নির্বাচন সরকারের কৌশলী খেলার উপাত্ত। কেউ মনে করেন না সরকার নাগরিক ভাবনা নিয়ে এই নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন সম্পর্কেও আওয়ামী লীগের ভাবনা সালিস মানি, তালগাছ আমার। উপজেলায় মানুষ সরকারের কোনো সদিচ্ছার প্রমাণ পায়নি। জেলা পরিষদ নির্লজ্জ দলীয়করণের এক উপমা। সরকার ভাবছে, নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে একটা জুয়া খেলা হয়ে যাক না। এটা দেউলে হওয়ার আগের অবস্থা। হয়তো জুয়া খেলে ভিটেমাটি হারাবার মতো অবস্থাও হয়ে যেতে পারে। এমন ভাবনাও তাদের পেয়ে বসতে পারে, তাদের আর হারাবার কী-ই বা আছে। জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক প্রভাব হারিয়ে স্থানীয় নির্বাচন দিয়ে কোমর সোজা করে দাঁড়ানো যায় না। ভোটার মন বিশ্বাস করতে চায় না, এই সরকার তাদের ভোটটা দিতে দেবে, অথবা ভোটের আমানত হেফাজত করার নৈতিকতা প্রদর্শন করবে। এই অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগের ভাণ্ডারে রয়েছে। আওয়ামী লীগ ধরেই নিয়েছে বিএনপি জোট ভোটের টোপ গিলবে। পাতানো খেলায় জেনে বুঝে বিষপানের মতো হলেও অংশ নেবে। তাতে আন্দোলন মুলতবি হয়ে যাবে। সরকার এ যাত্রাও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাবে সহজেই। তাতে আরো ক'টা দিন ক্ষমতার স্বাদ নেয়া যাবে। নিজস্ব এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়নের আরো কিছু মওকা মিলবে। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভাবার অবকাশ পাওয়া যাবে। পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিপক্ষ দমনের একটা দীর্ঘমেয়াদি কৌশলও ঠিক করা যাবে। বিএনপি আন্দোলন মুলতবি রেখে নির্বাচনে যাবে বলে মনে হয় না। তাদের এক চিন্তায় এটা আত্মঘাতী। অন্য ভাবনায় আন্দোলনের কৌশল। তারা ভাবতে চাইবে জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে নেগেটিভ ও পজেটিভ ভোট যোগ হয়ে তাদের প্রার্থীরা উৎরে যাবেন। ভাবনাচিন্তা জমাট বাঁধলে তারা আন্দোলনের কৌশল হিসেবেই সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে- এটাই সাধারণ বিবেচনায় স্বাভাবিক। আবার ঝুঁকিও কম নেই। এটা মগজ থেকে ঝেঁটিয়ে তারাও বিদায় করতে চান না। তারা ভাবতেই পারেন, হারার পরিস্থিতি দেশে নেই। একধরনের সিমপ্যাথি তারা পেয়েই যাবেন। জনগণের পরিবর্তনের মানসিকতার সুফলও তারা পাবেন। কারণ কোনো নাগরিক রাজনৈতিক বিবেচনা মাথায় না নিয়ে এবার ব্যালটে সিল দেবে না। পুকুরচুরি বা ভোট ডাকাতির অবস্থা সৃষ্টি হলে বিএনপি ভোটারদের জানিয়েই নির্বাচন বর্জন করবে। তাতেও তাদের হারানোর কিছু থাকবে না। সুষ্ঠু ভোট হলে যারা জেতার সম্ভাবনা ষাট-সত্তর শতাংশ, তারা পরিস্থিতি এভাবেই দেখবে- এভাবেই মূল্যায়ন করবে, তাতে আর নতুন কী। আওয়ামী লীগ চৌদ্দ দলকে নিয়ে যে ভোটার টানার অবস্থায় রয়েছে, তাতে চৌদ্দ দলের গড়ে চৌদ্দটি ভোট নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। একা আওয়ামী লীগ তার নিজস্ব ভোট ব্যাংক নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে, সেটা বাস্তব পরিস্থিতি সমর্থন জোগায় না। কারণ, বরফ যা গলবার তা ক্ষমতারই গলেছে। বিশ্বাস ভঙ্গের কারণও ঘটেছে সরকারের দিক থেকে। বিএনপি চাইবে তফসিল পরিবর্তন হোক। সবার জন্য সমতল মাঠের নিশ্চয়তা সব প্রার্থী চাইবেন। বিএনপিকে আস্থায় নিতে হলে সরকারকে যেমন প্রচুর ছাড় দিতে হবে, তেমনি ইসিকেও কিছু কথা শুনতে ও মানতে হবে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য, তারা বাধা দেবেন না। প্রার্থীরা নিরাপত্তা পাবেন। স্বীকৃতি মিললো এত দিন তারা বাধা দিয়েছেন। নিরাপত্তাও এত দিন দেননি। শুকনো কথায় চিঁড়া ভিজবে না। চিড়া এবার ভিজিয়ে প্রমাণ করতে হবে- চিঁড়া ভিজল। যারা বলছেন পরিস্থিতি প্রতিকূলে দেখলে আওয়ামী লীগ চারটি আচরণ করতে পারে। ক. নির্বাচন ভণ্ডুল, স্থগিত কিংবা বাতিল করার দিকে এগোবে। খ. আন্দোলন দমনের চূড়ান্ত খেলায় নেমে পড়বে। গ. আদালতি প্রক্রিয়ায় কিংবা অনুগত নির্বাচন কমিশনকে রেড সিগন্যাল দিয়ে নির্বাচনপ্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ করে দিতে পারে। ঘ. দু'কান কাটা বেহায়া মানুষ যেমন রাস্তার মাঝপথ ধরে হাঁটে- সরকারও ৫ জানুয়ারি ধরনের একটা জবরদস্তির ভোটারহীন নির্বাচন করে ফেলার চেষ্টাও করতে পারে, যাতে দু'ভাগ ভোট ৪০ ভাগ হয়ে যাবে। শক্তিবলে ইন্টারনাল কারচুপি ও জালিয়াতির বন্যা বইয়ে দিতে পারে। সবাই একমত যে, আওয়ামী লীগ এখন বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার মতো ভাবমর্যাদায় নেই। স্থিতিকালীন সুস্থির থাকার মতো পর্যায়েও নেই। তারা জনগণের মনে ইতিবাচক দাগ কাটার মতো অবস্থানেও নেই। বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের ধারণা, এরা জনসমর্থনপুষ্ট কিন্তু দুর্বল দল। নেতারা ঝুঁকি নেয়ার মতো বয়সের সীমা অতিক্রম করেছে। তরুণ জনশক্তি জানবাজ নয়, কিন্তু সাধারণ ভোটার সমর্থন তার অনুকূলে। সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের নেতাদের মতো রগুড়ে ভাষায় শিষ্টাচারবর্জিত রাজনীতির খিস্তি-খেউড় বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে শুনতে চায় না। তাই বলে তারা রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝে জবাবি বক্তব্য দিতে কার্পণ্য করবে- এমন ভালো মানুষীও আশা করে না। আন্দোলন আন্দোলন খেলা করুক, এটাও মানতে নারাজ। খালেদা জিয়ার আপসহীনতার ইমেজ জনগণের কাছে ইতিবাচক, অনেকের সুবিধাবাদী অবস্থান অপছন্দের। সমর্থক ও ভোটার মন অত্যন্ত সংবেদনশীল। ড. আহমদ আনিসুর রহমান চিন্তক ও তুখোড় লিখিয়ে। তার আর্যাবর্তে অস্থিরতা ও ভোটার মন নিয়ে লেখা এখনো স্মরণে পড়ে। বিচিত্রায় তিনি লিখেছিলেন- একটা মশার কামড়ের সহনীয় যন্ত্রণাও একজন ভোটারের মন বিগড়ে দিতে পারে। কার মন কখন কী কারণে বিগড়ে যায়, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষয়িত্রীকে জানি, পোশাকি শেখ হাসিনাকে তার পছন্দ। আবার রাজনীতির কারণে পছন্দ খালেদা জিয়াকে। একজনের চটুল স্বভাব, অন্য জনের পরিমিতিবোধ তার পছন্দ-অপছন্দের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো এক ঘরোয়া সাক্ষাতের ছবিতে খালেদা জিয়ার ঘোমটাবিহীন অবস্থা তার ভালো লাগেনি। আবার বকধার্মিকের মতো ভড়ং করা ছবিও তার পছন্দ নয়। এই যখন ভোটার মনের অবস্থা, তখন অন্যের পকেটে টাকা রেখে আপনি যেমন পরিকল্পনা নিতে পারেন না, তেমনি ভোটারদের হাতে ভোটটা রেখে কোনো প্রার্থী তার বিজয় সুনিশ্চিত ভাবতে পারেন না। তার পরও জনমত জরিপ এখন পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের অংশ। এই বিজ্ঞান মানলে আওয়ামী লীগের ভরাডু্বি অনেকটা নিশ্চিত। কার বিজয় সুনিশ্চিত সেটা ভোটার মনে দাগ কাটার মতো আবহ সৃষ্টির ওপর নির্ভর করবে। তবে আওয়ামী লীগ বর্তমান অবস্থান থেকে জিতলেও হারবে। বিএনপি হারলেও জিতবে। সরকার আন্দোলন-সংগ্রামের বাঁক ঘোরাতে রাজনৈতিক সঙ্কটকে সহিংসতার চাদরে ঢেকে দিতে চেয়েছে। বিএনপি নেত্রীকে জঙ্গী, তালেবান, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ সাজাতে চেয়েছে। জনগণ রাজনৈতিক সঙ্কটের কথা ভুলে যায়নি। উন্নয়ন গণতন্ত্রের ভেতর সঙ্ঘাত দেখাতে চেয়েছে- কেউ গিলেনি। বিদেশীদের কাছে মৌলবাদী সন্ত্রাসের ভীতি ছড়িয়ে দেশকে ও জনগণকে অভিযুক্ত করতে চেয়েছে- পশ্চিমা জগৎ দ্বিধান্বিত হয়েছে- বিশ্বাস করেনি। সর্বশেষ সিটি নির্বাচনের মায়াবী ফাঁদ। এই ফাঁদই ধূর্ত ও শঠদের অবশিষ্ট মুখোশ খুলে দিলে জনগণের কাছে সব কিছু ফকফকা হয়ে যাবে। হারজিতের এই সমীকরণ একেবারে ফেলনা নয়। তবে হারজিতের এ দৃশ্যমান খেলার নেপথ্যে রাজনীতির যে মরণ খেলা চলছে, সেটা বিবেচনায় না নিলে জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গের আরেকটা নাটকই শুধু মঞ্চস্থ হবে।
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
__._,_.___