প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জেনারেল জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগকে প্রধান শত্রু ভাবতেন। এ জন্য তিনি এ দলের নাম নিশানা মুছে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, দেশের মাটি থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলতে এ স্বৈরশাসক স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উত্থান ঘটিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'সেনা প্রধান জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি সায়েমকে অস্ত্রের মুখে উৎখাত করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং আওয়ামী লীগকে নিশ্চিন্ন ও দলের নাম নিশানা মুছে ফেলতে নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম করা শুরু করেন। আর এসব কাজে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরোধী চক্র রাজাকারদের ব্যবহার করেছেন'। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩৩তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তৃতা করেন জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, সাবেক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ও সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম।শেখ হাসিনা বলেন, দেশে আসার পর আমার এক নম্বর চিন্তা ছিল দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে।
' সংগঠনকে শক্তিশালী করা ও দেশ যেন আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসে এই ছিল আমার লক্ষ্য। দেশে এসে কোথায় থাকবো, কোথায় উঠব, কি খাবো, এসব চিন্তা তখন আমার মাথায় আসেনি ' এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন,তখন দেশে এসে দেখতে পাই, দেশ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে চলছে। জিয়াউর রহমানের ছত্রছায়ায় স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকাররা ক্ষমতায় বসে আছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার সব শেষ হয়ে যায়। পরিবারকে হাড়ানোর মাত্র ১৫ দিন আগে স্বামীর সঙ্গে জার্মানী চলে যাই। সেখানে বসে নানা কথা শুনতে থাকি। কেউ বলছে 'মা' বেঁেচ আছে, আবার কেউ বলছে ছোট ভাই রাসেলের কথা।প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময় দেশের বাইরে থাকা আমাদের দু'বোনকে আশ্রয় দেয়ার আশ্বাস দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটো।তিনি বলেন, সে সময় ভারতে এসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে দেশের অবস্থা ও পরিবারের সব সদস্যকে হারানো কথা জানতে পারি।
শেখ হাসিনা বলেন, সে সময় আওয়ামী লীগকে নিশ্চিন্ন করতে চার নেতাকে হত্যা ও অন্যান্যদের বন্দী করা হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী কাছ থেকে কোন সহায়তা পাইনি। এমনকি তিনি আমাদেরকে সংবাদ সম্মেলনও করতে দেননি। তবে সরকারী কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন রাষ্ট্রদূত (পরে জাতীয় সংসদের স্পীকার হয়েছেন) হুমায়ুর রশীদ চৌধুরী আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৭ বা ৭৮ সালে লন্ডনে আমার পক্ষে ছোট বোন শেখ রেহানা বাবাসহ পরিবারের সকল সদস্যদের হত্যার বিচার চেয়ে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন।তিনি বলেন, পরে ১৯৮০ সালে লন্ডনে গিয়ে সে দেশের সিনেট সদস্যদের নিয়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করি। এছাড়া সে বছরেরই ১৬ আগস্ট ইয়র্ক হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে জনসম্মুখে আমি প্রথম বক্তৃতা দেই।
শেখ হাসিনা বলেন, তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় জিয়াউর রহমান থাকায় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি রাজাকাররা দেশে ও দেশের বাইরে বেশ দাপটে ছিল। তারা দেশের বাইরেও আমাদের সভা-সমাবেশ করতে দিত না। সব সময়ই হত্যার হুমকি দিত।তিনি বলেন, সে অবস্থাতেই ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনকে সংগঠিত করতে যুক্তরাজ্যের নানা স্থানে সভা-সমাবেশ করতে থাকি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে ১৯৮৬ সালের নির্বাচন পর্যন্ত দেশে প্রতি রাতে (রাত ১১টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত) কার্ফ্য থাকতো। তিনি বলেন, অনেককেই বলতে শুনি জিয়াই গণতন্ত্র এনেছেন. ঐদি তাই হয়,তাহলে প্রতিরাতে কারফিউ দিয়ে দেশ চআলাতে হতো না। গণ্তান্ত্রিক র্ব্যবস্থায তো কারফি্ ুথাকার কথা না।
শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান সে সময়ে অবৈধভাবে শুধু ক্ষমতাই দখল করেনি, সশস্ত্র বাহিনীতে যে ১৮/১৯টি ক্যু হয়েছে, তার মাধ্যমে বহু মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে। ' আমি কখনই পার্টির সভাপতি হতে চাইনি। তবে চিঠির মাধ্যমে সব সময় দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার পরামর্শ দিতাম। কিন্তু দেখা গেল ১৯৮১ সালে দলের সম্মেলন করে আমাকে সভাপতি করা হলো। এতে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম' উর্লেখ কওে তিনি বলেন,সে সময়ে আমি যেন দেশে আসতে না পারি, জিয়া প্রশাসন নানাভাবে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তারপরও ১৯৮১ সালের ১৭ মে অসুস্থ মেয়ে পুৃতুলকে নিয়ে দেশে আসি।
তিনি বলেন, তখন কোথায় উঠব, কোথায় থাকবো, কি খাবো সে চিন্তা করিনি। শুধু ভেবেছি দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দলকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।শেখ হাসিনা অশ্র"সিক্ত নয়নে ও কান্না জড়ানে কন্ঠে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, যখন দেশে পৌঁছাই, তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। লাখো মানুষের ঢল ও পরিবার হারানোর বেদনায় আমার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল, কোন কথা বলতে পারছিলাম না।তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের সারি সারি কবর দেখে নিজের মানসিক অবস্থা যে কেমন হয়েছিল, তা আজও আমি প্রকাশ করতে পারব না। কি কঠিন সময় যে তখন আমাকে পাড় করতে হয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ ভাল জানেন।
শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান সে সময় ৩২ নম্বরে গিয়ে আমাকে বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের জন্য মিলাদ পড়তে দেয়নি। তখন রাস্তায় ও লেকের পাড়ে বসে আমাকে পরিবারের সদস্যদের জন্য মিলাদ ও দোয়া পড়তে হয়েছে।তিনি বলেন, সবাইকে রেখে দেশ ছেড়েছিলাম কিন্তু ফিরে এসে দেখি কেউ নেই। ৩২ নম্বরের সামনে লেকের পাড়ে বসে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিতাম। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ যত সহজে বলতে পারছি, তখন ওই অবস্থা মেনে নেয়া কষ্টকর ছিল। ওই অবস্থায় দলকেও সংগঠিত করতে নানা চড়াই-উৎড়াই পাড় হতে হয়েছে। তিনি বলেন, এর মাঝেও একটা চিন্তা মাথায় কাজ করতো, আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখতে হবে, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। সে চেতনাই তখন আমার কাছে সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে ওঠে।শেখ হাসিনা বলেন, আমি জাতির পিতার কন্যা, এ জন্য গর্ববোধ করি। এর চেয়ে আর কোনো পরিচয় আমার প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, প্রতিটি মানুষকেই আল্লাহ কিছু কাজ দিয়ে পাঠান। আমাকেও তিনি যে কাজটি দিয়েছেন, তা আমি পালন করে যেতে চাই। সে কাজ সম্পন্ন হওয়া না পর্যন্ত আল্লাহই আমাকে রক্ষা করবেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালীর জাতির জন্য, তাদের উন্নয়নের জন্য, তাদের ভাগ্য পরির্বতনের জন্য আমার বাবা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। আমিও বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই। তাদের সুখে না হোক, দুঃখে পাশে থাকতে চাই। তিনি বলেন, আমার বাবার স্বপ্ন ছিলো দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, আমারও একই স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমি মহান আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথানত করবো না। বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করেই চলবো।প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের কাছে আমার অনুরোধ 'সততাই শক্তি' এ আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত নয়।
ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, কিন্তু কখনো আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটি দলের দায়িত্ব নিতে হবে তা ভাবিনি।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি সবসময় একটা বিষয়েই জোর দিয়েছি, আমার জন্য দেশের ও দলের যেনো কোনও ক্ষতি না হয়। আমার কারণে যেনো দলের নেতা-কর্মীদের হেয় হতে না হয়। শেখ হাসিনা বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা তার কাছ থেকেই শিখেছি দেশকে ও দেশের মানুষকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়।মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, বাবা যখন জেলে থাকতেন তখন মাকেই দেখেছি দল সামলাতে। তার কাছ থেকেও আমি রাজনীতির শিক্ষা পেয়েছি।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ মানুষের কল্যাণে কাজ করে। আজ এ দলের জন্যই মানুষ দু'বেলা খেতে পারছে, শান্তিতে থাকতে পারছে। আওয়ামী লীগ না থাকলে মানুষ আজ এ অধিকার পেত না।তিনি বাংলাদেশের যে সীমিত সম্পদ রয়েছে, তা সঠিকভাবে ব্যবহার করে দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে সকল নেতকর্মীদের দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করে যাওয়াও আহবান জানান।
__._,_.___