এমন বন্ধুত্বের নজির বিশ্বের ইতিহাসে বিরল
মো. কামরুজ্জামান বাবলু
« আগের সংবাদ |
বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে আবেগের যত বিষয় আছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ অন্যতম। আর সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে প্রতিবেশী ভারত। তাই বাংলাদেশের অনেক মানুষই ভারতকে অকৃত্রিম বন্ধু বলেই মনে করেন, যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তার পেছনে ভারতের অনেক দুরভিসন্ধি ছিল বলে অভিযোগও নেহাত কম নয়। কিন্তু কার অন্তরে কী আছে, সেটাকে খুঁচিয়ে দেখার চেয়ে বাস্তবে কার দ্বারা কী হয়েছে সেটা বিবেচনা করাই এই আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে বুদ্ধিমানের কাজ বলেই বিশ্বাস করেন বেশিরভাগ সচেতন মানুষ।
পানি ভাগাভাগিতে বন্ধুত্ব
এবার আসা যাক স্বাধীন বাংলাদেশ তার অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের কাছ থেকে বিগত ৪২ বছরে বাস্তবে কী পেল সেই প্রসঙ্গে। প্রথমেই ধরা যাক অভিন্ন নদীতে ভারতের বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীর সংখ্যা ৫৮টি। এর মধ্যে ৫৫ মতান্তরে ৫৪টি নদীর উত্স ভারতে। অভিন্ন এই নদীগুলোর প্রত্যেকটিতে বাঁধ, পানিবিদ্যুত্ প্রকল্প, রিজার্ভারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে পানির প্রবাহ আটকে রেখেছে ভারত। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানির প্রবাহ থাকছে বললেই চলে। আবার বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানিতে বন্যায় ভাসছে এ দেশের মানুষ।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদীতে এ পর্যন্ত তিন হাজার ৬০০টি বাঁধ তৈরি করেছে। হিমালয়ের ভাটিতে বাংলাদেশের উজানে এসব বাঁধ ছাড়াও আরো এক হাজার বাঁধের নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হওয়ায় এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই তা করার কথা।
আইন অনুযায়ী এসব নদীতে বাঁধ নির্মাণ করতে হলে বা পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই ভাটির দেশ বাংলাদেশের অনুমতি লাগবে। কিন্তু অনুমতি নেয়া তো দূরের কথা, বাংলাদেশের জোর আপত্তি সত্ত্বেও ভারত এসব নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে রীতিমতো মরুভূমিতে পরিণত করে চলেছে। আর এরই কুফল হচ্ছে এক সময়ের খরস্রোতা পদ্মা এখন ধুধু বালুচর এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের বিরাট অংশ পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে দ্রুত।
ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে নির্মিত ও চালু হওয়া ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের মানুষের কাছে এখন যেন এক মরণ ফাঁদ। মাত্র কয়েকদিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালুর কথা বলে আজ ৪ দশক ধরে ভারত এই মরণফাঁদের জাঁতাকলে পিষ্ট করছে বাংলাদেশের মানুষকে। শুধু মরণফাঁদ ফারাক্কাই নয়, গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ আরও অন্তত ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করেছে ভারত। পাশাপাশি নির্মাণ করেছে আরও বহু আনুষঙ্গিক ছোট-বড় কাঠামো। এদিকে নতুন করে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকার ৫৩টি বিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও খবরে প্রকাশ।
এর মধ্যে অগ্রগতি বলতে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষর, যার কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। এছাড়া আর কোনো নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তির কথা বেশ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে এই চুক্তি হবে বলেও কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে প্রতি বছর যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে অগ্রগতি বলতে কিছুই নেই।
একসময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিন্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে যে আপত্তি জানানো হতো এখন তাও ঝিমিয়ে পড়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে তৈরি প্রকল্পের বিদ্যুত্ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যেতে ভারতকে বিদ্যুত্ করিডোর দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের কোনো চুক্তি বা সমঝোতা ছাড়াই বিদ্যুত্ বা সেচ প্রকল্পে আগাম সম্মতি দেয়া হচ্ছে ভারতকে। অথচ বাংলাদেশের নদনদী এ দেশের অর্থনীতির প্রাণ। নদীর পানি একতরফা প্রত্যাহার করা হলে এ দেশের কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। পরিবেশ হবে বিপন্ন। মাছের প্রাকৃতিক আধারগুলোও আর থাকবে না।
সীমান্তে বন্ধুত্ব
এবার আসা যাক সীমান্তে হত্যা প্রসঙ্গে। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ। মানবাধিকার সংগঠন 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচের' প্রতিবেদন অনুযায়ী বিগত ১০ বছরে সীমান্তে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। সে হিসেবে প্রতি ৪ দিনে একজন বাংলাদেশীকে সীমান্তে হত্যা করছে বিএসএফ।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ বছরে বিএসএফ ৬০৭ বাংলাদেশীকে হত্যা করে এবং একই সময়ে বিএসএফের গুলিতে ৬৬৩ বাংলাদেশী আহত হয়। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে বিএসএফের হাতে ৫১৪ বাংলাদেশী গ্রেফতার, ৭০৫ জন অপহৃত এবং ধর্ষণের শিকার হন ১০ বাংলাদেশী নারী। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে বিএসএফ কর্তৃক অন্তত ৬১টি লুটের ঘটনা ঘটেছে।
এত আলোচনা, এত বৈঠক, কিন্তু থেমে নেই বিএসএফের হাতে নিরীহ বাংলাদেশী নিধন পর্ব। এমনকি চলতি মাসেও (এপ্রিল ২০১৪) সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের খবর শোনা যাচ্ছে হরহামেশাই। গত ১৮ এপ্রিল কুড়িগ্রামের বালারহাট সীমান্তের ৯৩১নং আন্তর্জাতিক পিলারের নো-ম্যান্স ল্যান্ড এলাকা থেকে গরু আনতে গেলে স্থানীয় বাসিন্দা শামছুল হককে (৩২) ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্যরা গুলি করে। চলতি বছরের ২৪ মার্চ চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার মুন্সীপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিক আহাদ আলী সোনা (৩২) নিহত হয়েছেন। এর আগে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি সীমান্তে এক বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ।
দুই দেশের মধ্যে ৪ হাজার ১০০ কিলোমিটার বা প্রায় ২ হাজার ৫০০ মাইল সীমান্ত রয়েছে, যা পৃথিবীতে চতুর্থ বৃহত্ অভিন্ন স্থলসীমানা হিসেবে চিহ্নিত। এই পুরো সীমান্তজুড়েই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের মাধ্যমে সীমানাকে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। চোরাচালান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাদকের অবাধ চালানসহ সব অবৈধ কর্মকাণ্ড একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত।
ঐতিহাসিক বন্ধু বলে কথা
এতকিছুর পরও বাংলাদেশের একশ্রেণীর নতজানু রাজনীতিবিদ ভারতকে অকৃত্রিম বন্ধু বলতে বলতে মুখে যেন ফ্যানা তুলে ফেলছেন। এবার আসা যাক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। ভারত কি আদৌ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ভারতের ভূমিকাই বলে দেয় বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকুক, তা ভারত কতটা চায়। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলীল তার 'অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা' বইয়ের ভূমিকায় বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যকারী বলে কথিত প্রতিবেশী ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর বাংলাদেশের জনগণের প্রতি 'বিগ ব্রাদার'সুলভ আধিপত্যবাদী আচরণ মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে কেবল ম্লানই করেনি, করেছে বিকৃত এবং কলঙ্কিত। মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টরের সাবেক কমান্ডার হিসেবে বিগত ১৭ বছরে আমাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের অকাল মৃত্যু, গুম ও খুন। নির্মূল ও বিরান হয়ে গেছে তাদের সাজানো-পাতানো সংসার। স্বাধীনতা অর্জনের দাবিদার আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার ঘোষক বলে কথিত জিয়া সরকারের আমলেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা।'
একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তে ও তার পরপরই আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু ভারত এদেশে যা করেছিল, সেই প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে এই বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার তার বইয়ের অন্যত্র লিখেছেন, 'ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক সেই লুটপাটের খবর চারদিক থেকে আসা শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিত্যক্ত কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক গাড়ি, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ আরও মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাকবোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। প্রাইভেট কার পর্যন্ত যখন রক্ষা পায়নি, তখনই কেবল আমি খুলনা শহরের প্রাইভেট গাড়িগুলো রিকুইজিশন করে খুলনা সারকিট হাউস ময়দানে হেফাজতে রাখার চেষ্টা করি। এর পূর্ব পর্যন্ত যে গাড়ি পেয়েছে, সেটাকেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সীমান্তের ওপারে। যশোর সেনানিবাসের প্রত্যেকটি অফিস এবং কোয়ার্টার তন্ন তন্ন করে লুট করেছে। বাথরুমের মিরর এবং অন্যান্য ফিটিংস পর্যন্ত সেই লুটতরাজ থেকে রেহাই পায়নি।'
মেজর জলিল লিখেছেন, 'আমারই স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দি। ৩১ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১০টায় আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল রূপের প্রথম দৃশ্য দেখলাম আমি। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মদতে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ এবং তাত্পর্য বুঝে উঠতে তখন আর আমার এক মিনিটও বিলম্ব হয়নি।'
আর পেছনে ফেরা নয়
নতুন প্রজন্মের সচেতন অনেকের মনে হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে, স্বাধীনতার পরপরই একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে কী হয়েছিল শুধু সেটাকে বিবেচনা করা সমুচিত হবে না, বর্তমানে ভারত আমাদের কীভাবে দেখে, সেটাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই, একেবারেই সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার অবতারণা করলেই আশা করি সচেতন ও বিবেকবান প্রতিটি মানুষের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
গত বছরের (২০১৩) ৫ অক্টোবর ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় 'সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তানকে কড়া বার্তা প্রণবের' এমন শিরোনামে একটি খবর ছাপা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র ব্রাসেলসে ইউরোপের এক টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী পাকিস্তানের সমালোচনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলেন, 'কিন্তু ভারতের পক্ষে তার সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো সমঝোতা করা সম্ভব নয়। আর সীমান্তের ওপার থেকে সন্ত্রাসে মদত দেওয়াও বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। শিমলা চুক্তির পরে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বন্দি ৯১ হাজার পাক সেনাকে ছেড়ে দিয়েছিল ভারত।'
প্রণব মুখার্জীর কথায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, ভারত মনে করে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হলো আমাদের গৌরবগাথা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ, লাল-সবুজের পতাকা। ভারত আমাদের সেই যুদ্ধে সেনাবাহিনী, আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছিল, সেটি আমরা সবাই স্বীকার করি। এজন্য অবশ্যই আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ।
ইতিহাস সাক্ষী একাত্তরে প্রকৃত লড়াইটা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদার বাহিনীর মধ্যে। যুদ্ধে হতাহতের জরিপ থেকেও তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত এবং এটাই ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এ যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কেবল আমাদের 'অকৃত্রিম বন্ধু' হিসেবেই মূল্যায়ন করা যায়। কিন্তু প্রণব মুখার্জীর কথায় সেই যুদ্ধ যেন হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। তার এই বক্তব্য কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবমাননা নয়?
প্রণববাবু বলেছেন, শিমলা চুক্তির পরে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বন্দি ৯১ হাজার পাক সেনাকে ছেড়ে দিয়েছিল ভারত। পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করল আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষকে, ইজ্জত নিল আমাদের মা-বোনদের, আর তাদের ছেড়ে দিল ভারত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ছেড়ে দেয়ার ভারত কে? তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকল কোথায়? অথচ আমরা জানি, সিমলা চুক্তি মূলত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যেই হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি ভারতের ওই সময়ের সক্রিয় সহযোগিতার কারণে এবং ওই সময়ের বাস্তবতায় চুক্তিতে তিন দেশেই স্বাক্ষর করে এবং সেই হিসেবে চুক্তিটিকে সর্বোচ্চ ত্রিদেশীয় চুক্তি বলা যেতে পারে। কিন্তু ভারত কীভাবে বলে যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানের ৯১ হাজার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে দিয়েছে ভারত?
শুধু কী তাই প্রণব মুখার্জী তার সাক্ষাত্কারে বলেন, 'যুদ্ধে দখল করা ভূখণ্ডও ছেড়ে চলে এসেছিল ভারতীয় সেনা।' তার মানে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে কিছু সেনা পাঠিয়ে বাংলাদেশকে যে সহায়তা ভারত করেছিল সেটাকে আজও তারা বাংলাদেশের ভূখণ্ড দখলের সঙ্গে তুলনা করে। আর সেই ভূখণ্ড ছেড়ে আসাকে তাদের উদারতা হিসেবে তারা বিশ্বময় এখনো প্রচার করে বেড়াচ্ছে।
বন্ধুর আবদার বলে কথা
এত গেল সাত মাস আগের ঘটনা। এবার আসি একবারে সাম্প্রতিক ইস্যুতে। চলতি মাসে (১৮ এপ্রিল, ২০১৪) নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দাবি করেছে। বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা সুব্রামনিয়ম স্বামী এমন দাবি করেন। তিনি খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত সমান্তরাল রেখা টেনে এই জমি ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে বলেছেন বাংলাদেশকে। গত ১৮ এপ্রিল শনিবার আসামের শিলচর থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ এ খবর দিয়েছে।
হিন্দু উগ্রবাদী দল বিজেপির এই শীর্ষ নেতার যুক্তি হলো, ভারত ভাগের পর অধুনা বাংলাদেশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশকে। অন্যথায় এসব মুসলমানের সংস্থাপনের জন্য বাংলাদেশকে এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড ছাড়তে হবে।
তবে স্বামী জানিয়েছেন, এ নিয়ে তিনি এখনো মোদি বা বিজেপির সঙ্গে কথা বলেননি ঠিকই, কিন্তু নতুন এই তত্ত্বের কথা যথাসময়ে দেশের সংসদে উত্থাপন করবেন। সংসদে এ নিয়ে বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন সে কথা তিনি দলীয় নেতৃত্বকে বুঝিয়ে বলবেন। (সূত্র : দৈনিক সাময়িক, আসাম)।
উদারতাই আমাদের কাম্য
প্রশ্ন আসতে পারে, ভারতীয় রাজনৈতিক দল বিজেপির কোনো এক নেতার বক্তব্যকে পুরো ভারতের বক্তব্য হিসেবে চালানো কতটা যৌক্তিক? বাংলাদেশের মানুষও এক নেতার বক্তব্যকে পুরো ভারতের বক্তব্য হিসেবে দেখতে চায় না। এখন বিজেপির পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসা দরকার এই মর্মে যে, স্বামীর দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে বিজেপীর কোনো সম্পর্ক নেই। এমন একটি বিবৃতি ভারতের পক্ষ থেকে বর্তমান ভারতবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার আদায় করতে পারলেই হয়তো সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কিছুটা বাড়ত এবং ভারতের প্রতি এদেশের মানুষের যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে তাও কিছুটা হ্রাস পেত।
ভারতের সঙ্গে শত্রুতা সৃষ্টি করা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা রেখে কারও পক্ষেই সুন্দর জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। আর ভারতের মতো এত বড় এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্ পরাশক্তি যে কিনা আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে, তাদের সঙ্গে শত্রুতা নয়, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবে প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে, সজাগ থাকতে হবে যে কোনো প্রতিকূলতার জন্য। পরিত্যাগ করতে হবে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি। শিক্ষাদীক্ষায় এবং আধুনিক এই বিশ্বায়নের যুগে বেড়ে ওঠা সচেতন তরুণ সমাজকে নিশ্চয়ই ভুল বুঝিয়ে কারও গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ করা যাবে না, সেই বিশ্বাস নিয়েই এখানে ইতি টানলাম।
লেখক : সাংবাদিক
Email: mkbablu@gmail.com
পানি ভাগাভাগিতে বন্ধুত্ব
এবার আসা যাক স্বাধীন বাংলাদেশ তার অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের কাছ থেকে বিগত ৪২ বছরে বাস্তবে কী পেল সেই প্রসঙ্গে। প্রথমেই ধরা যাক অভিন্ন নদীতে ভারতের বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীর সংখ্যা ৫৮টি। এর মধ্যে ৫৫ মতান্তরে ৫৪টি নদীর উত্স ভারতে। অভিন্ন এই নদীগুলোর প্রত্যেকটিতে বাঁধ, পানিবিদ্যুত্ প্রকল্প, রিজার্ভারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে পানির প্রবাহ আটকে রেখেছে ভারত। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানির প্রবাহ থাকছে বললেই চলে। আবার বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানিতে বন্যায় ভাসছে এ দেশের মানুষ।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদীতে এ পর্যন্ত তিন হাজার ৬০০টি বাঁধ তৈরি করেছে। হিমালয়ের ভাটিতে বাংলাদেশের উজানে এসব বাঁধ ছাড়াও আরো এক হাজার বাঁধের নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হওয়ায় এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই তা করার কথা।
আইন অনুযায়ী এসব নদীতে বাঁধ নির্মাণ করতে হলে বা পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই ভাটির দেশ বাংলাদেশের অনুমতি লাগবে। কিন্তু অনুমতি নেয়া তো দূরের কথা, বাংলাদেশের জোর আপত্তি সত্ত্বেও ভারত এসব নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে রীতিমতো মরুভূমিতে পরিণত করে চলেছে। আর এরই কুফল হচ্ছে এক সময়ের খরস্রোতা পদ্মা এখন ধুধু বালুচর এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের বিরাট অংশ পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে দ্রুত।
ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে নির্মিত ও চালু হওয়া ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের মানুষের কাছে এখন যেন এক মরণ ফাঁদ। মাত্র কয়েকদিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালুর কথা বলে আজ ৪ দশক ধরে ভারত এই মরণফাঁদের জাঁতাকলে পিষ্ট করছে বাংলাদেশের মানুষকে। শুধু মরণফাঁদ ফারাক্কাই নয়, গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ আরও অন্তত ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করেছে ভারত। পাশাপাশি নির্মাণ করেছে আরও বহু আনুষঙ্গিক ছোট-বড় কাঠামো। এদিকে নতুন করে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকার ৫৩টি বিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও খবরে প্রকাশ।
এর মধ্যে অগ্রগতি বলতে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষর, যার কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। এছাড়া আর কোনো নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তির কথা বেশ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে এই চুক্তি হবে বলেও কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে প্রতি বছর যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে অগ্রগতি বলতে কিছুই নেই।
একসময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিন্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে যে আপত্তি জানানো হতো এখন তাও ঝিমিয়ে পড়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে তৈরি প্রকল্পের বিদ্যুত্ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যেতে ভারতকে বিদ্যুত্ করিডোর দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের কোনো চুক্তি বা সমঝোতা ছাড়াই বিদ্যুত্ বা সেচ প্রকল্পে আগাম সম্মতি দেয়া হচ্ছে ভারতকে। অথচ বাংলাদেশের নদনদী এ দেশের অর্থনীতির প্রাণ। নদীর পানি একতরফা প্রত্যাহার করা হলে এ দেশের কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। পরিবেশ হবে বিপন্ন। মাছের প্রাকৃতিক আধারগুলোও আর থাকবে না।
সীমান্তে বন্ধুত্ব
এবার আসা যাক সীমান্তে হত্যা প্রসঙ্গে। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ। মানবাধিকার সংগঠন 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচের' প্রতিবেদন অনুযায়ী বিগত ১০ বছরে সীমান্তে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। সে হিসেবে প্রতি ৪ দিনে একজন বাংলাদেশীকে সীমান্তে হত্যা করছে বিএসএফ।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ বছরে বিএসএফ ৬০৭ বাংলাদেশীকে হত্যা করে এবং একই সময়ে বিএসএফের গুলিতে ৬৬৩ বাংলাদেশী আহত হয়। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে বিএসএফের হাতে ৫১৪ বাংলাদেশী গ্রেফতার, ৭০৫ জন অপহৃত এবং ধর্ষণের শিকার হন ১০ বাংলাদেশী নারী। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে বিএসএফ কর্তৃক অন্তত ৬১টি লুটের ঘটনা ঘটেছে।
এত আলোচনা, এত বৈঠক, কিন্তু থেমে নেই বিএসএফের হাতে নিরীহ বাংলাদেশী নিধন পর্ব। এমনকি চলতি মাসেও (এপ্রিল ২০১৪) সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের খবর শোনা যাচ্ছে হরহামেশাই। গত ১৮ এপ্রিল কুড়িগ্রামের বালারহাট সীমান্তের ৯৩১নং আন্তর্জাতিক পিলারের নো-ম্যান্স ল্যান্ড এলাকা থেকে গরু আনতে গেলে স্থানীয় বাসিন্দা শামছুল হককে (৩২) ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্যরা গুলি করে। চলতি বছরের ২৪ মার্চ চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার মুন্সীপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিক আহাদ আলী সোনা (৩২) নিহত হয়েছেন। এর আগে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি সীমান্তে এক বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ।
দুই দেশের মধ্যে ৪ হাজার ১০০ কিলোমিটার বা প্রায় ২ হাজার ৫০০ মাইল সীমান্ত রয়েছে, যা পৃথিবীতে চতুর্থ বৃহত্ অভিন্ন স্থলসীমানা হিসেবে চিহ্নিত। এই পুরো সীমান্তজুড়েই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের মাধ্যমে সীমানাকে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। চোরাচালান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাদকের অবাধ চালানসহ সব অবৈধ কর্মকাণ্ড একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত।
ঐতিহাসিক বন্ধু বলে কথা
এতকিছুর পরও বাংলাদেশের একশ্রেণীর নতজানু রাজনীতিবিদ ভারতকে অকৃত্রিম বন্ধু বলতে বলতে মুখে যেন ফ্যানা তুলে ফেলছেন। এবার আসা যাক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। ভারত কি আদৌ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ভারতের ভূমিকাই বলে দেয় বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকুক, তা ভারত কতটা চায়। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলীল তার 'অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা' বইয়ের ভূমিকায় বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যকারী বলে কথিত প্রতিবেশী ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর বাংলাদেশের জনগণের প্রতি 'বিগ ব্রাদার'সুলভ আধিপত্যবাদী আচরণ মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে কেবল ম্লানই করেনি, করেছে বিকৃত এবং কলঙ্কিত। মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টরের সাবেক কমান্ডার হিসেবে বিগত ১৭ বছরে আমাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের অকাল মৃত্যু, গুম ও খুন। নির্মূল ও বিরান হয়ে গেছে তাদের সাজানো-পাতানো সংসার। স্বাধীনতা অর্জনের দাবিদার আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার ঘোষক বলে কথিত জিয়া সরকারের আমলেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা।'
একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তে ও তার পরপরই আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু ভারত এদেশে যা করেছিল, সেই প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে এই বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার তার বইয়ের অন্যত্র লিখেছেন, 'ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক সেই লুটপাটের খবর চারদিক থেকে আসা শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিত্যক্ত কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক গাড়ি, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ আরও মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাকবোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। প্রাইভেট কার পর্যন্ত যখন রক্ষা পায়নি, তখনই কেবল আমি খুলনা শহরের প্রাইভেট গাড়িগুলো রিকুইজিশন করে খুলনা সারকিট হাউস ময়দানে হেফাজতে রাখার চেষ্টা করি। এর পূর্ব পর্যন্ত যে গাড়ি পেয়েছে, সেটাকেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সীমান্তের ওপারে। যশোর সেনানিবাসের প্রত্যেকটি অফিস এবং কোয়ার্টার তন্ন তন্ন করে লুট করেছে। বাথরুমের মিরর এবং অন্যান্য ফিটিংস পর্যন্ত সেই লুটতরাজ থেকে রেহাই পায়নি।'
মেজর জলিল লিখেছেন, 'আমারই স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দি। ৩১ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১০টায় আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল রূপের প্রথম দৃশ্য দেখলাম আমি। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মদতে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ এবং তাত্পর্য বুঝে উঠতে তখন আর আমার এক মিনিটও বিলম্ব হয়নি।'
আর পেছনে ফেরা নয়
নতুন প্রজন্মের সচেতন অনেকের মনে হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে, স্বাধীনতার পরপরই একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে কী হয়েছিল শুধু সেটাকে বিবেচনা করা সমুচিত হবে না, বর্তমানে ভারত আমাদের কীভাবে দেখে, সেটাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই, একেবারেই সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার অবতারণা করলেই আশা করি সচেতন ও বিবেকবান প্রতিটি মানুষের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
গত বছরের (২০১৩) ৫ অক্টোবর ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় 'সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তানকে কড়া বার্তা প্রণবের' এমন শিরোনামে একটি খবর ছাপা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র ব্রাসেলসে ইউরোপের এক টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী পাকিস্তানের সমালোচনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলেন, 'কিন্তু ভারতের পক্ষে তার সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো সমঝোতা করা সম্ভব নয়। আর সীমান্তের ওপার থেকে সন্ত্রাসে মদত দেওয়াও বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। শিমলা চুক্তির পরে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বন্দি ৯১ হাজার পাক সেনাকে ছেড়ে দিয়েছিল ভারত।'
প্রণব মুখার্জীর কথায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, ভারত মনে করে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হলো আমাদের গৌরবগাথা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ, লাল-সবুজের পতাকা। ভারত আমাদের সেই যুদ্ধে সেনাবাহিনী, আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছিল, সেটি আমরা সবাই স্বীকার করি। এজন্য অবশ্যই আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ।
ইতিহাস সাক্ষী একাত্তরে প্রকৃত লড়াইটা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদার বাহিনীর মধ্যে। যুদ্ধে হতাহতের জরিপ থেকেও তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত এবং এটাই ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এ যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কেবল আমাদের 'অকৃত্রিম বন্ধু' হিসেবেই মূল্যায়ন করা যায়। কিন্তু প্রণব মুখার্জীর কথায় সেই যুদ্ধ যেন হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। তার এই বক্তব্য কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবমাননা নয়?
প্রণববাবু বলেছেন, শিমলা চুক্তির পরে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বন্দি ৯১ হাজার পাক সেনাকে ছেড়ে দিয়েছিল ভারত। পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করল আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষকে, ইজ্জত নিল আমাদের মা-বোনদের, আর তাদের ছেড়ে দিল ভারত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ছেড়ে দেয়ার ভারত কে? তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকল কোথায়? অথচ আমরা জানি, সিমলা চুক্তি মূলত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যেই হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি ভারতের ওই সময়ের সক্রিয় সহযোগিতার কারণে এবং ওই সময়ের বাস্তবতায় চুক্তিতে তিন দেশেই স্বাক্ষর করে এবং সেই হিসেবে চুক্তিটিকে সর্বোচ্চ ত্রিদেশীয় চুক্তি বলা যেতে পারে। কিন্তু ভারত কীভাবে বলে যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানের ৯১ হাজার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে দিয়েছে ভারত?
শুধু কী তাই প্রণব মুখার্জী তার সাক্ষাত্কারে বলেন, 'যুদ্ধে দখল করা ভূখণ্ডও ছেড়ে চলে এসেছিল ভারতীয় সেনা।' তার মানে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে কিছু সেনা পাঠিয়ে বাংলাদেশকে যে সহায়তা ভারত করেছিল সেটাকে আজও তারা বাংলাদেশের ভূখণ্ড দখলের সঙ্গে তুলনা করে। আর সেই ভূখণ্ড ছেড়ে আসাকে তাদের উদারতা হিসেবে তারা বিশ্বময় এখনো প্রচার করে বেড়াচ্ছে।
বন্ধুর আবদার বলে কথা
এত গেল সাত মাস আগের ঘটনা। এবার আসি একবারে সাম্প্রতিক ইস্যুতে। চলতি মাসে (১৮ এপ্রিল, ২০১৪) নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দাবি করেছে। বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা সুব্রামনিয়ম স্বামী এমন দাবি করেন। তিনি খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত সমান্তরাল রেখা টেনে এই জমি ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে বলেছেন বাংলাদেশকে। গত ১৮ এপ্রিল শনিবার আসামের শিলচর থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ এ খবর দিয়েছে।
হিন্দু উগ্রবাদী দল বিজেপির এই শীর্ষ নেতার যুক্তি হলো, ভারত ভাগের পর অধুনা বাংলাদেশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশকে। অন্যথায় এসব মুসলমানের সংস্থাপনের জন্য বাংলাদেশকে এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড ছাড়তে হবে।
তবে স্বামী জানিয়েছেন, এ নিয়ে তিনি এখনো মোদি বা বিজেপির সঙ্গে কথা বলেননি ঠিকই, কিন্তু নতুন এই তত্ত্বের কথা যথাসময়ে দেশের সংসদে উত্থাপন করবেন। সংসদে এ নিয়ে বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন সে কথা তিনি দলীয় নেতৃত্বকে বুঝিয়ে বলবেন। (সূত্র : দৈনিক সাময়িক, আসাম)।
উদারতাই আমাদের কাম্য
প্রশ্ন আসতে পারে, ভারতীয় রাজনৈতিক দল বিজেপির কোনো এক নেতার বক্তব্যকে পুরো ভারতের বক্তব্য হিসেবে চালানো কতটা যৌক্তিক? বাংলাদেশের মানুষও এক নেতার বক্তব্যকে পুরো ভারতের বক্তব্য হিসেবে দেখতে চায় না। এখন বিজেপির পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসা দরকার এই মর্মে যে, স্বামীর দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে বিজেপীর কোনো সম্পর্ক নেই। এমন একটি বিবৃতি ভারতের পক্ষ থেকে বর্তমান ভারতবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার আদায় করতে পারলেই হয়তো সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কিছুটা বাড়ত এবং ভারতের প্রতি এদেশের মানুষের যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে তাও কিছুটা হ্রাস পেত।
ভারতের সঙ্গে শত্রুতা সৃষ্টি করা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা রেখে কারও পক্ষেই সুন্দর জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। আর ভারতের মতো এত বড় এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্ পরাশক্তি যে কিনা আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে, তাদের সঙ্গে শত্রুতা নয়, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবে প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে, সজাগ থাকতে হবে যে কোনো প্রতিকূলতার জন্য। পরিত্যাগ করতে হবে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি। শিক্ষাদীক্ষায় এবং আধুনিক এই বিশ্বায়নের যুগে বেড়ে ওঠা সচেতন তরুণ সমাজকে নিশ্চয়ই ভুল বুঝিয়ে কারও গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ করা যাবে না, সেই বিশ্বাস নিয়েই এখানে ইতি টানলাম।
লেখক : সাংবাদিক
Email: mkbablu@gmail.com
__._,_.___