যে দেশের স্বপ্ন দেখেছি
ষোলোআনা বাঙালি
এরশাদ মজুমদার
১৯ এপ্রিল ২০১৪, শনিবার, ১০:১৪
১৯ এপ্রিল ২০১৪, শনিবার, ১০:১৪
দেখো এরশাদ, আমার স্বপ্নের কথা তোমাকে বহুবার বলেছি। আমার স্বপ্নটা হলো দেশের মানুষকে নিয়ে। আমি একটা সুখী মানুষের দেশ দেখতে চাই। স্কুলজীবন থেকেই এ স্বপ্ন দেখে আসছি। আমি একটা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমার কোনো অভাব ছিল না এবং এখনো নেই । পাকিস্তান টিকে থাকলে আমার ব্যক্তিগত কোনো অসুবিধা ছিল না। তবুও মুক্তিযুদ্ধে কেন গিয়েছিলাম? ভেবেছিলাম, পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেলে দেশের সাধারণ মানুষ এক কথায় যাদের গরিব বলা হয়, তারা সুখে থাকবে। রাষ্ট্র বা দেশ স্বাধীন হলেও মানুষ পরাধীন বা অধিকারহারা থাকতে পারে। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। যে ধারায় বা নীতি পদ্ধতিতে দেশ বা রাষ্ট্র চলছে তাতে এ জীবনে বাংলাদেশের মানুষকে সুখী দেখতে পাবো না। তুমি তো নামজাদা ইকোনমিক রিপোর্টার ছিলে। পূর্ব-পশ্চিমের সামগ্রিক বৈষম্য বা ডিসপ্যারিটি নিয়ে কম লেখনি। অবজারভার আর পূর্বদেশের ইকোনমিক রিপোর্ট পড়েই বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিতেন। হাটে মাঠে মানুষকে সে তথ্য পরিবেশন করতেন। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে পূর্বদেশে তোমার রিপোর্ট নিয়মিত পড়তাম। সচেতন ছাত্রদের সে রিপোর্ট দেখাতাম। পাকিস্তানের সাথে থেকে অধিকারহারা ছিলাম বলেই তো আমরা স্বাধীনতা চেয়েছি, স্বাধীনতা এনেছি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হতে চলেছে। দেশে এখন কোটি কোটি লোক বেকার, সবার ঘরে শিা প্রবেশ করেনি, সবাই চিকিৎসা পায় না, সবার নেই আশ্রয়। ইতোমধ্যেই কয়েক হাজার লোক লুটপাট করে ধনী হয়ে গেছে। তারা এখন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই তো সেদিন ভিয়েতনাম আমেরিকার কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছে। তার আগে দুই যুগ আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আজ তারা বাংলাদেশের চেয়েও ধনী। সেখানে আদর্শবান ত্যাগী নেতা আছেন। তাদের প্রধানতম আদর্শ হচ্ছে, দেশের মানুষের কল্যাণ। আজ আমেরিকা তাদের প্রধান বন্ধু। আশেপাশের সব দেশ এগিয়ে গেছে। আমি তো এমন বাংলাদেশ চাইনি। পাকিস্তান আমলে অবাঙালিরা শোষণ করত, এখন ভারতীয় অবাঙালি আর দেশীয় বাঙালিরা শোষণ করছে। মাত্র ৪৪ বছরে কেমন করে একটা বিজনেস গ্রুপ ৪৪ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়? কিছু লোক তো রাজনীতিকদের সহযোগিতায় ব্যাংকে আমানত রাখা জনগণের টাকা সরাসরি মেরে দিয়েছে।
আশি, তুমি তো অর্থনীতির কথা বলছ। আমি দেখছি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষার অবস্থা। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। কিন্তু দেশটি মাত্র শতকরা দশ ভাগ লোকের চিন্তাধারা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তারা বলছে, সব কিছুতেই 'বাঙালিয়ানা' আনতে হবে। যদি প্রশ্ন করো কি ভাবে বাঙালিয়ানা আনতে হবে? তখন আমতা আমতা করতে থাকে। তারা বলে, পয়লা বৈশাখ, ভাষা দিবস, বসন্ত উৎসব, হোলি বা দোল খেলা, পান্তা, ইলিশ, শুঁটকি খাওয়া বাঙালিদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। যারা এসব করে তারা কারা? তারা মাত্র কয়েক হাজার ছাত্র বা রাজধানীর কিছু লোক। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কি এসব করে? করবে না কেন? আস্তে আস্তে সবই করবে। বাঙালি হওয়ার জন্যই তো পাকিস্তান থেকে বেরিয়েছি। তারা বলে ধর্ম একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার, এর সাথে সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নেই।
তখন আমার মনে পড়ে গেল ভারতের এক মন্ত্রীর কথা। তিনি নাকি বাংলাদেশের হিতাকাক্সী। এক সময় তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, তোমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছ বাঙালি হওয়ার জন্য, এখন মুসলমান হতে চাও কেন? তোমরা মুসলমান হিসেবে তো পাকিস্তানের সাথেই ছিলে। যদি মুসলমান থাকতে চাও, তাহলে আলাদা হওয়ার কী দরকার ছিল। বললাম, আমি তো মুক্তিযুদ্ধে ছিলাম, তখন এমন কোনো কথা শুনিনি। Ñকেন? তোমাদের সেøাগান তো ছিল 'জয় বাংলা'।
দেখুন দাদা, ১৯৪৭ সালে আপনারা স্বাধীন অখণ্ড বাংলাদেশ চাননি। তাই আমরা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের সাথে গেছি। বাংলার প্রতি আপনাদের যদি দরদ থাকত তাহলে সাতচল্লিশে ভাগ করতেন না। ১৯০৫ সালে আপনারা বঙ্গভঙ্গ রোধ করার করার জন্য কী না করেছেন। এমনকি দাঙ্গাও করেছেন। এখন আবার বলছেন সাতচল্লিশের ভারত বিভাগ ভুল ছিল। আপনাদের কবিতায়, সাহিত্যে, নোবেল, নাটকে এখন আর পশ্চিম বাংলা বলেন না। বলেন বাংলাদেশ। আপনারা ভারতীয় বাঙালি। এই বাঙালিরা অবাঙালি দিল্লি দ্বারা শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। কই, আপনারা তো অখণ্ড বাংলাদেশের দাবিকে সামনে নিয়ে আসছেন না, বরং উল্টো বাংলাদেশের তরুণ সমাজের ভেতর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। আপনাদের ল্য কী?
আমরা চাই, তোমরা ষোলোয়ানা বাঙালি হিসেবে বিকশিত হও। Ñদেখুন দাদা, আমরা বাঙালিও , আবার মুসলমানও। শুধু বাঙালি নই। দুটোই আমাদের আইডেন্টিটি। ভৌগোলিক কারণে আমরা বাঙালি, আর ধর্মীয় কারণে আমরা মুসলমান। আমাদের বিশ্ব পরিচয় বাংলাদেশী। আর আপনাদের পরিচয় ভারতীয়। আমার পাসপোর্টে লেখা থাকে বাংলাদেশী। আপনার পাসপোর্টে লেখা থাকে ইন্ডিয়ান। হিন্দু বা মুসলমান কিছুই লেখা থাকে নাÑ আমি তো শুনেছি তুমি বাম চিন্তাধারার লোক ছিলে। বললাম ঠিকই শুনেছেন। ইসলাম একটি প্রগতিশীল চিন্তাধারার ধর্মীয় বিশ্বাস। মওলানা ভাসানী ছিলেন আমার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরু। আমি গণমানুষের মুক্তিতে বিশ্বাস করি, নিছক রাষ্ট্র বা দেশের মুক্তি নয়। মানুষের মুক্তির জন্য দেশের মুক্তি হলো, প্রথম ধাপ। বাংলাদেশের ভূখণ্ড মুক্তিলাভ করেছে, কিন্তু মানুষের মুক্তি আসেনি; মানুষ রাষ্ট্রের দাস হয়ে গেছে। সংবিধান বলে মানুষ নাকি 'সার্বভৌম'। আমি দেখি মানুষ রাষ্ট্রের দাস। দাদা, আপনাদের দেশের বামপন্থীরা মন্দিরে যায়, আবার কমিউনিস্টও থাকে। হিন্দু কমিউনিস্টদের কথা জানতে হলে কমরেড মুজফফর সাহেবের জীবনী পড়ুন। মুসলমান কমিউনিস্টরা মসজিদে গেলেই আপনাদের আপত্তি। আপনারা বলেন, ভারত সেকুলার দেশ। অথচ ভারতে সারা বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে থাকে। বাংলাদেশে কোনো দাঙ্গা হয় না, যা হয় তা রাজনীতি। দাঙ্গা রাজনীতির একটা অংশ। বহুকাল ধরে চলে আসছে।
ভারতের ওই মন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, দেখো এরশাদ আমরা তোমাদের স্বাধীন করেছি বিনা স্বার্থে নয়। এতে নিশ্চয়ই ভারতের স্বার্থ আছে। ভারতের সহযোগিতা না পেলে তোমরা কোনো দিনও স্বাধীন হতে পারতে না। কাশ্মির আর ভারতের পূর্বাঞ্চলের অবস্থা দেখছ না? আর তোমরা ৯ মাসেই স্বাধীন হয়ে গেলে। এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েছ, জাতিসঙ্ঘের সদস্য হয়েছ, জাতীয় পতাকা ওড়াচ্ছ, জাতীয় সঙ্গীত গাইছ। এসব কার অবদান? এখন ভারতের অবদান ভুলে গেলে চলবে কেন? ভারতের স্বার্থের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখালে তো চলবে না। ভুলে গেলে চলবে না, ভারত একটি শক্তিশালী দেশ। তোমরা তার প্রতিবেশী। আমাদের অনুরোধকে অবহেলা করে চীন আমেরিকার কথা শুনবে আর পাকিস্তানের সাথে আবার গাঁটছড়া বাঁধবে, তা কখনো হবে না। পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, ভৌগোলিক এলাকা থাকলেই কোনো দেশ সার্বভৌম হয় না। তোমাদের দেশের কিছু নেতা বা দল বাস্তবতা মানতে চায় না। আমাদের অমান্য করলে কোনো দলই এ দেশে রাজনীতি করতে পারবে না। তুমি কি ভুলে গেছ, শেখ মুজিব ভারতের অনুরোধকে অবহেলা করে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তান গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ বহু বছর মতার বাইরে ছিল। এখন বারবার মতায় আসতে শুরু করেছে। জিয়া সাহেবকেও মর্মান্তিকভাবে মতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। এক-এগারোর সরকার মতায় এসে খালেদা জিয়ার রাজনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। অথচ সেই সেনাপতিকে খালেদা জিয়াই নিয়োগ দিয়েছিলেন নিজের আত্মীয় বলে। ফল কী হয়েছে, তা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। নামমাত্র নির্বাচন করেও মতায় থাকা যায়, তা এখন বাংলাদেশের মানুষ দেখছে। সবাই বিরুদ্ধে থেকেও শেখ হাসিনার মতায় আবার আসাটাকে কেউ রোধ করতে পারেনি। ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কেউ মতায় থাকতে পারবে না।
সাথে আমার এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধুও ছিলেন মন্ত্রীর সামনে। তিনি হঠাৎ ভারতীয় মন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করে বলে ফেললেন, কিছু সাংবাদিক আছে যারা দেশের স্বার্থে রাজনীতির বাস্তবতা বুঝতে চায় না।
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে বিশ্বের কোনো ছোট দেশই সার্বভৌম নয়। ভারতের মন্ত্রী বললেন, দেখো এরশাদ তোমার লেখা কলাম আমাদের লোকেরা নিয়মিত পড়ে। তোমার কথা আমার পছন্দ। এসব হলো নীতি আর আদর্শের কথা, বাস্তবতা নয়। বাংলাদেশ কখনই স্বাধীন পররাষ্ট্র বা সামরিক নীতি অনুসরণ করতে পারবে না। বিশ্ব ভূ-রাজনীতির কারণে এটা সম্ভব নয়।
ক'দিন আগে আমার এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধু জাতীয় প্রেস কাবে দেখা হতেই বললেন, আপনাদের বিএনপির খবর কী? আমি বেশ কিছুণ বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উত্তরে বললাম, খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছেন। আমাদের বিএনপি! এই দল মতায় এলে আপনি চাকরি পান, আর দল হলো আমার। আমি তো জীবনেও কোনো সরকারের চাকরি বা তাঁবেদারি করিনি। উত্তরে বন্ধু বললেন, আরে না, ঠাট্টা করলাম। সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন? তবুও বললাম আপনারাই তো জেনারেল মইনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের একজন স্টাফের সাথে ক'দিন আগে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, দেখুন, আমি চাকরি করি। কোনো রাজনৈতিক দল করি না। আমি জানতে চাইলাম, আপনি তো বিএনপির মঞ্চেও ভাষণ দেন। তিনি উত্তর দিলেন, মেহমান হিসেবে উপস্থিত থাকি। এ ধরনের বহু লোক বিএনপি চেয়ারপারসনের চার দিকে বেষ্টন করে আছেন।
আওয়ামী লীগে আমার বহু বন্ধু আছে। তারা বলেন, এটা বঙ্গবন্ধুর দল, তাই এ দলে আছি। ছাত্রলীগে ছিলাম এখন আওয়ামী লীগে আছি। এটা একটা ধারাবাহিকতা। আওয়ামী রাজনীতির গভীরে কখনো যাইনি। এর আদর্শ বা দর্শন কী তা নিয়ে খুব একটা ভাবিনি। ভাবার প্রয়োজনও করিনি। যখন বলি, দেশের ৯৯ ভাগ হিন্দু আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে কেন? উত্তরে তারা বলেন, তারা হয়তো মনে করে আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী। হিন্দুদের সাথে ভারতের কী সম্পর্ক? পাকিস্তান আমলে না হয় ভারতপন্থী ছিল, এখনো কেন? এ দেশে তো তারা কম সুবিধা পান না। সংখ্যার দিক থেকে যা সুবিধা পাওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় বিশ ভাগ সুবিধা ভোগ করছেন। ভারতের মুসলমানেরা পঁচিশ ভাগ হয়েও মাত্র এক ভাগ সুবিধা পায়। এ বিষয়টা কি আপনারা কখনো চিন্তা করেছেন? ওভাবে চিন্তা করলে আমরা দলে থাকতে পারব না। আমাদের জ্ঞান গম্যি সাধনা সবই হলো আওয়ামী বিরোধী রাজনীতি ও দর্শনকে বিনাশ করা। আমরা মনে করি, আমরা স্বাধীনতা এনেছি, আমরাই দেশ চালাব। আমরাই একমাত্র দেশপ্রেমিক দল। আমরাই স্বাধীনতার সপরে দল, বাকিরা সবাই স্বাধীনতাবিরোধী। এটাই আমাদের ধ্যান-ধারণা। এর বাইরে আমরা চিন্তা করি না। আমাদের নেতা-নেত্রী যে ভাষায় কথা বলেন আমরা সে ভাষাতেই কথা বলি। আমাদের নেত্রী দূরদর্শী, তিনি জানেন ভারতের সাথে দ্বিমত করে মতায় থাকা যাবে না। তিনি মনে করেনÑ এটা ভারতের পে থাকা নয়, বরং সমঝোতার মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নেয়া। তিনি জানেন, তা না হলে নেপালের অবস্থা হবে, যেমন হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অবস্থা। অমন জনপ্রিয় নেতা এ দেশে আর জন্মগ্রহণ করবেন না।
দেখো, আমি দেশের পে কথা বলি বলে আমাকে বিএনপি বা জামায়াতপন্থী বলা হয়। আমি নাকি স্বাধীনতার সপরে শক্তি নই। এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেই চলবে না, 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'ও থাকতে হবে। তারা জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের দালাল বলে। খালেদা জিয়াকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলে। লন্ডনে তারেক জিয়া কী বলেছে তা নিয়ে এখন আওয়ামী নেতাদের ঘুম নেই। রাত-দিন খিস্তি খেউর করে চলেছে। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, রাজনীতি থেকে সভ্যতা ভব্যতা চির বিদায় নিতে চলেছে।
এত গেল রাজনীতি ও সংস্কৃতির অবস্থা। ক'দিন আগে বাঙালির ধর্মচিন্তা নামে একটি বইয়ের আলোচনা বৈঠকে গিয়েছিলাম। বইয়ের প্রকাশক সাইদ বারী আমার খুবই প্রিয় মানুষ। বইটি সম্পাদনা করেছেন ডক্টর আবদুল হাই। তিনিও বিনীত ভদ্রলোক। আলোচনায় অনেক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। আমি শিক ও জ্ঞানীদের ঢঙে কথা বলতে পারি না। আমার সে রকম প্রশিণ নেই। বইটির ভূমিকা আমার ভালো লেগেছে। আলোচকদের বক্তব্যও ভালো ছিল। বইটিতে যেসব লেখা সঙ্কলিত হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই ধর্মহীনতার দিকে ঝোঁক রয়েছে। সঙ্কলক বা সম্পাদক বলেছেন, ধর্মের পে তেমন ভালো লেখা পাননি। আমি মনে করি, ধর্ম না মানা বা ধর্মহীন থাকা কোনো অপরাধ নয়। এটা একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলাটা ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করি না। ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে ধর্মচর্চা করা পে থেকে বা বিপে থেকে। একজন ধার্মিকেরও উচিত হবে না অধার্মিকের বিরুদ্ধে কথা বলা। যারা ধর্ম মানেন না তাদের সংখ্যা জগতে অতি নগণ্য। আবার এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের লোককে গালমন্দ করাও উচিত নয়। সব ধর্মই এক আল্লাহ/খোদা/ ঈশ্বর/ভগবান/গড/ ইলাতে বিশ্বাস করেন। ঈশ্বর নিরাকার এ কথাও সবাই স্বীকার করেন। তিনি সর্ব অবস্থায় সর্বত্র বিরাজমান। শুধু ধর্ম কর্ম সম্পাদনের সময় বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন। শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন, 'যত মত তত পথ। কিন্তু ল্য এক।' সবাই স্বীকার করেন মানুষই স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। বইয়ের নামকরণ নিয়ে সবাই আপত্তি করেছেন। ভারতীয় বাংলায় বাঙালি বলতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীকেই বোঝায়। আর বাংলাদেশের নাগরিকদের অফিসিয়াল স্বীকৃতি হলো বাংলাদেশী। এখানে ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। বাকি ১০ ভাগ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ভৌগোলিক এবং ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মীয় আচারের প্রভাব রয়েছে। শুধু বাঙালি বলা হলেও ভারতীয় বাঙালির সাথে চিন্তাচেতনায় বিশাল ব্যবধান রয়েছে। সম্প্রতি সেকুলারিজম শব্দটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার একটা প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে সেকুলারিজমের অর্থ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কুচেষ্টা চলছে। এটা এক ধরনের ভণ্ডামি। সেকুলার শব্দের অর্থ ধর্মহীনতা। যিনি বা যারা ধর্মীয় শিা দীায় বিশ্বাস করেন না। পরকালেও বিশ্বাস করেন না। জগৎই তাদের কাছে প্রধান। এ কথাটি তারা প্রকাশ্যে সরাসরি বলতে চান না। আরেক গ্রুপ বেরিয়েছে যারা বলে, ধর্মীয় ইসলাম আর রাজনৈতিক ইসলাম এক নয়। এরাও আসলে ইসলামবিরোধী একটা গ্রুপ। আরো এক গ্রুপ আছে, যারা বলেন ধর্ম ব্যক্তিগত ও ঘরের ব্যাপার। একে বাইরে আনা যাবে না। হয়তো এক দিন শুনব এমনকি মসজিদও রাখা যাবে না। এমনকি জুমার নামাজও পড়া যাবে না। যদি পড়া হয়, তাহলে খুতবা কী হবে তা ঠিক করে দেবে সরকার।
ভারতও চায় বাংলাদেশ একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মহীন রাষ্ট্রে পরিণত হোক। রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ধর্ম হবে একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রাকে ধর্মমুক্ত বা ধর্মহীন রাখার একটা চেষ্টা চলছে।
কবি, ঐতিহ্য গবেষক
www.humannewspaper.wordpress.com
আশি, তুমি তো অর্থনীতির কথা বলছ। আমি দেখছি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষার অবস্থা। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। কিন্তু দেশটি মাত্র শতকরা দশ ভাগ লোকের চিন্তাধারা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তারা বলছে, সব কিছুতেই 'বাঙালিয়ানা' আনতে হবে। যদি প্রশ্ন করো কি ভাবে বাঙালিয়ানা আনতে হবে? তখন আমতা আমতা করতে থাকে। তারা বলে, পয়লা বৈশাখ, ভাষা দিবস, বসন্ত উৎসব, হোলি বা দোল খেলা, পান্তা, ইলিশ, শুঁটকি খাওয়া বাঙালিদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। যারা এসব করে তারা কারা? তারা মাত্র কয়েক হাজার ছাত্র বা রাজধানীর কিছু লোক। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কি এসব করে? করবে না কেন? আস্তে আস্তে সবই করবে। বাঙালি হওয়ার জন্যই তো পাকিস্তান থেকে বেরিয়েছি। তারা বলে ধর্ম একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার, এর সাথে সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নেই।
তখন আমার মনে পড়ে গেল ভারতের এক মন্ত্রীর কথা। তিনি নাকি বাংলাদেশের হিতাকাক্সী। এক সময় তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, তোমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছ বাঙালি হওয়ার জন্য, এখন মুসলমান হতে চাও কেন? তোমরা মুসলমান হিসেবে তো পাকিস্তানের সাথেই ছিলে। যদি মুসলমান থাকতে চাও, তাহলে আলাদা হওয়ার কী দরকার ছিল। বললাম, আমি তো মুক্তিযুদ্ধে ছিলাম, তখন এমন কোনো কথা শুনিনি। Ñকেন? তোমাদের সেøাগান তো ছিল 'জয় বাংলা'।
দেখুন দাদা, ১৯৪৭ সালে আপনারা স্বাধীন অখণ্ড বাংলাদেশ চাননি। তাই আমরা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের সাথে গেছি। বাংলার প্রতি আপনাদের যদি দরদ থাকত তাহলে সাতচল্লিশে ভাগ করতেন না। ১৯০৫ সালে আপনারা বঙ্গভঙ্গ রোধ করার করার জন্য কী না করেছেন। এমনকি দাঙ্গাও করেছেন। এখন আবার বলছেন সাতচল্লিশের ভারত বিভাগ ভুল ছিল। আপনাদের কবিতায়, সাহিত্যে, নোবেল, নাটকে এখন আর পশ্চিম বাংলা বলেন না। বলেন বাংলাদেশ। আপনারা ভারতীয় বাঙালি। এই বাঙালিরা অবাঙালি দিল্লি দ্বারা শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। কই, আপনারা তো অখণ্ড বাংলাদেশের দাবিকে সামনে নিয়ে আসছেন না, বরং উল্টো বাংলাদেশের তরুণ সমাজের ভেতর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। আপনাদের ল্য কী?
আমরা চাই, তোমরা ষোলোয়ানা বাঙালি হিসেবে বিকশিত হও। Ñদেখুন দাদা, আমরা বাঙালিও , আবার মুসলমানও। শুধু বাঙালি নই। দুটোই আমাদের আইডেন্টিটি। ভৌগোলিক কারণে আমরা বাঙালি, আর ধর্মীয় কারণে আমরা মুসলমান। আমাদের বিশ্ব পরিচয় বাংলাদেশী। আর আপনাদের পরিচয় ভারতীয়। আমার পাসপোর্টে লেখা থাকে বাংলাদেশী। আপনার পাসপোর্টে লেখা থাকে ইন্ডিয়ান। হিন্দু বা মুসলমান কিছুই লেখা থাকে নাÑ আমি তো শুনেছি তুমি বাম চিন্তাধারার লোক ছিলে। বললাম ঠিকই শুনেছেন। ইসলাম একটি প্রগতিশীল চিন্তাধারার ধর্মীয় বিশ্বাস। মওলানা ভাসানী ছিলেন আমার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরু। আমি গণমানুষের মুক্তিতে বিশ্বাস করি, নিছক রাষ্ট্র বা দেশের মুক্তি নয়। মানুষের মুক্তির জন্য দেশের মুক্তি হলো, প্রথম ধাপ। বাংলাদেশের ভূখণ্ড মুক্তিলাভ করেছে, কিন্তু মানুষের মুক্তি আসেনি; মানুষ রাষ্ট্রের দাস হয়ে গেছে। সংবিধান বলে মানুষ নাকি 'সার্বভৌম'। আমি দেখি মানুষ রাষ্ট্রের দাস। দাদা, আপনাদের দেশের বামপন্থীরা মন্দিরে যায়, আবার কমিউনিস্টও থাকে। হিন্দু কমিউনিস্টদের কথা জানতে হলে কমরেড মুজফফর সাহেবের জীবনী পড়ুন। মুসলমান কমিউনিস্টরা মসজিদে গেলেই আপনাদের আপত্তি। আপনারা বলেন, ভারত সেকুলার দেশ। অথচ ভারতে সারা বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে থাকে। বাংলাদেশে কোনো দাঙ্গা হয় না, যা হয় তা রাজনীতি। দাঙ্গা রাজনীতির একটা অংশ। বহুকাল ধরে চলে আসছে।
ভারতের ওই মন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, দেখো এরশাদ আমরা তোমাদের স্বাধীন করেছি বিনা স্বার্থে নয়। এতে নিশ্চয়ই ভারতের স্বার্থ আছে। ভারতের সহযোগিতা না পেলে তোমরা কোনো দিনও স্বাধীন হতে পারতে না। কাশ্মির আর ভারতের পূর্বাঞ্চলের অবস্থা দেখছ না? আর তোমরা ৯ মাসেই স্বাধীন হয়ে গেলে। এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েছ, জাতিসঙ্ঘের সদস্য হয়েছ, জাতীয় পতাকা ওড়াচ্ছ, জাতীয় সঙ্গীত গাইছ। এসব কার অবদান? এখন ভারতের অবদান ভুলে গেলে চলবে কেন? ভারতের স্বার্থের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখালে তো চলবে না। ভুলে গেলে চলবে না, ভারত একটি শক্তিশালী দেশ। তোমরা তার প্রতিবেশী। আমাদের অনুরোধকে অবহেলা করে চীন আমেরিকার কথা শুনবে আর পাকিস্তানের সাথে আবার গাঁটছড়া বাঁধবে, তা কখনো হবে না। পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, ভৌগোলিক এলাকা থাকলেই কোনো দেশ সার্বভৌম হয় না। তোমাদের দেশের কিছু নেতা বা দল বাস্তবতা মানতে চায় না। আমাদের অমান্য করলে কোনো দলই এ দেশে রাজনীতি করতে পারবে না। তুমি কি ভুলে গেছ, শেখ মুজিব ভারতের অনুরোধকে অবহেলা করে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তান গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ বহু বছর মতার বাইরে ছিল। এখন বারবার মতায় আসতে শুরু করেছে। জিয়া সাহেবকেও মর্মান্তিকভাবে মতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। এক-এগারোর সরকার মতায় এসে খালেদা জিয়ার রাজনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। অথচ সেই সেনাপতিকে খালেদা জিয়াই নিয়োগ দিয়েছিলেন নিজের আত্মীয় বলে। ফল কী হয়েছে, তা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। নামমাত্র নির্বাচন করেও মতায় থাকা যায়, তা এখন বাংলাদেশের মানুষ দেখছে। সবাই বিরুদ্ধে থেকেও শেখ হাসিনার মতায় আবার আসাটাকে কেউ রোধ করতে পারেনি। ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কেউ মতায় থাকতে পারবে না।
সাথে আমার এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধুও ছিলেন মন্ত্রীর সামনে। তিনি হঠাৎ ভারতীয় মন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করে বলে ফেললেন, কিছু সাংবাদিক আছে যারা দেশের স্বার্থে রাজনীতির বাস্তবতা বুঝতে চায় না।
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে বিশ্বের কোনো ছোট দেশই সার্বভৌম নয়। ভারতের মন্ত্রী বললেন, দেখো এরশাদ তোমার লেখা কলাম আমাদের লোকেরা নিয়মিত পড়ে। তোমার কথা আমার পছন্দ। এসব হলো নীতি আর আদর্শের কথা, বাস্তবতা নয়। বাংলাদেশ কখনই স্বাধীন পররাষ্ট্র বা সামরিক নীতি অনুসরণ করতে পারবে না। বিশ্ব ভূ-রাজনীতির কারণে এটা সম্ভব নয়।
ক'দিন আগে আমার এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধু জাতীয় প্রেস কাবে দেখা হতেই বললেন, আপনাদের বিএনপির খবর কী? আমি বেশ কিছুণ বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উত্তরে বললাম, খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছেন। আমাদের বিএনপি! এই দল মতায় এলে আপনি চাকরি পান, আর দল হলো আমার। আমি তো জীবনেও কোনো সরকারের চাকরি বা তাঁবেদারি করিনি। উত্তরে বন্ধু বললেন, আরে না, ঠাট্টা করলাম। সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন? তবুও বললাম আপনারাই তো জেনারেল মইনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের একজন স্টাফের সাথে ক'দিন আগে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, দেখুন, আমি চাকরি করি। কোনো রাজনৈতিক দল করি না। আমি জানতে চাইলাম, আপনি তো বিএনপির মঞ্চেও ভাষণ দেন। তিনি উত্তর দিলেন, মেহমান হিসেবে উপস্থিত থাকি। এ ধরনের বহু লোক বিএনপি চেয়ারপারসনের চার দিকে বেষ্টন করে আছেন।
আওয়ামী লীগে আমার বহু বন্ধু আছে। তারা বলেন, এটা বঙ্গবন্ধুর দল, তাই এ দলে আছি। ছাত্রলীগে ছিলাম এখন আওয়ামী লীগে আছি। এটা একটা ধারাবাহিকতা। আওয়ামী রাজনীতির গভীরে কখনো যাইনি। এর আদর্শ বা দর্শন কী তা নিয়ে খুব একটা ভাবিনি। ভাবার প্রয়োজনও করিনি। যখন বলি, দেশের ৯৯ ভাগ হিন্দু আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে কেন? উত্তরে তারা বলেন, তারা হয়তো মনে করে আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী। হিন্দুদের সাথে ভারতের কী সম্পর্ক? পাকিস্তান আমলে না হয় ভারতপন্থী ছিল, এখনো কেন? এ দেশে তো তারা কম সুবিধা পান না। সংখ্যার দিক থেকে যা সুবিধা পাওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় বিশ ভাগ সুবিধা ভোগ করছেন। ভারতের মুসলমানেরা পঁচিশ ভাগ হয়েও মাত্র এক ভাগ সুবিধা পায়। এ বিষয়টা কি আপনারা কখনো চিন্তা করেছেন? ওভাবে চিন্তা করলে আমরা দলে থাকতে পারব না। আমাদের জ্ঞান গম্যি সাধনা সবই হলো আওয়ামী বিরোধী রাজনীতি ও দর্শনকে বিনাশ করা। আমরা মনে করি, আমরা স্বাধীনতা এনেছি, আমরাই দেশ চালাব। আমরাই একমাত্র দেশপ্রেমিক দল। আমরাই স্বাধীনতার সপরে দল, বাকিরা সবাই স্বাধীনতাবিরোধী। এটাই আমাদের ধ্যান-ধারণা। এর বাইরে আমরা চিন্তা করি না। আমাদের নেতা-নেত্রী যে ভাষায় কথা বলেন আমরা সে ভাষাতেই কথা বলি। আমাদের নেত্রী দূরদর্শী, তিনি জানেন ভারতের সাথে দ্বিমত করে মতায় থাকা যাবে না। তিনি মনে করেনÑ এটা ভারতের পে থাকা নয়, বরং সমঝোতার মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নেয়া। তিনি জানেন, তা না হলে নেপালের অবস্থা হবে, যেমন হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অবস্থা। অমন জনপ্রিয় নেতা এ দেশে আর জন্মগ্রহণ করবেন না।
দেখো, আমি দেশের পে কথা বলি বলে আমাকে বিএনপি বা জামায়াতপন্থী বলা হয়। আমি নাকি স্বাধীনতার সপরে শক্তি নই। এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেই চলবে না, 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'ও থাকতে হবে। তারা জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের দালাল বলে। খালেদা জিয়াকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলে। লন্ডনে তারেক জিয়া কী বলেছে তা নিয়ে এখন আওয়ামী নেতাদের ঘুম নেই। রাত-দিন খিস্তি খেউর করে চলেছে। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, রাজনীতি থেকে সভ্যতা ভব্যতা চির বিদায় নিতে চলেছে।
এত গেল রাজনীতি ও সংস্কৃতির অবস্থা। ক'দিন আগে বাঙালির ধর্মচিন্তা নামে একটি বইয়ের আলোচনা বৈঠকে গিয়েছিলাম। বইয়ের প্রকাশক সাইদ বারী আমার খুবই প্রিয় মানুষ। বইটি সম্পাদনা করেছেন ডক্টর আবদুল হাই। তিনিও বিনীত ভদ্রলোক। আলোচনায় অনেক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। আমি শিক ও জ্ঞানীদের ঢঙে কথা বলতে পারি না। আমার সে রকম প্রশিণ নেই। বইটির ভূমিকা আমার ভালো লেগেছে। আলোচকদের বক্তব্যও ভালো ছিল। বইটিতে যেসব লেখা সঙ্কলিত হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই ধর্মহীনতার দিকে ঝোঁক রয়েছে। সঙ্কলক বা সম্পাদক বলেছেন, ধর্মের পে তেমন ভালো লেখা পাননি। আমি মনে করি, ধর্ম না মানা বা ধর্মহীন থাকা কোনো অপরাধ নয়। এটা একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলাটা ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করি না। ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে ধর্মচর্চা করা পে থেকে বা বিপে থেকে। একজন ধার্মিকেরও উচিত হবে না অধার্মিকের বিরুদ্ধে কথা বলা। যারা ধর্ম মানেন না তাদের সংখ্যা জগতে অতি নগণ্য। আবার এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের লোককে গালমন্দ করাও উচিত নয়। সব ধর্মই এক আল্লাহ/খোদা/ ঈশ্বর/ভগবান/গড/ ইলাতে বিশ্বাস করেন। ঈশ্বর নিরাকার এ কথাও সবাই স্বীকার করেন। তিনি সর্ব অবস্থায় সর্বত্র বিরাজমান। শুধু ধর্ম কর্ম সম্পাদনের সময় বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন। শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন, 'যত মত তত পথ। কিন্তু ল্য এক।' সবাই স্বীকার করেন মানুষই স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। বইয়ের নামকরণ নিয়ে সবাই আপত্তি করেছেন। ভারতীয় বাংলায় বাঙালি বলতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীকেই বোঝায়। আর বাংলাদেশের নাগরিকদের অফিসিয়াল স্বীকৃতি হলো বাংলাদেশী। এখানে ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। বাকি ১০ ভাগ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ভৌগোলিক এবং ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মীয় আচারের প্রভাব রয়েছে। শুধু বাঙালি বলা হলেও ভারতীয় বাঙালির সাথে চিন্তাচেতনায় বিশাল ব্যবধান রয়েছে। সম্প্রতি সেকুলারিজম শব্দটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার একটা প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে সেকুলারিজমের অর্থ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কুচেষ্টা চলছে। এটা এক ধরনের ভণ্ডামি। সেকুলার শব্দের অর্থ ধর্মহীনতা। যিনি বা যারা ধর্মীয় শিা দীায় বিশ্বাস করেন না। পরকালেও বিশ্বাস করেন না। জগৎই তাদের কাছে প্রধান। এ কথাটি তারা প্রকাশ্যে সরাসরি বলতে চান না। আরেক গ্রুপ বেরিয়েছে যারা বলে, ধর্মীয় ইসলাম আর রাজনৈতিক ইসলাম এক নয়। এরাও আসলে ইসলামবিরোধী একটা গ্রুপ। আরো এক গ্রুপ আছে, যারা বলেন ধর্ম ব্যক্তিগত ও ঘরের ব্যাপার। একে বাইরে আনা যাবে না। হয়তো এক দিন শুনব এমনকি মসজিদও রাখা যাবে না। এমনকি জুমার নামাজও পড়া যাবে না। যদি পড়া হয়, তাহলে খুতবা কী হবে তা ঠিক করে দেবে সরকার।
ভারতও চায় বাংলাদেশ একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মহীন রাষ্ট্রে পরিণত হোক। রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ধর্ম হবে একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রাকে ধর্মমুক্ত বা ধর্মহীন রাখার একটা চেষ্টা চলছে।
কবি, ঐতিহ্য গবেষক
www.humannewspaper.wordpress.com
__._,_.___