Banner Advertise

Friday, March 14, 2014

[chottala.com] জিন্নাহ নয় দ্বিজাতিতত্ত্বের মূল উদ্ভাবক হিন্দু মহাসভা



জিন্নাহ নয় দ্বিজাতিতত্ত্বের মূল উদ্ভাবক হিন্দু মহাসভা

ই ব রা হি ম র হ মা ন
আধুনিক জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে দ্বিজাতিতত্ত্ব একটি নতুন সংযোজন। একক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পৃথিবীতে বহু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে দাবিকৃত একটি বৃহত্ জাতিকে নতুন স্লোগান দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত করা সারা পৃথিবীতে একটিই নজির। এই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে '৪৭ সালে বহু জাতির সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্রকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়। বৃহত্ ভারতীয় উপমহাদেশকে এই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত করায় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত জন্মলাভ করে। এই দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পাকিস্তান ভেঙে আরেকটি রাষ্ট্র জন্মলাভ করে, তার নাম বাংলাদেশ। যে যাই বলুক না কেন বাংলাদেশ দ্বিজাতিতত্ত্বেরই অনিবার্য ফসল বা পরিণতি।
সবাই জানেন, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভাবক। অর্থাত্ জিন্নাহ উদ্ভাবিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশে দুটি রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। কারও কারও বিশ্বাস অনুযায়ী এ দুটি রাষ্ট্রের জন্মই বৃথা বা ভুল।
১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠিত হলে অবহেলিত মুসলমানরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। ঢাকাকে রাজধানী করায় পূর্ববঙ্গের অবহেলিত মুসলমানদের ভাগ্যোন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরি হয়। ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। নতুন প্রদেশে ভাগ্য গড়ার লক্ষ্যে নওয়াব সলিমুল্লার নেতৃত্বে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের স্বীয় স্বার্থ সম্পর্কে সচেতনতা ও ঐক্য গড়ে উঠলে কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু জমিদারদের স্বার্থে আঘাত লাগে। হিন্দু জমিদাররা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। সেদিনও কিছু কিছু মুসলমান নিজেদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে হিন্দু জমিদারদের পক্ষ নেয়।
বর্তমানে যারা দ্বিজাতিতত্ত্বকে অস্বীকার করেন, তাদের পূর্বসূরিরা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছিলেন। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ '৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার পরিণতি।
যারা দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করে না, তাদের এবং তাদের দোসরদের বিশ্বাস কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহই তাদের ভাষায় বিভেদকারী দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভাবক ও উদগাতা। তাদের বিরোধিতার অন্যতম কারণও তা-ই। তারা যদি জানত জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের উদগাতা নন, তাহলে হয়তো তারা এভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করত না। তারা যদি জানত, দ্বিজাতিতত্ত্বের মূল উদগাতা হিন্দু মহাসভা বা হিন্দুরাই, তাহলে হয়তো তাদের এই মতিভ্রম হতো না।
হিন্দু মহাসভার দ্বিজাতিতত্ত্ব
হিন্দু মহাসভার নেতাদের বক্তব্য থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণ হয়, তারা হিন্দু-মুসলমানের একজাতিত্বে বিশ্বাস করে না। হিন্দু-মুসলমান দুটি আলাদা জাতি বলে তারা দাবি করল। ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে তার সভাপতি সাভারকার পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করলেন, 'ভারতবর্ষকে আজ আর এক, অবিভাজ্য ও সুসংহত জাতি মনে করা যায় না। এদেশে প্রধানত দুটি জাতি হিন্দু ও মুসলমান।' (রাম গোপাল, সমগ্রন্থ, ২৬৪ পৃ.)। ১৯৩৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মহাসভার সম্মেলনেও তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা আরও জোর দিয়ে উল্লেখ করেন। দু'জাতির কথা সাভারকার বললেও অবশ্য ভারতবিভক্তির কথা তিনি বলেননি। এখানে প্রণিধানযোগ্য, দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের সময় জিন্নাহ বললেও আসলে অনেক আগেই হিন্দু মহাসভার সভাপতি সাভারকার হিন্দু-মুসলমান দুটি আলাদা জাতি ও দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা খোলাখুলিভাবে উল্লেখ করেছিলেন। তাই দেখা যাচ্ছে, ভারত বিভাগের ভিত্তি যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার উদগাতা জিন্নাহ নন, হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকার।
হিন্দু মহাসভা নেতারা ঘোরপ্যাঁচের তোয়াক্কা না করে সোজাসুজি এ বাস্তব সত্যকে প্রকাশ করেছেন। ভারত উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমান যে দুটি আলাদা জাতি, এ কথা সাভারকারের বহু আগে বাংলার অনেক বিখ্যাত হিন্দু নেতা স্বীকার করতেন। প্রখ্যাত মুসলিম লেখিকা কাজী জাহান আরা তার বার্ষিকীতে একটি বাণী চেয়ে তত্কালীন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে যখন অনুরোধ জানিয়ে পত্র লেখেন, তখন শরত্বাবু ১৯১৬ সালে সামতাবেড়িয়া থেকে কাজী জাহান আরাকে লিখে পাঠান, 'ভারতের হিন্দু-মুসলমান দুই বৃহত্ জাতি বহুদিন যাবত্ পাশাপাশি বাস করছে। তাদের মধ্যে বাইরে লেনদেন অনেক হয়েছে, কিন্তু অন্তরের লেনদেন হয়নি। সেই লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব আমার ও তোমার।' শরত্বাবু সে সময় ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্বশীল হিন্দু নেতা। তাই তার মতামতকে গোটা শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের মতামত বলে ধরে নেয়া যায়। শুধু কাজী জাহান আরার কাছে চিঠিতেই যে শরত্বাবু এই উক্তি করেছিলেন তা নয়, ১৯১২ সালে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর কলকাতায় রবীন্দ্রনাথকে যে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল, সে সভার সভাপতি হিসেবে শরত্বাবু রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, 'আমি আপনাকে ভারতের মহান হিন্দু জাতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।'
উপরোক্ত দুটো ঘটনা ছাড়াও অধ্যাপক কাজী আবদুল ওয়াদুদকে লেখা শরত্বাবুর আরও একটি চিঠির অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। চিঠিটিতে ১৯১৮ সালের ২০ মার্চ শরত্বাবু লিখেছিলেন, কাজী আবদুল ওয়াদুদকে তার 'মীর পরিবার' বই সম্পর্কে : 'আপনার রচনার মধ্যে যে উর্দু কথা ব্যবহার করিয়াছেন সে ভালই হইয়াছে। তা না হইলে মুসলমান পাঠক-পাঠিকা কখনই ইহাকে নিজেদের মাতৃভাষা বলিয়া অসংকোচে গ্রহণ করিতে পারিত না। তাহাদের কেবলই মনে হইত ইহা হিন্দুদের ভাষা, আমাদের নয়। পাশাপাশি দুই জাতির মধ্যে সাহিত্যের সংযোগসাধনের বোধ করি ইহাই সবচেয়ে ভাল উপায়। অবশ্য সকল সাহিত্যিকই এই মতের সপক্ষে নয়, কিন্তু আমি নিজে এরূপ রচনারই পক্ষপাতী।'
হিন্দু মহাসভা নেতাদের তত্কালীন মুসলমানদের প্রতি কী ধরনের বিদ্বেষ ও শত্রুতামূলক মনোভাব ছিল, তার কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায় প্রখ্যাত কলামিস্ট মরহুম আবু জাফর শামসুদ্দিনের লেখা 'মুসলিম সমাজের ঝড়ো পাখি বেনজীর আহমদ' বইতে। তিনি লিখেছেন : 'কাচারীর বিপরীত দিকে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের বিরাট প্রাঙ্গণ। সেখানে বিশাল চন্দ্রাতপের নিচে নিখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার সম্মেলন হচ্ছে। খুব সম্ভব ১৯২৮ সালের অথবা ১৯২৯ সালের প্রথম দিককার কথা, ঠিক মনে করতে পারছি না। সম্মেলন উপলক্ষে শহরে জোর প্রচার চলছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগে লাগে অবস্থা। স্মরণীয় যে, ঢাকা শহর ইতিপূর্বেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। প্রচারপত্র এবং ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের গেটে ঝুলন্ত ব্যানারে দেখলাম, নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার নেতা ডক্টর মুঞ্জে এবং এনসি কেলেকার সভায় বক্তৃতা দেবেন। সম্মেলনে বিধর্মীর প্রবেশ নিষিদ্ধ। বেনজীর সাহেব সর্বক্ষণ ধুতি-শার্ট পরতেন। আমাকে বললেন, ধুতি পরে চলুন, ওরা কী বলে শুনে আসি। আমি মাদ্রাসার ছাত্র, ধুতি ছিল না। বাবা নিজে সাদা তহবন, সাদা পাঞ্জাবি এবং সাদা টুপি পরতেন, আমাদের ধুতি কিনে দিতেন না। এক বন্ধুর কাছ থেকে ধুতি জোগাড় করলাম। বিকেলে দু'জনে গেলাম সভায়। ডক্টর মুঞ্জে এবং এনসি কেলেকার উভয়েই উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী বক্তৃতা করলেন। দু'জনের মধ্যে কোন জন, আজ এতকাল পরে ঠিক মনে করতে পারছি না। কিন্তু দু'জনেরই একজন বলেছিলেন যে, মুসলমানরা যদি এদেশে থাকতে চায়, তাহলে হিন্দু জাতির সঙ্গে লীন হয়ে থাকতে হবে, নতুবা সাতশ' বছর বসবাসের পর মুসলমানরা স্পেন হতে যেভাবে বিতাড়িত হয়েছিল, আমরাও তাদেরকে সেভাবেই আরব সাগর পার করে দেবো। তখন পাঞ্জাবে জোর শুদ্ধি আন্দোলন চলছিল। স্বামী দয়ানন্দ ছিলেন আর্যসমাজ ও শুদ্ধি আন্দোলনের নেতা। দয়ানন্দের মৃত্যুর পর স্বামী শ্রদ্ধানন্দ সেই আন্দোলনের নেতা হন। ১৯২৬ সালে আবদুর রশীদ নামক এক ব্যক্তির ছুরিকাঘাতে তিনি নিহত হলে হিন্দু মুসলিম সমস্যার দারুণ অবনতি ঘটে। ঢাকা এবং কলকাতায় দাঙ্গা হয়। বলা বাহুল্য, ওই বক্তৃতা শুনে বেনজীর সাহেব এবং আমি খুবই ক্ষুব্ধ হই। আমরা সভা শেষ হওয়ার আগেই করোনেশন পার্কে চলে যাই। ফিরে আসার সময় ভিকটোরিয়া পার্কের কাছে পৌঁছে দেখি আতঙ্কগ্রস্ত লোকজনের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে গিয়েছিল কিনা আজ আর তা মনে করতে পারছি না।' (মুসলিম সমাজের ঝড়ো পাখী, বেনজীর আহমদ, পৃষ্ঠা-২২)।
উপরোক্ত লেখা থেকে সেই ১৯২৭/২৮ সালে মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু নেতাদের এসব বক্তব্যই নিঃসন্দেহে এককালীন হিন্দু-মুসলমান মিলনের রাজদূত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে হিন্দু-মুসলমান মিলনের চরম অবিশ্বাসী করে তোলে। ভারতে হিন্দু-মুসলমান দুটি পৃথক সম্প্রদায় নয়, দুটি আলাদা জাতি। হিন্দু মহাসভা নেতাদের এই বিশ্লেষণ জিন্নাহর চিন্তাধারাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে, যেভাবে সম্ভবত প্রভাবিত করেছিল অনেক আগে কবি ইকবালকে। দার্শনিক কবি ইকবাল ১৯৩৪/৩৫-এর দিকে ভারতের পশ্চিম অংশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছিলেন। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে তার কল্পনার কথা ৩০ দশকের প্রথম দিক থেকেই বলে আসছিলেন, কিন্তু জিন্নাহ সে সময় ইকবালের কথায় তেমন গুরুত্ব দেননি। ১৯৩৭ সালের পর থেকে সম্ভবত জিন্নাহ হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে পৃথক জাতির জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজনীয়তার কথা সবিশেষ গুরুত্বসহ চিন্তা করতে আরম্ভ করেন। তার মনোজগতে এ চিন্তা আসার পেছনে হিন্দু মহাসভার নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি যে অনেকখানি কাজ করেছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে তিনি খুবই অপছন্দ করতেন ঘটনাক্রমে নিয়তির নির্মম বিধানে সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে তাকে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়তে হলো। অবশ্য তখন তার চোখে মুসলমানরা আর একটি সম্প্রদায় নয়, একটি জাতি এবং তিনি যেন একটি জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে মনে করতেন।
কংগ্রেস মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পর 'নাজাত দিবস' পালন শেষে মুসলিম সম্প্রদায়ের মনোভাব দ্রুত পরিবর্তন হলো। এতদিনকার পরিচয় ধর্মাবলম্বী হিসেবে মুসলমান, কিন্তু জাতি হিসেবে ভারতীয় পরিচয় থেকে ধর্মাবলম্বী হিসেবে মুসলমান এবং জাতি হিসেবেও মুসলমান—এই পরিচয়ে মুসলমানরা নিজেদের অভিহিত করতে লাগল। গান্ধী মুসলমানদের এই মানসিক ভাবধারার পরিবর্তনে বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। তার পরামর্শে মুসলমানদের মনোভাবকে প্রভাবিত করার জন্য ১৯৪০ সালে মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে কংগ্রেসের সভাপতি করা হয়। জিন্নাহকে খুশি করার জন্য গান্ধী এক চিঠিতে তাকে কায়েদে আজম বলে সম্বোধন করেন।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব
১৯৪০ সালের মার্চ মাসে লাহোরে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানরা যে একটি আলাদা জাতি এ দাবি প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করে বললেন, ভারতে উত্তর-পশ্চিমে ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের দাবি পূরণ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থাতেই তিনি রাজি হবেন না। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগের সভাপতি এ কে ফজলুল হক।
৬০ হাজার ডেলিগেটের সামনে জিন্নাহ সেদিন দু'ঘণ্টা ধরে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা ছিল যেমনই হৃদয়গ্রাহী যুক্তিজালে সমর্থিত, চিত্তাকর্ষক, তেমনই ছিল আবেগময় ও প্রাণস্পর্শী। বক্তৃতার প্রথম দিকে খানিকটা উর্দু থাকলেও পরের সম্পূর্ণ অংশ ছিল ইংরেজিতে। শ্রোতৃমণ্ডলী তার বক্তৃতার অধিকাংশ না বুঝলেও মন্ত্রমুগ্ধের মতো দু'ঘণ্টা ধরে তার বক্তৃতা শুনছিল এবং মাঝে মাঝে সোল্লাশে হাততালি দিচ্ছিল।
তিনি তার বক্তৃতায় বললেন, 'হিন্দু-মুসলমান সমস্যা আর ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ প্রশ্ন বা সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর ব্যাপার নয়, এই বিবাদকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করে তিনি ঘোষণা করলেন, 'ভারতবর্ষের সমস্যা আন্তঃসাম্প্রদায়িক নয়। এটা আন্তর্জাতিক চরিত্রের এবং অবশ্যম্ভাবী রূপে একে তদনুরূপ বিবেচনা করতে হবে। এই মৌলিক সত্য উপলব্ধি না করা পর্যন্ত যে সংবিধানই রচনা করা হোক না কেন তা এক দুর্বিপাকেরই সৃষ্টি করবে। তা কেবল মুসলমানদের পক্ষেই ধ্বংসাত্মক এবং ক্ষতিকারক বলে প্রতিপন্ন হবে না, ব্রিটিশ ও হিন্দুদের ওপরও তার একই পরিণাম হবে। ব্রিটিশ সরকার যদি এই উপমহাদেশের অধিবাসীদের শান্তি ও সুখের জন্য যথার্থই আন্তরিকতাসম্পন্ন হন, তাহলে আমাদের সকলের সামনে যে একমাত্র পথ খোলা আছে, তা হলো ভারতবর্ষকে 'স্বয়ংশাসিত জাতীয় রাষ্ট্র' হিসেবে বিভক্ত করে বিভিন্ন জাতিগুলোকে (ঘধঃরড়হং) পৃথক পৃথক বাসভূমি পেতে দেওয়া।'
আগে যেমন বলা হয়েছে, এর অনুসরণে ২৩ মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ভারত বিভক্তি সম্পর্কে নিম্নোক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে : 'নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এই অধিবেশনের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, নিম্নোক্ত মূলনীতি অনুযায়ী না হলে কোনো সাংবিধানিক পরিকল্পনা এদেশে কার্যকরী হবে না বা মুসলমানদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে না। এই মূল নীতি হলো ভৌগোলিক দিক থেকে পরস্পর সমন্বিত এলাকাসমূহকে প্রয়োজনীয় আঞ্চলিক ব্যবস্থাপিতকরণের (জবধফলঁংঃসবহঃ) সহায়তায় এমনভাবে পৃথক পৃথক এলাকায় পরিণত করতে হবে, যেন ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মত যেসব এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেগুলোকে একত্র করে 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ (ঝঃধঃবং) গঠন করা সম্ভব হয়, যার অঙ্গীভূত এলাকাসমূহ স্বয়ংশাসিত ও সার্বভৌম হবে।'
এইভাবে মুসলমান জাতির জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবি উপস্থাপিত করে একদিকে জিন্নাহ যেমন তার অনুগামীদের চোখে পাকিস্তানের জনক ঐতিহাসিক পুরুষে পরিণত হয়েছেন, অন্যদিকে তার সমালোচকদের দৃষ্টিতে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবলতম প্রবক্তারূপে পরিগণিত হলেন।
সভাপতির ভাষণে জিন্নাহ বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেন, মুসলমানরা সংখ্যালঘু নয়। যে কোনো সংখ্যা অনুযায়ী মুসলমানরা এক জাতি। ...ভারতের সমস্যা আন্তঃসাম্প্রদায়িক ধরনের নয়, বরং তা স্পষ্টত আন্তর্জাতিক ধরনের এবং অনুরূপভাবেই তা বিবেচনা করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট


__._,_.___


[* Moderator�s Note - CHOTTALA is a non-profit, non-religious, non-political and non-discriminatory organization.

* Disclaimer: Any posting to the CHOTTALA are the opinion of the author. Authors of the messages to the CHOTTALA are responsible for the accuracy of their information and the conformance of their material with applicable copyright and other laws. Many people will read your post, and it will be archived for a very long time. The act of posting to the CHOTTALA indicates the subscriber's agreement to accept the adjudications of the moderator]





__,_._,___