ফাঁসির রায়ের রাজনীতি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া
বিচিন্তা
মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০১৩, ০৩:৫২ অপরাহ্ন
সাদেক খান প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট
রমজানের ঈদের পর যখন হজব্রতীদের যাত্রা সুগম করার তাগিদে রাজপথের রাজনৈতিক উত্তেজনা অপোকৃত শান্ত হয়ে আসছিল, আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে মতারার প বনাম মতা পুনরুদ্ধারের প উভয়েই যখন প্রচারযুদ্ধ আর সাড়ম্বর গণসংযোগে নিবিড়ভাবে ব্যাপৃত; তখন ১৭ সেপ্টেম্বর একটা কালবৈশাখীর মতো হঠাৎ ব্যবচ্ছেদ ঘটাল উচ্চতম আপিল আদালতে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ বাড়িয়ে ফাঁসির রায়। আবার শুরু হলো সারা দেশে হরতাল বিােভের পালা, ধরপাকড় ভাঙচুর-আগুন-অবরোধ, মতাসীনদের মধ্য থেকে 'যুদ্ধাপরাধী' জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি, প্রায় একই সাথে শুরু হলো শ্রমিক অসন্তোষ, পোশাক তৈরির কারখানা বন্ধের হিড়িক, পোশাক শিল্পে শ্রমিক অস্থিরতা উসকে দিলেন সরকারেরই নৌমন্ত্রী। এ দেশের রফতানি শিল্পবাণিজ্যে দেখা দিলো চরম বিপর্যয়ের আশঙ্কা। সামাজিক বিশৃঙ্খলার বর্ধিত আলামত দেখা দিলো ভারতের পালিয়ে যাওয়া গডফাদারদের পরিচালনায় টেলিফোনসন্ত্রাস, রাপণ আদায়, অপহরণ বাণিজ্য, চুক্তিখুন আর ডাকাতি রাহাজানির অবাধ বিস্তারে। শিাঙ্গনে আবারো দানা বাঁধল উত্তাপ আর দলীয়-উপদলীয় দখলদারির রক্তাক্ত সঙ্ঘাত, পুলিশ ডাকাডাকি। আরো দেখা দিলো পলিটেকনিক ছাত্রগোষ্ঠীর দেশব্যাপী আন্দোলন, পুলিশের সাথে লড়াই। প্রাথমিক শিকদের স্কুলে তালা দেয়ার হুমকি। সচিবালয়েও দেখা দিলো বিশৃঙ্খলার আলামত, পদোন্নতি, বেতনভাতা ইত্যাদি নানা বিষয়ে জটিলতা ও অসন্তোষকে কেন্দ্র করে। এসব েেত্রই সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে নতুন যে বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে, পুলিশ একতরফা মার দিয়ে পার পাচ্ছে না, পাল্টা মার খাচ্ছে। আহত-নিহত হয়েছেন কয়েকজন। এসব যখন জোড়াতালি দিয়ে খানিকটা সামলে ওঠার লণ দেখা দিলো, তখন সরাসরি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ১ অক্টোবর আরেকটি ফাঁসির রায় ঘোষণা হলো। বিদ্যমান জাতীয় সংসদের অন্যতম বিরোধীদলীয় সদস্য, ছয়বার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে ৪২ বছর আগে তার ছাত্রাবস্থায় পিতৃগৃহে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালপ্রধান এ টি এম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। রায়ের আগে থেকেই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক নিবাসস্থল চট্টগ্রাম জেলা ছিল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনাপীড়িত। মোতায়েন ছিল সর্বত্র র্যাব-পুলিশের পাহারা। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় রায় ঘোষণার পরপরই মার্কেটগুলো বন্ধ হয়ে যায়, বেসরকারি শিাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। জনপ্রিয় নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে দেয়া রায় প্রত্যাখ্যান করে ২ অক্টোবর চট্টগ্রামে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে স্থানীয় বিএনপি। ১ অক্টোবর রায় ঘোষণার আগে সকাল থেকেই রাঙ্গুনিয়ায় সড়ক অবরোধ করে গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় বিএনপি ও সাকার কর্মী-সমর্থকেরা। রায় ঘোষণার পর মিরসরাইতে রেললাইনে আগুন দেয় তারা। হাটহাজারীতে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক অবরোধ করে ভাঙচুর চালায়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে দু'টি বাসে আগুন দেয়া হয়। রাজধানী ঢাকায়ও ১ অক্টোবর বেলা দেড়টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফকিরাপুল, বঙ্গবাজার ও বাবুবাজার এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ, ভাঙচুর এসব ঘটনা ঘটে। রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে দুপুরের পর রাজধানীর রাজপথ থেকে হঠাৎ করেই যানবাহন উধাও হয়ে যায়। ব্যস্ততম সড়কগুলোতে যানজটের পরিবর্তে দেখা দেয় যানবাহন সঙ্কট। অন্য দিকে ওই রায় থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে মতাসীন নয়া বাকশালী চক্রের পে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ দাবি করলেন, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে ওই দলটি (বিএনপি) যুদ্ধাপরাধের দল। সেই ফায়দার ধুয়া অবশ্য চাপা পড়ে গেল যখন দেখা গেল, স্কাইপ কেলেঙ্কারিতে ফাঁস হওয়া ট্রাইব্যুনাল-১-এর পদত্যাগী প্রধান বিচারকের প্রবাসী এক নয়া বাকশালী আইনজ্ঞের কাছে সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় লিখে দিতে বলার ঘটনার মতোই দেখা গেল সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার আগেই ইন্টারনেটে রায় ফাঁস হয়ে গেছে। ট্রাইব্যুনালে যখন রায় পড়া হচ্ছিল, তখন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কয়েকবার দাঁড়িয়ে বলেন, রায় তো অনলাইনে দেয়াই আছে। আর পড়ার দরকার কী। রায় ঘোষণার পর তার স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী সাংবাদিকদের রায়ের কপি দেখিয়ে বলেন, 'এই যে রায়ের কপি। আগেই আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে'। তার আগে রায় ঘোষণার দিন সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে আসামিপ থেকে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে একটি বুলেটিন বিতরণ করা হয়। তাতে ফাঁস হওয়া রায়ের সারমর্ম এবং কোথা থেকে এটি ফাঁস হয়েছে তার সূত্র তুলে ধরা হয়। বুলেটিনে এবং বেশ কয়েকটি সামাজিক মাধ্যমের ব্লগে দাবি করা হয়, ট্রাইব্যুনাল যে রায় ঘোষণা করেছে তার অনুলিপি আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হকের অফিসের কম্পিউটারে রতি ছিল। আইন মন্ত্রণালয়ের ছয় তলার একটি কম্পিউটারে 'ডি ড্রাইভে' এ রায়ের কপি পাওয়া যায়। এ রায়ের কপিটি যে ফাইলে পাওয়া গেছে তার প্রোপারটিস অপশনে গিয়ে তথ্য পাওয়া যায়, ডি ড্রাইভের 'আলম' নামে ফোল্ডারের সাব-ফোল্ডার 'ডিফারেন্ট কোর্টস অ্যান্ড পোস্ট ক্রিয়েশন'-এর মধ্যে আরেকটি সাব-ফোল্ডার 'ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল'। এই ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের মধ্যে আরেকটি ফোল্ডার 'চিফ প্রসিকিউটর-ওয়ার ট্রাইব্যুনাল'-এর মধ্যে রাখা রায়ের খসড়া কপিটির নাম ছিল 'সাকা ফাইনাল-১'। রায় লেখা চূড়ান্ত করার পর খসড়া কপিটির নাম 'সাকা-১' পরিবর্তন করে রাখা হয়, 'আইসিটি বিডি কেস নং ০২ অব ২০১১ (ডেলিভারি অব জাজমেন্ট) (ফাইনাল)'। আলম নামের যে ব্যক্তির কম্পিউটারে ফাইলটি পাওয়া গেছে, সেই আলম হলেন ভারপ্রাপ্ত (তখনকার) আইনসচিব আবু সালেহ শেখ মো: জহিরুল হকের কম্পিউটার অপারেটর। কম্পিউটারের তথ্যে দেখা যায়, আইন মন্ত্রণালয়ে ওই ফাইলটি তৈরি করা হয়েছে চলতি বছর ২৩ মে ১২টা ১ মিনিটে, যখন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন সাীর স্যাগ্রহণ চলছিল। বিচার শেষ হওয়ার আগেই ২৩ মে থেকে রায় লেখা শুরু করেছিল আইন মন্ত্রণালয়। ওই বুলেটিন হাতে পাওয়ার আগেই ওয়েবসাইট আর অনলাইন ঘাঁটা সাংবাদিকেরা আবিষ্কার করেছেন যে বেলজিয়ামভিত্তিক ট্রাইব্যুনাল লিকস নামের একটা ওয়েবসাইটে রায়সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হকের কম্পিউটার থেকে রায়ের কপিটি পাওয়া গেছে। তবে প্রকাশিত কপিতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে দণ্ডের জায়গাটি খালি। ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে একই খবর প্রকাশিত হয় বিডি টুমরো ব্লগসহ বেশ কিছু সামাজিক ওয়েবসাইটে। এরপর বেশ কয়েকটি অনলাইন মাধ্যম এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। রায় ঘোষণার পর দেখা যায় প্রকাশিত রায় ও ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায় মিলে গেছে। রায় ঘোষণার পরপরই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, তার ছেলে হুমাম কাদের চৌধুরী ও আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ট্রাইব্যুনালে একটু আগে যে রায় পড়ে শোনানো হলো সেটি আসলে আইন মন্ত্রণালয় থেকে লিখে পাঠানো হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা আইন মন্ত্রণালয়ের লেখা রায় পড়ে শুনিয়েছেন মাত্র। এটি তাদের রায় নয়। রায়ের ভারডিক্ট অংশ ছাড়া বাকি অংশ আইন মন্ত্রণালয়ের লেখা কপির সাথে হুবহু মিলে গেছে। আইন মন্ত্রণালয়ের লেখা রায় কিভাবে বিচারপতিরা পড়ে শোনাতে পারলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ফারহাত কাদের চৌধুরী। বলেন, ট্রাইব্যুনালের এ রায় ঘোষণা থেকে বিরত থাকা উচিত ছিল। এখানে জুডিশিয়াল কিলিং হচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি না কোথায় যাবো, কোথায় বিচার পাবো। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের প থেকে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ভবনের অডিটোরিয়ামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, 'বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে না। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই; কিন্তু তার অর্থ এই না যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন হবে সেই বিচারে। আমরা দেখতে পাচ্ছি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো ব্যক্তি, যার দালাল আইনে কোনো নাম ছিল না, দীর্ঘ ৪০ বছর পর তাকে এ মামলায় আসামি করা হয়। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী যুদ্ধকালে পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। তার পে একজন বিচারপতিকে সাফাই সাী দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল। তারও আগ্রহ ছিল সত্য কথা বলার; কিন্তু তাকে স্যা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। এ বিচার প্রহসনের বিচার। ইনশাআল্লাহ যদি জাতীয়তাবাদী শক্তি মতায় আসে, তা হলে সত্যিকার অর্থে যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের বিচার হবে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে নির্দোষ ব্যক্তিদের যে বিচার করা হয়েছে, কাল্পনিক গল্প দিয়ে যে মামলা তৈরি করা হয়েছে, অবশ্যই সেটি চলে যাবে। যারা এ প্রহসনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল, ইনশাআল্লাহ বাংলার মাটিতে তাদেরও বিচার হবে।' তাৎণিকভাবে অ্যাটর্নি জেনারেল ও ভারপ্রাপ্ত আইনসচিব দু'জনই জোরগলায় দাবি করেছিলেন যে ট্রাইব্যুনালের রায় আগেভাগে প্রকাশের প্রশ্নই ওঠে না; ওই রায়ের বা তার অনুলিপি প্রকাশের সাথে আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু পরদিন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে ট্রাইব্যুনাল-১-এর পে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার রায় ফাঁসের কথা 'আংশিক' স্বীকার করলেন। লিখিত বক্তব্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ আবিষ্কার করে তিনি বললেন, রায় প্রকাশের পর দেখা যায় কথিত 'লিকড' রায়ের খসড়ার সাথে ঘোষিত রায়ের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে; কিন্তু এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার জন্য প্রস্তুত করা রায় নয়। আপনারা ল করবেন যে, ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত রায়ে অনুচ্ছেদ নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। পান্তরে, কথিত 'লিকড' খসড়া রায়ে কোনো অনুচ্ছেদ নম্বর নেই। এটি নিতান্তই একটি খসড়া, যা রায় ঘোষণার অনেক আগেই কোনো-না-কোনোভাবে 'লিকড' হয়েছে। খসড়াপর্যায়ে 'লিকড' হওয়া খসড়াটি রায় ঘোষণার বেশ কয়েক দিন আগেই দুষ্টচক্রের হাতে পড়েছে বলে অনুমান করা যায়। সার্বিক বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে যে কথিত খসড়া রায় ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটারে কম্পোজ করার পর তা 'লিকড' হয়েছে। বিষয়টি উদঘাটনের ল্েয ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশক্রমে থানায় জিডি করা হয়েছে। আমরা আশা করি, সত্য বেরিয়ে আসবে এবং এ ষড়যন্ত্রের সাথে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা যাবে। ট্রাইব্যুনালে কর্মরত কেউ যদি এ অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত থাকেন, তবে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। "রায়ের দিন ট্রাইব্যুনালে আসার পর সাকা চৌধুরীর পরে আইনজীবীর দায়িত্ব ছিল আগের রাতে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে রায় প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নজরে আনা; কিন্তু তারা তা না করে রায় ঘোষণার পর কথিত রায়ের হার্ডকপি মিডিয়ার সামনে দেখিয়ে দাবি করেন, রায় আগেই 'লিকড' (ফাঁস) হয়েছে; এটি আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটারে আছে এবং এটি একটি 'ডিকটেটেড রায়'। অভিযুক্তের আইনজীবীর এমন উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য অসদাচরণ বটে। নিঃসন্দেহে রায় ঘোষণার পর এমন দাবি করা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চক্রান্তের একটি অংশ।" থানার সাধারণ ডায়েরিতে দেখা যায়, ঘটনার বিবরণ দিয়ে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার উপসংহারে লিখেছেনÑ 'আদালত থেকে প্রচারিত রায় এবং ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত রায়ের মধ্যে মিল আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রচারিত সব রায় ট্রাইব্যুনালেই প্রস্তুত করা হয়। রায় ঘোষণার আগে রায়ের কোনো অংশের কপি অন্য কোনোভাবে প্রকাশের সুযোগ নেই; কিন্তু তার পরও কথিত খসড়া রায়ের অংশ কিভাবে ইন্টারনেটে প্রচারিত হলো বা কিভাবে ট্রাইব্যুনাল থেকে খসড়া রায়ের অংশবিশেষ ফাঁস হলো, তা উদ্বেগের বিষয়। বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। উল্লেখ্য, (ট্রাইব্যুনাল লিকস.বি) ওয়েবসাইটে কথিত খসড়া রায়ের অংশ আপলোডেড দেখা যায়। এমতাবস্থায় বিষয়টি তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।' এ দিকে রায় সম্পর্কে বার কাউন্সিলের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যানের মন্তব্য নিয়ে বার কাউন্সিলের সরকার নিযুক্ত চেয়ারম্যান তথা অ্যাটর্নি জেনারেল সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ করেনÑ 'সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, এ বিচারের সাথে যারা জড়িত তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে। মাই লর্ড এ বিচারের সাথে আপনারাও জড়িত। ফলে এ বক্তব্যের মাধ্যমে আপনাদেরও বোঝানো হয়েছে। তিনি এই কোর্টের একজন অফিসার হয়ে এ ধরনের কথা বলতে পারেন কি না?' আপিল আদালতের বিচারপতিরা বললেনÑ 'আমরা কিছু দেখি নাই, শুনি নাই। আমাদের সামনে ঘটনা ঘটেনি। আমাদের সামনে আছে শুধু পেপার বুক। তা দেখে আমরা বিচার করি। আপনারা প্রপার জায়গায় যান।' সুপ্রিম কোর্টের এ মন্তব্যের পর সরকারপ আর এ নিয়ে অগ্রসর হয়নি। তবে আইন প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, 'অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আইনের শাসনের জন্য হুমকি ও আদালত অবমাননার শামিল। তাঁকে অবিলম্বে তাঁর এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানাচ্ছি।' তবে 'প্রপার জায়গা' তথা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে 'আকেলমন্দ' প্রসিকিউটরদের জন্য এসব 'ইশারাই কাফি' ছিল। যুদ্ধাপরাধ মামলাগুলোর জন্য নিযুক্ত চিফ প্রসিকিউটর বা রাষ্ট্রপরে প্রধান উকিল গোলাম আরিফ টিপু ৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল-১-এর আদালতে বার কাউন্সিলের অন্যতম শীর্ষ পদাধিকারী খন্দকার মাহবুব হোসেনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা ঠুকে দিয়েছেন। তার শুনানি করে ট্রাইব্যুনাল-১-এর প্রধান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ৬ অক্টোবর মামলা আমলে নেয়ার রুল বা আদেশের তারিখ দিয়েছেন। বার কাউন্সিল নেতার এ অসম্মান ও 'সাজানো' রায়ের আলামতের আলোচনা-সমালোচনাকে আদালত অবমাননা বলে বিবেকের কণ্ঠরোধের হীন প্রয়াসের নিন্দা করে সুপ্রিম কোর্টের তরুণ আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গণে বিােভ সমাবেশ করেছেন। বিদেশে যুক্তরাজ্যে ও যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমে 'যুদ্ধাপরাধের ত্র"টিপূর্ণ বিচার' ও 'বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল' সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য এসেছে। স্কাইপ কেলেঙ্কারির তথ্য 'জনস্বার্থে' প্রকাশের দায়ে বৈদেশিক পত্রিকার সম্পাদকের কৈফিয়ত ট্রাইব্যুনাল তলব করেছিলেন, জবাব পেয়ে চুপ করে গেছেন বলে ধারণা করছেন আদালতপাড়ার সাংবাদিকেরা। প্রকাশিত সেই সংবাদ পুনঃপ্রকাশের দায়ে জব্দ করা হয়েছে এ দেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিক আমার দেশ; তার সম্পাদককে মামলা দিয়ে জামিন না দিয়ে জেলে আটক রাখা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। প্রতিকার নেই। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সনদ ও সুবিচারের আন্তর্জাতিকমানের বরখেলাপ হচ্ছে বাংলাদেশে, মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন করে চলেছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং তার প্রতিকারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তপে প্রয়োজন, এ মর্মে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধানকে চিঠি দিয়েছেন বিলেতের বিচারক মর্যাদার যুদ্ধাপরাধ বিশারদ রাজপ্রতিনিধি লর্ড কার্লাইল। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারপ্রক্রিয়া ও রায় প্রদানে নির্বাহী মন্ত্রণালয়ের হস্তেেপর অভিযোগের যথাযথ তদন্ত দাবি করে তিনি আবারো বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ত্র"টিপূর্ণ বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ট্রাইব্যুনালের রায় ফাঁস হওয়ার মামলায় তদন্ত পুলিশ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কৌঁসুলির কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে কম্পিউটার ও সিডি জব্দ করেছে, সাকা চৌধুরীর দুই ম্যানেজারের কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়েছে ট্রাইব্যুনালের 'সর্ষের মধ্যে ভূত' এ কথা বলে কেবল ট্রাইব্যুনালের ঝাড়ুদার নয়ন ও কর্মচারী ফারুককে গ্রেফতার করেছে, রহস্যোদ্ধার হয়নি। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের তরফে বলা হয়েছে, রায়ের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়ায় শেষ সুযোগ নিতে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল আবেদন করা হবে, তবে ন্যায়বিচার পাবেন বলে ভরসা পাচ্ছেন না তারা। এসব আইনি কিংবা নিম-আইনি কথাবার্তা কার্যকলাপের মধ্যে সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে ২ অক্টোবর সর্বাত্মক হরতালে সকাল-সন্ধ্যা বন্দরনগরীসহ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিক জীবন অচল করে দিয়েছিল বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিএনপি নেতৃত্ব। তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেশব্যাপী কোনো হরতালের কর্মসূচি দেয়নি। ২ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায়ের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বিএনপির তরফে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, 'এই ট্রাইব্যুনাল গঠন ও তার বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকপর্যায়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি মনে করে, মানবতাবিরোধী বিচারের নামে সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপকে নির্মূলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের অপচেষ্টা করছে মতাসীন দল।' প্রতিবাদে ৩ অক্টোবর সারা দেশের জেলা ও থানায় বিােভ সমাবেশের কর্মসূচি এবং রাজধানী ঢাকা মহানগরের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেলা ৩টায় জনসমাবেশ করেছে বিএনপি। ওয়াকিবহাল মহলের খবর : বিএনপি মনে করে একের পর এক যুদ্ধাপরাধের বিচারে ফাঁসির রায় দিয়ে মতাসীন নব্য বাকশালী চক্র যে 'উসকানি' দিয়ে চলেছে, তার পেছনে একটা কৌশলগত মতলব আছে। সেই 'উসকানির' ফাঁদে পা না দিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে একটানে সরকার পতনের অভ্যুত্থান ঘটানোর সঙ্কল্পে অবিচল থাকতে চায় বিএনপি। দফায় দফায় ধরপাকড় মামলা হামলার শিকার হয়ে সেই পরিকল্পিত অভ্যুত্থানের শক্তি য় করতে নারাজ বিএনপি নেতারা। ৫ অক্টোবর সিলেটে মহাসমাবেশ থেকে 'একদলীয় নির্বাচন রুখতে' প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে জনতার সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে গণঐক্যের ডাক দিয়েছেন ১৮ দলীয় জোটনেত্রী খালেদা জিয়া। আর ওয়াদা পূরণের প্রয়োজনে আবারো তাকে মতায় বসানোর জন্য ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন শেখ হাসিনা; বলছেন বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত দেশের ও ইসলামের শত্র"। অনিবার্য সঙ্ঘাতের দিকে এগিয়ে চলেছে এ দেশের রাজনীতি।
__._,_.___