Banner Advertise

Tuesday, September 24, 2013

[chottala.com] আমার বাবা—আমার প্রেরণার বাতিঘর



আমার বাবা—আমার প্রেরণার বাতিঘর

এম আ ব দু ল্লা হ
১৮২৬ সালে ব্রিটিশ কবি ফেলিসিয়া হেম্যানস রচনা করেন বিখ্যাত কবিতা কাসাবিয়াঙ্কা। কবিতাটির পটভূমি ১৭৯৮ সালের নীলনদের যুদ্ধ। ফরাসি জাহাজ লা ওরিয়েন্টে ১০-১২ বছরের এক ছেলে লুই ডে কাসাবিয়াঙ্কা বাবার নির্দেশে জাহাজে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে শত্রুপক্ষ আক্রমণ চালালো জাহাজের ওপর। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধেয়ে আসছে একের পর এক আগুনের গোলা। ছেলেটির গায়ের ওপর হামলে পড়ছে সে আগুনের কুণ্ডলী। তার পরও সে স্থান ত্যাগ করছে না এক চুলও। অপেক্ষা করছে বাবার নির্দেশের। কারণ বাবা বলে গেছেন, ওখান থেকে না নড়ার জন্য। শেষ মুহূর্তে শেষবারের মতো সে বিনীত কণ্ঠে শুধু বলল, 'বাবা, বলো বাবা, আমি কি রইব দাঁড়িয়ে! একবার শুধু বলো আমার কর্তব্য পালন হয়েছে তো?'
কবিতাটিতে বাবার প্রতি সন্তানের তীব্র ভালোবাসা ও অপরিমেয় আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে। সন্তানের জন্য বাবার কিংবা বাবার জন্য সন্তানের এ ত্যাগ-ভালোবাসা তখনই সম্ভব যখন একজন আরেকজনকে উপলব্ধি করতে পারে। একজন সন্তানের ক্রমবর্ধমান জীবনে প্রয়োজন পড়ে একজন বলিষ্ঠ সাহচর্যের। বাবা তার সে সাহচর্য। হিংসাভরা এ কুটিল পৃথিবীতে আপদে-বিপদে ছায়ার মতো শক্ত হাতে তাকে আগলে রাখেন বাবা; সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেন, অনুপ্রেরণা দেন সব কাজে।
কবিতার সেই ছেলে লুই ডে কাসাবিয়াঙ্কার মতো হতে পারিনি আমি। আমার শ্রদ্ধেয় বাবা প্রবীণ শিক্ষাবিদ মাওলানা মো. নূরুল হুদার সব আদেশ পালন করতে পারিনি যথাযথভাবে। কিন্তু বাবা প্রতিটি মুহূর্ত আগলে রেখেছেন আমাকে। বড় হয়েছি। নিজে সন্তানের বাবা হয়েছি। কিন্তু আমার বাবার মতো বাবা হতে পারিনি। জীবনসংগ্রাম আর কণ্টকাকীর্ণ পথ চলতে গিয়ে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতে এগিয়েছে আমাদের পরিবার। সেই জীবনযুদ্ধে বাবা ছিলেন প্রধান সিপাহসালার। নীতি ও নিষ্ঠার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন-অবিচল। সন্তানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। গা ভাসাননি গড্ডালিকা প্রবাহে। সারাটি জীবন যিনি মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন, তাকে তো ব্যক্তিত্বের প্রশ্নে, নীতির প্রশ্নে অটল থাকতেই হবে। ছিলেনও আমৃত্যু।
একজন মানবসন্তানের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বাধিকবার উচ্চারণ করতে হয় যে শব্দগুলো, তার মধ্যে 'আম্মু', এর পরই 'আব্বু' বা বাবা। আব্বা কিংবা বাবা যে শব্দেই ডাকি, তার মূল পরিচয় হলো তিনি জন্মদাতা বা জনক। বাবা যে বাবাই। যার কারণে এই পৃথিবীর রঙ, রূপ, আলোর দর্শন। সেই বাবা নামটির সঙ্গেই যে অপার স্নেহ আর মমতার মিশেলে এক বন্ধন জড়িয়ে আছে। আমার কাছে বাবা মাওলানা নূরুল হুদা শুধু জন্মদাতা নন, আদর্শেরও প্রতীক। বাবা আমার কাছে ছিলেন এক মহীরুহ, চিরন্তন আস্থার প্রতীক।
সেই শৈশব থেকে আমৃত্যু বাবা ছিলেন আমার জন্য বড় শক্তি। শৈশবে বাবাকে দেখেছি পরিবারের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, জ্ঞানী, স্নেহশীল এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে। জীবনের শুরুতেই আদর্শ পুরুষ হিসেবে বাবাকেই দেখেছি। একই সঙ্গে দেখেছি শক্তির উত্স হিসেবে। তাই সব সময় চেয়েছি বাবার মতোই শক্তি অর্জন করতে তথা পরিবারের সর্বময় কর্তা হতে। শৈশব থেকে যখন বাড়ন্ত অবস্থায় পৌঁছেছি, তখন বাবা মূল্যবান উপদেশ দিয়ে জীবনের পথ বাতলে দেন। অনেক ক্ষেত্রে অবাধ্য হয়েছি। বাবার মনে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমার যেটুকু অর্জন তার পেছনে বাবার অবদান অপরিসীম।
আমি আমার বাবা মাওলানা নূরুল হুদাকে নিয়ে গর্বিত। তিনি তার সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন শিক্ষকতা পেশায়। মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন তিনি। প্রথমে তিনি পড়ালেখা করেন কওমি মাদরাসায়। সেখানে সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিস পাস করে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। দেশের শীর্ষস্থানীয় কওমি মাদরাসাগুলোর একটি সোনাগাজীর ভাদাদিয়া নূরুল উলুম মাদরাসা। এ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান ছিলেন দেশের কওমি শিক্ষার অগ্রদূত। তিনি বাবাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। তার মাদরাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত করেন। সেখানে বাবার কাছে পড়েছেন এমন অনেকেই এখন দেশের বহু কওমি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও মুহতামিম (প্রিন্সিপাল)। এরই মধ্যে বাবা আলিয়া বা সরকারি মাদরাসায় উচ্চতর ডিগ্রি (কামিল) অর্জন করেন। ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় বাবা প্রতিষ্ঠা করেন আমাদের এলাকার প্রথম মাদরাসা আমিরাবাদ ইসলামিয়া মাদরাসা। ফেনী-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন ও তার পরিবারের আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাটি এখন ওই অঞ্চলের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরে কিছু সময়ের জন্য সোনাগাজী ফাজিল মাদরাসায় অধ্যাপনা করেন তিনি। এলাকাবাসীর অনুরোধে আবার দায়িত্বে ফেরেন নিজের প্রতিষ্ঠিত আমিরাবাদ মাদরাসায়। মাদরাসাটিকে আলিম পর্যায়ে উন্নীত করে সরকারি এমপিওভুক্ত করেন তিনি।
একপর্যায়ে এলাকা ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়। দায়িত্ব নেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সিভিল এলাকা মানিকদীতে প্রতিষ্ঠিত মানিকদী সিনিয়র মাদরাসায়। এখানে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মানিকদী নূরানী জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
সবশেষে রাজধানীর উপকণ্ঠ টঙ্গীর কাছে হারবাইদ দারুল উলুম ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসায় যোগ দেন তিনি। সেখানে প্রথমে ভাইস প্রিন্সিপাল ও পরে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে মাদরাসাটি দেশের অন্যতম সফল মাদরাসায় রূপান্তরিত হয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নও হয় ব্যাপক। আমৃত্যু তিনি এই মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্বে ছিলেন।
নিজে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি আরও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। টঙ্গীর স্বনামধন্য দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল-হেলাল প্রিক্যাডেট একাডেমী ও আল-হেলাল একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। স্থানীয় খাদিজা (রা.) জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন আমৃত্যু। এলাকার সব আলেম ও ইমাম তাকে শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ বলে সম্বোধন করতেন। ধর্মীয় সব অনুষ্ঠানে তাকে বসাতেন প্রধান আসনে। তার জানাজায় শত শত আলেমের সমাবেশ ঘটে।
পারিবারিক ব্যবসায় আর্থিক সচ্ছলতা আসার পর বহুবার তাকে আমরা অনুরোধ করেছিলাম চাকরি থেকে অবসর নিতে। পর্যাপ্ত অর্থ হাতখরচের জন্য দিয়ে অনুরোধ করা হয়েছিল—তার আর কষ্ট করার দরকার নেই। কিন্তু জবাবে তিনি বলতেন, 'আমি তো শুধু টাকার জন্য চাকরি করছি না, চাকরিটা ছাড়লে শত শত ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে ব্যস্ত না থাকলে আমি তাড়াতাড়ি মরে যাব।' শিক্ষকতাকে শুধু পেশা নয়, নেশা হিসেবেও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। কওমি ও আলিয়া উভয় ধারার সর্বোচ্চ ডিগ্রি থাকায় তার শিক্ষাদানের মান ছিল অসাধারণ। যারা তার পাঠ গ্রহণ করেছেন তাদের মতে, বাবা যখন পড়াতেন তখন মনে হতো জাদুর মতো মনে-মগজে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন।
মহান শিক্ষকতা পেশায় বাবার সারাটি জীবন কাটিয়ে দেয়া আমাদের জন্য কত আনন্দের, কত গৌরবের—তা বোঝাতে পারব না। দেশের প্রতিটি এলাকায় বাবার ছাত্রের দেখা মেলে। বাবার বহু ছাত্র এখন দেশের বহু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল। অনেকে পরে সাধারণ শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি, সামরিক-বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তা হয়েছেন। অনেককে আগে চিনতাম না। বাবার মৃত্যু সংবাদ গণমাধ্যমে দেখে অনেকে ছুটে এসেছেন জানাজায়। অনেকে দেশ-বিদেশ থেকে ফোন করে তাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
সাংবাদিকতার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় কাজ করতে গিয়ে বারবার বিপদে পড়েছি। দুর্নীতিবাজ ও অপশক্তির বিরুদ্ধে কলম ধরতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার হয়েছি একাধিকবার। জীবন বিপন্ন হয়েছে। প্রতিটি বিপদের দিনে আব্বাজান ছিলেন আমার পাশে। প্রতিটি বিপদসঙ্কুল সময়ে তাত্ক্ষণিকভাবে আমি তার ভেজা কণ্ঠ শুনতে পেয়েছি ফোনে। আমাকে সাহস জুগিয়ে, অভয় দিয়ে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায় দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি।
আজকাল সবকিছুতেই আনুষ্ঠানিকতা চলে এসেছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ভালোবাসার বেশ অভাব, সব সম্পর্কের ভেতরেই শূন্যতা আছে তাদের। তাই তাদের অনুষ্ঠান করে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে হয়। মা দিবস ও বাবা দিবস পালন করা হয় ঘটা করে। আমাদের মুসলিম সমাজে ভালোবাসার ঘাটতি আছে কি? আমাদের সব দিনই বিশেষ দিন, প্রতিটি মুহূর্তই বিশেষ মুহূর্ত। আন্তর্জাতিকভাবে বছরে একটি দিন 'বাবা দিবস' পালন আমি মানি না। বাবার জন্য একটা দিন মাত্র! না, বাবাকে ভালোবাসার জন্য কোনো দিন-ক্ষণ লাগে না।
বাবাকে সম্মান করা, তাকে ভালোবাসা, তার সঙ্গে সদাচরণ করা, তার সেবা করা ইসলামে একটি বাধ্যতামূলক কাজ। এ কাজের পন্থা-পদ্ধতি ইসলামে নির্ধারিত। এক্ষেত্রে নতুন কোনো বিষয় বা পদ্ধতি পালন ইসলামী পরিভাষায় বেদা'ত বলে গণ্য। ইসলাম বাবা-মাকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে, অন্য কোনো ধর্ম বা সমাজ ততটা দেয়নি। বাবা-মায়ের জন্য একটি দিবস পালন করে দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে বলে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করার মানে হলো তাদের সর্বদা গুরুত্ব দেয়ার সময় আমার নেই। অথচ ইসলাম বলে—তাদের সর্বদাই গুরুত্ব দিতে হবে, ভালোবাসতে হবে। এমনকি নিজের স্ত্রী-সন্তানদের চেয়েও। মুসলমানের প্রতিটি দিবস হবে মা দিবস, প্রতিটি দিবসই হবে বাবা দিবস। আল-কোরআন মা-বাবাকে যে গুরুত্ব দিতে বলেছে, তা প্রতিটি মুহূর্তের জন্যই।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও তাঁর রাসুল (সা.) বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ও যত্ন নিতে যা বলেছেন, যেভাবে বলেছেন—তেমনটা কেউ বলেনি, বলতে পারেনি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আমি মানুষকে মা-বাবার সঙ্গে সুন্দর আচরণের তাগিদ দিয়েছি। তার মা অনেক কষ্টে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং বহু কষ্ট করে ভূমিষ্ঠ করেছে। গর্ভে ধারণ করা ও দুধ পান করানোর (কঠিন কাজের) সময়কাল হলো আড়াই বছর।' তিনি আরো বলেন, 'তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করবে না এবং মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ ও সুন্দর ব্যবহার করবে।'
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে শুধু মা-বাবা জীবিত থাকাকালে তাদের সঙ্গে সদাচরণ যথেষ্ট নয়। তাদের মৃত্যুর পর সন্তানের ওপর দায়িত্ব থেকে যায় তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করা। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, 'তোমার রব আদেশ দিয়েছেন, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না ও বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের 'উফ' বলো না, তাদের ধমক দিও না এবং তাদের সঙ্গে সম্মানজনকভাবে কথা বলো। তাদের উভয়ের জন্য দয়ার সঙ্গে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বলো—হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করো, যেভাবে শৈশবে আমাকে তারা লালন-পালন করেছেন।'
মা-বাবার মৃত্যুর পর তাদের শান্তির জন্য দোয়া করা, তাদের জন্য কল্যাণ হয়—এমন কাজ করে তা তাদের রুহের জন্য উত্সর্গ করা সন্তানের দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব কোনো দিবস, বছর বা মাস দিয়ে সীমিত করা হয়নি।
একজন বাবা যেমন তার প্রতিচ্ছবি সন্তানের মধ্যে দেখতে চান, তিনি অবশ্যই আশা করেন তার সন্তান সত্যিকারের একজন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে—তেমনি একজন সন্তানের আশা থাকে তার প্রিয় বাবাটি তার চলার পথে ছায়া হয়ে, বন্ধু হয়ে তাকে আগলে রাখবেন, পথপ্রদর্শক হয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দেবেন। বস্তুত, বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক হৃদয়ভিত্তিক ও সামাজিক।
১৯৯৩ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাবার সান্নিধ্যে সন্তান যত বেশি থাকবে, ততই তার জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়বে, সন্তান নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পাবে। সন্তানের আচরণ ও সামাজিকায়নের ওপর ইতিবাচক প্রভাব এনে দিতে পারেন একজন বাবা। এখনকার বাবারা অনেক বেশি কর্মব্যস্ত। সেই সকালে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে চলে যান, ফিরে আসেন রাতে। সারা দিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যে তার প্রিয় সন্তানটি মনের মণিকোঠায় থাকলেও তাকে সেভাবে সময় দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
কিন্তু আমার বাবা ছিলেন আলাদা। সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও দিনে অন্তত তিন-চার বার ফোন করতেন কোথায় আছে, কেমন আছে তা জানতে। শত ব্যস্ততা, অসুস্থতার মধ্যেও সন্তানদের খোঁজ রাখতেন প্রতিনিয়ত। বিদেশে যাওয়ার সময় প্রথম নির্দেশ থাকত—'পৌঁছেই আমাকে ফোন নম্বর দিবি।' দেশের বাইরে ব্যয়বহুল কল করেও অন্তত দু'বার খোঁজ নিতেন। দেশের ভেতরে দূরযাত্রায় বিপদের আশঙ্কা করতেন ও উত্কণ্ঠায় ভুগতেন। গ্রামের বাড়িতে রওনা করলে কিংবা ফেরার খবর পেলে পুরো পথ অতিক্রমকালে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করতেন। প্রশ্ন একটাই—কোথায়? আমার সাংবাদিকতা পেশার প্রথম ধাপে দৈনিক ইনকিলাবে কাজ করার সময় রাত ২টা-৩টা বেজে যেত বাসায় ফিরতে। দরজায় নক করার সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ সময় বাবা দরজা খুলে দিতেন। কখনও কখনও আম্মাও খুলতেন। যেন উদ্বেগাকুল হয়ে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। যতক্ষণ বাসায় না ফিরতাম বাবা-মায়ের চোখে ঘুম আসত না।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। হতভাগা দেশের ভ্রান্ত চিকিত্সাব্যবস্থার ফলে শেষ দিনগুলোতে কতই না কষ্ট করেছেন আমার বাবা। এখন পিতৃহীন জীবনের প্রতি মুহূর্তে প্রিয় বাবাকে অসম্ভব রকম মিস করছি। জীবনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে আনন্দে-কষ্টে বাবার উপস্থিতি ছিল। এখন নেই। কষ্টে-বেদনায় চোখ ভিজে আসে, বুকটা ফেটে যেতে চায়। আমার দায়িত্বশীল বাবা সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য, পরিবারের জন্য কতই না খেটেছেন। জন্মদাতা হওয়া সহজ, কিন্তু বাবা হওয়া কঠিন। আমার বাবা ছিলেন আমাদের জন্য এক বিশাল ছায়া। যে ছায়ায় ছিল মায়া, মমতা আর ভালোবাসা। আমার বাবা ছিলেন একজন 'সম্পূর্ণ বাবা'।
'আব্বা' বা 'বাবা' দুটো অক্ষরে উচ্চারিত ও পরিবৃত্ত। এই বাবার অতলেই প্রবহমান এক বিশাল সমুদ্র। যে সমুদ্রের গহীনে থরে থরে সাজানো রয়েছে আদর, স্নেহ, দায়িত্ব, শাসন, কর্তব্যসহ জীবনীশক্তির সবুজ প্রান্তর। আমার কাছে বাবা ছিলেন সুবিশাল আকাশের মতো। সন্তানের ভবিষ্যত্ রচনার স্তবকগুলো নির্মাণে তিনি ছিলেন সদা তত্পর। আমার বাবার চরিত্রটা এমনই যে, আমাদের পরিবারকে ঘিরে বাবার ছায়াটা লতিয়ে উঠতে থাকে ক্রমেই। আর বাবাও সেই লতিয়ে ওঠা ছায়াকে ধারণ করে আমৃত্যু পরিবারের সুখে-দুঃখে একটা বৈশিষ্ট্যের আদল হয়ে যে কোনো পরিস্থিতিতে সন্তান ও পরিবারের সব সদস্যের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
আমার বাবা কখনও কোমল, কখনওবা কঠোর আবরণের এক বিশেষ মানুষ ছিলেন। যে মানুষের বাইরের রূপ দিয়ে অনেক সময় ভেতরের রূপটাকে চেনা যায়নি। সন্তানদের ভবিষ্যত্ চিন্তায় সার্বক্ষণিক উদ্বিগ্ন বাবা কোনো কোনো সময় সন্তানের জীবনধারায় এক-আধটু বিচ্যুতি হলে শাসনের উষ্ণতা বর্ষণ করলেও পরক্ষণেই বাবার মর্মে অনুতাপের অন্তর্জ্বালাটা হৃদয়জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা হয়তো বাবার মনের সেই অবস্থাটা সহজে টের পাইনি। বাবার ওপর অভিমান করেছি। কিন্তু তার বিয়োগের সপ্তাহ না পেরুতেই বুঝতে পারছি, বাবা নিজ ছেলেমেয়েদের জন্য জীবনের সবটুকু বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।
একজন অভিভাবক হিসেবে বাবার যে কী বিরাট ভূমিকা ছিল—তা এখন মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারছি। যে কোনো চাহিদা পূরণে বাবা চরিত্রটি কোনোদিন পিছপা হয়নি। প্রতিদিনকার প্রয়োজনে বাবা যেমন সংসারের একটা অপরিহার্য অংশ, তেমনি প্রতি পদে বাবার অনস্বীকার্য উপস্থিতি আরও গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। আবার এ কথাটিও সত্যি যে, বাবা বেঁচে থাকতে পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, তিনি কতটা অমূল্য সম্পদ ছিলেন; কিন্তু যখন ছায়া মাথার ওপর থেকে সরে গেছে, তখন টের পাচ্ছি গভীরভাবে।
বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানের লেখা 'পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন' লাইনটি মনে করিয়ে দেয়—বাবা তার সন্তানের কাছে শুধু পিতাই নন, একটি গোটা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে সন্তানের জন্য বরাদ্দ থাকে উদারতা, ভালোবাসা, আবার শৃঙ্খলাও। পিতা হতে পারেন সবাই, কিন্তু বাবা হন কেউ কেউ। বাবা হওয়ার জন্য শুধু দায়িত্বপালনই নয়, সন্তানের কাছে পিতাকে প্রমাণ করতে হয় তার প্রয়োজনই অপরিহার্য। আমার বাবা তা প্রমাণ করে গেছেন শতভাগ।


__._,_.___


[* Moderator�s Note - CHOTTALA is a non-profit, non-religious, non-political and non-discriminatory organization.

* Disclaimer: Any posting to the CHOTTALA are the opinion of the author. Authors of the messages to the CHOTTALA are responsible for the accuracy of their information and the conformance of their material with applicable copyright and other laws. Many people will read your post, and it will be archived for a very long time. The act of posting to the CHOTTALA indicates the subscriber's agreement to accept the adjudications of the moderator]




Your email settings: Individual Email|Traditional
Change settings via the Web (Yahoo! ID required)
Change settings via email: Switch delivery to Daily Digest | Switch to Fully Featured
Visit Your Group | Yahoo! Groups Terms of Use | Unsubscribe

__,_._,___